ইয়াযিদী সৈন্যদের ভয়ংকর পরিণতির ইতিহাস

1138 0
  1. জান্নাতের সর্দার, সাইয়্যেদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর শাহাদাত এক মহা হৃদয় বিদারক ঘটনা। কারবালার শহীদানের উত্সদর্গীত রক্তের প্রতিটি ফোঁটার বিনিময়ে আজ এ পৃথিবী অশ্রু সাগরে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর কোন মর্মান্তিক ঘটনায় এত অশ্রু ঝরেনি যত অশ্রু কারবালার শহীদানের ব্যাপারে ঝরেছে।

কারবালার এ হৃদয়বিদারক ঘটনার পর ইয়াযিদী বাহিনীর উপর নেমে এসেছিল আল্লাহর মহাগযব। এই গযব ছিল ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর শাহাদাতের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সকল ব্যক্তির উপর। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে দুনিয়াতে নির্মমভাবে শাস্তি দিয়ে ধ্বংস করে দেন। নবীর আহলে বাইতকে কষ্ট দেয়া মানে নবীকে কষ্ট দেয়া। আর নবীকে কষ্ট দেয়া মানে স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাকেই কষ্ট দেয়া। আর ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যাকারীদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেনঃ

ﻭَﻣَﻦْ ﻳَﻘْﺘُﻞْ ﻣُﺆْﻣِﻨًﺎ ﻣُﺘَﻌَﻤِّﺪًﺍ ﻓَﺠَﺰَﺍﺅُﻩُ ﺟَﻬَﻨَّﻢُ ﺧَﺎﻟِﺪًﺍ ﻓِﻴﻬَﺎ ﻭَﻏَﻀِﺐَ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﻟَﻌَﻨَﻪُ ﻭَﺃَﻋَﺪَّ ﻟَﻪُ ﻋَﺬَﺍﺑًﺎ ﻋَﻈِﻴﻤًﺎ

“এবং যে ব্যক্তি কোন মুমিনকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করে, তার শাস্তি জাহান্নাম। যেখানে সে চিরস্থায়ীভাবে বসবাস করবে। তার উপর আল্লাহর গযব ও অভিশম্পাত এবং আল্লাহ তায়ালা তার জন্য মহা শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন।”
সূরা নিসা, সূরা নং ৪, আয়াত নং ৯৩।

কে না জানে যে, ইয়াজিদ এবং তার সৈন্যরা যত নিরাপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল, সেগুলো সব ইচ্ছাকৃতভাবেই হয়েছিল।

আশুরার দিন হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম পিপাসার্ত অবস্থায় পানি পান করার জন্য ফোরাত নদীর তীরে পৌঁছুলেন। এমতাবস্থায় অভিশপ্ত হাসীন বিন নুমাইর তাঁকে লক্ষ্য করে তীর ছুড়লো, যা ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর মুখ
মুবারকে লাগলো। সে সময়ে তাঁর জবান হতে অনিচ্ছাকৃতভাবে বদ দোয়া বের হয়ে আসলোঃ
“হে আল্লাহ! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম- এর মেয়ের সন্তানদের সাথে যে আচরণ করা হচ্ছে, আমি তার অভিযোগ তোমার কাছেই করছি। হে রাব্বুল আলামীন! তাদেরকে খুঁজে খুঁজে হত্যা করো, টুকরা টুকরা করে দাও। তাদের মধ্য থেকে কাউকে তুমি ছেড়ে দিও না।”

এমন মজলুমের দোয়া!!, যিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম-এর নাতি সন্তান; তাঁর দোয়া কবুলের ব্যাপারে কি সন্দেহ থাকতে পারে?! সুতরাং দোয়া কবুল হলো এবং আল্লাহ আখেরাতের পূর্বে দুনিয়াতেও তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করলেন। আর এ জন্যেই তাদের প্রত্যেককে খুজে খুজে বের করে হত্যা করা হয়েছিল।

ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাইল বুখারীর শিক্ষক ইমাম যুহরী বর্ণনা করেন, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর শাহাদাতে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্য থেকে এমন একজনও রক্ষা পায়নি, যাদের আখেরাতের পূর্বে দুনিয়াতে শাস্তি হয়নি। তাদের
মধ্যে কাউকে হত্যা করা হয়েছে, কারো চেহারা কুৎসিত ও বিকৃত হয়েছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তারা সরকারী ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়েছে। প্রকাশ থাকে যে, এটাই তাদের কর্মকান্ডের আসল শাস্তি নয় বরং একটা দৃষ্টান্ত মাত্র, যা মানবজাতির শিক্ষার জন্য দুনিয়াতে দেখানো হয়েছিল।

কারবালার ঘটনার পর হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর হত্যাকারীদের উপর বিভিন্ন প্রকার আসমানী বালা-মুসিবত নেমে এসেছিল। ইমামের শাহাদাতের পাঁচ বছর পর ৬৬ হিজরীতে মুখতার সাকাফী ইমামের হত্যাকারীদের কাছ থেকে প্রতিশোধ (কিসাস) নেওয়ার অঙ্গীকার করলো। সাধারণ মুসলমানরাও তার সাথী হলো এবং কিছু দিনের মধ্যেই তার এমন শক্তি অর্জিত হলো যে, কুফা ও ইরাকের উপর তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলো। অতঃপর সে সর্বসাধারণের মাঝে ঘোষণা করল যে, “ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর হত্যাকারীরা ছাড়া সবাই নিরাপদ।” অতঃপর ইমামের হত্যাকারীদের গ্রেফতারের ব্যাপারে সে সর্বশক্তি নিয়োগ করে।

অপর এক বর্ণনায় এরকম এসেছেঃ
[মুখতার সাকাফী আদেশ জারী করেছিলো যে, “যে সকল লোক কারবালার ময়দানে জড়িত ছিল, তাদেরকে যেখানে পাও সেখানেই হত্যা করো।” একথা শুনতেই কুফায় অবস্থানরত ইমাম হুসাইনের শাহাদাতে শরীক ব্যক্তিরা বসরার দিকে পালাতে লাগলো। এ খবর পাওয়া মাত্রই মুখতারের সৈন্যবাহিনী তাদের পিছনে ধাওয়া করে। মুখতারের সৈন্যবাহিনী যাকে যেখানে পায় তাকে সেখানেই হত্যা করে।]

কারবালায় হত্যাকারীদের কিছু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিঃ

১. আমর বিন হাজ্জাজ যুবাইদীঃ
এ ব্যক্তি গরমের মধ্যে পিপাসার্ত অবস্থায় পালিয়েছিল। পিপাসার দরুণ সে বেহুশ হয়ে পড়ে রইলো। অতঃপর সেই অবস্থায়ই তার শিরোচ্ছেদ করা হল।

২. সীমার যিল জুশানঃ
সে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি অভিশপ্ত এবং দূর্ভাগা ছিল। তাকে হত্যা করে তার লাশ কুকুরের সামনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল।

৩. আব্দুল্লাহ বিন উসাইদ জাহনামী, মালিক বিন বশীর বদী, হামল বিন মালিক-
এদের সবাইকে আটক করা হল। তারা ক্ষমার আবেদন জানালো। মুখতার বলল, হে জালিমরা! তোমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম-এর নাতির প্রতি সদয় হওনি, তোমাদের উপর কিভাবে সদয় হওয়া যায়? অতঃপর এক এক করে সবাইকে হত্যা করা হলো। এদের মধ্যে মালিক বিন বশীর হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর টুপি মুবারক ছিনিয়ে নিয়েছিল। তার দুই হাত-পা কর্তন করে খোলা ময়দানে নিক্ষেপ করা হয়। সে ছটফট করতে করতে মারা যায়।

৪. উসমান বিন খালিদ এবং বশীর বিন সমীতঃ
তারা মুসলিম বিন আক্বীল রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর হত্যায় সহযোগীতা করেছিল। এই পাপিষ্ঠদেরকে হত্যা করে তাদের লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়।

৫. উমার বিন সা’দঃ
সে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর বিরুদ্ধে ইয়াজিদী বাহিনীর সেনাপতি ছিল। তাকে হত্যা করে তার মাথা মুখতারের সামনে আনা হল। অন্যদিকে আমির মুখতার, ইবনে সাদের ছেলে হাফসকে পূর্বেই নিজ দরবারে বসিয়ে রেখেছিল।যখন এই কর্তিত মাথা মজলিশের মধ্যে আনা হলো, তখন মুখতার হাফসকে বলল, “তুমি কি জানো এই মাথা কার?” সে বলল, ‘হ্যা’ এটা দেখার পর আমিও আমার জীবন চাই না।” অতঃপর তাকেও হত্যা করা হলো। অবশেষে মুখতার বলল যে, “উমার বিন সা’দ এর হত্যা তো ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর বদলায় এবং হাফস-এর হত্যা আলী আসগর বিন হুসাইন আলাইহিস সালাম- এর বদলায়।”

অন্য এক বর্ণনায় এসেছেঃ
মুখতার কুফার শাসনভার গ্রহণ করার পর উমার বিন সা’দ-কে নিজ দরবারে ডেকে পাঠায়। এতে উমার বিন সা’দ -এর ছেলে হাফ্স হাজির হলো। মুখতার সাকাফী জিজ্ঞাসা করলো, তোমার বাবা কোথায়? সে বলল, নিখোঁজ হয়ে গিয়েছে। একথা শুনে মুখতার রাগান্বিত হয়ে বলল যে, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর শাহাদাতের দিন সে কেনো নিখোঁজ হয়নি। যেই সাম্রাজের লোভে সে আওলাদে রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, এখন তোমাদের সেই ইয়াজিদী সাম্রাজ্য কোথায় গেল? অতঃপর উমার বিন সা’দকে ধরে আনার পর মুখতার সাকাফী উমার বিন সা’দ, তার ছেলে হাফস ও অভিশপ্ত সীমারকে দ্রুত শিরোচ্ছেদের আদেশ দিল। এমতাবস্থায় তাদের শিরোচ্ছেদ করে ইমামে আলী মাক্বাম- এর ভাই হযরত মুহাম্মদ বিন হানফিয়্যাহ আলভী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র (যিনি হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর বৈমাত্রিক ভাই ছিলেন) নিকট মদিনা শরীফে পাঠালো। এরপর ঘোড়া অভিশপ্ত সীমার এর লাশের উপর দৌড়িয়ে খন্ড বিখন্ড করে দিল। উল্লেখ্য যে, এই অভিশপ্ত সীমার ইমামে আলি মাক্বাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর হত্যাকারী এবং উমার বিন সা’দ সেই ইয়াযিদী সৈন্যবাহিনীর সেনাপতি ছিল।

৬. হাকীম বিন তুফাইলঃ
সে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-কে লক্ষ্য করে তীর মেরেছিল। প্রতিশোধ স্বরূপ তার দেহকে তীর দ্বারা ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয় এবং এতেই সে জাহান্নামে গমন করে।

৭. যায়েদ বিন রিফাদঃ
সে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর ভাতিজা এবং মুসলিম বিন আক্বীল এর শাহজাদা হযরত আব্দুল্লাহকে তীর মেরেছিল। হযরত আব্দুল্লাহ আলাইহিস সালাম হাত দ্বারা তাঁর কপাল রক্ষা করতে গিয়েছিলেন। তীর হাত ভেদ করে কপালে লাগলো। এতে তাঁর হাতটিও কপালের সাথে আহত হলো। সেই রিফাদকে আটক করে প্রথমে তাকে তীর নিক্ষেপ, পরে পাথর নিক্ষেপ করা হলো। অতঃপর জীবন্ত পুড়ে ফেলা হলো।

৮. সিনান বিন আনাসঃ
সে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর মাথা মুবারক কর্তনে অগ্রসর হয়েছিল। সে কুফা থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। এরপর তার বাড়ী ভেঙ্গে ফেলা হয়।

৯. খাওলা বিন ইয়াজিদকে জীবিত আটক করে মুখতার সাকাফী’র সামনে আনা হল। মুখতার আদেশ দিল যে, তার চার হাত-পা কেটে শূলে লটকিয়ে দাও এবং তারপর তার লাশকে আগুনে জ্বালিয়ে দাও।

১০. কারবালার শহীদানের হত্যাকারীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ছয় হাজার। ইবনে যিয়াদ ছিল কারবালার হত্যাকান্ডের দ্বিতীয় মহা অপরাধী ব্যক্তি। সে ছিল কুফার গভর্ণর। আমির মুখতারের শাসনামলে সে প্রায় ত্রিশ হাজার সৈন্যসহ দামেস্ক থেকে মুসেল শহর দখলের জন্যে রওয়ানা হয়েছিল। এ সংবাদ পেয়ে আমির মুখতার সাকাফী, ইবরাহীম বিন মালিক আশতারকে কয়েক হাজার সৈন্যসহ ইবনে যিয়াদকে প্রতিরোধের জন্য প্রেরণ করলো। মুসেল শহর হতে পনেরো কোষ দূরে ফোরাত নদীর তীরে দুই পক্ষের সৈন্যদের মধ্যে সারাদিন যুদ্ধ চলে। পরিশেষে সন্ধ্যার দিকে মুখতারের বাহিনী ইবনে যিয়াদের সৈন্যবাহিনীকে পরাজিত করতে সমর্থ্য হয়। অতঃপর ইবনে যিয়াদ যুদ্ধের ময়দান থেকে পালানোর চেষ্টা করতে লাগলো। ইবরাহীম আশতারের সৈন্যবাহিনী ইবনে যিয়াদের বাহিনীকে ধাওয়া করে অনেককে হত্যা করে। ঐ পরিস্থিতিতে ইবনে যিয়াদও ১০ই মুহাররম ৬৭ হিজরীতে ফোরাতের মূল তীরে ঠিক ঐ স্থানেই মারা গেলো, যেখানে এই জালিম নরাধমের হুকুমে ইমামে আলী মাক্বাম ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-কে শহীদ করা হয়েছিল।

যখন ইবনে যিয়াদ এবং তার সেনাপতিদের মাথা আমির মুখতার সাকাফীর সামনে এনে রাখা হলো, তখন হঠাৎ এক বিশাল অজগর সাপ দেখা গেলো। এমতাবস্থায় অজগরটি সব মাথা ছেড়ে ইবনে যিয়াদের মাথায় উঠে তার নাকের ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করলো। কিছুক্ষণ পরই অজগরটি মুখ দিয়ে বের হয়ে আসলো। অতঃপর আবার নাক দিয়ে ঢুকলো, আবার মুখ দিয়ে বের হলো। এমন করে এ কাজটি তিন বার পুনরাবৃত্তি হলো।

ইয়াযিদী সৈন্যদের উপর দুনিয়াবী শাস্তির আরো কিছু দৃষ্টান্তঃ

১. কারবালায় ইয়াযিদী জালিমদের সৈন্যবাহিনীতে যুদ্ধাহতদের ঔষধ হিসেবে ব্যবহারের জন্যে হলুদ রঙের যে ঘাস রাখা হয়েছিল, তা পুড়ে ছাঁই হয়ে যায়। তখন এই জালিমরা একটি উষ্ট্রী যবেহ করলো। তারা সেই গোশতের মধ্যে আগুনের স্ফুলিঙ্গ বের হতে দেখলো। যখন উষ্ট্রীর গোশত রান্না করা হলো, তখন তা তিক্ত বিষে পরিণত হয়ে গেলো।

২. এক লোক হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর শানে বেয়াদবীপূর্ণ কথা বলেছিল। তখন আল্লাহু জাব্বার ওয়া কাহহার তার উপর আসমানী তারকারাজির দুইটা স্ফুলিঙ্গ ছুঁড়লেন, যার ফলে তার দৃষ্টিশক্তি চলে যায়।

৩. মুহাম্মদ বিন ছলাত আব্দী এবং র’বী বিন মুনযির তুরী, তাদের পিতাদের কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, এক ব্যক্তি এসে ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর শাহাদাতের সুসংবাদ দেয়। ফলে সে তখনই অন্ধ হয়ে যায়।

৪. আল্লামা জাওযীর দৌহিত্র বর্ণনা করেছেন যে, এক বৃদ্ধ হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর শাহাদাতের সাথে জড়িত ছিল। সে একদিন হঠাৎ অন্ধ হয়ে গেল। লোকজন এর কারণ জানতে চাইলে সে বললঃ “আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম-কে স্বপ্নে দেখলাম। দেখলাম, তাঁর জামার আস্তিন গুটানো, হাতের মধ্যে তলোয়ার এবং সামনে চামড়ার একটি কার্পেট, যার উপর অপরাধীদের মৃত্যূদন্ড কার্যকর করা হয়। এর উপর ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর দশ জন হত্যাকারীর লাশ যবেহকৃত অবস্থায় রাখা ছিল। তারপর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম আমাকে ধমক দিলেন এবং ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর রক্তের ফোটা আমার চোঁখে লাগিয়ে দিলেন। সকালে উঠে দেখি আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছি।”

৫. আল্লামা ইবনে জাওযী বর্ণনা করেন যে, যে ব্যক্তি হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর মাথা মোবারককে নিজের ঘোড়ার ঘাড়ের সাথে লটকিয়ে রেখেছিল তাকে এমন অবস্থায় দেখা গিয়েছিলো যে, তার মুখ আলকাতরার ন্যায় কুৎসিত হয়ে গেলো। লোকজন জিজ্ঞাসা করলো, তুমি সমগ্র আরবের মধ্যে অন্যতম সুদর্শন ব্যক্তি ছিলে। তোমার এ অবস্থা কিভাবে হলো? সে বললঃ “যেদিন আমি ইমাম হুসাইনের মাথা মুবারক ঘোড়ার ঘাড়ের সাথে লটকিয়েছিলাম; তার পরের দিন কিছুক্ষণের জন্য ঘুমালাম। তখন আমি স্বপ্নে দেখলাম দুইজন লোক আমার বাহু ধরে জ্বলন্ত এক অগ্নি কুন্ডের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অতঃপর তাতে আমাকে নিক্ষেপ করে। ফলে আমার মুখ ঝলসে যায়।” অতঃপর কিছুদিন পর সে এই অবস্থা নিয়েই মারা যায়।

৬. ঐতিহাসিকরা লিখেছেনঃ
“যে লোক হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-কে তীর নিক্ষেপ করেছিল এবং পানি পান করতে দেয় নাই, সে ব্যক্তির মধ্যে আল্লাহ তা’আলা এমন পিপাসার সঞ্চার করে দিলেন যে, কোনভাবেই তার পিপাসা নিবারণ হতো না। পানি পান করার পরও সে পিপাসায় ছটফট করতে থাকতো। এমতাবস্থায় মাত্রাতিরিক্ত পানি পানে তার পেট ফেটে গেল এবং সে অবশেষে মারা গেল।”

৭. ইবনে আইনিয়্যাহ বর্ণনা করেন যে, আমাকে আমার দাদী বলছেন, জুফাইন গোত্রের দু’ব্যক্তি হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর শাহাদাতে শরীক ছিল। তাদের মধ্য থেকে একজনের লজ্জাস্থান এতটাই দীর্ঘ হয়ে গিয়েছিল যে, সে বাধ্য হয়েই সেটাকে ভাঁজ করে চলাফেরা করতো এবং অপরজনের এত চরম পিপাসা সৃষ্টি হয়ে গেলো যে, সে পানি ভর্তি মশক মুখের সাথে লাগিয়ে রাখতো আর পাত্রের শেষ বিন্দু পর্যন্ত চুষে খেতো। আর এ যন্ত্রনায় সে মারা যায়।

৮. সুদ্দী বর্ণনা করেছেন যে, আমি এক জায়গায় মেহমান হিসেবে গেলাম, যেখানে ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর শাহাদাতের আলোচনা চলছিল। আমি বললাম, হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর শাহাদাতে যারা জড়িত ছিল তারা ন্যাক্কারজনকভাবে মারা গিয়েছে। একথা শুনে এক ব্যক্তি বলল, হে ইরাকীরা! তোমরা কতইনা মিথ্যাবাদী। দেখো! আমি হুসাইনের হত্যায় জড়িত ছিলাম, কিন্তু এখনও পর্যন্ত আমি এহেন মৃত্যূ থেকে নিরাপদ আছি। এ কথা শেষ করে সে জ্বলন্ত একটি চেরাগে তেল ভরে নিজের আঙ্গুল দ্বারা কিছুটা বাড়িয়ে দিতেই আঙ্গুলে আগুন লেগে যায়। সে ঐ আগুন তার থু থু দ্বারা নিভাতে চেষ্টা করলো। ঠিক তখনই তার দাঁড়িতে আগুন ধরে যায়। সে সেখান থেকে দৌঁড়িয়ে পানিতে ঝাপ দেয় যাতে আগুন নিভে যায়। কিন্তু পরিশেষে দেখা গেল, সে জ্বলে কয়ালায় পরিণত হয়ে গিয়েছে।

৯. ইমাম আহমদ বিন হাম্বল বর্ণনা করেন যে, এক ব্যক্তি ইমাম হুসাইনকে ফাসিক ইবনে ফাসিক (ফাসিকের ছেলে ফাসিক) বলে গালি দেয় (নাউযুবিল্লাহ)। আল্লাহ তা’আলা তখনই তার উপর দুইটি ছোট তারকার স্ফুলিঙ্গ বর্ষণ করে অন্ধ করে দেন।

১০. ইয়াযিদের অনুসারী মুসলিম বিন উকবা মদীনা শরীফে গিয়ে লোকদেরকে ইয়াযিদের হাতে বাইআত হওয়ার আহবান জানাতেই কিছু লোক জান মালের ভয়ে ইয়াযিদের হাতে বাইআত হয়ে যায়। বাইআতের সময় তাদের মধ্যে কুরাইশ গোত্রের এক ব্যক্তি বলল যে, আমি বাইআত হলাম ইয়াজিদের আনুগত্যের উপর, যদিও আমি তার গুনাহের সাথে একমত নই। একথা শোনা মাত্রই মুসলিম বিন উকবা তাকে হত্যা করলো। এমতাবস্থায় সে ব্যক্তির মা, ছেলে হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার শপথ নিয়ে বলল যে, যদি মুসলিম বিন উকবা মরেও যায় তাহলেও আমি কবর খনন করে তার লাশ জ্বালিয়ে দেব। মুসলিম বিন উকবা যখন মারা গেল তখন ঐ ছেলের মা কৃতদাসকে কবর খনন করার জন্যে বললো। খননের এক পর্যায়ে যখন লাশের নিকট পৌঁছলো তখন দেখলো যে, মুসলিম বিন উকবার ঘাড়ে অজগর সাপ পেঁচিয়ে আছে এবং তার নাক দিয়ে ঢুকে তাকে দংশন করছে।

১১. ইবনে আসাকির আ’মাশের কাছ থেকে বর্ণনা করেন যে, এক ব্যক্তি ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর মাজার শরীফে মল ত্যাগ করে (নাউজুবিল্লাহ)। সে সঙ্গে সঙ্গে পাগল হয়ে যায় এবং কুকুরের ন্যায় ঘেউ ঘেউ শব্দ করতে থাকে। যখন সে মারা যায় তখন তার কবর থেকেও কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ আসতে থাকে।

১২. হযরত মাওলানা আব্দুর রহমান জামী রহমাতুল্লাহি তা’আলা আলাইহি উল্লেখ করেন যে, সাইয়্যেদুনা ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর কাফেলা থেকে বেঁচে যাওয়া কিছু উট ছিল। ওগুলোকে ইয়াযিদী জালিমরা যবেহ করে কাবাব বানালো। ঐ গোশতের স্বাদ এতই তিক্ত ছিল যে, সেখান থেকে ভক্ষন করার সাহস কারো হলো না।

এ ছিল দুনিয়াতে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক পরিণতি। আখেরাতের শাস্তি তো আছেই। আল্লাহ বলেনঃ

كَذَلِكَ الْعَذَابُ وَلَعَذَابُ الْآخِرَةِ أَكْبَرُ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ

“শাস্তি এমনই হয়ে থাকে এবং আখেরাতের শাস্তি এর চেয়েও ভয়াবহ, যদি তারা জানতো।”
সূরা আল ক্বালাম, সূরা নং ৬৮, আয়াত নং ৩৩।

সূত্রসমূহঃ
[সাওয়াইক আল মুহরিক্বাহ, তইয়ুল ফারাসিখ লি ইবনে আসাকির, তাবাক্বাতে মানাদী আজ জামালে আউলিয়া, লানাত বার ইয়াযিদ; ফয়েজ আহমাদ ওয়াইসী, শাওয়াহিদুন নাবুও-ওয়া, তারিখুল মুলুক ওয়াল উমাম লি মুহাম্মাদ ইবনে জারীর তাবারী, তাবাক্বাতুল কুবরা লি ইবনে সা’দ, মাকতুবাত শরীফ, মাক্বতাল লি খাওয়ারিজমী।]

Related Post

দুরুদ-এ-কারবালা

Posted by - August 26, 2022 0
💞দূরুদে কারবালা💞 মহররমের চাঁদ উঠেছে চেয়ে দেখো মুসলমান (২) ইমাম হুসাইনের আহবান ডাকছে শহীদের ময়দান… চলরে মন যাইরে চল কারবালার…

ইয়াজিদ কর্তৃক ইমাম হুসাইনকে (আ.) হত্যার প্রমান

Posted by - September 10, 2022 0
১. কুখ্যাত ইয়াজিদ ক্ষমতায় বসেই মদিনার গভর্নর ওলিদকে চিঠি লেখে তাতেই ইমাম হুসাইন(আ:)-কে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ইয়াজিদের চিঠির অংশ…

ইয়াজিদ কি চেয়েছিল?

Posted by - July 31, 2022 0
মহররমের শোক-কথা (পর্ব-এক) সে তো সব কিছুই নিতে চেয়েছিল। ‘তাজ’ অর্থাৎ মুকুট পাওয়ার পর সে বলল, “এবার সিংহাসন চাই।” সিংহাসন…

শাম-এ-গারিবা

Posted by - August 30, 2020 0
পশ্চিম আকাশে লালিমা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, এইতো কিছু, পূর্বে ছিল কোলাহল ছিল মৃত্যুধ্বনি, তরবারির ঝনঝনানি আরও কতো শব্দ ছিল আকাশে…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »