স্বাধীনতা বনাম পরাধীনতা

834 0

যারা বিশ্বাস করেন,‘মানুষের সকল ভাল-মন্দ কাজের মূলে আল্লাহর শক্তিমত্তা কাজ করছে এবং সকল কিছুর স্রষ্টাও তিনি’-তারা তাদের বক্তব্যের স্বপক্ষে কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াতদ্বয় পেশ করে থাকেন। আল্লাহ্ বলেন,

إِنَّ اللَّـهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

অর্থাৎ,নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল কিছুর উপর শক্তিমান।(আল বাকারা,আ : নং ১০৯)

তিনি আরো বলেন,

(هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُم مَّا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا)

অর্থাৎ,তিনি আল্লাহ্,যিনি তোমাদের জন্যে যমিনের বুকে সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন।(আল বাকারা,আ : নং ২৯)

তারা উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ে ব্যাখ্যায় মানুষের সকল মন্দ বা অমঙ্গল কাজগুলোকেও আল্লাহর কাজ বলে চালিয়ে দিতে চান। তারা এ ধরনের আয়াতের অর্থ সমুন্নত রাখতে গিয়ে আল্লাহর ন্যায়বিচার ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গেছেন। সঙ্গে সঙ্গে পরকালের হিসাব নিকাশকেও প্রশ্নের সম্মুখীন করে তুলেছেন। কেননা,যে আল্লাহ্ নিজে মন্দ বা অমঙ্গল কাজ করেন সে আল্লাহ্ কি করে মানুষের মন্দ কাজের বিচার করবেন? আর যদি মানুষের মন্দ কাজের জন্যে তিনি নিজেই দায়ী হন তাহলে তার মন্দ কাজের জন্যে তিনি মানুষকে কি করে শাস্তি প্রদান করতে পারেন? আর এভাবেই পরকালের বিচার দিবসে হিসাব নিকাশ অর্থহীন হয়ে পড়বে। আশআরী মতাবলম্বী ব্যক্তিবর্গ এ ধরণের ভিত্তিহীন ও পক্ষপাতিত্ব বক্তব্যের মাধ্যমে ইসলামকে বিবেক ও বুদ্ধিবৃত্তি-বিরোধী একটা মতবাদে রূপান্তরিত করে ফেলেছেন।

অপরদিকে,মু’তাযিলা অনুসারীগণ বিশ্বাস করেন,মানুষ সম্পূর্ণ ও নিরংকুশ স্বাধীন। আল্লাহ্ মানুষকে স্বাধীনতা প্রদান করে ছেড়ে দিয়েছেন। মানুষ ভাল-মন্দ যা কিছু ইচ্ছে স্বাধীনভাবে তা আঞ্জাম দিতে সক্ষম। এতে আল্লাহর কোন হস্তক্ষেপ নেই। আল্লাহ্ শুধু বসে তামাশা দেখছেন,মানুষ কি করছে। আল্লাহ্ মানুষকে সৃষ্টি করে সকল কিছুর দায়িত্ব তার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। তারা তাদের বক্তব্যের স্বপক্ষে দলীল হিসেবে আল্লাহর সুবিচার ও প্রজ্ঞার বিষয়টি উপস্থাপন করে থাকেন। মু’তাযিলিরা নিম্নোক্ত আয়াতদ্বয়ের ন্যায় কোরআনের যতস্থানে আল্লাহর ন্যায়বিচার,অন্যায় কার্য পরিহার ও তার প্রজ্ঞার কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোকে তাদের বক্তব্যের সমর্থনে পেশ করে থাকেন।

এক :  . (إِنَّ اللَّـهَ عَلِيمٌ حَكِيمٌ)

অর্থাৎ,নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মহাজ্ঞানী ও মহাপ্রজ্ঞাবান।(আত তাওবা,আয়াত নং ২৮)

দুই :  (إِنَّ اللَّـهَ لَا يَظْلِمُ النَّاسَ شَيْئًا وَلَـٰكِنَّ النَّاسَ أَنفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ)

অর্থাৎ,নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মানুষের উপর কোন প্রকার যুলুম-অত্যাচার করেন না বরং মানুষই নিজেরাই নিজেদের উপর যুলুম করে থাকে।(ইউনুস,আয়াত নং ৪৪)

তারা বলে,যদি আল্লাহ কোন মন্দ কাজ করেন অথবা মন্দ কাজে মানুষের সাথে অংশ গ্রহণ করেন তাহলে তিনি সুবিচারকের মহান পদ থেকে অপসারিত হয়ে যাবেন। কিন্তু কোরআন ও বুদ্ধিবৃত্তিক দলীল প্রমাণের মাধ্যমে সুপ্রমাণিত যে আল্লাহ একজন ন্যায় বিচারক ও আদেল। তারা আল্লাহর ন্যায়বিচারের গুণকে সমুন্নত রাখতে গিয়ে আল্লাহর শক্তিমত্তাকে সীমিত করে ফেলেছেন যা আশআরী চিন্তাভাবনার চেয়েও অত্যন্ত বিপদজনক। এটা নির্ঘাত সত্য যে,বিশ্বজগতের সকল কিছু আল্লাহ্ তার স্বীয় ক্বুদরতে সৃষ্টি করেছেন। কোন কিছুই তাঁর শক্তিমত্তার বাইরে নয়। সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা তিনি। কিন্তু মানুষের কর্মকান্ড ও অন্যান্য প্রাণীদের কর্ম-ধারা একই রকম নয়। সৃষ্টি জগতের সকল কিছুই আল্লাহ্ প্রদত্ত নিয়ম-নীতি মোতাবেক কার্য সম্পাদন করে থাকে,এমন কি মানবজাতিও। আকাশ-বাতাস,পাহাড় পর্বত,গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদি সকল সৃষ্ট বস্তু আল্লাহর নির্দেশের অনুগত। এক্ষেত্রে মানুষও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু মানুষের কর্ম-ধারার সাথে অন্যান্য সৃষ্টির কর্ম-পদ্ধতির পার্থক্য রয়েছে। অনেকে ভুলবশতঃ সবকিছুকে একই পদ্ধতি ও নিয়ম-ধারার মধ্যে সংমিশ্রণ করে অন্যান্য সৃষ্টি বস্তুসমূহের সাথে মানুষের তুলনা করে থাকেন। ফলে আল্ কোরআনে যেখানে বলা হয়েছে,‘আল্লাহ সকল কিছুকে সৃষ্টি করেছেন’। অথবা ‘আল্লাহ সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান’। সেখানে তারা এ সকল আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্পষ্ট বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে গেছেন। মানুষ ব্যতীত অন্যান্য সকল সৃষ্টির প্রতি আল্লাহর নির্দেশ হচেছ,‘কোন রকম বিবেক-বুদ্ধি ছাড়াই নির্দেশ মেনে চলতে হবে’। আর মানবজাতীর প্রতি আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে : ‘সকল কাজ-কর্ম বিবেকের বিশ্লেষণের মাপকাঠিতে সম্পন্ন করতে হবে’। সুতরাং এ ক্ষেত্রেও আল্লাহর নির্দেশের অনুসরণ করে চলেছে মানবকুল। তবে যেহেতু সে ভাল-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা রাখে এবং সে অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন করে থাকে,তাই তার কর্মের ফলাফলও তাকেই ভোগ করতে হবে।

পরিশেষে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে,আশআরী ও তার অনুসারীদের ন্যায় মানুষকে তার ক্রিয়া-কর্মে পরাধীন মনে করা যেমনি যথার্থ বলে পরিগণিত হতে পারে না তেমনি মু’তাযিলীদের মত আল্লাহর ক্ষমতা ও প্রভাবকে সীমাবদ্ধ করাও অন্যায় ও অমার্জনীয় অপরাধ বলে পরিগণিত।

এক দিকে আশআরীগণ মানুষকে এমনভাবে খাঁচাবদ্ধ করে ফেলেছে যে,তাদের মতে মানুষ স্বেচ্ছায় কোন কাজই আঞ্জাম দিতে সক্ষম নয়। পক্ষান্তরে মু’তাযিলীরা মানুষকে এমনভাবে স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার ক্ষমতা প্রদান করেছে যে তাদের বক্তব্য মতে আল্লাহ্ সকল ক্ষমতা মানুষের উপর অর্পন করে তিনি হাত গুটিয়ে বসে আছেন। এ উভয় মতামত-ই বিভ্রান্তির শিকার।

উপরোক্ত দু’টি মতামতের মাঝামাঝি আরেকটি মতামত বিদ্যমান যা সত্যের মাপকাঁঠিতে সঠিক ও যথার্থ বলে স্বীকৃতি লাভ করেছে বুদ্ধিমান ও চিন্তাবিদদের মাঝে। তা’হলো একদিকে আমরা বলতে পারি মানুষের কর্ম ক্ষমতার পেছনে মূল শক্তিমত্তা হিসেবে আল্লাহ্-ই কাজ করেন। কেননা আল্লাহ্-ই তো আমাদেরকে শক্তি-সামর্থ্য,বিবেক-বুদ্ধি ও বিচার ক্ষমতা দিয়েছেন। কিন্তু তাই বলে আল্লাহকে মানুষের মন্দ কাজের জন্যে দায়ী করা যাবে না। কেননা মানুষ তার কাজ-কর্ম স্বেচ্ছায় আঞ্জাম দিয়ে থাকে,কারো চাপের মুখে নয়। তাই তো এ বিবেক ও বিচার ক্ষমতার অধিকারী হয়ে মানুষ,সমাজ,রাষ্ট্র নির্বিশেষে মানবতার জন্যে অসংখ্য খেদমত করে যেতে পারে আবার বিপরীতভাবে অপরিসীম অমঙ্গল অন্যায় ও অকল্যাণ কাজ আঞ্জাম দিয়ে যেতে পারে। তাই পূণ্য ও মন্দ উভয় প্রকার কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে পুরস্কার অথবা শাস্তি তাকেই ভোগ করতে হবে। আর এ ধরনের তৃতীয় একটি মধ্যপন্থী মতবাদের মাধ্যমেই পরকালে বিশ্বাস,আল্লাহর ন্যায় বিচার ও তার সর্বময় ক্ষমতার গুণাবলী স্ব-স্থানে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

এ সম্পর্কে নবী (সাঃ) বংশের ষষ্ঠ পুরুষ ইমাম জা’ফর বিন মুহাম্মদ আস্ সাদেক বলেছেন,

‘‘বাধ্যবাধকতাও নয়,নিরংকুশ স্বাধীনতাও নয় বরং এ দু’টোর মাঝামাঝি একটি অবস্থা-ই হচেছ সঠিক।’’২৬

Related Post

সৃষ্টিকর্তার গুণাবলী

Posted by - December 6, 2019 0
বিশ্ব বিধাতা পরিপূর্ণ ও পরম সত্তা। তাঁর জাত বা সারসত্তা সকল প্রকার গুণাবলীতে ভরপূর। কেননা,যা কিছু আমরা পরিপূর্ণতা বলে আখ্যায়িত…

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি

Posted by - December 2, 2019 0
শিশু জন্মলগ্ন থেকেই তার চার পাশে অনেককে দেখতে পায়। সর্বপ্রথম যার সাথে সাক্ষাৎ ঘটে তিনি হলেন নবজাত শিশুর মা। ধীরে…

বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অপনোদন

Posted by - December 6, 2019 0
বস্তুবাদীরা আস্তিকবাদীদের উপর জোরালো আপত্তি উত্থাপন করতে পারেন এই বলে যে,“প্রকৃতিই হল সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা ও নির্মাতা। এ প্রকৃতির কারনেই…

মানব-প্রকৃতি ও সত্যান্বেষী স্বভাব

Posted by - December 2, 2019 0
এ বিশ্বের সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব প্রমাণের বিভিন্ন পথ রয়েছ। দার্শনিকগণ তাদের দর্শনের প্রমাণ করে থাকেন। আরেফ ও আধ্যাত্মি ব্যক্তিবর্গ তাদের নিজ…

বিশ্ব স্রষ্টা এক ও অদ্বিতীয়

Posted by - December 6, 2019 0
মানব জাতির সহজাত বৈশিষ্ট্য হল শক্তিশালী কোন সত্তার সম্মুখে নিজেকে অবনত রাখা। শৈশব থেকে যখন মানব বিচার-বুদ্ধি উন্নতি লাভ করতে…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *