মোক্ষম সময়েই তাগুতের বিরোদ্ধে রুখে দাড়ালেন ইমাম হুসাইন

1316 0

হিজরী ষাট সনের রজব মাস। এ মাসের পনের তারিখে বহু ঘটনা-দূর্ঘটনার নায়ক আমিরে মুয়াবিয়ার মৃত্যু হয়। পরক্ষনেই খেলাফতের স্থলাভিসিক্তি নামক পিতার বহু কষ্টার্জিত সম্পদ ভোগে ঝাপিয়ে পড়ে ইয়াযিদআরোহণ করে দামেস্কের খেলাফতের মসনদে সে ক্ষমতা গ্রহণ করার পর কালবিলম্ব না করেই একটি কমন বিষয়ে মুসলিম বিশ্বের সকল গভর্নরদের উদ্দেশ্যে নির্দেশপত্র প্রেরণ করে সেই পত্রগুলোতে মুয়াবিয়ার মৃত্যু সংবাদ, নিজের স্থলাভিসিক্তির পুনরাবৃত্তি-যা মুয়াবিয়া নির্ধারন করে দিয়ে গিয়েছিল আর ইয়াযিদের পক্ষে মুসলমানদের বাইয়াত নেয়া হয়েছিল, এবং গভর্নরদের পূন:নিয়োগের ঘোষনাসহ গভর্নরদের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছিল যে, তারা যেন জনগণের কাছ থেকে পুনরায় বাইয়াত গ্রহণ করেএরকম একটি নির্দেশনামা মদিনার তৎকালীন গভর্নর ওয়ালিদ ইবনে উতবার কাছেও আসে ওয়ালিদ এই নির্দেশনামার সাথে আরেকটি ছোট পত্রও ইয়াযিদের পক্ষ থেকে পায় সেই পত্রে মুয়াবিয়ার আমলে মদিনায় অবস্থিত যে তিনজন বিশিষ্ট ও খ্যাতনামা ব্যক্তি ইয়াযিদের কাছে বাইয়াত স্বীকার করেননি তাদের কাছ থেকেও বাইয়াত নেয়ার ব্যাপারে বিশেষ জোড় দেয়া হয়েছিল সেই পত্রে ইয়াযিদ লিখেছিল:

خُذِ الحُسَینََ بنَ عَلِی وَ عَبدَ اللهِ بنَ عُمَرَ و عَبدَ اللهِ بنَ زُبَیرَ أَخذًا شَدِیدًا لَیسَت فِیهِ رُخصَةٌ حَتَّی یُبَایِعُوا والسَلاَم

অর্থাৎ “হুসাইন  ইবনে আলী, আবদুল্লাহ ইবনে উমর ও আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইরের কাছ থেকে কঠোরতার সাথে বাইয়াত গ্রহণ করো, বাইয়াত গ্রহণ না করা পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোন ছাড় নেই ওয়াস সালাম        

ইয়াযিদের নির্দেশ পেয়ে মদিনার গভর্নর ইমাম হুসাইনকে প্রাসাদে ডেকে আনে। ইমামকে ইয়াযিদের নির্দেশ পড়ে শুনায় ওয়ালিদ। সেই বৈঠকে মদিনার প্রাক্তন গভর্নর মারওয়ানও ছিল। ইমাম আগামীকালের জন্যে অপেক্ষা করতে বললেন। তিনি আগামীকাল সিদ্ধান্ত নিবেন বলে জানালেন। 

ইমাম গভর্নরের প্রাসাদে ইয়াযিদের নির্দেশ শুনতে পেয়ে বুঝতে পারেছিলেন তাকে জোড়পূর্বক বাইয়াত গ্রহণে বাধ্য করা হবে তিনি মদিনাতে আততায়ী অথবা গভর্নরের বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার চেয়ে সংগ্রামের পথকে বেছে নিলেন। আগামীকাল ইমাম পরিবার পরিজন নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। তিনি নিরূপায় হয়ে মদিনা ত্যাগ করে মক্কায় আশ্রয় নিলেন। এক্ষেত্রে ইমামের জন্যে অন্য কোন বিকল্প পথ খোলা ছিল না। তিনি গোপনে নিহত হওয়াকে সমীচীন মনে করলেন না। তাই তিনি মক্কাতে পৌছে সংগ্রামের পথকে সুগম এবং এ আন্দোলনকে চিরভাস্বর করার লক্ষ্যে মুসলমানদেরকে জাগ্রত হবার আহ্বান জানাতে থাকেন। 

ইমাম হুসাইন সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের ঐক্যমত যে, ইয়াযিদ ক্ষমতা গ্রহণ করা মাত্রই ইমাম হুসাইন বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করেননি এরকমটি মোটেই নয় যে, তিনি ইয়াজিদকে কোন প্রকার সময় না দিয়ে খেলাফতের মসনদে বসার সাথে সাথেই ইয়াযিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেনএখানে ইমামের পক্ষ থেকে সময় দেয়া বা না দেয়ার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। কেননা, ইমামকে বাইয়াত গ্রহণে বাধ্য না করলে তিনি ইয়াযিদের বিরোদ্ধে বিদ্রোহের জন্যে মক্কা না গিয়ে অন্য পথও বেছে নিতে পারতেন। বরং ইয়াযিদই ইমামকে সময় দেয়নি। ইয়াযিদ ছিল একনায়ক ও সৈরাচার। সে দ্রুত রাসূলের স্মৃতিচিহৃকে করতলগত করতে চেয়েছিল। সে চেয়েছিল সেবাদাস। সে ইমামের কাছে নি:শর্ত আনুগত্য দাবী করেছিল।  

যখন ইয়াযিদের হাতে বাইয়াতে বাধ্য করা হচ্ছিলো তখনি ইমাম মদিনা ছেড়ে মক্কায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বিশ্ব মুসলমানদের সচেতন করার লক্ষ্যে সেদিন ছিলো রোজ রবিবার, হিজরী রজব মাসের শেষ দিন তিনি তার পরিবার পরিজন ও কিছু সঙ্গী নিয়ে যখন মদিনা ত্যাগ করছিলেন তখন নিম্নের আয়াতটি তিলাওয়াত করতে থাকেন

فَخَرَجَ مِنْهَا خَائِفًا يَتَرَقَّبُ قَالَ رَبِّ نَجِّنِي مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ

অর্থাৎ“(হযরত মুসা) সেখান(মিশর) থেকে ভীত সন্ত্রস্থ অবস্থায় বের হয়ে পড়লেন এহেন অবস্থায় বললেন: হে আমার প্রতিপালক! এ অত্যাচারী জনগোষ্ঠী থেকে আমাকে পরিত্রান দাও  

ইমাম হুসাইন আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইরের ন্যায়-যিনি ওয়ালিদের আহ্ববানে গভর্নরের প্রাসাদে উপস্থিত না হয়ে চোরা পথে মদিনা থেকে মক্কায় পৌছেন, তার মতো চোরা পথে না গিয়ে মূল পথ ধরেই মদিনা থেকে মক্কা পানে যাত্রা করেন ইমামের এক সঙ্গী ইমামকে গোপন পথে- যে পথে সাধারণ লোকজন চলাচল করে না, সে পথ দিয়ে মক্কার দিকে যাত্রার পরামর্শ দিলে ইমাম বলেন:

… لاَ وَاللهِ! لاَ اُفَارِقُهُ حَتَّی یَقضِیَ اللهُ مَا هُوَ قَاضٍ 

অর্থাৎ “না, আল্লাহর কসম! আমি সাধারণ লোকদের চলাচলের পথ থেকে বিচ্যুত হবো না আল্লাহ্ যা পরিণতি রেখেছেন তাই হবে      

মক্কার উদ্দেশ্যে ইমামের যাত্রার উদ্দেশ্য একটাই আর তা হচ্ছে, সেখানে তিনি বিভিন্ন স্থান ও বিভিন্ন গোত্রের লোকজনদের সাথে আলোচনা করার সুযোগ পাবেন সেখানে তিনি তাদেরকে সংগ্রামের দাওয়াত দিবেন ইমাম চেয়েছিলেন, মুসলমানরা এবং মসলমানদের নেতৃবৃন্দ যদি এ সংগ্রামের সাথে থাকেন, তাহলে এ আন্দোলন আরো বেগবান হবে 

ইমাম পাঁচ দিনের পথ অতিক্রম শেষে শা’বান মাসের তৃতীয় দিনে বৃহস্পতিবারের দিবাগত রাত্রে পবিত্র মক্কা নগরীতে পৌছেন মক্কা প্রবেশের সময় তিনি নিম্নের আয়াতটি তিলাওয়াত করেন:

وَلَمَّا تَوَجَّهَ تِلْقَاءَ مَدْيَنَ قَالَ عَسَى رَبِّي أَن يَهْدِيَنِي سَوَاءَ السَّبِيلِ

অর্থাৎ “যখন (হযরত মুসা ফেরউনের হাত থেকে পরিত্রান পাবার জন্যে) মাদইয়ান শহরে পৌছলেন, তখন তিনি বলেছিলেন: আমার প্রতিপালক আমাকে মঙ্গল ও সফল পথে হেদায়াত করবেন  

মক্কায় অবস্থানকালে ইমাম হুসাইন মুসলিম বিশ্বের প্রথম কাতারের সকল নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করেছেন তাদেরকে বুঝিয়েছেন তিনি বারবার বলেছেন যে এখন ইসলামের চরম বিপদ মুহূর্ত যদি ইয়াযিদের হাত থেকে ইসলামকে বাঁচানো না যায় তাহলে ইসলাম চিরবিদায় নিবে কিন্তু তারপরো মুসলিম নেতৃবৃন্দ ইমামের সাথে এ আন্দোলনে যোগ দেয়নি বরং অনেকে ইমামকে ইয়াযিদের বিরোদ্ধে কথা না বলার পরামর্শ দেয় কেউ আবার আরেকটু এগিয়ে যায় তারা ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত হওয়ার জন্যেও পরামর্শ দেয়। এমনি একজন ছিলেন আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর। তিনি ইমাম হুসাইনের মক্কা পৌছার আগেই মুস্তাহাব ওমরা পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় অবস্থান করছিলেন। ইমামের মক্কা প্রবেশের সংবাদ পৌছার পরপরই আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর মদিনা ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। তবে তিনি ফেরার পথে ইমামের সাথে সাক্ষাত করে ইয়াযিদের সাথে আপোষ ও বাইয়াত করার পরামর্শ দেন। তিনি ইমামকে ইয়াযিদের সাথে বিরোধীতার অশুভ ও বিপদজনক পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দেন। ইমাম তার আপোষহীনতার কথা বলে, মৃত্যুর ভয় করেন না এ কথা জানিয়ে দিয়ে এবং আল্লাহর রাসূলের আহলে বাইতের গায়ে হাত তোলার পরিণাম যে শুভ হবে না, ব্যক্ত করে ইবনে ওমরের কাপুরুষতার জবাব দিয়েছিলেন। এরকম যারা মক্কাতে ইমামকে নসিহত করেছিলেন এবং বিপদ ও অশুভ পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস ও আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর অন্যতম। ইমাম হুসাইন ইবনে আব্বাসের উপদেশের উত্তরে তাঁর চুড়ান্ত সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন।

হ্যাঁ, ইমাম নিজেও খুব ভাল করেই জানতেন, তাঁর এ সংগ্রামে বিপদ ও ঝুকি অপরিসীম। তিনি জেনেই এ পথে পা বাড়িয়েছেন। কেননা, তিনি তো তাঁর কর্তব্য পালন থেকে বিরত থাকতে পারেন না। তাই তো আমরা দেখতে পাই, বনি হাশিমের যে সকল সদস্য তখনো মদিনায় অবস্থান করছিলেন, তাদের উদ্দেশ্যে এক পত্রে ইমাম হুসাইন লিখেছিলেন:

بِسمِ اللهِ الرَحمَنِ الرَحِیمِ. مِنَ الحُسَینِ بنِ عَلِی اِلَی مُحَمَّدِ بنِ عَلِیِّ وَ مَن قِبَلُهُ مِن بَنِی هَاشِمٍ، أَمَّا بَعدُ فَاِنَّ مَن لَحِقَ بِی اُستُشهِدَ وَ مَن تَخَلَّفَ لَم یُدرِکِ الفَتحَ. وَالسَلاَمُ

অর্থাৎ “আল্লাহর নামে, যিনি দয়ালু ও অতিশয় মেহেরবান(এ পত্র)হুসাইন ইবনে আলীর কাছ থেকে মুহাম্মাদ ইবনে আলী ও তার সাথে বনি হাশিমের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের প্রতি,

মনে রেখো! যদি আমার সাথে তোমরা যোগদান করো তাহলে নিশ্চিত শাহাদাত বরণ করবে আর যদি এ কাজ থেকে বিরত থাকো তাহলে তোমরা কখনো বিজয়ের মুখ দেখবে না ওয়াস্ সালাম     

তারপরো বনি হাশিমের গণমান্য লোকেরা ইমামের সংগ্রামী কাফেলাতে যোগদানে ব্যর্থ হয়েছেন। এরপরো ইমাম হতাশ হননি ইমাম যে ক’দিন মক্কায় ছিলেন সে দিনগুলোতে তিনি সঠিক ইসলামের প্রচার কার্যে এবং আন্দোলনের কর্মী সংগ্রহে অতি মাত্রায় তৎপর ছিলেন পাশাপাশি তিনি মদিনা, কুফা ও বসরার প্রধান ব্যক্তিদের কাছে এখান থেকেই পত্র প্রেরণ করে যাচ্ছিলেন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও তফসীরবিদ মুহাম্মাদ ইবনে জারীর তাবারী একষট্টি হিজরীর ঘটনাবলীর বিবরণ দিতে গিয়ে বসরা নগরীর যে সকল গোত্রপতিদের কাছে ইমাম হুসাইন পত্র প্রেরণ করেছিলেন বলে লিখেছেন, তাদের মধ্যে মালিক ইবনে মুসমা’ বাকরী, মা’সুদ ইবনে আমর ও মুনযির ইবনে জারুদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইমাম এ সকল পত্রে আল্লাহ্ ও রাসূলের ভুয়সী প্রশংসার পর রাসূলের আহলে বাইতের গুরুত্ব ও মর্যাদা এবং তাদের প্রতি আনুগত্য করা যে ফরয, সে কথা তুলে ধরেন। অত:পর এক পর্যায়ে লিখেন:

قَد بَعَثتُ رَسُولِی اِلَیکُم بِهَذَا الکِتَابِ وَ اَنَا اَدعُوکُم اِلَی کِتَابِ اللهِ وَ سُنَّةِ نَبِیِّهِ فَاِنَّ السُنَّةَ قَد اُمِتَت وَ البِدعَةَ قَد اُحیِیَت فَاِن تَسمَعُوا قَولِی اَهدِکُم اِلَی سَبِیلِ الرِشَادِ. وَالسَلاَمُ عَلَیکُم وَ رَحمَةُ اللهِ وَ بَرَکَاتُهُ

অর্থাৎ “আমি তোমাদের কাছে আমার পিয়ন প্রেরণ করেছি সে আমার পত্র নিয়ে এসেছে আমি তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব ও নবির সুন্নাতের দিকে আহ্বান জানাচ্ছি কেননা, প্রকৃতপক্ষে সুন্নাতের মৃত্যু হয়েছে আর বেদআত প্রাণ লাভ করেছে যদি তোমরা আমার কথা শ্রবন করো তাহলে আমি তোমাদেরকে সৌভাগ্য পানে নিয়ে যাবো ওয়াস্ সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ্

সত্য ও ন্যয়ের সংগ্রামে জনবল প্রধান বিষয় নয়। প্রকৃত বিষয়টি হচ্ছে জনগণের কাছে সত্য ও মিথ্যা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। ইমাম সঠিক সময়কেই আন্দোলনের জন্যে বেছে নিয়েছিলেন এ ধরনের সংগ্রামের পিচ্ছিল পথে এগুনো ছাড়া ইমামের জন্যে আর কোন পথই খোলা ছিল না কেননা, ইয়াযিদ, মুয়াবিয়ার মত মুনাফিকীর মুখোশ নিয়ে সিংহাসনে বসেনি ইয়াযিদ মুখোশ উম্মোচন করে এবং প্রকাশ্যে আল্লাহর একত্ববাদ ও রাসূলের রেসালতের বিরোদ্ধে অবস্থান নিয়েই ক্ষমতায় আরোহণ করে সে প্রকাশ্যেই মদ পান করতো, নারী নৃত্যের প্রদর্শনী ও বানর নাচের আয়োজন করতো জনগণের কাছে ইয়াযিদের প্রকৃত চেহারা প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিল এখন কেউ ইমাম হুসাইনকে এ কথা বলতে পারবে না যে, ইয়াযিদ তো মুয়াবিয়ার মত প্রকাশ্যে ইসলামের হুকুম আহকাম মেনে চলছে, আপনি কেন তার বিরোদ্ধে বিদ্রোহ করবেন ইতিহাস সাক্ষী আছে যে, ইমাম মাক্কায় মুসলিম নেতৃবৃন্দের সাথে ইয়াযিদের বিরোদ্ধে রুখে দাড়ানোর আহ্বান জানালে সেদিন কেউ ইয়াযিদের পক্ষে কথা বলেননি, কেউ ইয়াযিদকে ভাল বলেননি তারা ইয়াযিদ ও সিরীয় বাহিনীর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্থ ছিলেন তারা কেউ ঝুকি নিতে প্রস্তুত ছিলেন না ইয়াযিদের শাসন যে খোদাদ্রোহী শাসন এ ব্যাপারে তৎকালীন বনি উমাইয়্যা বহির্ভূত মুসলিম নেতৃবৃন্দের কারো মনে কোন প্রকার সন্দেহ ছিল না তাই, এ ধরনের তাগুতের বিরোদ্ধে রুখে দাড়ানোর মোক্ষম সময় তখনি ছিল 

তাছাড়াও, ইমাম হুসাইনকে তাগুতের কাছে নতি স্বীকার করার জন্যে বাধ্য করা হয়েছিল এটাও ছিল আরেকটা এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যার কারণে ইমামের জন্যে পিছনে ফেরার আর কোন উপায় ছিল না তিনি ডাক দিলেন তাগুত উৎখাতের ইয়াযিদের মত তাগুতের বিরোদ্ধে সংগ্রামের জন্যে এর চেয়ে ভাল সময় আর হতে পারে না তারপরো তিনি শুধুমাত্র কুফাবাসীদের দাওয়াতেই কুফার দিকে যাত্রা শুরু করেননি কোন কোন ঐতিহাসিক লিখেছেন, কুফা থেকে ইমামের কাছে বারো হাজারেরও অধিক পত্র প্রেরণ করা হয়েছিলো তারপরও ইমাম তাদের পত্রের কারণে নিজের সিদ্ধান্ত ঘোষনা করেন নি বরং যখন ইয়াযিদের গুপ্তচরেরা মাসজিদুল হারামেই ইমামের প্রাণনাশের চেষ্টা করেছিলো তখনি তিনি ইহরামের কাপড় ছেড়ে হজ্ব সমাপ্ত না করে মক্কা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন তাই তো ইমাম কোন এক হিতাকাংখী মুসলিম নেতার প্রশ্নের উত্তরে বলেন: “আমাদের উপর ভিষণভাবে অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল, আমরা সহ্য করেছি আমাদের পরিবারের বিরোদ্ধে গাল মন্দের রেওয়াজ চালু করা হয়েছে, নিশ্চুপ থেকেছি কিন্তু এখন দেখছি আমাদের রক্ত ঝড়িয়ে আল্লাহর ঘর কাবাকে অসম্মানিত করতে চাচ্ছে এখন আর বসে থাকা সমীচীন হবে না” মক্কাতে ইমাম হুসাইন আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইরের উপদেশ শুনেও ইমামকে হত্যার ব্যাপারে বনি উমাইয়্যাদের দৃঢ় সংকল্পের কথা ব্যক্ত করেছিলেন  

অবশেষে ইমাম হুসাইন মুষ্টিমেয় সঙ্গী এবং পরিবার পরিজনকে সাথে নিয়ে কুফার দিকে যাত্রা করেন ইমাম মক্কাতে এ বিপদময় সংগ্রামের সাথী সংগ্রহে কোন প্রকার ত্রুটি করেননি সে সময় মুসলমানদের মধ্যে নিরপেক্ষতার শ্লোগান ছিল তুঙ্গে কিন্তু ইমাম যে নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না এবং এ মুহূর্তে ইমামের জন্যে নিরপেক্ষ থাকার কোন সুযোগও নেই, এ কথাটি সেদিন অধিকাংশ মুসলমান উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়নি তারা এটাও বুঝতে পারেনি যে, ইমাম হুসাইন যে পদক্ষেপ নিবেন তাই সঠিক হবে তাই তো, সেদিন ইসলামী নেতৃবৃন্দের মধ্যে ইমামের ভক্তরা ইমামকে কুফার দিকে না যাওয়ার অথবা ইয়যিদের হাতে বাইয়াত করার পরামর্শ দিয়েছিল ইমামের সাথে ইয়াযিদের বিরোধকে অনেকে ব্যক্তি কোন্দল হিসেবে দেখেছিল অনেকে আবার এটাকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার দৃষ্টিতে নিয়েছিল প্রকৃতপক্ষে, মৃত্যুভয়, আতঙ্ক, দুনিয়ার মোহ আর কর্তব্য অবহেলায় অভ্যস্থতা তৎকালীন মুসলিম নেতৃবৃন্দকে ইমামের সংগ্রামের সঙ্গী হতে বাধাগ্রস্থ করেছিল আর তাই তো, ইমাম হুসাইন তার সংগ্রামের স্বরূপ তার ভাই মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়্যার উদ্দেশ্যে লেখা অসিয়তনামাতে স্পষ্ট করে তুলেছেন তিনি উক্ত চিঠির একাংশে লিখেছেন:

اِنِّی لَم اَخرُج اَشِرًا وَ لاَ بَطِرًا وَ لاَ مُفسِدًا وَ لاَ ظَالِمًا وَ اِنَّمَا خَرَجتُ لِطَلَبِ الاّصلاَحِ فِی اُمّةِ جَدِّی(ص)، اُرِیدُ اَن آمُرَ بِالمَعرُوفِ وَ اَنهَی عَنِ المُنکَرِ وَ اَسِیرَ بِسِیرَةِ جَدِّی وَ اَبِی عَلِی بنِ اَبِی طَالِبٍ 

“ … আমি স্বার্থপরতার বশবতী হয়ে, অথবা বিলাসীতার মোহে অথবা বিশৃংখলা সৃষ্টি ও অবিচার কায়েমের লক্ষ্যে এই সংগ্রামের পথে যাত্রা শুরু করিনি আমার এই যাত্রার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমার নানাজানের উম্মতের ভ্রান্তি সংশোধন করা। আমি মানুষকে সৎ কাজের দিকে আহ্বান করতে আর অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখতে চাই আমি আমার নানার সুন্নত পূন:প্রতিষ্ঠা করত: আমার বাবা আলী ইবনে আবি তালিবের পথ অতিক্রম করতে চাই…”

পরিশেষে ইমাম হুসাইনের(আ.)এ পথের সিঁড়ি বেয়ে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার সংকল্প ব্যক্ত করে এবং কারবালার শহীদদের উপর হাজারো দরুদ ও সালাম পেশ করে এ লেখার ইতি টানছি আর যুগে যুগে এ পথে যারা শাহাদাত বরণ করেছেন তাদেরকেও জানাই আমাদের অন্তর নিংড়ানো সালাম আল্লাহ্ আমাদেরকেও এ পথে শাহাদাতের সুধা পান করার তৌফিক দান করুন 

__নূরে আলম মুহাম্মাদী।  

Related Post

কারবালার ময়দানে শহীদগনের নামের তালিকা

Posted by - August 23, 2020 0
😭হিজরী একষট্টি সনের দশই মহররমে কারবালার উত্তপ্ত ময়দানে আল্লাহর দ্বীন ও রাসূলের সুন্নত প্রতিষ্ঠাকল্পে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের নাম নিচে…

কারবালা থে‌কে কুফায় কা‌ফেলা !!

Posted by - August 30, 2020 0
‌বিদঘূ‌টে অন্ধকারাচ্ছন্ন রা‌ত্রি ! সারারাত খোলা আকা‌শের নি‌চে ! পা‌য়ে বে‌ড়ি পড়া ,হা‌তে হাতকড়া ! কখ‌নো হে‌টে কখ‌নো বা ঘোড়ার…

ইয়াজিদ কি চেয়েছিল?

Posted by - July 31, 2022 0
মহররমের শোক-কথা (পর্ব-এক) সে তো সব কিছুই নিতে চেয়েছিল। ‘তাজ’ অর্থাৎ মুকুট পাওয়ার পর সে বলল, “এবার সিংহাসন চাই।” সিংহাসন…

আশুরার পূর্ব রাত

Posted by - August 29, 2020 0
একষট্টি হিজরীর নবম মহররমের দিবাগত রাত আজ আশুরার পূর্ব রাত। যেন মহাপ্রলয়ের পূর্ব রাত। কারবালা প্রান্তরের বাতাসেও আজ শোকের পূর্বাভাস।…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *