তক্বদীরে বিশ্বাস

908 0

তক্বদীরে বিশ্বাস স্থাপন করা আমাদের সকলের জন্যে অবশ্য কর্তব্য। বিবেক প্রসূত বিষয়াদির অন্যতম এটি। কিন্তু তক্বদীরের ব্যাপারে বিভ্রান্তমূলক ব্যাখ্যা আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত। তন্মধ্যে একটি হলো,“আমাদের কপালে যা লিখা আছে তাই হবে।” আবার অনেকে বলেন,“গরীব-ধনী,সৎ-অসৎ হওয়া ইত্যাদি সব কিছু প্রথম থেকেই তক্বদীরে লিপিবদ্ধ আছে,তাই আমাদের করার কিছু নেই।”

উপরোক্ত ভ্রান্ত ধারণা-বিশ্বাস একজন মানুষকে সকল প্রকার কর্ম-চাঞ্চল্যতা থেকে বিরত রাখতে বাধ্য করে। ফলে মানুষ যে কোন প্রচেষ্টা চালানোর পূর্বেই ফলাফল নির্ধারণ করে বসে। এসব কিছুই হচ্ছে তক্বদীর সম্পর্কে ভ্রান্ত ব্যাখ্যা।

কুরআনুল কারিমের সুস্পষ্ট বক্তব্যানুযায়ী তক্বদীরের উপর মুশরিকরাও বিশ্বাস করতো। তবে তারা এও বিশ্বাস করতো যে,তক্বদীরের ফলেই মানুষ তাদের কাজ-কর্মে পরাধীন এবং পূর্ব নির্ধারিত ফলাফলই ভোগ করে থাকে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন :

سَيَقُولُ الَّذِينَ أَشْرَكُوا لَوْ شَاءَ اللَّـهُ مَا أَشْرَكْنَا وَلَا آبَاؤُنَا وَلَا حَرَّمْنَا مِن شَيْءٍ

অর্থাৎ : মুশরিকরা বলে যদি আল্লাহ্ ইচ্ছে করতেন তা’হলে আমরা এবং আমাদের বাপ-দাদারা শিরক করতাম না আর কোন কিছুকে হারাম করতাম না।(আল্ আনআম,আঃ নং-১৪৮)

আর মহান রাব্বুল আ’লামিন মুশরিকদের আক্বিদার উত্তর দিচ্ছেন এভাবে :

وَإِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً قَالُوا وَجَدْنَا عَلَيْهَا آبَاءَنَا وَاللَّـهُ أَمَرَنَا بِهَا قُلْ إِنَّ اللَّـهَ لَا يَأْمُرُ بِالْفَحْشَاءِ ۖ أَتَقُولُونَ عَلَى اللَّـهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ

অর্থাৎ : যখন তারা কোন মন্দ কাজ করে তখন বলে আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের এই কাজে পেয়েছি এবং আল্লাহ আমাদের এই কাজে নির্দেশ দিয়েছেন। বল (হে রাসূল) নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন মন্দ কাজের নির্দেশ দেন না। তোমরা কি আল্লাহ সম্পর্কে এমন কিছু বল যা তোমরা জান না।(আল আরাফ,আঃ ২৮)

এ প্রসঙ্গে মহানবী (সাঃ) বলেছেন:

“আমার উম্মতের উপর এমন এক সময় আসবে যখন তারা নিজেদের পাপ কর্মগুলোকে আল্লাহর হুকুম বলে চালিয়ে দেবে। তারা আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন আর আমিও তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট।”২৪

মুসলমানদের ভিতর যারা তক্বদীর ও পূর্ব নির্ধারিত ফয়সালর দোহাই দিয়ে মানুষের স্বাধীনতা হরণ করে তাদেরকে পরাধীনতার শিকলে আটকে রাখতে চায় তাদের মধ্যে আমীর মুয়াবিয়া সর্বপ্রথম। এ প্রসঙ্গে ইবনে কুতাইবা বলেন :

মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ান ইমাম হাসানকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করার পর যখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বীয় পুত্র ইয়াযিদকে পরবর্তী খলীফা হিসেবে মনোনয়ন দানের উপযোগী মনে করলো তখন আবদুল্লাহ বিন ওমর প্রতিবাদ করলে তিনি বলেছিলেন,মুসলিম উম্মতকে দ্বিধাবিভক্ত করা ও তাদের রক্ত ঝরানোর ব্যাপারে তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি ইয়াযিদের খেলাফতের বিষয়টা ভাগ্যের লিখন ও ফয়সালা। বৈ কিছু নয়,এতে জনগণের করার কিছু নেই।২৫

এর বিপরীতে অনেক কালাম শাস্ত্রবিদ বলেন,তক্বদীরের উপর বিশ্বাসের অর্থ এই নয় যে,মানুষ তার কাজ-কর্মে কোন স্বাধীনতা রাখে না। ক্বাদা ও ক্বাদার তো মানুষের স্বাধীনতা খর্ব করে না বরং মানবজাতীর স্বাধীনতার রক্ষাকবচ এই ক্বাদা ও ক্বাদার।

তক্বদীর ও ফয়সালার অর্থ:

তক্বদীর ও ফয়সালা শব্দদ্বয় আরবী ভাষায় একসঙ্গে ব্যবহৃত হয়ে থাকে যা আল্ ক্বাদা ওয়াল ক্বাদার নামে পরিচিত। যদিও বাংলা ভাষায় এ দু’টো শব্দ তক্বদীর বা ভাগ্য অর্থে বহুল প্রচলিত। তথাপি আরবী পরিভাষায় উক্ত শব্দদ্বয়ের মধ্যে পর্যাপ্ত ব্যবধান ও পার্থক্য বিদ্যমান।

তক্বদীরের অর্থ হচ্ছে তাহ্দীদ বা পরিমাপ ও সীমা নির্ধারণ আর ক্বাদা হচ্ছে হুকুম বা ফয়সালা। এ দু’টোই আবার …ইলমি বা জ্ঞানগত এবং আইনি বা বাস্তবময় দু’ভাগে বিভক্ত। অতএব,ক্বাদা ও ক্বাদার সর্বমোট চারভাগে বিভক্ত।

(১) জ্ঞানগত ফয়সালা: যদি কোন বস্তু তার অস্তিত্ব লাভের শর্তসমূহ পূরণ করে তাহলে তা অবশ্যই অস্তিত্বমান হবে …এ সম্পর্কে আল্লাহর জ্ঞানকে জ্ঞানগত ফয়সালা বলা হয়ে থাকে।

(২) জ্ঞানগত তক্বদীর : বিশ্ব সৃষ্টির পূর্বে অথবা বস্তুগত সত্তাসমূহের সৃষ্টির পূর্বে প্রতিটি বস্তুর সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যসমূহের ব্যাপারে আল্লাহর চিরন্তন জ্ঞান ভান্ডারে যে পরিমাপ ও সীমানা নির্ধারিত তাকে জ্ঞানগত তক্বদীর বলা হয়। সুতরাং আল্লাহর রাব্বুল আ’লামীন প্রতিটি বস্তুর সীমারেখা ও পরিমাপ এবং এর আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সর্বপ্রকার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সম্যক অবহিত।

(৩) বাস্তবময় ফয়সালা : কোন বস্তুর সকল কার্যকারণ সম্পন্ন হয়ে গেলেই তা সত্তাশীল হওয়ার জন্যে অবশ্যম্ভাবী রূপ ধারণ করবে। আর এটাই হল বাস্তবময় ফয়সালা।

(৪) বাস্তবময় তক্বদীর : যখন কোন বস্তু অস্তিত্বশীল হয় তখন সে তার সকল বৈশিষ্ট্য নিয়েই অস্তিত্বে বহিঃপ্রকাশিত হয়। এটাই হচ্ছে বাস্তবময় তক্বদীর।

মূলত : তক্বদীরের অর্থ কখনো এটা হতে পারে না যে,‘দৃষ্টান্ত স্বরূপ প্রথম থেকেই আমার কপালে লিখা আছে আমি কি গরীব হবো না,ধনী,জ্ঞানী হবো না কি নির্বোধ ইত্যাদি’। তক্বদীরের আভিধানিক অর্থ হলো,‘পরিমাপ’। অর্থাৎ,বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল কিছুর ব্যাপারে আল্লাহ্ প্রদত্ত একটা পরিমাপ বিরাজমান। ভূ-মন্ডল কিভাবে,কার চতুর্দিকে,বৎসরে কতবার প্রদক্ষিণ করবে এ সকল কিছুর জন্যে একটা নির্দিষ্ট পরিমাপ বা নিয়ম-নীতি বিদ্যমান। তদ্রূপ মানবজাতির জন্যেও এক সুনির্দিষ্ট আইন ও পরিমাপ নির্ধারিত আছে। মানুষের কপালে গরীব বা ধনী বলে কোন কিছু লিখা নাই। বরং সৃষ্টি জগতের জন্যে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের পক্ষ থেকে যে নির্ধারিত পরিমাপ বিরাজমান তারই নাম ‘তক্বদীর’। দৃষ্টান্ত স্বরূপ এ ধরনের পরিমাপ নির্ধারিত যে,‘মানুষ পরিশ্রম অনুযায়ী ফলাফল ভোগ করবে’। অলসতা করে কাজে অবহেলা করলে পরিণতি কি হবে তার পরিমাপ নিশ্চয়ই আছে।

তক্বদীর বা ভাগ্য পরিমাপের অর্থে প্রতিটি প্রাণীর কর্মের দক্ষতা ও একাগ্রতা এবং সময়ের মূল্য ও কর্মের বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে। সার্বিকতার আলোকে কতকগুলো নিয়ম-নীতির সমষ্টি-ই হচ্ছে তক্বদীর বা ভাগ্য,যদিও আল্লাহর জ্ঞান প্রতিটি প্রাণীর অতীত,বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কার্যের ব্যপারেও সুপ্রসারিত। মানুষ তার স্বীয় কর্ম ক্ষমতা বলে নিজের ভাগ্য নিজেই নির্ণয় করতে সক্ষম। মানুষ ইচ্ছে করলে পৃথিবীতে সুখের নীড় গড়তে পারে আবার আখেরাতের জন্যে শান্তির নিবাসও তৈরী করতে পারে। আবার সে নেতিবাচক কাজ আঞ্জাম দিতে তার স্বাধীনতা ও ইচ্ছা ক্ষমতারও অপব্যবহার করতে পারে। মানুষের ভাগ্য তার নিজের হাতেই।

এ প্রসঙ্গে আল্ কোরআনে আল্লাহ্ বলেনঃ

إِنَّ اللَّـهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ

নিশ্চয়ই আল্লাহ্ কোন জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না যতক্ষন পর্যন্ত না তারা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে সচেষ্ট হয়।(সূরা আর রায়াদ,আয়াত নং ১১)।

Related Post

আস্তিকবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ

Posted by - December 6, 2019 0
কার্যকারণ নিঃসন্দেহে বিশ্বজগতের প্রতিটি বস্তুই অপর কোন সত্তার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। অন্য কথায় প্রতিটি বস্তুর সৃষ্টির পেছনে নিশ্চয়ই কোন কার্যকারণ…

মানব-প্রকৃতি ও সত্যান্বেষী স্বভাব

Posted by - December 2, 2019 0
এ বিশ্বের সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব প্রমাণের বিভিন্ন পথ রয়েছ। দার্শনিকগণ তাদের দর্শনের প্রমাণ করে থাকেন। আরেফ ও আধ্যাত্মি ব্যক্তিবর্গ তাদের নিজ…

বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে সৃষ্টিকর্তার পরিচয়

Posted by - December 6, 2019 0
বিজ্ঞান ঈমানের অগ্রদূত “বিশ্ব-শ্রেষ্ট পদার্থবিদদের মধ্যে ‘লর্ড কেলওয়াই’ অন্যতম। তিনি বলেন : যদি আপনি উত্তম রূপে চিন্তা-ভাবনা করেন তাহলে দেখতে…

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি

Posted by - December 2, 2019 0
শিশু জন্মলগ্ন থেকেই তার চার পাশে অনেককে দেখতে পায়। সর্বপ্রথম যার সাথে সাক্ষাৎ ঘটে তিনি হলেন নবজাত শিশুর মা। ধীরে…

এ বিশ্ব ও সৃষ্টিজগতের বিষ্ময়কর উপমা

Posted by - December 1, 2019 0
এ বিশ্ব বিশ্ব-সৃষ্টি কতই না সুন্দর! মনোরম সব কিছু। নিখুঁত ভাবে সাজানো রয়েছে এ জগতের প্রতিটি বস্তু। নভোমন্ডল,গ্রহসমূহ,নক্ষত্ররাজি,বায়ুমন্ডল,নদ-নদী,সাগর-মহাসাগর,বন-জঙ্গল ও পাহাড়-পর্বত…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *