হাররার ঘটনা

1541 0
🔴সাইয়িদুশ্ শুহাদা হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামের মর্মান্তিক শাহাদাতের দুই বৎসর পর পবিত্র মদিনা নগরীতে হাররার ঘটনাটি ঘটে। সেদিনগুলো ছিল হিজরী তেষট্টি সনের যিলহজ্ব মাসের শেষের তিন দিন রোজ বুধবার, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার।🔴
📚ইবনে ক্বুতাইবা; আল ইমামাতু ওয়াস সিয়াসাহ, খণ্ড ১, পৃঃ নং ১৮৫; বালাযুরী; আনসাবুল আশরাফ, খণ্ড ৪, অধ্যায় ২, পৃঃ নং ৪১; তারিখ তাবারী, খণ্ড ৫, পৃঃ নং ৪৯৪।
 
সেদিনগুলোতে (তিন দিন) নরখাদক, কাফির, রক্তপিপাসু পাপিষ্ঠ ইয়াযিদের নির্দেশে তার সেনাবাহিনী মুসলমানদের হত্যালীলায় মাতাল হয়ে উঠেছিল। নবীজীর সম্মানিত সাহাবাদের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল পবিত্র মদীনা মুনাওওয়ারার প্রতিটি অলি গলি।
 
🔴রক্তরঞ্জিত হয়েছিল প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র রওজা মুবারক। মসজিদে নববীতে তিন দিন কোন নামাজ হয়নি। মসজিদে নববী এই তিনদিন ইয়াযিদের সেনাবাহিনীর ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত হয়েছিল।
 
💢ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার সব পাপাচার ও চারিত্রিক অপরাধ তৎকালীন সকলের জন্যে জানা ছিল। তা সত্ত্বেও মুসলমানদের মধ্যে অল্প সংখ্যক লোকই ইয়াযিদের শাসনের বিরোধীতা করেছিল। তবে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে ইমাম হুসাইনের ক্বিয়ামের পর। ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের অল্প কিছুকাল পর মদিনাবাসীরা একটি প্রতিনিধি দল শ্যামের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করে, যেনো কাছ থেকে ইয়াযিদের অবস্থার প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে পারে।
 
হযরত হানযালা(রা:) ছিলেন রাসূলের(সা.) নেতৃত্বে ওহুদ যুদ্ধে শাহাদাতপ্রাপ্ত এমন ব্যক্তি, যার শাহাদাতের পর তাঁর লাশ ফেরেস্তারা গোসল দেয় এবং তখন থেকে তাকে আরবীতে “গ্বাসিলুল মালা-ইকা” বলে সম্বোধন করা হতো।
 
এ প্রতিনিধি দল আব্দুল্লাহ ইবনে হানযালার নেতৃত্বে কিছুদিন শ্যামে অবস্থানের পর মদীনাতে প্রত্যাবর্তন করে এবং তাদের দর্শনীয় বিষয়গুলো জনগণের কাছে বর্ণনা করে। ইতিহাসে এসেছে: “তারা ইয়াযিদকে মদ পান করা ও বানরের সাথে খেলারত অবস্থায় দেখে।”যখন তারা মদীনায় ফিরে আসলো তখন তারা তাদের দর্শনীয় তথ্য বর্ণনা করে ইয়াযিদকে লানত ও গালমন্দ করতে থাকে। অত:পর তারা তাকে খেলাফতের পদ থেকে বহিস্কারের ঘোষনা দেয় এবং মদীনায় ইয়াযিদের নির্বাহী, উসমান ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবি সুফিয়ানকে মদীনা থেকে বের করে দেয়। তারা বলে: “আমরা এমন এক ব্যক্তির কাছ থেকে এসেছি যার কোন দ্বীন ধর্ম নেই, যে মদ পান করে, যে সর্বদা মাতাল থাকে এবং কখনো সালাত আদায় করে না।” মদীনাবাসীরা উক্ত প্রতিবেদনটি শ্রবনের পর আব্দুল্লাহ্ ইবনে হানযালার হাতে বাইয়াত করে। সেও মদীনার জনসাধারণের উদ্দেশ্যে বলে: “হে জনগণ! আল্লাহর কসম করে বলছি, এমন সময় আমরা ইয়াযিদের বিরোদ্ধে ক্বিয়াম করেছি যখন আসমান থেকে (আল্লাহর আযাবস্বরূপ) পাথর নিক্ষেপ হওয়ার ভয় করতে লাগলাম। সে এমন ব্যক্তি যে তার মাহরামদের সাথে যৌন ক্রিয়ায় লিপ্ত হয় এবং এক্ষেত্রে কখনো মুয়াবিয়ার স্ত্রীরা, কন্যারা ও বোনরা ইয়াযিদের হাত থেকে নিরাপদ নয়। সে সর্বদা মদ্য পানে লিপ্ত থাকে এবং সালাত তরক করে। যদি আমরা তার বিরোদ্ধে বিদ্রোহ না করি, তাহলে আল্লাহর কসম! আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে বড় ধরনের বালা-মুসিবতের সমুক্ষীন হবো।”
📚শামসুদ্দীন আবু মুযাফফার সিবত ইবনে জাওযী, তাযকিরাতুল খাওয়াস, পৃঃ নং ২৮৮।
 
💢ওয়াহাবিদের ইমাম, ইবনে তাইমিয়ার শিষ্য ঐতিহাসিক ইবনে কাসীর বলেনঃ
“মদীনা মুনাওওয়ারাহ থেকে একটি দল দামেশকে ইয়াযিদ বিন মুয়াবিয়ার সাথে সাক্ষাতের জন্য আগমণ করলে সে তাদেরকে ভালভাবে আপ্যায়ণ করে এবং অনেক উপহার প্রদান করে। এ দলের আমীর ছিলেন আব্দুল্লাহ বিন হানযালা। তাঁর বাবা হানযালা রাদিয়াল্লাহু আনহু উহুদের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। তার ছেলেও ছিলেন নবীজীর একজন সাহাবী। দামেশকে অবস্থানকালে তাঁরা ইয়াযিদের সীমালঙ্ঘন ও ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ নিজ চক্ষে দেখেছিলেন, যা তাদেরকে ভীষণভাবে মর্মাহত করেছিল।
 
তাঁরা যখন মদীনায় ফিরে আসলেন, তখন মদীনা মুনাওওয়ারার জনগণকে ইয়াজিদের বিভিন্ন অপকর্মের কথা যেমনঃ মদ পান করা, মাতাল হয়ে নামাজ ছেড়ে দেয়া ইত্যাদি অবহিত করলেন। মদিনার জনগণ মসজিদে নববীর মিম্বরের সামনে উপস্থিত হয়ে ইয়াযিদকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করলেন। তারা ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত করতে অস্বীকৃতি জানালেন। সংবাদ পৌঁছে গেল ইয়াজিদের কাছে। ইয়াযিদ ক্ষিপ্ত হয়ে মুসলিম বিন উকবার নেতৃত্বে একটি সেনাদল প্রেরণ করল। যখন সেনাদলটি মদীনায় পৌঁছল, মুসলিম বিন উকবাহ তার বাহিনীর সৈন্যদের কাছে মদীনা মুনাওওয়ারাকে তিনদিনের জন্য হালাল ঘোষণা করে দিল। অর্থাৎ এই তিনদিনে তারা মদীনায় যা খুশি তাই করতে পারবে, কোন বাধা থাকবে না। এ তিন দিনে ইয়াজিদ বাহিনী দশ হাজার মদিনাবাসীকে হত্যা করেছিল। ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এ সময় ইয়াযিদের বাহিনী সাত শত কোরআনের হাফেজকে হত্যা করেছিল। এর মধ্যে তিনজন ছিলেন সাহাবী। এ ঘটনাকে ইতিহাসে হাররার ঘটনা বলে অভিহিত করা হয়েছে।”
📚আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, খণ্ড ৬, অধ্যায়ঃ আল ইখবারু আন ওয়াকআতিল হাররাহ।
 
🔴এ ঘটনাকালে ইয়াযিদ বাহিনী মানুষ হত্যা, সম্পদ লুন্ঠন এবং নারী ধর্ষণসহ সব কিছুই করেছিল।
📚তারিখ তাবারী, খণ্ড ৫, পৃঃ নং ৪৮৪; আল কামিল ফিত্ তারিখ, খণ্ড ৪, পৃঃ নং ১১২; আল বিদায়া ওয়ান্ নিহায়া, খণ্ড ৮, পৃঃ নং ২১৮।
 
🔴এ ঘটনাকালে মুসলমানের রক্তে পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছিল মদীনার রাজপথগুলো। মুসলমানদের রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের রওযা মোবারক পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। মসজিদে নববী রক্তে ভরে গিয়েছিল। দশ হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছিল। ধর্ষণের ফলে এ হাজার জারজ সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছিল।
📚আত তাযকিরাহ, লেখকঃ ইমাম ইবনুল জাওযী, পৃঃ নং ৬৩ ও ১৬৩।
 
💢নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম উক্ত ঘটনাটি সম্পর্কে ভবিষ্যতবাণী করে গিয়েছিলেন। হযরত আইয়ুব বিন বুশাইর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম একদা সফরে বের হলেন। অতঃপর হাররা নামক স্থান অতিক্রম করতে গিয়ে থেমে গেলেন। অতঃপর ফিরে আসতে চাইলেন। সাহাবীদের নিকট এ খবর পৌছলে উমর ইবনুল খত্তাব বলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি সেখানে কী দেখলেন? তিনি বললেন, এটা তোমাদের কোন সফরের পথ হতে পারে না। সাহাবারা বললেন, সেটা কী? হে আল্লাহর রাসুল! তিনি বললেন, এ হাররা নামক স্থানে আমার সাহাবীদের উপর হামলা করা হবে। আমার উম্মতের অনেক ভাল লোককে হত্যা করা হবে।
📚দালাইলুন নাবুওওয়াহ, লেখকঃ ইমাম বাইহাকী, হাদীস নং ২৮১৭।
 
💢হযরত হাফিয ইবনে হাজার আসকালানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ঐতিহাসিকগণ হাররার ঘটনার সত্যতার ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, হাররার ঘটনায় আশি জন সাহাবী শহীদ হয়েছিলেন। এ ঘটনার পর আর কোন বদরী সাহাবী জীবিত থাকেন নি।
📚ফতহুল বারী, খণ্ড ৮, পৃঃ নং ৬৫১।
 
💢ইবনে তাইমিয়াহ বলেন, ইয়াজিদের শাসন আমলে একটি বড় ঘটনা ঘটেছিল। মদীনাবাসী তার নিকট বাইয়াত গ্রহণে অস্বীকার করেছিলেন এবং ইয়াযিদ কর্তৃক নিয়োগকৃত মদিনার গভর্ণরকে তাঁর পরিবার সহ মদীনা থেকে বের করে দিয়েছিলেন। মূলতঃ ফাসিক ইয়াজিদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে তারা তাকে সপরিবারে বের করে দিয়েছিলেন, যা ইমাম ইবনে হাজার আসক্বালানী তাঁর কিতাবে উল্লেখ করেছেন। অতঃপর ইয়াযিদ একটি সেনাদল প্রেরণ করল। মদীনায় পৌঁছে তারা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। আর এটা ছিল ইয়াজিদের নির্দেশে এক অত্যাচার আর সীমালংঘনের নিদর্শন।
📚মাজমুউল ফাতাওয়া: খণ্ড ৩, পৃঃ নং ৪১২।
 
📖💯(উপরোক্ত সবগুলো সুত্র আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের বিশ্বস্ত আলেমদের লেখা এবং ওয়াহাবীদের ইমাম, ইবনে তাইমিয়া ও তার শিষ্য ইবনে কাসিরের উক্তি। আর মনে রাখা দরকার, নবীজীর সুন্নত উপেক্ষা করে এবং ইমাম হাসান আলাইহিস সালামের সাথে কৃত চুক্তি ভঙ্গ করে এই ইয়াযিদকে কুখ্যাত মুয়াবিয়াই ক্ষমতার মসনদে পাকাপোক্ত করে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। তাই, ইয়াযিদের সকল অপকর্মের জন্যে মুয়াবিয়াও সমপরিমান দায়ী।)
↯↻↯↻↯

Related Post

পবিত্র কাবা ঘর ও যমযম কুপের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

Posted by - August 22, 2019 0
🔊 পবিত্র কাবা ঘরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ👇 পবিত্র কাবা আল্লাহর ঘর। একে বেষ্টন করে আছে মসজিদুল হারাম। জীবাত্মা ও পরমাত্মার সেতুবন্ধন…

বিজয়ের ৫০তম বর্ষে সবাইকে মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা

Posted by - December 16, 2021 0
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব প্রকাশের দিন। ৫০তম বর্ষে বিজয়ের গৌরব বুকে নিয়েই আমরা…

আবু সুফিয়ান ও মুয়াবিয়া সম্পর্কে রাসূলের (সাঃ) পক্ষ থেকে সত্য প্রকাশ

Posted by - October 6, 2019 0
রাসূলের (সাঃ)-এর পক্ষ থেকে সত্য প্রকাশ এবং আবু সুফিয়ান ও মুয়াবিয়ার উপর অভিসম্পাতঃ ইসলামের মহান রাসূল(সা.) শুধুমাত্র বনি উমাইয়্যার পুনরায়…

ইয়াজিদের মৃত্যু ইতিহাস

Posted by - September 17, 2019 0
৬৪ হিজরির ১৪ই রবিউল আউয়াল জালিম ও খোদাদ্রোহী শাসক ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়া মারা যায়। (আল্লাহর অনন্ত অভিশাপ তার ওপর বর্ষিত…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »