অন্ত:তপক্ষে আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে খোলাফায়ে রাশেদিন বিভিন্ন দিক থেকে খেলাফতের আসনে উপবিষ্ট হওয়ার শর্তাবলী পূরণ করেছেন এবং শরয়ী পন্থা ও ইসলামের দৃষ্টিকোন থেকে বৈধতার ব্যাখ্যা প্রদানে সক্ষমতার মাধ্যমে তারা খেলাফত লাভ করেছেন। আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিকোন থেকে তারা সমাজে ন্যায়পরায়নতায় অভ্যস্থ ছিলেন এবং ন্যায় পথে চলেছেন। আহলে সুন্নাত হাদিস, রিজাল ও ইতিহাসের গ্রন্থাদিতে যে সকল বৈশিষ্ট্য খলীফাদের সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন তা পরিদর্শনে উপরোক্ত মন্তব্য অনায়াসেই করা যায়।
অপরদিকে তারা সাহাবী ছিলেন। আর অনেক আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে “তাদের যে কাউকে অনুসরণ করলে হেদায়েত পেয়ে যাবে” হাদিসটি- যা তাদের মতে রাসূল(সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, এটি খলীফাদের ব্যাপারে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। ঠিক এ কারণেই ইসলামী ন্যায়ানুগতা ও খোদায়ী তাক্বওয়া তাদেরকে বাধ্য করেছিল যে, তারা তাদের পরবর্তিতে সাহাবীদের মধ্য থেকে এমন ব্যক্তিকে পরবর্তি খলীফা হিসেবে মনোনয়ন দিবেন যাদের সাথে তাদের কোন বংশীয় বা আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকবে না অথবা ছয়জনকে পরবর্তি নেতা নির্বাচনের জন্যে চিহ্নিত করেছিলেন। তাদের ফিক্বাহাতের ব্যাপারেও পড়ে থাকি যে, সাহাবীদের আমলে মুসলিম উম্মতের ফিকাহ শাস্ত্রবিদগণ তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিলেন। খোদ আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে খোলাফায়ে রাশেদিনের মধ্যে উমার ও আলী প্রথম সারীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন আর আবু বাকর ও উসমান দ্বিতীয় সারী বা মধ্যম সারীর মধ্যে গণ্য হতেন। (আহমাদ নে’মাতী, এজতেহাদ ভা সেইরে তারিখে অন আয দিদগহে আহলে সুন্নাত, পৃ: ১৬৯)।
যেহেতু আহলে সুন্নাত খেলাফতের বিষয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ও অপনোদনমূখী অবস্থান গ্রহণ করেছেন, ক্রিয়াশীল ও সমালোচনামূলক নয়, তাই তারা নিরুপায় হয়েই বেশী মর্যাদাবান ব্যক্তি ও বেশী বড় ফিক্বাহবিদ বিদ্যমান থাকা সত্তে¡ও কম মর্যাদাবান ব্যক্তিকে খেলাফতের জন্যে যথেষ্ট ও যোগ্য মনে করেন। এ কারণেই তারা আলী ও উমারের উপস্থিতি সত্তে¡ও আবু বাকর-এর খেলাফত এবং আলী বর্তমান থাকা সত্তে¡ও উসমানের খেলাফতকে সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নিয়েছেন আর সেটাকে আপত্তিহীন মনে করেছেন। সে যাই হোক, খোলাফায়ে রাশেদিন ফিকাহাতের অধিকারী ছিলেন বলেই খেলাফতের আসনের জন্যে তা অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে রূপ ধারণ করেছে এবং আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে এক্ষেত্রেও তারা কোন অসুবিধার সমুক্ষীন হন না। যদিও খলীফা ও খেলাফতের আসনের ব্যাপারে পূর্বে যে গবেষণা ও বিভিন্ন মতামতের অবতারণা হয়েছে তা পরিদর্শনে বলা যায় যে, সেসব লেখা খোলাফায়ে রাশেদিন ও ইয়াযিদের খেলাফতের পর তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দিতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়া ও খেলাফত লাভের শর্তাবলীঃ
খেলাফতের আভিধানিক অর্থ সম্পর্কে আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিভঙ্গি পর্যালোচনার পর খেলাফত- যা দ্বীনি ও রাজনৈতিক পদ, তার হস্তান্তরের প্রক্রিয়া ও শর্তাবলী সমন্ধে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। আর এরই ধারাবাহিকতায় ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার খেলাফত নিয়ে আলোচনা যথাযথ হবে বলে মনে হয়। কেননা, আহলে সুন্নাতের অনেকে তাকে মুসলমানদের খলীফা বলে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন এবং তার বিরোদ্ধে যে কোন ধরনের যুদ্ধ ও বিরোধীতাকে ভুল ও অন্যায় জ্ঞান করেছেন। এমনকি অনেকে আশুরার বিপ্লবকে এ দৃষ্টিকোন থেকে সমালোচনাও করেছেন।
যেমনিভাবে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে খেলাফতের জন্যে সবচেয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ শর্তগুলো সবার আগে পর্যালোচনা হওয়া দরকার এবং যা খেলাফতের দাবীদার ব্যক্তির খেলাফতের আসনে উপবিষ্ট হওয়ার পূর্বেই উন্মোচন হওয়া দরকার, তা হলো ন্যায়বাদিতা ও ফিক্বাহ শাস্ত্রে পান্ডিত্য। এ দু’টি শর্ত এমন একজন লোকের জন্যে অত্যাবশ্যক বিষয় যিনি খলীফা হতে ইচ্ছুক। আর এ শর্তগুলো ব্যতিত খেলাফত ও রাজনৈতিক ক্ষমতা- তা যে পথেই অর্জিত হোক না কেন, তা যে পন্থায়ই হস্তগত হোক না কেন, কোন উপকারেই আসবে না। কেননা, “যখন শর্ত অনুপস্থিত তখন শর্ত ধারণকারীও আর উপস্থিত থাকে না”-এ প্রসিদ্ধ উক্তি মোতাবেক অথবা যে ব্যক্তি আদালাত বা ফিক্বাহাত শুণ্য, খেলাফত শব্দটি তার জন্যে “বিষয় অনুপস্থিতির কারণে হুকুমও বিলুপ্ত হয়ে যায়” বাক্য অনুপাতে অর্থহীন হয়ে দাড়ায়।
ইয়াযিদের ন্যায়পরায়নতা (আদালাত):
এটা স্পষ্ট যে, এ বিষয়ে পর্যালোচনা ও গবেষণার ক্ষেত্রে অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় আহলে সুন্নাতের আলেমদের দ্বীনি গবেষণালব্ধ লেখনি ও ঐতিহাসিক উৎসসমূহের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে হবে। ইয়াযিদের জীবনী, প্রশিক্ষন, চরিত্র ও শিষ্টাচার (আখলাক) সম্পর্কে আহলে সুন্নাতের উৎসসমূহে প্রচুর আলোচনা করা হয়েছে এবং এ ব্যাপারে ইতিহাসের নিরবতা অথবা ইতিহাস লেখকদের অবহেলা ও পাশ কেটে যাওয়ার মত অসুবিধার সমুক্ষীন হতে হবে না। সুতরাং এখানে সংক্ষিপ্তাকারে এ বিষয়ে আলোকপাত করছি।
প্রশিক্ষনের (তারবিয়াত) পরিবেশ ও পদ্ধতিঃ
নি:সন্দেহে প্রশিক্ষনের পন্থা, প্রশিক্ষকবৃন্দ, পরিবেশ ও বন্ধু-বান্ধব একজন মানুষের আখলাক-চরিত্র ও মন-মানস এবং ব্যক্তিত্বের গঠন ও বুদ্ধি লাভ আর তার প্রকৃত স্বরূপের উপর প্রচন্ড প্রভাব বিস্তার করে, যা কোনক্রমে অস্বীকার করার জো নেই। এ কারণে, শৈশবকালের সচেতনতা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষনের সংস্কৃতি সমন্ধে “শৈশবে জ্ঞানার্জন পাথরে চিত্র অঙ্কনের সমান” প্রসিদ্ধ বাক্যটি সর্বজন স্বীকৃত।
ইমাম হুসাইনের ন্যায় ইয়াযিদও একটি পারিবারিক প্রশিক্ষন, গোত্রীয় ব্যবহার ও চিন্তা-চেতনা, পরিবেশ এবং শৈশবের নিকট ও দূরের বন্ধু-বান্ধবদের অনুগামী হয়ে বৃদ্ধি লাভ করেছে আর তার ব্যক্তিত্ব ও চিন্তাধারা মারাত্মকভাবে সেই সময়কালের প্রভাবে পরিপূর্ণতা পেয়েছে। এ স্বত:সিদ্ধ ও সুনিশ্চিত সুত্রের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তার বেড়ে উঠা ও প্রশিক্ষনের সময়কালের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করবো। আহলে সুন্নাতের একজন ইতিহাসবিদ, যিনি ইয়াযিদ ও কারবালার বিপ্লব সমন্ধে অনুসন্ধান চালিয়েছেন, এভাবে লিখছেন:
“আমি আমার অন্য একটি লেখা সামউল মা’না ফি সামভিয যাত-এ লিখেছি যে, ইয়াযিদ খৃষ্টান সংস্কৃতি ও আদব-কায়দায় বড় হয়েছে এবং ইসলামী জ্ঞান থেকে সে অনেক দূরে ছিল। কেননা, ইয়াযিদ মাতৃত্বের দিক থেকে বনি কালবের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। এ গোত্রটি ইসলামপূর্ব কালে খৃষ্টান ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট ছিল। সামাজিক বিজ্ঞান ও মনবিজ্ঞানে এ বিষয়টি অত্যন্ত স্বত:সিদ্ধ যে, লালিত চিন্তাধারা ও আক্বায়েদ-বিশ্বাস থেকে একটি বৃহৎ গোষ্ঠীর দূরত্ব সৃষ্টি ও পৃথকীকরণ একটি সুদীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। তাছাড়াও, একদল ইতিহাস লেখক বিশ্বাস করেন এবং প্রতিবেদন লিখেছেন যে, ইয়াযিদের কিছু শিক্ষক ও প্রশিক্ষক নাসতুরী খৃষ্টান ধর্মের অনুসারী ছিলেন।” (আব্দুল্লাহ আল আলায়েলী, তারিখুল হুসাইন, সমালোচনা ও বিশ্লেষণ, পৃ: ২৪০-২৪১)।
তিনি আরো লিখেছেন:
“যখন এ পর্যায়ে পরিচয় লাভ করেছি যে, ইয়াযিদ তার আয়ুষ্কালে বনি কালব গোত্রের মধ্যে এমন লাগামহীন জীবন যাপন আর তাদের মাঝে মুক্ত ও ইচ্ছামাফিক যৌবনকাল অতিবাহিত করেছে তখন আমরা এ ফলাফলে পৌছে যাই, কেন তার আচরণকে ঐতিহাসিক প্রতিবেদনসমূহ সবচেয়ে বেশী বিপদজনক ও ইসলাম থেকে বহুদূরে বলে আখ্যায়িত করেছে।
যা কিছু এ বিষয়ে অধিক চিন্তা করতে বাধ্য করে তার কিছু বিষয় ইতিহাসে সংঘটিত হয়েছে:
“ইতিহাসবিদগণ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, ইয়াযিদ মদ্যপায়ী হিসেবে খ্যাত ছিল এবং কুকুরদের সাথে খেলাধুলা করতো আর দ্বীনের হুকুম আহকামেরে ব্যাপারে কোন তোয়াক্কাই করতো না। সে জুয়া খেলতো এবং বানর ও অন্যান্য পশুদের সাথে নিয়ে শিকারে গমন করতো। (প্রাগুক্ত, পৃ: ২৪২; আদ দামিরী, হাইয়াতুল হাইয়াওয়ান, খন্ড ২, পৃ: ২৭০; আহমাদ ইবনে ইফসুফ আল ক্বিরমানী, আখবারুদ দুওয়াল, পৃ: ১৩০-১৩১)।
প্রকৃত সত্য হচ্ছে বনি কালবের গোত্রের সাথে ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার সম্পৃক্ততা তার জীবনের এক দূর্বল ও অন্ধকারচ্ছন্ন অংশ হিসেবে পরিগণিত ছিল যা মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান-এর কর্তৃত্বের চুড়ান্ত সীমার সময়কালেও স্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ ও সাধারণ মুসলমানদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। তারা এখানেই থেমে যাননি, তারা ইয়াযিদের ইসলামী প্রশিক্ষন ও শিষ্টাচারের ব্যাপারে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ছিলেন। এমনকি সাঈদ ইবনে উসমানের ন্যায় মুয়াবিয়ার নিকটতম লোকজন ও বন্ধু-বান্ধবরা পর্যন্ত উক্ত বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন এবং ইয়াযিদের ভবিষ্যত ও তার যোগ্যতা সম্পর্কে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছিলেন। মুয়াবিয়াও যে শুধুমাত্র উক্ত বিষয়টিকে বাতিল করেননি বরং সেটাকে অস্বীকার অযোগ্য বলে মনে করতেন। (মুহাম্মাদ ইবনে জারির তাবারী, তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক, খন্ড ৩, পৃ: ২৪৯)।
আবু সুফিয়ানের চিন্তাগত উত্তরাধিকার ও ইয়াযিদঃ
পিতৃত্বের আত্মীয়তার দিক থেকে ইয়াযিদ ইবনে মুয়বিয়ার এমন কোন দৃঢ় ও সমর্থনযোগ্য সম্পর্ক ইসলাম, রাসূলে আকরাম(সা.) ও তাঁর-এর পরিবারের সাথে ছিল না। ইয়াযিদের দাদা আবু সুফিয়ান ইবনে হারব মক্কার অন্যতম বড় পুজিপতি ব্যবসায়ী ও উমাইয়্যা বংশের লোক ছিল, যে বংশ রাসূল(সা.)-এর বংশের সাথে প্রাচীনকাল থেকেই অত্যন্ত মাখামাখি প্রতিযোগীতা করতো। আবু সুফিয়ান ও তার পুত্ররা, বিশেষত: মুয়াবিয়া ও তার সমর্থকরা, হিজরী অষ্টম বছরে এবং মক্কা বিজয়ের সময়ে আত্মসমর্পন করে মুসলমান হওয়ার দাবী করে। ইসলামের নবীও(সা.) ইসলামের দয়া ও মমতার উপর ভিত্তি করে মক্কাবাসীদেরকে, বিশেষ করে আবু সুফিয়ান ও তার কাফের সমর্থকদেরকে ষড়যন্ত্রপূর্ণ ও শত্রæতাপূর্ণ অতীতের জন্যে তিরস্কার করেননি এবং তখন তিনি বলেছিলেন Òاَنتُمُ الطُّلَقَاÓ অর্থাৎ “তোমরা মুক্ত” আর এভাবে তিনি প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। এ কারণে তৎকালীন সমাজে উক্ত ব্যক্তি ও তার অনুসারীদেরকে ÒطُلَقَاÓ নামেই ডাকা হতো। ইসলামের প্রাথমিক যুগে তাদের বিপরীতে মুসলমানদের মধ্যকার দুটি মূল অংশ মুহাজির ও আনসার নামে পরিচিত ছিল। (নাহজুল বালাগ্বা, পত্র নং ২৮; আহমাদ আল মাক্বরিযি আশ শাফিয়ী, আন নিযাউ ওয়াত তাখাসুম ফিমা বাইনা বানি উমাইয়্যা ওয়া বানি হাশিম, গবেষনা: মুহাম্মাদ আ’রনুস, পৃ: ৫২)।
ঐতিহাসিক বিভিন্ন সাক্ষী-প্রমাণ উল্লেখ করছে যে, আবু সুফিয়ান ও তার অনুসারীরা ইসলাম ও তাদের নিজেদের মুসলমান হওয়ার দাবীর প্রতি “শিকারের খাদ্য” হিসেবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতো এবং অন্তরের গভীরতা থেকে তারা ইসলামের দিকে আসেনি আর শেষ পর্যন্ত এহেন অবস্থা থেকে তারা প্রত্যাবর্তনও করেনি:
ক) আবু সুফিয়ান অন্যান্য কুরাইশের ন্যায় পয়গম্বর(সা.) -এর তাওহীদের আহ্বান নবুয়্যতের সেই শুরু থেকেই শ্রবন করেছিল, কিন্তু কখনো তা গ্রহণ করার প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেনি এবং নিজেকে সর্বক্ষন সেই খোদায়ী আলো নিভিয়ে দেয়ার চেষ্টায় নিয়োজিত রেখেছিল অথবা রাসূলে আকরাম(সা.)-কে এবং তাঁর ব্যক্তিত্বকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল। সে ইসলামের প্রথামিক আমলে সর্বকালের জন্যে এ শ্বাশত ধর্মকে ধ্বংস করার নিমিত্তে বিভিন্ন যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। বদর, ওহুদ, খন্দক ও আরো অন্যান্য যুদ্ধ তার নেতৃত্বে ইসলামের বিরোদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল এবং সরাসরী অথবা অসরাসরীভাবে তার ভুমিকার কারণে সেগুলো সংঘটিত হয়েছিল। সে এ সকল যুদ্ধে মুসলমান ও কুরাইশের উপর অনবরত চাপ সৃষ্টি করে রেখেছিল এবং বহু প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির সমুক্ষীন করেছিল এবং এর ধারাবাহিকতায় অব্যাহতভাবে সে তার বংশীয়, শ্রেণীগত ও জাহেলী চিন্তাধারার স্বপক্ষে অটল ছিল। আর সে তার পূর্ণ অস্তিত্ব দিয়ে অতীত বিশ্বাস ও শিক্ষা-দীক্ষার উপর পরিপূর্ণ আগ্রহ ও বিশ্বাসের বহি:প্রকাশ ঘটাতো। এরকম ব্যক্তির পক্ষে এটা সম্ভব নয়, হঠাৎ করে মক্কা বিজয়ের বছরে- যে বছরে সে তার সর্বশেষ সংগ্রাম ও প্রতিরোধ শক্তি নি:শেষ করে ফেলেছিল, অতীত জাহেলী চিন্তাধারা ও সংস্কৃতি ত্যাগ করে ইসলামে দীক্ষিত হয়ে যাবে এবং ঐশ্বী দ্বীনকে ঐকান্তিকতা ও অন্তরের উদ্দীপনা দিয়ে গ্রহণ করে ফেলবে। (নাহজুল বালাগ্বা, পত্র নং ২৮ ; আহমাদ আল মাক্বরিযি আশ শাফিয়ী, আন নিযাউ ওয়াত তাখাসুম ফিমা বাইনা বানি উমাইয়্যা ওয়া বানি হাশিম, গবেষনা: মুহাম্মাদ আ’রনুস, পৃ: ৫২)।
সে মক্কা বিজয়কালে শুধুমাত্র ইসলামের ব্যাপারেই যে কোন নতুন উদ্দীপনা ও বিশেষ আকর্ষন অনুভব করেনি তাই নয়, বরং আল্লাহর রাসূলের(সা.) সাথে বিভিন্ন যুদ্ধে তার সকল পরাজয় ও পুন:পুন শত্রæতা তার প্রতিশোধ স্পৃহা ও প্রতিহিংসার পরিমান বহুগুণে বৃদ্ধি করেছিল এবং তাকে আপদামস্তক হিংসা, বিদ্বেষ ও প্রতিশোধের আগুণে ভরে দিয়েছিল। আর এ জন্যে তার ইসলামে দীক্ষিত হওয়া একটি চিন্তাগত পরিবর্তন ও প্রবনতার চেয়ে বেশী কৌশলগত পদক্ষেপ ও সংগ্রামের পদ্ধতি পরিবর্তন হিসেবে পরিগণিত। (প্রাগুক্ত, পৃ: ২৯, ৩১)।
খ) আবু সুফিয়ান ইসলামের সাথে সুগভীর বিরোধীতার ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপাদানের পক্ষ থেকে, এমনকি তার স্ত্রীর পক্ষ থেকেও (সাধারণত: স্ত্রীরা তাদের স্বামীদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে) সমর্থন লাভ করেছিল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা বদরের যুদ্ধে তার পিতা, ভ্রাতা ও চাচাকে হারিয়েছিল। আর তাই ইসলামের প্রতি তার সুগভীর প্রতিহিংসার উপর ভিত্তি করে সে প্রকাশ্যে পয়গম্বর(সা.) ও তাঁর চাচা হামযা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব এবং তাঁর জামাতা ও চাচাত ভাই আলী ইবনে আবি তালিবের ন্যায় রাসূলের সবচেয়ে নিকটতম সাথী ও সেনাপতিদের হত্যার জন্যে নিলাম ডেকেছিল। অবশেষে সে তার কৃতদাসের মাধ্যমে ওহুদ যুদ্ধে আমির হামযাকে শহীদ করতে সক্ষম হয় আর তখন থেকেই সে “কলিজা খেদক হিন্দা” নামে খ্যাতি লাভ করে। এ প্রতিহিংসুক ও প্রতিশোধ গ্রহণকারী স্ত্রী আবু সুফিয়ানের কুফর ও সুযোগ সন্ধানের পরিকল্পনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে আরো বেশী শক্তি ও সাহস যোগাতে পারে।
গ) আবু সুফিয়ান ও তার সহযোগীদের মধ্যে জাহেলী যুগের বিশ্বাস অব্যাহত থাকার কারণে তারা মুসলমানদের মাঝে ÒطُلَقَاÓ তুলাক্বা বা Òمُؤَلِّفَة القُلُوبÓ মুয়াল্লিফাতুল ক্বুলুব নামে পরিচিত। (প্রাগুক্ত, পৃ: ২৯, ৩১)। এ বিষয়টি ভালভাবে বুঝায় যে, এমনকি মুসলমানরাও এই অবস্থা সম্পর্কে উদাসীন ছিল না, তারা বিষয়টি সমন্ধে অবগত ছিল। এ কারণে, এ দলটি হুনাইনের যুদ্ধের ন্যায় শেষ যুদ্ধগুলোতে মুজাহিদ হিসেবে নয় বরং তারা পর্যবেক্ষনকারী হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিল। এ সম্ভাবনাই বেশী যে, তারা সুযোগ অথবা মুসলমানদের পরাজয়ের অপেক্ষায় প্রহর গুণছিল। রাসূল(সা.)ও এ যুদ্ধে বিজয়ের পর তাদেরকে “মুয়াল্লিফাতুল ক্বুলুব” হিসেবে গনিমত থেকে দান করেছিলেন, অধিকারের মালিক হিসেবে নয়।
ঘ) আবু সুফিয়ান নিজেই মক্কা বিজয়ের পর, বিশেষ করে রাসূলের(সা.) ওফাতের পর এমন সব কাজ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করে যা থেকে ভালভাবে তার জাহেলী যুগের চিন্তা ভাবনার বহি:প্রকাশ ঘটে। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে: সাক্বিফায়ে বানি সায়েদার মাহফিল সংঘটিত এবং আবু বাকর ইবনে আবি ক্বুহাফার খেলাফতের আসনে উপবিষ্ট হওয়ার পর আবু সুফিয়ান মদীনাতে এসে বলে: “আমি তুফান দেখছি, রক্ত ছাড়া অন্য কোন কিছু এটাকে মিটাতে পারবে না।” (ইবনে আবিল হাদিদ, শারহে নাহজুল বালাগ্বা, খণ্ড ২, পৃ: ৪৪)। অত:পর আলীর নিকট গিয়ে তাকে বিদ্রোহ ও আন্দোলনে উৎসাহ দিতে থাকে আর নিম্ন কবিতাটি আবৃতি করেঃ
“হে হাশিমের সন্তানরা! উঠে দাড়াও! যেন তামিম গোত্র (আবু বাকরের বংশ) অথবা আদি (উমারের বংশ)-এর মত গোত্রের লোকেরা তোমাদের নিশ্চিত অধিকারের প্রতি লোভনীয় দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে না পারে। খেলাফতের বিষয়টি তোমাদের সাথে সম্পর্কীত এবং তোমাদের অধিকার আর এ জন্যে আলী ব্যতিত আর কেউ যোগ্য নয়। হে আলী! খেলাফতের লাগাম ভালভাবে ধারণ করো; কেননা, তুমি জনগণের আশা-আকাঙ্খা ও আদর্শ বাস্তবায়নে অন্যদের চেয়ে বেশী যোগ্যতার অধিকারী।” (প্রাগুক্ত ; মাহদী পিশভয়ী, রিশেহয়ে তরিখী ভা যামিনেহয়ে এতেক্বদীইয়ে নেহযাতে আশুরা, খন্ড ২, পৃ: ৩০১)।
আলী, আবু সুফিয়ানের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছিলেন আর তাকে ভাল করে চিনতেন, তাই আলী তার কথার উত্তরে বলেছিলেন: “আপনি যে উদ্দেশ্য সফল করতে চান আমরা সে ধরনের ব্যক্তি না।” নাহজুল বালাগ্বাতে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তিনি তাঁর কথায় যে শুধুমাত্র আবু সুফিয়ানকে হতাশ করেছিলেন তাই নয়, বরং মুসলমানদেরকেও এ ধরনের ফিৎনা, রহস্যজনক ও ধ্বংসাত্মক অপতৎপরতা থেকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। (নাহজুল বালাগ্বা, খুতবা নং ৫)।
সে যখন আলীর কাছ থেকে নিরাশ হয় তখন সে আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের দুয়ারে কড়া নাড়ে এবং তার চিন্তাধারা বাস্তবায়িত করার জন্যে সাহায্যপ্রার্থী হয়। সে বলে: “আপনি খেলাফতের যোগ্য এবং আপনার ভাইপোর উত্তরাধীকারের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী অগ্রাধিকার রাখেন। আপনি হাত বাড়িয়ে দেন, আমি আপনার হাতে বাইয়াত করি যেন অন্য কেউ আপনার সাথে বিরোধীতা না করে। আব্বাস হেসে বলেন: “হে আবু সুফিয়ান! কিভাবে সম্ভব, যে প্রস্তাব আলী ফিরিয়ে দিয়েছে সেই প্রস্তাব আমি মানবো?” (সাইয়্যেদ আলী খান মাদানি, আদ দারাজাতুর রাফিয়্যা ফি তাবাক্বাতিশ শিয়া, পৃ: ৮৭; আব্দুল হুসাইন আমিনী, আল্ গ্বাদীর, খণ্ড ১০, পৃ: ৮০-৮৪)।
জাওহারী বলেন: “সে আলীকে বলে, কুরাইশের সবচেয়ে দূর্বল ব্যক্তি তোমাদের উপর শাসন ক্ষমতা হাতে নিয়েছে। আল্লাহর কসম, যদি তুমি চাও আমি জনগণকে আবু বাকরের বিরোদ্ধে জমায়েত করতে পারি এবং অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী দিয়ে শহরকে ভরপুর করে দিতে পারি। আলী বললেন, আপনি বহুদিন থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্যে অমঙ্গল কামনা করে আসছেন, কিন্তু তাদের কোন ক্ষতি করতে পারেননি, আরোহী ও পদাতিক বাহিনী আমাদের প্রয়োজন নেই।” (ইবনে আবিল হাদিদ, শারহে নাহজুল বালাগ্বা, খণ্ড ২, পৃ: ৪৪-৪৫; আহমাদ আল্ মাক্বরিযি, আন্ নিযা’ ওয়াত তাখাসুম ফিমা বাইনা বানি উমাইয়্যা ওয়া বানি হাশিম, পৃ: ৩১)।
উমারও আবু সুফিয়ান ও তুলাকাদের অতীত জীবন ও তাদের চিন্তাধারা সম্পর্কে অবহিত ছিল, তাই তিনি আবু সুফিয়ানের কর্ম তৎপরতার ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রেখেছিলেন। তিনি এ পথে সাক্বিফার অনুষ্ঠানের পর তার দুশ্চিন্তার কথা গোপন করতেন না। এ কারণে তিনি আবু বাকরকে বলেন: “আবু সুফিয়ান সফর (যাকাত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে) শেষে ফিরে এসেছে এবং আমি তার অমঙ্গল থেকে নিরাপদ নই।” আবু বাকর এ সাবধান বাণীকে একাগ্রতার সাথে গ্রহণ করেছে এবং তিনি উমারের কথার পরিপ্রেক্ষীতে সংগ্রহীত যাকাত উক্ত ব্যক্তিকে দান করে দিয়েছেন যেন পুনরায় অন্তরের সংযোগ (مُؤَلِّفَةُ اْلْقُلُوْبْ) স্থাপন করতে সক্ষম হয় আর এভাবে তাকে মুখবন্ধ রাখার (حَقُّ اْلْسُّكُوْتْ) মজুরি প্রদান করা হয়। আবু সুফিয়ানও এর পর থেকে মুখ বন্ধ করে রেখেছিল। (ইবনে আবিল হাদিদ, শারহে নাহজুল বালাগ্বা, খণ্ড ২, পৃঃ ৪৪-৪৫; আহমাদ আল্ মাক্বরিযি, আন্ নিযা’ ওয়াত তাখাসুম ফিমা বাইনা বানি উমাইয়্যা ওয়া বানি হাশিম, পৃ: ৩১)।
উমার ইবনুল খাত্তাবের খেলাফত আমলে ইয়াযিদ ইবনে আবি সুফিয়ানকে শ্যাম রাজ্যের গভর্নর পদে নিয়োগ এবং তার মৃত্যুর পর সে পদে মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ানের নিয়োগ দানের কারণে আবু সুফিয়ান কিছু বক্তব্য প্রদান করে যা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। এ সকল কথা ও প্রতিক্রিয়া তার ইসলাম বিরোধী ও জাহেলী চিন্তাধারারই বহি:প্রকাশ। যখন উমাইয়্যা বংশের লোক উসমান ইবনে আফফান খেলাফতের আসনে উপবিষ্ট হন তখন আবু সুফিয়ান উমাভিদের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠিত রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বলে: “এখন যেহেতু ক্ষমতা তোমাদের হাতে এসে পড়েছে তাই এটাকে একটি বলের ন্যায় নিজেদের মধ্যে হস্তান্তর করতে থাকবে আর চেষ্টা করবে যেন তা উমাইয়্যা বংশ থেকে বাইরে গমন না করে। আমি যার উপর ইমান স্থাপন করি তার শপথ! না কোন ইলাহ আছে না ক্বিয়ামতের কোন হিসাব নিকাশ আছে, বেহেস্তও নেই আর ক্বিয়ামতই নেই।” (ইবনে আবিল হাদিদ, শারহে নাহজুল বালাগ্বা, খণ্ড ৯, পৃ: ৫৩; ইফসুফ ইবনে আব্দু রাববিহ, আল ইসতিয়াব ফি মা’রিফাতিল আসহাব, খন্ড ৪, পৃ: ৮৭)।
আবার আবু সুফিয়ান একদা ওহুদ যুদ্ধের এলাকা দিয়ে অতিক্রমকালে সাইয়্যেদুশ শুহাদা আমির হামযার কবরে লাথি মেরে বলে: “যার জন্যে গতকাল তলোয়ার দিয়ে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতাম আজ তা আমাদের সন্তানদের হাতে এসে পড়েছে আর তারা তা নিয়ে খেলাধুলা করছে।” (ইবনে হাজার আসক্বালানী, আল আসাবা ফি তাময়িযিস সাহাবা, খণ্ড ৮, পৃ: ২৮৫ ; মুহাম্মাদ তাক্বী তুসতারী, ক্বামুসুর রিজাল, খণ্ড ১, পৃ: ৮০ ; মাহদী পিশভয়ী, রিশেহয়ে তরিখী ভা যামিনেহয়ে এতেক্বদীইয়ে নেহযাতে আশুরা, খণ্ড ২, পৃ: ৩০৫; আব্দুল হুসাইন আমিনী, আল্ গ্বাদীর, খণ্ড ১০, পৃ: ৮৩)।