তপ্ত রোদে খোলা আকাশের নিচে সেই কবে থেকে বসে আছে মা, হিসেব মেলানো দুঃসাধ্য। কিই বা আর করবেন আর মা। এমন কচি খোকা ঘরে না ফিরলে মায়ের কি ঘুম হয়!
এমন প্রানের ধন বুক খালি করে চলে যেতে পারে, মায়ের জন্য বিশ্বাস করা অসম্ভব। তাই তো, মা বসে আছেন খোলা আকাশের নিচে। খোকা ফিরবেই! কাজল কালো চোখে তাকিয়ে থাকবে শুধু, বলতে তো পারবে না কিছুই। ওর আর বয়সই বা কতো। সবে তো মাস কয়েক।
আরও কতো এলোমেলো ভাবনা ঘুরে-ফিরে মায়ের মনে। বোধ ফিরে পেলেন একমাত্র অবলম্বনের ডাকে, যাকে দেখেই কতোনা না দেখার বেদনাকে দাবিয়ে রাখেন মা! নয়নের একমাত্র জ্যোতির দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাঁকালেন।
পুত্র বললেন: এবার একটু ছায়ায় এসো মা! একটু ঠান্ডা পানি মরূসম গলে একবার দাও মা!! আমাদের নয়নের মানিককে যে হায়েনারা খেয়ে ফেলেছিলো, তাকে শিকার করা হয়েছে। এবার তো একটু হাঁসো!!!
মা দির্ঘশ্বাঃস ছেড়ে দূরপ্রান্তের দিকে তাঁকিয়ে বললেন: তুমি পারবে বুকের ব্যাথায় হাঁটু গেড়ে বসা থেকে বিরত থাকতে? পারবে কি বলো! রক্ত অশ্রু বিসর্জন থামিয়ে দিতে!?!? পারবে কি বলো? ছোট মানিকের নাম ধরে নির্জনে বুক ভাসানো প্রতিনিয়ত বিলাপ থেকে ফিরে আসতে?!?! যেদিন পারবে, সেদিন আমাকে জানাবে। দুঃখি মায়ের অশ্রু সেদিন দেখবে না তুমি, খোদার কসম করে বলি…..
সকলে মিলে পশুটিকে টেনে হিঁচড়ে শোয়ালো। কসাই ছুরিতে শান দিচ্ছে। মুখে আল্লাহ খোদার নাম নিয়ে মাত্রই জবাই করতে যাবে, এমন সময় কাছের কোথাও থেকে একটি আওয়াজ আসলো: ‘দাঁড়াও’!
সবাই অবাক, কিছুটা বিরক্তও বটে। এমন একটি মহৎ কাজে কে বাধা দিলো। দেখলো একজন ব্যক্তি হেলে দুলে এগিয়ে আসছে। আশ্চর্য! আজকের দিনেও তার মুখে কোন হাঁসি নেই। চোখ দুটি ফুলে উঠেছে। চেহারায় অব্যক্ত বেদনার ছাপ স্পষ্ট।
জিজ্ঞেস করলো: ‘কি করছো তোমরা! পশুটিকে জবাই করার পূর্বে পানি দিয়েছিলে?!?’
সবাই এবারও বিরক্ত হলো। একজন সবার পক্ষ থেকে জবাব দিলো: ‘কি বলছেন আপনি!?! একটি পশুকে জবাই করার পূর্বে তাকে পানি দিবো না! এতো নিষ্ঠুর তো কোন মানুষ হতে পারে না!’
লোকটির চোখে এবার অশ্রুর বান বয়ে গেলো যেন। বললো: ‘অথচ আমার পিতাকে নির্মমভাবে জবাই করার পূর্বে একফোঁটা পানিও দেয়া হয়নি!’
এই বলেই লোকটি চলে যাচ্ছে। আর বাকিরা অপলক তার চলার পথে নিথর তাকিয়ে রইলো…..
গভির রাতে চমকে উঠলো সে! আমার প্রাসাদে এমন আর্তনাদ! ‘উফফ! এত বিভোর ঘুম কিভাবে ভাঙ্গে? সন্ধ্যা থেকেই তো রোমীয় মদ গলা ডুবিয়ে খেয়েছিলাম! আজকের দিনটিও বেশ ছিল! কিন্তু বাচ্চা কণ্ঠের এই আর্তনাদ ঘুমাতে দিচ্ছে না আমায়!’ হাঁক ছেড়ে ডাকল পেয়াদাকে- ‘এই কে আছিস? এত চেচামেচি কিসের? কোথা থেকে আসছে এ বিলাপের শব্দ!’
পেয়াদা ভীত কণ্ঠে জবাব দিলোঃ ‘জনাব! যাকে হত্যা করা হয়েছে তাঁর তৃষ্ণার্ত শিশু কন্যা কাঁদছে?’
‘ওহহো! সে তো মরেই গেছে! আর কেদে কি লাভ! কাদলে কি ফিরে আসবে!! তাঁর কান্না আমার জীবনকে নরক বানিয়ে দিচ্ছে। কি চায় সে?’
‘তাঁর পিতার মাথা’
‘তাঁকে তা দিয়ে দাও! আর আমাকে ঘুমাতে দাও! যার যা চাই তা দিয়ে দাও! আমাকে ঘুমাতে দাও!’
কারাগারের অন্ধকার গলিতে হঠাৎ আলোর রেখা ফুটে উঠলো। তাহলে কি সবাইকে হত্যার নির্দেশ চলে এসেছে। ক্ষিন আলোর মশাল অন্ধকারের চাদর চিঁরে বেরিয়ে আসলো রক্ষি, হাতে নিয়ে বাবার কর্তিত মস্তক। তুলে দিল আর্তনাদরত মেয়েটির কোলে।
যেন প্রান ফিরে পেলো সে। চোখ মুছে বাবার ঠোঁটে চুমু দিচ্ছে। কচি হাতে মুছে দিচ্ছে চেহারায় লেগে থাকা রক্তের দাগ। ক্ষিন কণ্ঠে গুনগুন করছেঃ ‘বাবা! তুমি কোথায় গিয়েছিলে? তুমি জান না, তুমি না থাকলে আমার ঘুম হয় না। তোমার পাশে না শুয়ে থাকলে আমি চোখ বুঝতে পারি না।
আমার ভয় করে বাবা! তুমি কোথায় গেলে? জানো, ওরা আমাকে অনেক মেরেছে। আমাদের সবাইকে কতদুর থেকে হাঁটিয়ে নিয়ে এসেছে। আমি অনেক ক্লান্ত বাবা! আমার মাথায় তোমার আদরের হাত না বুলালে আমি ঘুমাতে পারি না।
তুমি কোথায় গেলে বাবা! তুমি কোথায়…… তুমি কোথায়………।’
রাজ্যের ঘুম যেন চেপে বসলো মেয়েটির চোখে। বিলাপের সুরে বাবার কর্তিত মস্তকের সাথে কথা বলতে বলতেই ঘুমিয়ে পড়লো। চিরনিদ্রায় শায়িত, বাবার মাথার সাথে……………
__মোস্তফা কামাল সুমনের