পবিত্র কাবা ঘর ও যমযম কুপের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

1332 0

🔊 পবিত্র কাবা ঘরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ👇

পবিত্র কাবা আল্লাহর ঘর। একে বেষ্টন করে আছে মসজিদুল হারাম। জীবাত্মা ও পরমাত্মার সেতুবন্ধন এই কাবাঘর পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল মক্কা নগরীতে অবস্থিত। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে মক্কার অবস্থান এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার মধ্যস্থলে। তাই মহান আল্লাহ তায়ালা বিশ্বমানবের প্রথম উপসনালয় কাবাঘর মক্কাতেই স্থাপন করেন। কাবা আরবি শব্দ। সাধারণত দৈর্ঘ্য প্রস্থ ও উচ্চতা প্রায় সমান এ রকম বর্গাকারবিশিষ্ট উঁচু মর্যাদাসম্পন্ন স্থানকে কাবা বোঝানো হয়।

তারিখ-আল-ইয়াকুবির তথ্য থেকে জানা যায়, হযরত আদম (আ:) -এর জন্মের দুই হাজার বছর আগে ফেরেশতারা আল্লাহ পাকের ইবাদতের উদ্দেশ্যে এইঘর নির্মাণ করেন। এইঘর ফেরেশতাদের ইবাদতগৃহ বায়তুল মামুরের অনুকরণে করা হয় এবং বেহেশতের মহা মূল্যবান পাথর ‘ইয়াকুত’ সংস্থাপন করা হয়। বায়তুল মামুরের আকৃতিতে জ্যোর্তিময় এ ঘরকে মহান আল্লাহ তায়লা স্বয়ং সম্মানিত বরকতময় ও কল্যাণের আধার করেছেন। যা স্যাটেলাইট সংযোগ কেন্দ্রের মতই বিশ্বের সব মুসলমানের জন্য আধ্যাত্মিক সংযোগ কেন্দ্র। কাবার দিকে মুখ ফেরানো অর্থ বায়তুল মামুরের দিকে মুখ ফেরানো। বায়তুল মামুরের দিকে মুখ ফেরানো মানেই মহান স্রষ্টার দিকে মুখ ফেরানো এবং তাঁর দিদার লাভে ধন্য হওয়া। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে ফেরেশতারা যখন পৃথিবীতে ঘর নির্মাণ করতে আসেন তখন সমগ্র বিশ্বের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পানিতে পরিপূর্ণ ছিল। ওই বিস্তীর্ণ জলভাগেই পবিত্র কাবার ভিত্তি স্থাপন করা হয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রাসূল (সা:)-কে কৌতুহলবশতঃ জিজ্ঞেস করলেন, হুজুর! আল্লাহ এই জমিন কোথা থেকে সৃষ্টি করলেন? তিনি বললেন-পানির ফেনা থেকে। সাহাবীর কৌতুহলের শেষ নেই। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, পানির ফেনা কোথা থেকে এলো? রাসূল (সা:) বললেন, পানির ঢেউ থেকে। আবার জিজ্ঞেস করা হলো, পানির ঢেউ কোথা থেকে এলো? তিনি বললেন-আল্লাহর হুকুমে সৃষ্ট বাতাসের মাধ্যমে পানি থেকে। প্রখ্যাত তাফসিরবিদরা বলেন, বর্তমান কাবাঘর যেখানে বিদ্যমান সেখানেই ঐ পানির ফেনা সৃষ্টি হয়েছিল। এরপর ফেরেশতাদের মাধ্যমে সেখানে মাটি বিছানো হয়েছিল এবং পৃথিবী গড়ে তোলা হয়েছিল। বায়হাকি শরীফে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূল (সা:) বলেন, হযরত আদম (আ:) ও বিবি হাওয়া (আ:) পৃথিবীতে আগমনের পর আল্লাহ তায়ালা জিব্রাইলের মাধ্যমে তাদের কাবাঘর নির্মাণের আদেশ দেন। এই ঘর নির্মিত হয়ে গেলে তা তাওয়াফ করার আদেশ দেয়া হয় এবং বলা হয়, আপনি সর্বপ্রথম মানব এবং এই ঘর সর্বপ্রথম ঘর যা মানবমণ্ডলীর জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে।

আল্লামা সুয়ুতি তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘তারিখ-আল-মক্কা’-তে উল্লেখ করেছেন, পবিত্র কাবাঘর নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ সংঘটিত হয় দশবার। প্রথমবার হযরত আদম (আ:)-এর সৃষ্টির দুই হাজার বছর আগে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে ফেরেশতারা কাবাঘর নির্মাণ করেন। দ্বিতীয়বার হযরত আদম (আ:) হেরা পর্বতের পাথর, তুরে সিনার পাথর, তুরে জিইতা (জায়তুন), জুদি ও লেবানন পাহাড়ের পাথর সংগ্রহ করে কাবাঘর নির্মাণ করেন। তৃতীয়বার কাবা নির্মাণ করেন হযরত আদম (আ:) -এর পুত্র হযরত শিষ (আ:)। যা নূহ (আ:)-এর সময় সংঘটিত মহাপ্লাবনের সময় বালির নিচে ঢাকা পড়ে যায়। চতুর্থবার হযরত ইব্রাহিম (আ:) ও তাঁর পুত্র হযরত ইসমাইল (আ:)-যা নয় গজ উঁচু, ত্রিশগজ লম্বা এবং তেইশ গজ চওড়া ও দুই দরজাবিশিষ্ট ছিল। আল্লাহ তায়ালা তখন ফেরেশতাদের মাধ্যমে বালুর স্তুপের নিচে অবস্থিত পূর্বের ভিত্তি চিহ্নিত করে দিয়েছেন। আল কুরআনে এ বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে, “যখন আমি ইবরাহীমকে বায়তুল্লাহর স্থান ঠিক করে দিয়েছিলাম” (সূরা হাজ্ব, আয়াত নং ২৬)। কাবাঘর পুনর্নির্মাণের সময় তাঁরা আল্লাহর দরবারে সূরা বাকারার ১২৭, ১২৮ ও ১২৯ নম্বর আয়াতে বর্ণিত দোয়া করেছিলেন। অত:পর তাঁরা সূরা হাজ্বের ২৬, ২৭ ও ২৮ নম্বর আয়াত মোতাবেক হজ্বের ঘোষণা প্রচার করেন। পঞ্চমবার ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে আমালিকা গোত্র, ষষ্ঠবার জোরহাম গোত্র, সপ্তমবার নির্মাণ করেন মহানবী (সা:) -এর পঞ্চম পূর্বপুরুষ কুসাই ইবনে কিলাব। অষ্টমবার নতুন করে তা নির্মাণ করেন কুরাইশরা। রাসূল (সা:) -এর বয়স তখন ৩৫ বছর। তিনি স্বয়ং এ নির্মাণ কাজে শরিক হয়ে নিজ কাঁধে পাথর বহন করে নির্মাণের যোগান দিয়েছিলেন। এ সময় হাজরে আসওয়াদকে নিয়ে কুরাইশদের মধ্যে যুদ্ধের উপক্রম হলে তিনি সুকৌশলে শান্তিপূর্ণভাবে তা মীমাংসা করে দেন। কুরাইশ নেতারা একটি চাদরের কিনারা ধরে পাথরখানা দেয়ালের কাছে নিলে, সবার পক্ষ থেকে প্রতিনিধি হিসেবে তিনিই পবিত্র পাথরখানা যথাস্থানে রেখে দিলেন। নবমবার হযরত ইব্রাহিম (আ:)-এর নির্মিত কাবার অনুরূপ করে জনাব আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের কাবা নির্মাণ করেন। দশমবার নির্মাণ করে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ যা আজ পর্যন্ত বিদ্যমান। পরবর্তীতে খলিফা হারুন-অর -রশিদ চেয়েছিলেন হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের নির্মাণ করা কাবাঘর ভেঙে দিয়ে রাসূল (সা:)-এর আকাংখা মোতাবেক হযরত ইব্রাহিম (আ:)-এর অনুরূপ করে নির্মাণ করবেন, কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। ইমাম মালেক (র:) এতে কঠোরভাবে নিষেধ করেন। কারণ এতে করে কাবাঘর বার বার ভাঙা এবং নির্মাণের বিষয় রাজা-বাদশাদের খেল-তামাশার বস্তুতে পরিণত হবে। সব ওলামায়ে কেরামও এতে ঐকমত পোষণ করেন।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৬০১ খ্রিষ্টাব্দে (১০২১হি:)তে সুলতান আহমদ তুর্কি কাবাঘর মেরামত করেন। ১৯৪৭ সালে (১৩৬৭ হিজরী সনে) মহররম মাসে বাদশাহ আজিজ ইবনে সাউদ কাবাঘরের দরজা নতুনভাবে তৈরী করে। হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর সময় কাবাঘর পুনর্নির্মাণের আগে কাবা ছিল পাথরে নির্মিত চার দেয়ালওয়ালা ছাদবিহীন এবং একজন মানুষের উচ্চতার সমান। হযরত নবী করিম (সা:)-এর কাবাঘর ১৮ গজ লম্বা ছিল বলে জানা যায়। যা আবিসিনীয় পদ্ধতিতে এক স্তর পাথর আর এক স্তর কাঠ দিয়ে পর্যায়ক্রমে ১৬টি পাথরের স্তর আর ১৫টি কাঠের স্তরের সমন্বয়ে ৩১টি স্তরে নির্মাণ করা হয়। ঐতিহাসিক ইয়াকুবির তথ্যানুসারে ৬টি স্তম্ভের ওপর কাঠের ছাদ ছিল। আবিসিয়ার রাজা আবরাহা হস্তিবাহিনী নিয়ে কাবাঘর আক্রমণ করলে, আবদুল মুত্তালিব তা রক্ষায় অসমর্থ হলে, আল্লাহ তায়ালা ঝাঁক ঝাঁক পাখি পাঠিয়ে কাবাঘর রক্ষা করেন। কথিত আছে, ইয়েমেনের রাজা তুববা আসআদ আবু কারিব আল হিময়ারি-ই নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষার জন্য সর্বপ্রথম কাবায় গিলাফ করেন এবং তালাযুক্ত দরজার ব্যবস্থা করেন। বর্তমানে গিলাফ মক্কার দারুল কিসওয়ায় তৈরী হয়। খাঁটি প্রাকৃতিক রেশমি রঙের সাথে কলো রঙের কাপড় দিয়ে পবিত্র কাবার গিলাফ তৈরী হয়। এর মধ্যে পবিত্র কুরআন শরীফের কিছু আয়াত শোভা পায়। অক্ষরগুলো সোনালী আভায় উদ্ভাসিত হয়ে থাকে।

প্রতিবছর হজ্বের সময় হাজীদের অন্যতম কাজ আল্লাহর প্রেমে ব্যাকুল হয়ে এই পবিত্র কাবাঘর যিয়ারত ও তাওয়াফ করা। বিশ্বের প্রতিটি মুসলমান কা’বাতিশ শরিফাতে আল্লাহু আকবার বলে এই ঘরের দিকে মুখে করেই নামাজ আদায় করে থাকেন।

↯↻↯↻↯

🔊 যমযম কুপের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিঃ👇

✍রাহমাতুল্লিল আলামীনের পবিত্র জন্মের ২৫৭২ বছর পূর্বে যমযম কুয়ার আবির্ভাব হয়। এই হিসেব অনুযায়ী এখন থেকে প্রায় চার হাজার বার বছর আগে এই যমযম কুয়ার উৎপত্তি হয়। যমযম কুপ, আল্লাহ পাকের কুদরতের এক অপূর্ব নিদর্শন। মক্কার পবিত্র কাবা ঘরের পূর্ব পাশে এ কুপ অবস্থিত। চাহিদা অনুযায়ী পানি উত্তোলিত হচ্ছে, কোন কমতি নেই। হজ্বের মৌসুমে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ পান করছেন, সারা বৎসর ব্যাপী মক্কা-মদিনার জনসাধারণ ও অগণিত তীর্থযাত্রী এ পানি পান করে চলেছেন এবং সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু পানির স্তর একই রকম, একটুও কমছে না। আল্লাহ পাকের কী অসীম করুণাধারা!
হজরত ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর প্রাণপ্রিয় শিশুপুত্র হজরত ইসমাঈল (আঃ)সহ বিবি হাজেরাকে ঊষ্ণ প্রস্তরময় পাহাড়-পর্বতসঙ্কুল জনমানবহীন মক্কার এক উপত্যকায় আল্লাহ পাকের নির্দেশ অনুসারে রেখে গেলেন। সেখানে কোন লোকালয় এমনকি লোক চলাচলও ছিল না। না ছিল আহার্যের কোন ব্যবস্থা, না ছিল পানীয়জলের কোন ব্যবস্থা। আল্লাহ পাকের প্রতি তাদের ভালবাসা যে কত গভীরে প্রোথিত ছিল তা আমাদের ধারণারও অতীত। আল্লাহ পাকের কাছে নিজেদেরকে একান্তভাবে সমর্পন করতে পেরেছিলেন বলেই তো সৃষ্টির শেষ পর্যন্ত আল্লাহ পাক তাঁদের ত্যাগের মহিমাকে আদর্শ করে রেখেছেন আমাদের জন্য। ত্যাগের মহিমায় চির ভাস্বর হয়ে আছেন হজরত ইব্রাহীম (আ:), বিবি হাজেরা ও হজরত ইসমাঈল (আঃ)।
পিপাসায় কাতর বিবি হাজেরা, প্রাণ ওষ্ঠাগত, দুগ্ধপোষ্য শিশুপুত্র হজরত ইসমাঈল (আঃ)-এর জীবন সংশয়, দুশ্চিন্তায় অধীর হয়ে আল্লাহ পাকের উপর ভরসা রেখে পানির অন্বেষনে বের হলেন বিবি হাজেরা এবং ঐ ছাফা ও মারওয়া দুই পাহাড়ে সাত বার দৌঁড়াদৌঁড়ি করেন। এক সময় তিনি অদৃশ্য আওয়াজ পেলেন শিশুর কাছে যাওয়ার জন্য। দেখতে পেলেন ইসমাঈলের পাদদেশে পানি। বিবি হাজেরা তাড়াতাড়ি দৌঁড়ে গেলেন শিশুপুত্রের কাছে। অবশেষে শিশুর কাছে গিয়ে দেখতে পেলেন তার পায়ের কাছে পানির ফোয়ারা বের হচ্ছে। তিনি প্রথমে তাঁর মশ্ক ভরে নিলেন পানি দিয়ে, তারপর বালু বা পাথর দিয়ে পানির চতুপার্শ্বে আটকিয়ে দিলেন। সেই থেকে শুরু করে এই বেহেশতি ঝর্ণা আজো প্রবাহিত হচ্ছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা বইতে থাকবে।💐

↯↻↯↻↯

Related Post

আবু সুফিয়ান ও মুয়াবিয়া সম্পর্কে রাসূলের (সাঃ) পক্ষ থেকে সত্য প্রকাশ

Posted by - October 6, 2019 0
রাসূলের (সাঃ)-এর পক্ষ থেকে সত্য প্রকাশ এবং আবু সুফিয়ান ও মুয়াবিয়ার উপর অভিসম্পাতঃ ইসলামের মহান রাসূল(সা.) শুধুমাত্র বনি উমাইয়্যার পুনরায়…

গাদীরে খুমে ইসলামী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গোড়াপত্তন

Posted by - July 14, 2022 0
⁉রাষ্ট্রবিজ্ঞান (Political science) সমন্ধে কতটুকু ধারনা আমাদের রয়েছে? যে বিজ্ঞান রাষ্ট্র, রাষ্ট্র পরিচালনা, সরকার, সরকার পরিচালনা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, নেতা-নেতৃত্ব,…

বিজয়ের ৫০তম বর্ষে সবাইকে মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা

Posted by - December 16, 2021 0
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব প্রকাশের দিন। ৫০তম বর্ষে বিজয়ের গৌরব বুকে নিয়েই আমরা…

গাদীরে খুমের ঘটনা

Posted by - July 12, 2022 0
হিজরী দশম বছর । রাসূল (সা.) বিদায় হজ্ব সম্পন্ন করেছেন । এ নশ্বর পৃথিবী থেকে শেষ বিদায়ের জণ্যে প্রহর গুনছেন…

ঈদুল মুবাহালা সম্পর্কে ঐতিহাতিক পর্যালোচনা

Posted by - August 15, 2020 0
🌹ঈদুল মুবাহালা সম্পর্কে ঐতিহাতিক পর্যালোচনাঃ🌹 ✔ ২৪শে যিলহজ্জ্ব, মুসলিম উম্মাহ-র এক ইসলামী-ঐতিহাসিক ও ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক গুরুত্বপূর্ণ দিন। দশম হিজরীর ২৪শে যিলহজ্জ্ব-এ…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *