খেলাফত শব্দের অর্থ-পরিচয়

668 0
ঐতিহাসিক উৎসসমূহে খেলাফত ও খলীফা শব্দদ্বয়ের কোন সংজ্ঞা প্রদান করা হয়নি। আর খলীফা শব্দের ব্যাপারে শুধুমাত্র ব্যক্তিদের উপমা পেশ, তাদের পরিচয় ও গুণাবলী বর্ণনা ও শাষন ক্ষমতার সময়কালের আলোচনা করেই ক্ষ্যান্ত হয়েছে। এ কাজটির বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। তার মধ্যে ইতিহাসবিদদের পক্ষ থেকে এ দু’টি শব্দের অর্থ স্পষ্ট থাকা বা স্পষ্ট বলে ধরে নেয়া হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে। প্রকৃত সত্য কথা হলো, ইতিহাস লেখকগণ সম্মানিত রাসূল(সা.)-এর জীবন বৃত্তান্ত ও সিরাতের প্রতিবেদন লেখার মাধ্যমে খলীফাদের সময়কালে প্রবেশ করেন। তারা একাদশ হিজরী থেকে ইমাম আলী বা ইমাম হাসান অথবা এমনকি বাগদাদের পতন(৬৫৬হি.) পর্যন্ত খেলাফতের সময়কাল বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্ব অথবা তার অধিকাংশ অঞ্চল, তা কখনো দামেশক আবার কখনো বাগদাদ-এর নেতৃত্বকে মুসলমানদের খলীফা বলে ধারনা করেছেন।
 
এ শব্দের ব্যাপারে অন্য একটি বিষয় হচ্ছে অভিধানের দৃষ্টিকোন থেকে এর সংজ্ঞা পরিচয় এতসব অভিধান ও সাহিত্যকর্ম বিদ্যমান সত্তে¡ও এর পারিভাষিক অর্থ রাষ্ট্র বিজ্ঞানগত ফিকাহ শাস্ত্রতে নিহিত রয়েছে যা কিছুকাল পূর্ব পর্যন্ত মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষন করেনি। যাই হোক, আহলে সুন্নাতের আলেমগণ প্রতিষ্ঠিত রাজ দরবারের সাথে তাদের ঐতিহাসিক ও চিরকালীন সম্পর্কের কারণে অন্যান্য ইসলামী ফের্কাদের পূর্বেই রাষ্ট্র বিজ্ঞানগত ফিকাহ শাস্ত্র নিয়ে আলোচনার সুত্রপাত করেছেন। এ শাস্ত্রের অন্যতম আলোচনা হচ্ছে খেলাফত ও খলীফা শব্দদ্বয় নিয়ে। তারা এ ব্যাপারে মতামতও ব্যক্ত করেছেন যার মধ্যে এক অভিন্ন রায় ও অভিমত পরিলক্ষিত হয়।
খেলাফতের আভিধানিক অর্থ উত্তরাধিকারী, নেতা ও ইমাম ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং মুসলিম ফিকাহবিদ ও কিছু ইতিহাস লেখকগণ যারা তৎকালীন শাষকদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন তাদের মাঝে এ ধরনের অর্থই প্রচলিত আছে। আল্ মাওয়াক্বেফের লেখক লিখেছেন: “খেলাফতের অর্থ হলো সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী শেষ রাসূল(সা.)-এর পক্ষ থেকে দ্বীন ও দুনিয়ার ব্যাপারে জনসাধারণের উপর কর্তৃত্ব।” (আল্ মাওয়াক্বিফ, পৃ: ৬০৩)।
 
অন্যান্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে যে সংজ্ঞা এসেছে তা থেকে এটাই ধরে নেয়া যায় যে, “খেলাফত হচ্ছে দ্বীন প্রতিষ্ঠা ও তার সীমারেখা রক্ষার লক্ষ্যে রাসূলের উত্তরাধিকারত্ব, এমনভাবে যে, অন্যদের উপর তার অনুসরণ অত্যাবশ্যকীয় হয়ে যায়।” (আবু ইয়ালী মাওয়ারদী, আল্ আহকামুস সুলতানিয়্যা ফি উলায়াতিদ দ্বীনিয়্যা, পৃ: ২৯)।
আবুল হাসান মাওয়ারদী উক্ত শব্দের সংজ্ঞায় বলেছেন:
 
اَلْاِمَاْمَةُ مَوْضُوْعَةٌ لِخِلَاْفَةِ اْلْنَبُوَّةِ فِيْ حَرَاْسَةِ اْلْدِيْنِ وَ سِيَاْسَةِ اْلْدُنْيَاْ
অর্থাৎ “ইমামত হচ্ছে দ্বীন রক্ষায় ও দুনিয়ার রাজনীতিতে নবুয়তের উত্তরাধিকারত্ব।” (আবু ইয়ালী মাওয়ারদী, আল্ আহকামুস সুলতানিয়্যা ফি উলায়াতিদ দ্বীনিয়্যা, পৃ: ২৯)।
 
প্রকৃতপক্ষে এ সংজ্ঞাটি পূর্বের সংজ্ঞার সাথে সামান্য শব্দের তারতম্য ছাড়া অন্য কোন পার্থক্য নেই। মুসলিম ইতিহাস লেখকদের মধ্যে আব্দুর রাহমান ইবনে খালদুন দ্বীনি দৃষ্টিকোন থেকে এ শব্দের সংজ্ঞার প্রতি দৃষ্টি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন: “খেলাফত অর্থ প্রকৃতপক্ষে দ্বীন রক্ষায় শরীয়তের প্রবর্তকের উত্তরাধিকারত্ব এবং দ্বীনের ভিত্তিতে দুনিয়ার রাজনীতিকে সাজানো।” (আবু ইয়ালী মাওয়ারদী, আল্ আহকামুস সুলতানিয়্যা ফি উলায়াতিদ দ্বীনিয়্যা, পৃ: ২৯)।
 
সর্বোপরি এটাই বলা যায়, “খেলাফত হচ্ছে দ্বীন ইসলামের রক্ষা, ব্যাখ্যা ও প্রসারে এবং দ্বীনের দৃষ্টিকোন ও হুকুমের ভিত্তিতে মুসলমানদের কার্যক্রম পরিচালনায় রাসুল(সা.) এর উত্তরাধিকারত্ব”। (আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী সাহেবও খেলাফত ও ইমামতকে প্রতিশব্দ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং এর অর্থ করেছেন “ইসলামের দৃষ্টিতে নেতৃত্ব”)।

 খেলাফতের শর্তাবলীঃ

আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে খেলাফতের অর্থ পরিস্কার হবার পর তাদের দৃষ্টিতে খেলাফতের শর্তাবলী সম্পর্কে আলোচনা করা যুক্তিযুক্ত মনে করছি। এটা দেখা দরকার যে, কী শর্তাবলী ও বৈশিষ্ট্যসমূহ থাকলে সে খেলাফতের পদের অধিকারী এবং ইসলামী খেলাফত তার জন্যে উপযুক্ত ও শরীয়তসম্মত হবে। সুতরাং যদি কেউ এর একটি বা ততোধিক শর্ত বিবর্জিত হয় তাহলে সে খেলাফতের অধিকারী হতে পারে না আর তখন তার দাবীর মোকাবেলায় অথবা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ফলে সে শরীয়তের দৃষ্টিকোন থেকে মুসলমানদের খলীফা বলে স্বীকৃতি লাভ থেকে বঞ্চিত হয়।
 
আহলে সুন্নাতের কিতাবাদি ও উৎসসমূহের প্রতি সামান্য দৃষ্টি নিক্ষেপের মাধ্যমে যা খেলাফত ও মুসলমানদের খলীফা সমন্ধে লেখা হয়েছে এটাই উপলব্ধি করা যায় যে, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়ামূলক আচরণ করেছেন। মুসলমানদের খলীফা ও তার শর্তাবলী সম্পর্কে সকল পূর্ব ফলাফল বর্জিত ও আবেগ দ্বারা তাড়িত না হয়ে পর্যালোচনা এবং এর খুটিনাটি বিষয়গুলো পরিস্কারভাবে, জ্ঞানগত ও গবেষনামূলকভাবে সামনে উপস্থিত করার লক্ষ্যে মুক্ত চিন্তা ও ক্রিয়াশীলভাবে মুসলমানদের সর্বপ্রাথমিক উৎসসমুহ যেমন কোরআনুল কারিম ও নবির সুন্নাতের প্রতি তারা দৃষ্টি নিক্ষেপ করেননি। অত:পর তারা ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারেও এ একই পন্থা অবলম্বনে মুসলমানদের ইতিহাসে খেলাফতের আসনে উপবিষ্ট ব্যক্তি অথবা এ পদের দাবীদার ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন আর এভাবেই অর্জিত মাপকাঠির ভিত্তিতে তাদেরকে বিচার করেছেন।
 
আহলে সুন্নাতের আলেমগণ খোলাফায়ে রাশেদিনের ব্যাপারে গুনাহর সম্ভাবনা না দেয়ার কারণে তাদের কর্মপন্থাকে দলীল ও শেষ কথা হিসেবে ধরে নিয়েছেন। তারা তাদের রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাষ্ট্র ক্ষমতায় আরোহনের পদ্ধতি আর তাদের বৈশিষ্ট্যসমূহকে শরীয়তসম্মত শর্তাবলী এবং ক্ষমতা হস্তান্তর ও খেলাফতের অব্যাহত ধারার জন্যে এ ব্যবস্থাকে সর্বসম্মত গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থাপনা হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছেন। আহলে সুন্নাতের বিদ্বান ব্যক্তিরা খোলাফায়ে রাশেদিনের বৈশিষ্ট্যাবলী অথবা তাদের চেয়েও আরো উপরের দিকে লক্ষ্য প্রদানের পরিপ্রেক্ষীতে যে সকল শর্তাবলীর কথা লিপিবদ্ধ করেছেন তা বৈচিত্রময় ও বিভিন্নরকম। তাদের মধ্যে কোরাইশী হওয়া নিয়ে মতভেদ আর অধিকাংশ শর্তাবলীর ব্যাপারে মতৈক্য বিদ্যমান যা সংক্ষিপ্তাকারে নিম্নে আলোচনা করছি:

ক) ন্যায়বাদিতা (আদালাত):

এ বিষয়ে আহলে সুন্নাতের আলেমদের মধ্যে ঐক্য রয়েছে। সুন্নী ফক্বিহ্ ও ইতিহাস লেখকগণ একজন ব্যক্তির খেলাফতের আসন অলংকৃত করার জন্যে ন্যায়বাদিতার বিষয়টিকে অনিবার্য শর্ত হিসেবে গণ্য করেছেন। তারা কোন ফাসেক(ন্যায়বাদিতা শূন্য) ব্যক্তিকে মুসলমানদের উপর কর্তৃত্ব এবং দ্বীন ও দুনিয়ার বিষয়ে রাসূল(সা.) এর উত্তরাধিকারীত্বের ব্যাপারে যোগ্য মনে করেন না। হ্যাঁ, তাদের আলেমদের পক্ষ থেকে এ বিষয়টির বর্ণনার ক্ষেত্রে একই পন্থা অবণম্বন করেননি। দৃষ্টান্তস্বরূপ, আবু ইয়ালী উক্ত বিষয়কে দ্বিতীয় শর্তের মধ্যে “নেতৃত্বের জন্যে চারটি শর্ত” শিরোনামে এভাবে লিখেছেন: “ইমামত ও খেলাফতের যোগ্য ব্যক্তিদের জন্যে দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে তার এমন পর্যায়ের শক্তি থাকবে যার মাধ্যমে সে বিচারকের পদে উপবিষ্ট হবার যোগ্যতা রাখে। অর্থাৎ তাকে মুক্ত মানুষ, বালেগ, বুদ্ধিমান ও বিবেকবান, জ্ঞানী ও ন্যায়পরায়ন হতে হবে।” [আবু ইয়ালী মাওয়ারদী, আল্ আহকামুস সুলতানিয়্যা ফি উলায়াতিদ দ্বীনিয়্যা, পৃ:২০; মা’ছারুল ইনাফা ফি মাআ’লিমিল খেলাফাহ্, খন্ড ১, পৃ: ৩১-৩৯; রাওদ্বুত ত্বালিবিন, পৃ: ৪৫(আ: সুবহানী কর্তৃক উদ্ধৃত)]।
 
তিনি চতুর্থ শর্তের মধ্যে একটু অসরাসরীভাবে এ যোগ্যতার দিকে ঈঙ্গিত প্রদান করেছেন। তিনি বলেন: “চতুর্থ শর্ত হচ্ছে ইমাম বা খলীফা দ্বীন ও জ্ঞানের জগতে জনগণের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত ব্যক্তি হবেন।” [আবু ইয়ালী মাওয়ারদী, আল্ আহকামুস সুলতানিয়্যা ফি উলায়াতিদ দ্বীনিয়্যা, পৃ:২০; মা’ছারুল ইনাফা ফি মাআ’লিমিল খেলাফাহ্, খন্ড ১, পৃ: ৩১-৩৯; রাওদ্বুত ত্বালিবিন, পৃ: ৪৫(আ: সুবহানী কর্তৃক উদ্ধৃত)]।
 
মাওয়ারদী নেতৃত্বের গুণাবলীসম্পন্ন ব্যক্তিদের (আহলে ইমামাত) জন্যে শর্তাবলীর বিষয়ে লিখেছেন: “অত:পর নেতৃত্বের গুণাবলীসম্পন্ন ব্যক্তিদের(আহলে ইমামাত) জন্যে নির্ভরযোগ্য শর্তাবলী হচ্ছে সাতটি। তন্মোধ্যে একটি হচ্ছে ন্যায়পরায়নতা, যা সকল শর্তাবলীর উপর প্রতিষ্ঠিত।” (আবু ইয়ালী মাওয়ারদী, আল্ আহকামুস সুলতানিয়্যা ফি উলায়াতিদ দ্বীনিয়্যা, পৃ:৩১; মুহাম্মাদ আল্ মুবারাক, নিযামুল ইসলাম, পৃ: ৬১, ৬৩-৬৪)।
আরো অনেকে ন্যায়বাদিতাকে খলীফা ও মুসলমানদের ইমামের জন্যে অত্যাবশ্যকীয় জ্ঞান করেছেন। এ দলটি যদি এ বিষয়ের কোন কিছুতে সন্দেহ ও সংশয় করে থাকে তা হচ্ছে উক্ত শর্তের উপর অন্যান্য শর্তাবলী নিয়ে যেমন, সাহসিকতা, কোরাইশী হওয়া, সঠিক সিদ্ধান্তের অধিকারী হওয়া প্রভৃতি। ইবনে খালদুনও ন্যায়পরায়নতাকে খলীফার জন্যে অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হিসেবে গননা করেছেন। মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে ইয়াযিদের স্থলাভিষিক্তির সময়কালে সে উক্ত মূলনীতির (ন্যায়বাদিতা) অধিকারী ছিল না অথবা অন্ত:তপক্ষে মুয়াবিয়া এ বিষয়ে অবগত ছিলেন না এবং জেনে শুনেই তার পুত্র ইয়াযিদের পক্ষে বাইয়াতের ব্যাপারে জোড় তাগিদ দিয়েছিলেন ইত্যাদি বিষয়ে ইবনে খালদুন শক্তভাবে বিরোধীতা করে বলেছেন: “ন্যায়পরায়নতার শর্তের ব্যাপারে কথা হচ্ছে এ যে, ইমামত একটি দ্বীনি পদ এবং যে সকল পদের জন্যে ন্যায়বাদিতা (আদালাত) শর্ত তাদের সকলের উর্দ্ধে নিয়ন্ত্রনকারী পদটি হচ্ছে এই ইমামত। তাই, ইমামতের পদের জন্যে ন্যায়বাদিতার শর্ত জুড়ে দেয়া আরো বেশী সংঙ্গতিপূর্ণ।” তিনি ইয়াযিদের ফিসক্ব(ন্যায়পরায়নতা শূন্য) এর ব্যাপারে মুয়াবিয়ার অনবগতার বিষয়টি এভাবে লিখছেন: “মুয়াবিয়ার ব্যাপারে এরকম ধারনা করা ঠিক হবে না যে, তিনি ইয়াযিদের ফিসক্বের বিষয়ে অবহিত ছিলেন। তিনি এসব বিষয়ের চেয়ে বেশী ন্যায়পরায়ন ছিলেন এবং তার মর্যাদা এর চেয়েও উর্দ্ধে।” (আবু ইয়ালী মাওয়ারদী, আল্ আহকামুস সুলতানিয়্যা ফি উলায়াতিদ দ্বীনিয়্যা, পৃ:৩১; মুহাম্মাদ আল্ মুবারাক, নিযামুল ইসলাম, পৃ: ৬১, ৬৩-৬৪)।
 
যে বিষয়টি ভুলে গেলে হবে না, সে বিষয়টি হলো, কিছু ফক্বিহ্ ন্যায়পরায়নতার বিষয়টির উপর জোড় তাগিদ দিয়েছেন আবার অনেকে সেটাকে ন্যায়পরায়নতা ও দ্বীনদারীতা বুঝিয়েছেন যার উদ্দেশ্য নায়পরায়নতা নিম্নের দু’টি অর্থেই বিদ্যমান: ১. ব্যক্তির অভ্যন্তরে এমন এক শক্তির অবস্থান যা সেই ব্যক্তিকে কবিরা গুনাহ থেকে ও সগিরা গুনাহর পুনরাবৃত্তি থেকে বিরত রাখে। ২. জনগণের সাথে সাম্য ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে ব্যবহার করা। উপরোক্ত দুটির যে কোন একটি বৈশিষ্ট্য ন্যায়পরায়নতার জন্যে যথেষ্ট নয়।

খ) ইসলামী আইনজ্ঞতা (ফিক্বাহাত):

ফিক্বাহাতের শর্তের ব্যাপারে মুসলমান আলেম এবং বিশেষ করে সুন্নী আলেমদের মধ্যে কোন বিতর্ক নেই। এর আগেও বলা হয়েছিল, আলেমরা তার মাপকাঠি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন: খলীফা ফিকাহ্ শাস্ত্রের এমন পর্যায়ে থাকবেন যে, তিনি সকল মানুষের চেয়ে বেশী যোগ্য বলে পরিগণিত হবেন আর বিচারকের পদ অলংকৃত করার যোগতা ধারন করবেন। আবু ইয়ালী মাওয়ারদী শক্তভাবে বলেন: “ হুকুম আহকামের বিষয়ে জ্ঞান ইজতিহাদের পর্যায়ে পৌছবে।” [আবু ইয়ালী মাওয়ারদী, আল্ আহকামুস সুলতানিয়্যা ফি উলায়াতিদ দ্বীনিয়্যা, পৃ:৩১; মা’ছারুল ইনাফা ফি মাআ’লিমিল খেলাফাহ্, খন্ড ১, পৃ: ৩৭(আ: সুবহানী কর্তৃক উদ্ধৃত)]।
 
আল্লামা জুরজানী, কাজী আযুদুদ্দীন ইজি-এর বিখ্যান্ত গ্রন্থ “আল্ মাওয়াক্বিফ”-এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন: “ফক্বিহদের সর্বসম্মত অভিমত হচ্ছে, শুধুমাত্র ইসলামী মূলনীতি(উসুল) ও ইসলামী শাখা-প্রশাখা(ফুরু’)-তে একজন ফক্বিহ্ ও মুজতাহিদই জনগণের উপর কর্তৃত্বের জন্যে ক্বিয়াম করার অধিকার রাখেন।” (মাশরুহু মাওয়াক্বিফ জুরজানী, খন্ড ৮, পৃ: ৩৪৯; মুহাম্মাদ ইবনে ইদ্রিস শাফেয়ী, আল্ ফিক্হুল আকবার, পৃ: ৩৯)।
 
একজন গবেষক যিনি এ বিষয়ে প্রচুর গবেষনা করেছেন এবং মুসলমানদের খলীফা ও ইমামের জন্যে ফিকাহাতের শর্ত আহলে সুন্নাতের নিকট একটি ঐক্যমতের বিষয় বলে গণ্য করেন, তিনি বলেন: “শিয়া ও সুন্নী উভয় মাযহাবের আলেমদের দৃষ্টিতে শরীয়তসম্মত সর্বনির্ভর হুকুমত হচ্ছে সেই শাষন ব্যবস্থা যেখানে একজন ফক্বিহ রাষ্ট্রের কর্ণধার হন। সকল সুন্নী ফক্বীহ এ বিষয়ে ঐক্যমত পোষন করেন এবং ফিক্বাহাতকে খেলাফত ও বাইয়াতের মধ্যকার বন্ধনটি সহি-শুদ্ধ হওয়ার শর্ত হিসেবে গণ্য করেন। আল আহকামুস সুলতানিয়্যা-এর উদ্ধৃতি অনুযায়ী ইমামুল হারামাইন জুভাইনী এ বিষয়েই জোড় তাগিদ দিয়েছেন … আর এ ব্যাপারে ফিক্বাহ্ শাস্ত্রবিদদের বক্তব্যের পরিমান অত্যাধিক। আমি সেগুলোর কিছু অংশ আমার গ্রন্থ বিলায়াতুল আমর-এ ১০৬ থেকে ১০৮ পৃষ্ঠার মধ্যে লিপিবদ্ধ করেছি।” (মুহাম্মাদ মাহদী আসেফী, বিশেষ সাক্ষাতকার, গবেষনা ও হাওযা ম্যাগাজিন, দ্বিতীয় বর্ষ, সপ্তম সংখ্যা, পয়িয ১৩৮০ফারসী, পৃ: ৭৬-৭৭)।

গ) অন্যান্য শর্তাবলী:

যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, তা খেলাফতের পদে অধিষ্ট হওয়ার জন্যে পরিমিত শর্তাবলী ছিল না। মুসলিম আলেমরা আরো অন্যান্য শর্ত যেমন পুরুষ হওয়া, সাহসিকতা, প্রজ্ঞার সাথে পরিচালনা, রাষ্ট্রনীতি জানা, ভাল বংশ ও শারীরিক ও মানুষিক সুস্থতার অধিকারী হওয়া ইত্যাদি শর্তাবলী একজন ব্যক্তির খেলাফতের আসন লাভ করা ও তার শরীয়তসম্মত খেলাফত অব্যাহত দানের জন্যে অত্যাবশ্যক জ্ঞান করে থাকেন এবং বিভিন্ন শিরোনামের অধিনে এ বিষয়ের উপর জোর দিয়েছেন যা এখানে আমরা বিষয়টিকে আলোচনা বহির্ভুত মনে করছি।

Related Post

খেলাফত লাভ ও হস্তান্তরের পদ্ধতি

Posted by - October 14, 2019 0
ইয়াযিদ বনাম খেলাফতের পদপ্রাপ্তির জন্যে উল্লেখযোগ্য শর্তঃ সকল মুসলমানদের ঐক্যমতের সিদ্ধান্ত ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার পাপাচার স্পষ্ট হওয়ার মাধ্যমে আর তার…

খেলাফত হস্তান্তরের পদ্ধতি

Posted by - October 2, 2019 0
খেলাফত সমন্ধে যে সকল বিষয় মুসলিম সম্প্রদায় বিশেষত: আহলে সুন্নাতের আলেম ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে তন্মোধ্যে খেলাফতের হস্তান্তরের…

ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার খেলাফত

Posted by - September 20, 2019 0
আহলে সুন্নাতের মাঝে অনৈক্য ও বিসংবাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার শাষন ক্ষমতাকে “খেলাফত” নামে ভ‚ষিত করা। সুন্নী…

খোলাফায়ে রাশেদিন-এর খেলাফতের আসনে উপবিষ্ট হওয়ার গুণাবলী ও পন্থা

Posted by - October 4, 2019 0
অন্ত:তপক্ষে আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে খোলাফায়ে রাশেদিন বিভিন্ন দিক থেকে খেলাফতের আসনে উপবিষ্ট হওয়ার শর্তাবলী পূরণ করেছেন এবং শরয়ী পন্থা ও…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *