হক্কানী মুর্শিদের হাতে বাইআ’ত অপরিহার্য

1929 0
পৃথিবীর সূচনাকাল থেকেই আল্লাহ পাক হেদায়েতের দুটি ধারা পাশাপাশি রেখেছেন। একটি ধারার নাম হলো, কিতাবুল্লাহ। আর অপর ধারার নাম হলো রিজালুল্লাহ। রিজালুল্লাহ অর্থ এমন ব্যক্তিত্ব, যারা তাফাক্কুহ ফিদ্দীন তথা দ্বীনি বিষয়ে পরাঙ্গম ও আমলি-নমুনা, রুসূখ ফিল ইলম তথা ইলমি-গভীরতায় অনন্য এবং তাকওয়া ও আল্লাহভীতির গুণে গুণান্বিত হবেন। যারা নিজেদের কর্ম ও আচরণ এবং সূরত ও চরিত্রের মাধ্যমে ইসলামী আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করবেন আর অন্যের জন্যে উসওয়ায়ে হাসানা তথা উত্তম আদর্শ হবেন। যাদের ইখলাস ও লিল্লাহিয়্যাত সকল সন্দেহ-সংশয়ের উর্দ্ধে থাকবে, যারা হবেন মুসলিম উম্মাহর ব্যাথায় ব্যথিত এবং উম্মাহর কল্যাণে শরীয়তের বিধান মোতাবেক বিভিন্ন অঙ্গনে নিবেদিত। মনে রাখতে হবে, এই ব্যক্তিবর্গকে আল্লাহ তাঁর কিতাব পাঠানোর আগে পাঠিয়েছেন। দেখুন, যখন নবী আদম আ’লা নাবিয়্যিনা ওয়া আলিহি ওয়া আলাইহিস সালাম ও তাঁর স্ত্রীসহ মোট দুই জন মানুষ এ পৃথিবীতে ছিলেন তখনো কিন্তু তাদের মধ্যে একজন নবী তথা আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত ব্যক্তি মানুষের হেদায়াতের জন্যে ছিলেন। তাছাড়াও আল্লাহর কিতাব যে পাত্রে রাখা হয় তারা হন নবী ও রাসূল। তাদের গুরুত্ব সবার উর্ধে। এ কারণে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম সাক্বালাইনের হাদিসে কিতাবুল্লাহ-র পাশাপাশি রিজালুল্লাহর কথাও বর্ণনা করেছেনঃ
 
“আমি তোমাদের মাঝে ভারবাহী ও সম ওজন বিশিষ্ট্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। একটি আল্লাহর কিতাব আর অপরটি আমার পবিত্র আহলে বাইত। যারা এ দু’টিকে আকড়ে ধরবে তারা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। তারা কখনো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না হাউযে কাউসারে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত।” এই আহলে বাইত হচ্ছেন, রিজালুল্লাহ। তাঁরা হচ্ছেন মানব জাতির মুর্শিদ। আর এই শব্দটিকে প্রাচীন ফার্সিতে ও ইরফানি অর্থে পীর শব্দ দ্বারা বুঝানো হয়ে থাকে। তাই, আমাদের যামানার বড় ও মূল পীর এবং শ্রেষ্ঠ মুর্শিদ হযরত ইমাম মাহদী আলাইহিস সালাম। তাঁর গাইবাতকালে যারা মানুষের হেদায়েতের দায়িত্ব পালন করবেন তারা ইমামের এজাযতক্রমে তাঁর পক্ষ থেকে সেই জনগোষ্ঠির মুর্শিদ ও পীর হবেন। এ ধরনের ব্যক্তিই বাইআ’ত গ্রহণ করতে পারে।
 
মুর্শিদ শব্দের অর্থ হল পথপ্রদর্শক। যিনি আল্লাহর আদেশ নিষেধ এবং আল্লাহ তাআলা যেভাবে চান সেভাবে পালন করার প্রশিক্ষণ দেন। আর মুরীদ শব্দটির অর্থ হল ইচ্ছাপোষণকারী। যে ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ-নিষেধ, আল্লাহ তাআলা যেভাবে চান সেভাবে পালন করার ইচ্ছা পোষণ করে কোন পীর ও মুর্শিদের কাছে শপথ করে, তাকে বলা হবে মুরীদ। উক্ত অর্থে পীর মুরীদির এ পদ্ধতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লামের আমল থেকে চলে এসেছে। কোরআন ও হাদীসে মুরীদ হওয়ার বিষয়টি এসেছে بيعة ‘বাইআ’ত’ শব্দ নামে। বাইআ’ত প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেনঃ
 
إِنَّ الَّذِينَ يُبَايِعُونَكَ إِنَّمَا يُبَايِعُونَ اللَّهَ يَدُاللَّهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ فَمَنْ نَكَثَ فَإِنَّمَا يَنْكُثُ عَلَى نَفْسِهِ وَمَنْ أَوْفَى بِمَا عَاهَدَ عَلَيْهُ اللَّهَ فَسَيُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا.
 
‘(হে নবী!) যারা আপনার কাছে ‘বাইআ’ত’ [=আনুগত্যের শপথ] করে, তারা তো আল্লাহর কাছে ‘বাইআ’ত’ করে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর রয়েছে। অতএব, যে ব্যক্তি শপথ ভঙ্গ করে সে অবশ্যই নিজের সাথেই শপথ ভঙ্গ করেছে এবং যে আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করে; আল্লাহ অতি দ্রুত তাকে মহাপুরস্কার দান করবেন।” (সূরা আল ফাতহ, সূরা নং ৪৮, আয়াত নং ১০)।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের কাছ থেকে ‘বাইআ’ত’ নিয়েছেন এবং আল্লাহমুখী হওয়ার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। সুতরাং বলা যায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম হলেন সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে বড় পীর এবং সাহাবায়ে কেরাম হলেন প্রথম মুরীদান।
 
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের যুগে যে ধরনের ‘বাইআ’ত’ ছিল তা হলো বাইআ’তে রাসূল। এ ধরনের বাইআ’ত দ্বীন রক্ষার জন্যে কখনো ছিল রাজনৈতিক, কখনো যুদ্ধের শুরুতে আবার কখনো সামাজিক ও আত্মশুদ্ধিমূলক। খলিফাদের সাথে যে বাইআ’ত ছিল তা ছিল বাইআ’তে খিলাফাহ, আর তা ছিল শুধুমাত্র রাজনৈতিক। আবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম কখনো সাহাবাদেরকে উন্নত শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্দেশ্যেও ‘বাইআ’ত’ করেছেন। এ মর্মে অনেক হাদীস বিভিন্ন হাদিসের কিতাবে দৃষ্টিগোচর হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপঃ সহীহ বুখারীতে এসেছেঃ
 
حَدَّثَنَا أَبُو الْيَمَانِ، قَالَ أَخْبَرَنَا شُعَيْبٌ، عَنِ الزُّهْرِيِّ، قَالَ أَخْبَرَنِي أَبُو إِدْرِيسَ، عَائِذُ اللَّهِ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ أَنَّ عُبَادَةَ بْنَ الصَّامِتِ ـ رضى الله عنه ـ وَكَانَ شَهِدَ بَدْرًا، وَهُوَ أَحَدُ النُّقَبَاءِ لَيْلَةَ الْعَقَبَةِ ـ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ وَحَوْلَهُ عِصَابَةٌ مِنْ أَصْحَابِهِ ‏ “‏ بَايِعُونِي عَلَى أَنْ لاَ تُشْرِكُوا بِاللَّهِ شَيْئًا، وَلاَ تَسْرِقُوا، وَلاَ تَزْنُوا، وَلاَ تَقْتُلُوا أَوْلاَدَكُمْ، وَلاَ تَأْتُوا بِبُهْتَانٍ تَفْتَرُونَهُ بَيْنَ أَيْدِيكُمْ وَأَرْجُلِكُمْ، وَلاَ تَعْصُوا فِي مَعْرُوفٍ، فَمَنْ وَفَى مِنْكُمْ فَأَجْرُهُ عَلَى اللَّهِ، وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا فَعُوقِبَ فِي الدُّنْيَا فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَهُ، وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا ثُمَّ سَتَرَهُ اللَّهُ، فَهُوَ إِلَى اللَّهِ إِنْ شَاءَ عَفَا عَنْهُ، وَإِنْ شَاءَ عَاقَبَهُ ‏”‏‏.‏ فَبَايَعْنَاهُ عَلَى ذَلِكَ‏.‏
 
‘উবাদা ইবনুস সামিত বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম একদল সাহাবীর উপস্থিতিতে ইরশাদ করেন, তোমরা আমার কাছে এই মর্মে বাইআ’ত গ্রহণ করো যে, আল্লাহ্‌র সঙ্গে কোন কিছুর শরীক করবে না, চুরি করবে না, যিনা করবে না, তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না, কাউকে মিথ্যা অপবাদ দেবে না এবং নেক কাজে নাফরমানী করবে না। তোমাদের মধ্যে যে তা পূরণ করবে, তার বিনিময় আল্লাহ্‌র কাছে। আর কেউ এর কোন একটিতে লিপ্ত হয়ে পড়লে এবং দুনিয়াতে তার শাস্তি পেয়ে গেলে, তবে তা হবে তার জন্য কাফ্‌ফারা। আর কেউ এর কোন একটিতে লিপ্ত হয়ে পড়লে এবং আল্লাহ্ তা অপ্রকাশিত রাখলে, তবে তা আল্লাহ্‌র ইচ্ছাধীন। তিনি যদি চান, তাকে মাফ করে দেবেন আর যদি চান, তাকে শাস্তি দেবেন। আমরা এর উপর বাইআ’ত গ্রহণ করলাম।”(সহী আল বুখারী, হাদীস নং ১৭)।
 
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পীর-মুরীদি তথা বাইআ’ত করা শরীয়ত সম্মত কাজ। স্বনামধন্য মুহাদ্দিস আবদূল হক্ব মুহাদ্দেসে দেহলভী রহ. তার ‘কওলুল জামিল’ কিতাবে লিখেন, বাইআ’ত গ্রহণ করা সুন্নত। তাসাউফ ও ইরফান শিখতে হলে অবশ্যই কোন হক্কানী পীরের কাছে বাইআ’ত গ্রহণ করতেই হবে। ইসলাম ও কুরআনের দৃষ্টিতে যত্র তত্র বাইআ’ত গ্রহণ করা হারাম। এ জন্যেই ইয়াযিদের হাতে বাইআ’ত হারাম ছিল আর ইমাম হুসাইনের হাতে বাইআ’ত ফরজ ছিল। অথচ অজ্ঞ ও সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত কিছু লোক জেনে ও না-জেনে, বুঝে ও না-বুঝে মানুষকে রিজালুল্লাহ তথা আহলে বাইত থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে চায়। আহলে বাইতের ধারায় বাইআ’ত হতে গেলেই অনেক অজ্ঞ ও বক ধার্মিক লোক বলে, তারা শীয়া হয়ে গেছে, তারা সুন্নী না, ইত্যাদি নানা ধরনের কথা বলে রিজালুল্লাহ তথা আহলে বাইত থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে চায়।
 
তবে, মনে রাখতে হবে, সব আসল জিনিসেরই নকল বের হয়ে যায়। ইসলামের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ইমাম হুসাইন আসল ইসলামকে রক্ষার জন্যে সেই নকল ইসলামের বিরোদ্ধেই ক্বিয়াম করেছিলেন। পীর-মুরীদি ও বাইআ’তের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। তাই, যাচাই বাছাই করে হক্কানী পীরের হাতেই বাইআ’ত হতে হবে। আর তা না হলে আখেরাতে সমূহ ক্ষতির সমুক্ষিন হতে হবে নাউযুবিল্লাহ।

Related Post

হযরত আয়াতুল্লাহ মারেফাত (রহ:)

Posted by - September 19, 2019 0
অধুনা কালের একক ও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব, শিক্ষাগুরু ও আধ্যাত্মিক সাধক হযরত আয়াতুল্লাহ মারেফাত (রহ:)  ভূমিকাঃ “যাঁকে হিকমত বা প্রজ্ঞা দান…

পীর ও মুর্শিদ

Posted by - August 17, 2019 0
ফার্সি ভাষায় পীর শব্দের বাংলা অর্থ হচ্ছেঃ বৃদ্ধ, মুরুব্বী, অগ্রণী, নেতা, পথ প্রদর্শক প্রভৃতি। পীর শব্দটি কোরআন পাকে নেই। পীর…

আল্লাহর ইসমে আযম

Posted by - September 17, 2019 0
✍️‎[হযরত বারায়া ইবনে আযিব(রাঃ) বলেন, আমি আমিরুল মুমিনিন আলী ‌‎(সালাওয়াতুল্লাহি আলাইহি)-এর ‎খেদমতে‎ আল্লাহর কসম দিয়ে আরজ করলাম, ‎আমাকে আল্লাহর ইসমে…

সূরা ইউসুফ, আয়াত নং ৯৯

Posted by - August 16, 2019 0
•✦✨ ﷽ ✨✦• 〖 فَلَمَّا دَخَلُوا عَلَىٰ يُوسُفَ آوَىٰ إِلَيْهِ أَبَوَيْهِ وَقَالَ ادْخُلُوا مِصْرَ إِنْ شَاءَ اللَّهُ آمِنِينَ〗 🔰 সূরা…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *