খেলাফত হস্তান্তরের পদ্ধতি

488 0
খেলাফত সমন্ধে যে সকল বিষয় মুসলিম সম্প্রদায় বিশেষত: আহলে সুন্নাতের আলেম ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে তন্মোধ্যে খেলাফতের হস্তান্তরের পদ্ধতি ও এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে শরীয়তসম্মত উপায়ে ব্যবহৃত পন্থা অন্যতম। এ বিষয়ের উৎস ও সুত্রসমূহে একটা অংশ উক্ত বিষয়ে নির্দিষ্ট করা হয়েছে যা “নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার উপায়সমূহ” শিরোনামে আলোচনা করা হয়েছে। এ আলোচনাতে খেলাফত হস্তান্তরের নীতিমালা ও শর্তাবলী পরিমান ও বৈশিষ্ট্যের দৃষ্টিকোন থেকে পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে প্রতিটি শর্ত ও নীতি সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিমত বর্ণনা করা হয়েছে যা পূর্বের বিষয়ের ন্যায় কিছু বিষয় বিভেদমূলক আর অন্যান্য বিষয়ে অভিন্ন মতামত পোষন করা হয়েছে।
 
সর্বোপরি এ বিষয়ে শরয়ী ও যথোপযুক্ত পদ্ধতিকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে যার প্রত্যেকটি পন্থার জন্যে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও শর্ত বিরাজমান:
 
ক) পূর্ববর্তি ইমাম বা খলীফা কর্তৃক নিয়োগ: আহলে সুন্নাত ইমামত ও খেলাফত প্রতিষ্ঠার শরয়ী একটি পন্থা হিসেবে পূর্ববর্তি ইমামের মননোয়ন ও নিয়োগকে ধার্য করেছেন। তারা এ বিষয়ের জন্যে দ্বিতীয় খলীফা নির্ধারনের ব্যাপারে প্রথম খলীফার পদক্ষেপকে দলীল হিসেবে পেশ করে থাকেন। আর দ্বিতীয় খলীফাও অসিয়ত করে গেছেন যেন ছয় সদস্য বিশিষ্ট শুরা বা বোর্ড পরবর্তি খলীফা নির্ধারণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আহলে সুন্নাত এ দু’টি পদক্ষেপকে উক্ত পদ্ধতির শরয়ী নীতি বলে মনে করেন।
খ) আহলে হাল ওয়াল আক্বদ কর্তৃক নির্বাচন: খেলাফত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতার শরয়ী হস্তান্তরের ব্যবস্থাপনার দ্বিতীয় পন্থাটি হচ্ছে আহলে হাল ওয়াল আক্বদের নির্বাচন। আহলে হাল ওয়াল আক্বদ-যারা আহলে রিতক্ব ওয়াল ফিতক্ব হিসেবেও পরিচিত, তারা মুসলিম উম্মতের প্রাজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি। তাদের সন্তুষ্টি ও ইতিবাচক মতামত বা রায় সাধারণ জনগণের মতামত বলে পরিগণিত হয়। এ শ্রেণীর লোকেরা স্বাভাবিকভাবেই জনগণের মনোভাবের প্রতিফলন ঘটান ও তাদের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন।
আহলে সুন্নাতের উৎসসমূহে জনমতকে সন্তুষ্ট ও তুষ্ট করে উম্মতের ঐক্যমত অর্জন করার জন্যে আহলে হাল ওয়াল আক্বদের লোকসংখ্যা কতজন হবেন, এ ব্যাপারে যথেষ্ট মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। অনেকে উপরোক্ত উদ্দেশ্য পূরণ এবং মুসলমানদের ঐক্যমত সংরক্ষনে প্রতিটি শহরের আহলে হাল ওয়াল আক্বদের সকল সদস্যের একমত হওয়া জরুরী বলে গণ্য করেছেন। আবু আলী মাওয়ারদী বলেন: “আহলে হাল ওয়াল আক্বদ-এর মাধ্যমে অর্জিত সম্মতি সর্বসাধারণের পক্ষ থেকে গৃহীত হবে এবং নির্বাচিত খলীফার নেতৃত্ব অধিকাংশের মতামতের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে।” (আবু ইয়ালী মাওয়ারদী, আল্ আহকামুস সুলতানিয়্যা ফি উলায়াতিদ দ্বীনিয়্যা, পৃ:৩৩-৩৪)।
 
এদের বিপরীতে অন্য একদল প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খলীফার প্রয়োগকৃত পন্থাকে দৃঢ়ভাবে ধারণের মাধ্যমে বর্ণিত শর্তকে বাতিল করে দিয়েছেন এবং সেটাকে দুই জন সাক্ষীর পর্যায়ে নীচে নামিয়ে এনেছেন যেমনি করে “বিয়ের আক্বদ অভিভাবক ও দুইজন সাক্ষীর উপস্থিতির মাধ্যমেই বাস্তবায়ন হয়ে থাকে” (আবু ইয়ালী মাওয়ারদী, আল্ আহকামুস সুলতানিয়্যা ফি উলায়াতিদ দ্বীনিয়্যা, পৃ:৩৩-৩৪) ।
 
এমনকি বর্ণিত হয়েছে যে, কিছু লোকের সম্মতি অথবা আহলে হাল ওয়াল আক্বদের একজন ব্যক্তির সমর্থনও খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্যে যথেষ্ট (প্রাগুক্ত, পৃ: ৩৪; আবু বাকর ইবনুল আরাবী আল মালিকী, আল আওয়াসিম মিনাল ক্বাওয়াসিম, পৃ: ২২৯)।
 
আবার আরেকদল এ গোজামিল থেকে নিরাপদে আবস্থান গ্রহণের লক্ষ্যে “শাওকাত(আড়ম্বর)” শব্দের আশ্রয় নিয়েছেন। তারা ইমামত প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত “আড়ম্বরকামী”-দের সমর্থন বলে গননা করেছেন এবং জোর তাগিদ দিয়েছেন যে, এ মতটি আহলে সুন্নাত কতৃক সমর্থিত। তারা বলেছেন:
 
“ইমামত আহলে সুন্নাতের নিকট আহলে শাওকাতের সমর্থনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং একজন ব্যক্তির ইমামতের পদে অধিষ্টিত হওয়ার জন্যে আহলে শাওকাতের সমর্থন ও ইতিবাচক রায়ের প্রয়োজন। ইমামত, ক্ষমতা ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্জিত হয়। সুতরাং যখন বাইয়াত গ্রহণ সম্পন্ন হয় তখন ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে নির্বাচিত ব্যক্তি ইমাম হিসেবে পরিগণিত হয়।” (ইবনে তাইমিয়া, মিনহাজ আস সুন্নাহ আন নাবাবিয়্যা, খন্ড ১, পৃ: ১৮৯-১৯০)।
 
স্বত:সিদ্ধ সাধারণের সম্মতি যা আহলে হাল ওয়াল আক্বদ অথবা আহলে শাওকাতের সম্মতির কারণে প্রতিফলিত হয়, তা মুক্তভাবে ও সচেতনতার সাথে সমর্থনকে বুঝায়। এভাবে নির্বাচিত ইমামের ব্যাপারে কোন প্রকার জবরদস্তি কার্যকরী হবে না।
 
এতসকল কিছুর পরও এ দু’টি পন্থাকে একটি পন্থায় রূপ দেয়া যেতে পারে। যেমনিকরে পূর্বোল্লেখিত প্রাজ্ঞ ব্যক্তিগণ পূর্বের ইমামের পক্ষ থেকে নির্ধারণ-এর বিষয়টি এককভাবে তুলে ধরেননি। বরং তারা আহলে হাল ওয়াল আক্বদের সম্মতির সাথে বিষয়টি পেশ করে দুটিকে একটি বিষয়ের মধ্যে একত্রিত করেছেন। তাদের আলোচনা থেকে এটাই বুঝা যায় যে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে আহলে হাল ওয়াল আক্বদ বা বিশেষজ্ঞদের ঐক্যমত যা সাধারণ মুসলমানদের মতামতের প্রতিফলন আর এটাই শরয়ী খেলাফতের বাস্তবতার কারণ।
 
আহলে হাল ওয়াল আক্বদের সংখ্যা নিয়ে আলোচনার পর এ শ্রেণীর লোকদের যোগ্যতা ও বৈশিষ্ট্যসমূহ পর্যালোচনা করার দাবী রাখে। এ শ্রেণীর যোগ্যতার আলোচনাতে তেমন কোন বিভেদ বিদ্যমান নেই এবং বিভিন্ন উৎস সামগ্রিকভাবে তিনটি যোগ্যতা তাদের জন্যে আবশ্যক বলে মনে করেন:
 
১. সর্বময় ন্যায়পরায়নতা(আদালাত);
২. এমন জ্ঞান বিদ্যমান থাকা যার মাধ্যমে সকল গুণের অধিকারী ইমামকে চেনা ও নির্বাচন করা সম্ভব;
৩. পান্ডিত্য ও প্রজ্ঞার অধিকারী হওয়া যার মাধ্যমে ইমামের রাজনৈতিক বিষয়াদিকে চিহ্নিত করা যায়। তিনি ইমামত বা নেতৃত্বের জন্যে সবচেয়ে বেশী উপযুক্ত এবং জনসাধারণের মঙ্গলের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী সচেতন ও তা রক্ষায় সবচেয়ে বেশী দৃঢ় হবেন। (আবু ইয়ালী মাওয়ারদী, আল্ আহকামুস সুলতানিয়্যা ফি উলায়াতিদ দ্বীনিয়্যা, পৃ:৩১)।
 
উপরোক্ত শর্তাবলী ও বৈশিষ্ট্যসমূহ আহলে হাল ওয়াল আক্বদ-এর লোকদেরকে অন্যদের থেকে পৃথক করে তাদের মতামত ও সম্মতি শরয়ী হিসেবে পরিগণিত করে। এ যোগ্যতাসমূহের অব্যবহিত পর আহলে শাওকাতের গুণটিও ধার্তব্য। কেননা, তা না হলে পূর্বোল্লেখিত যোগ্যতাসমূহের সাথে বিরোধ সৃষ্টি করে। যার ফলে শক্তি প্রদর্শনকারী, সামরিক অভ্যুত্থান ও লুটতরাজের রাজত্ব কায়েম হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।

Related Post

খেলাফত শব্দের অর্থ-পরিচয়

Posted by - September 22, 2019 0
ঐতিহাসিক উৎসসমূহে খেলাফত ও খলীফা শব্দদ্বয়ের কোন সংজ্ঞা প্রদান করা হয়নি। আর খলীফা শব্দের ব্যাপারে শুধুমাত্র ব্যক্তিদের উপমা পেশ, তাদের…

ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার খেলাফত

Posted by - September 20, 2019 0
আহলে সুন্নাতের মাঝে অনৈক্য ও বিসংবাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার শাষন ক্ষমতাকে “খেলাফত” নামে ভ‚ষিত করা। সুন্নী…

খেলাফত লাভ ও হস্তান্তরের পদ্ধতি

Posted by - October 14, 2019 0
ইয়াযিদ বনাম খেলাফতের পদপ্রাপ্তির জন্যে উল্লেখযোগ্য শর্তঃ সকল মুসলমানদের ঐক্যমতের সিদ্ধান্ত ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার পাপাচার স্পষ্ট হওয়ার মাধ্যমে আর তার…

খোলাফায়ে রাশেদিন-এর খেলাফতের আসনে উপবিষ্ট হওয়ার গুণাবলী ও পন্থা

Posted by - October 4, 2019 0
অন্ত:তপক্ষে আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে খোলাফায়ে রাশেদিন বিভিন্ন দিক থেকে খেলাফতের আসনে উপবিষ্ট হওয়ার শর্তাবলী পূরণ করেছেন এবং শরয়ী পন্থা ও…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *