সূরা আবাসা সম্পর্কে কিছু তথ্য

1840 0
(আমি) আল্লাহর নামে (শুরু করছি), যিনি রাহমান [=পরম করুণাময় সকল সৃষ্টির জন্যে], যিনি রাহিম [=অসীম দয়াবান কিছু বিশেষ ব্যক্তিদের জন্যে]।
১। কোরআনের বর্তমান উসমানী মুসহাফ এর ক্রমিক নম্বর অনুসারে এ সূরাটি আশিতম।
২। নাযিল হওয়ার ধারাবাহিকতা অনুসারে এ সূরাটি চব্বিশ নম্বরে অবস্থিত।
৩। নাযিলের স্থানটি হচ্ছে পবিত্র মক্কা নগরী।
৪। আয়াতের সংখ্যা ৪২।
৫। এ সূরাটির অভ্যন্তরে অবস্থিত শব্দ সংখ্যা ১৩১।
৬। এ সূরাটির অভ্যন্তরে মোট বর্ণ ব্যবহৃত হয়েছে ৫৫৩ টি।
৭। এ সূরাটির অভ্যন্তরে “আল্ল-হ” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১ বার।
৮। সূরাটির নামের অর্থ: “আবাসা’ মূল ধাতু আবুস থেকে নির্গত এবং তা অতীত কালের ক্রিয়াতে রূপান্তরিত হয়ে আবাসা হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে, এমন ব্যক্তি যে তার চেহারাতে বিরক্তিভাব প্রকাশ করেছে।
৯। সূরাটির অন্যান্য নাম: “আ’মা” যার অর্থ অন্ধ, “সাফারাহ্” যার অর্থ আল্লাহর দূতগণ।

১০। সূরাটির বৈশিষ্ট্য:

মানুষের জন্মের সূচণার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ, যখন সে এক ফোঁটা নাপাক ও মূল্যহীন পানির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে, একজন মানুষের অসচেতনতাবোধ ও আত্মঅহংকার, আত্মগরীমা, অতিরিক্ত আত্মসন্মানবোধ ও স্বার্থপরতা এবং স্বেচ্ছাচারি স্বভাবের উপর আঘাত এবং এ বিষয়ের উপর তিরস্কার। মানুষ একটি অপারগ, মুখাপেক্ষী ও নির্ভরশীল সৃষ্টি ছাড়া কিছু নয়।

১১। সামগ্রিকভাবে এ সূরাটির আলোচ্য বিষয়বস্তু হচ্ছে নিম্নরূপ:

কোরআন ও হেদায়েতের পথ প্রদর্শন এবং শিক্ষনীয় প্রকৃত অন্তর্নিহিত বিষয়ে ইঙ্গিত প্রদান।
অহংকারী ব্যক্তিদের প্রতি প্রচন্ড তিরস্কার।
সৃষ্টিকর্তার কিছু নেয়ামতের গননা।
ক্বিয়ামত সংঘটনের নিশ্চিয়তা।

১২। এ সূরা তিলাওয়াতের ফযিলত:

হযরত রাসূলে আকরাম (সা.): “যে ব্যক্তি এ সূরাটি পাঠ করবে সে ক্বিয়ামতের দিনে হাস্যোজ্জ্বলতা ও প্রফুল্লতার সাথে উথিত হবে। (তাফসীর মাজমাউল বায়ান, খন্ড ১০, পৃ: নং ২৬৩।)
ইমাম জাফার সাদিক্ব(আ.): “যে ব্যক্তি এ সূরাটি পাঠ করবে সে বেহেস্তে আল্লাহতায়ালার দয়া ও অনুগ্রহের পতাকা ও ছায়ার নিচে আশ্রিত থাকবে। এটা আল্লাহর জন্যে খুবই ছোট একটি কাজ। (সাওয়াবুল আ’মাল, পৃ: নং ১২১।)
 
১৩। “যে ব্যক্তি এ সূরাটি পাঠ করবে এবং তার সাথে রাখবে সে সফরকালে প্রচুর কল্যাণের অধিকারী এবং তার মনোবাসনা পূরণ হবে। (তাফসীর আল মিযান, খন্ড ২০, সূরা আবাসা-র ১-১৬ নং আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গ।)
 
১৪। তিন দিন পর্যন্ত প্রতিদিন সাতবার করে যদি কেউ কোন শুষ্ক ঝর্ণা বা শুষ্ক কুঁয়ার মুখে সূরা আবাসা পড়ে তাহলে এর পর থেকে সেখানে প্রচুর পরিমানে পানি পাওয়া যাবে।
 
১৫। যদি কেউ কোন কিছু লুকিয়ে রাখার পর ভুলে যায় এবং খুজে না পায়, এহেন অবস্থায় সূরা আবাসা তিলাওয়াত করলে আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে সেই বস্তুটির লুকিয়ে থাকা স্থানটিকে স্মরণ করিয়ে দিবেন। (আর মিসবাহু কাফহামী, পৃ: নং ১৮২।)
 
১৬। যদি কেউ বৃষ্টি বর্ষনের সময় সূরা আবাসা তিলাওয়াত করে আল্লাহ পাক তার বৃষ্টির ফোঁটাগুলোর সমসংখ্যক গুনাহ মাফ করে দিবেন। (আল মুসতাদরাক আল ওয়াসায়িল, খন্ড ৬, পৃ: নং ২১০।)

১৭। শানে নুযুল:

তাফসীর মাজমাউল বায়ান ও তাফসীর আল বায়ান গ্রন্থদ্বয়ে ইমাম জাফার সাদিক্ব(আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, এই সূরা বনি উমাইয়্যা গোত্রের এক ব্যক্তি সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। সেই ব্যক্তিটি রাসূলের সামনে উপস্থিত ছিল আর আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম নামক অন্ধ মানুষটি যখন তাদের সামনে আসলো তখন তাকে দেখে ঐ উমাইয়্যার গোত্রের লোকটি চেহারায় বিরক্তিভাব এনে অন্ধ লোকটির কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। তার এই নোংরা ও অন্যায় কাজটিকে তিরস্কার করার জন্যে উক্ত সূরাটি নাযিল হয়েছে। তবে উমাইয়্যা গোত্রের সেই ধনী ও বিত্তশালী লোকটির পরিচয়ের ক্ষেত্রে তফসীরকারক ও ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতনৈক্য আছে। “এ প্রসঙ্গে যে ব্যক্তিদের নাম সকল মুফাসসিরদের মধ্যে বর্ণিত হয়েছে তারা হলো, উতবা ইবনে রাবিয়া, আবু জাহল, আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব। তারা সহ আরো কিছু লোক রাসূলের কাছে উপস্থিত ছিল। রাসূল(সা.) তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছিলেন এবং ইসলামের সুন্দর বিধানগুলো নিয়ে আলোচনা করছিলেন যেন তাদের অন্তরে কথাগুলো প্রভাব ফেলে। এমন সময় আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম নামক একজন অন্ধ লোক সেই ভীড়ে এসে আল্লাহর রাসূলের কাছ থেকে কিছু আয়াত শুনা এবং তাকে শিখানোর জন্যে অনুরোধ করলো। আর তার অনুরোধের কথাগুলো অনবরত পুনরাবৃত্তি করতে লাগলো।” (বার গোযিদে তাফসীরে নেমুনে(ফারসী ভাষায় লিখিত), খন্ড ৫, পৃ: নং ৪০৬।)
 
এক্ষেত্রে তাফসীর মাজমাউল বায়ান ও তাফসীর আল বায়ান গ্রন্থদ্বয়ে উল্লেখিত হাদিসটি যোগ করলে এটাই পরিস্কার হয় যে, আল্লাহ তায়ালার প্রচন্ড তিরস্কার ঐ উমাইয়্যা ব্যক্তিটির ব্যাপারে নাযিল হয়েছে।

১৮। সামান্য তাফসীর:

উল্লেখিত শানে নুযুল থেকে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, যে ব্যক্তিটি ভ্রু কুঞ্চিত করলো সে আল্লাহর রাসূল নন, উপস্থিত লোকজনদের কেউ একজন হবে। আর দশ ও এগার নং আয়াতে ঐ অন্ধ লোকটিকে অবজ্ঞা করার কারণে যে আয়াত দুটি নাযিল হয়েছে, সেখানে নবীর তাবলীগের ব্যাপারে প্রচন্ড প্রচেষ্টা এবং মানুষদের হেদায়েতের জন্যে তাঁর তীব্র আকাঙ্খাই ফুঁটে উঠেছে। আর অন্ধ লোকটিকে অবজ্ঞার বিষয়টি রাসূলের পক্ষ থেকে মানুষের হেদায়েতের আকাঙ্খার কারণে সংঘটিত হয়েছে। গায়েবের ব্যাপারে আল্লাহ যতটুকু রাসূলকে জানাতেন ততটুকুই তিনি জানতেন। রাসূল(সা.) একটা কাজে আগের থেকেই ব্যস্ত ছিলেন, যার উদ্দেশ্য হেদায়েত করা। তিনি তো জানতেন না যে, ঐ বিত্তবানরা হেদায়েত পাবেন না আর অন্ধ লোকটি তাদের চেয়ে দ্রুত হেদায়েত পাবেন। তাই, ১১ নং আয়াতে আল্লাহ স্পষ্ট বলেছেন, এটি রাসূলকে উপদেশ হিসেবে বলেছেন। আর এ কারণে এ কাজটি রাসূলের মর্যাদার উপর কোন প্রকার আঘাত বলে গণ্য হতে পারে না। বরং এ কারণে একটি শাশ্বত শিক্ষা মানুষ পেয়ে গেল যে, মুসতাজআ’ফ মানুষেরা বিত্তবান ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চেয়ে দ্রুত হেদায়েত প্রাপ্ত হয়।

Related Post

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *