খেলাফত লাভ ও হস্তান্তরের পদ্ধতি

665

ইয়াযিদ বনাম খেলাফতের পদপ্রাপ্তির জন্যে উল্লেখযোগ্য শর্তঃ

সকল মুসলমানদের ঐক্যমতের সিদ্ধান্ত ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার পাপাচার স্পষ্ট হওয়ার মাধ্যমে আর তার কুফুরের ব্যাপারে আহলে সুন্নাতের বহু আলেম ও ফিকাহবিদদের গৃহিত মতামতের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, ইয়াযিদের শাসন প্রথম থেকেই শরীয়ত বিরোধী, স্বৈরাচারী ও অবৈধ দখলদারীত্ব বলেই পরিগণিত। সুতরাং তার বিরোদ্ধে যে কোন প্রকার বিদ্রোহ শরীয়ত সম্মত এবং শরীয়ত ও বিবেক-বুদ্ধির দৃষ্টিতে শুধুমাত্র বৈধই নয় বরং যেমনিভাবে ইমাম হুসাইন তার এক বক্তৃতায় জোর তাগিদ দিয়েছেন, প্রতিটি মুসলমানের (শুধু হুসাইন ইবনে আলী অথবা ইমামের জন্যেই নয়) কর্তব্য ও দায়িত্ব হচ্ছে খেলাফতকে তার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা, ন্যায়বিচার(আদালাত) প্রতিষ্ঠা করা এবং অত্যাচারী শাসককে তার অপরাধ থেকে বিরত রাখা।

ফিকাহ শাস্ত্র(ফিক্বাহাত) সমন্ধে প্রয়োজনীয় জ্ঞানঃ

যেমনি করে উল্লেখ হয়েছে, একজন মুসলিম খলিফার জন্যে ইসলামী জ্ঞান ও ফিকাহাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়- যার ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যমত রয়েছে। আহলে সুন্নাতের সকল জ্ঞানী ব্যক্তিরা খলীফার জন্যে ইসলামী জ্ঞান, আর বিশেষ করে দ্বীনি ফিক্বাহ-র ব্যাপারে জ্ঞানের অধিকারী হওয়া অত্যাবশ্যক বলে মনে করেন এবং খেলাফতের আসন অলংকৃত করার জন্যে তার প্রয়োজনীয় জ্ঞান ছাড়া সেই আসনে উপবিষ্ট হওয়াকে অবৈধ বলে গণ্য করেছেন। কোন কোন উৎসে এ বিশেষ গুণকে ইজতিহাদ, কিছু উৎসে ইলম বা জ্ঞান আবার অন্য কিছু উৎসসমূহে সেটাকে ফিক্বাহ শাস্ত্রের জ্ঞান(ফিক্বাহাত) এবং অবশেষে অনেক উৎসে সেটাকে জ্ঞান ও সচেতনতা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (বিস্তারিত জানার জন্যে দেখুন: আবু যুহরা, আল ফিক্বহ আ’লাল মাযহিবিল আরবায়া’ ; আব্দুল কারিম যাইদান, আল ওয়াজিযাতু ফি উসুলিশ শারিয়া’; জাফার সুবহানী, পিশভয়ী আয্ নাযারে এসলম, পৃষ্ঠা ২২)। এ কারণে তারা বিশ্বাস করেন যে, খোলাফায়ে রাশিদীন ব্যতিক্রম ব্যতিরকে সকলে তাদের নিজ যামানার অন্যতম ফক্বিহ হিসেবে গণ্য হতেন এবং স্তর বিন্যাসের দৃষ্টিভঙ্গিতে (যা পূর্বে উল্লেখ হয়েছে) তাদের জ্ঞান ও ইজতিহাদের ভিত্তিতে কেউ প্রথম সারীর আবার কেউ দ্বিতীয় সারীর ফক্বিহ বলে পরিগণিত। কোন এক সুত্রে- যা সাহাবীদের মধ্যকার ফক্বিহ ও আহলে সুন্নাতের জ্ঞানী ব্যক্তিদের দৃষ্টিভঙ্গির পর্যালোচনা করা হয়েছে, দ্বিতীয় খলিফা ও ইমাম আলীকে প্রথম সারীর ফক্বিহ আর আবু বাকর ও উসমানকে দ্বিতীয় সারী বা মধ্যম সারীর ফক্বিহদের মধ্যে গণনা করেছেন। এভাবে আহলে সুন্নাত, খলিফাদের ফিক্বাহাতকে দ্বীনি খেলাফতের পদে উপবিষ্ট হওয়ার জন্যে অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এত কিছুর পরও, কোন ঐতিহাসিক, ফিক্বহ শাস্ত্র ও হাদিসের উৎস ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়াকে ফক্বিহ বলে মনে করেনি। যেমনি করে ফিক্বাহ শাস্ত্রের কোন আসল (اصل) বা কোন রেওয়্যাত অথবা ফিক্বহী মসলা- মাসায়েল তার কাছ থেকে নি:সারিত হয়নি। প্রকৃতপক্ষে ইয়াযিদ যদি সত্য ইসলাম গ্রহণ করতো এবং তার উপর দৃঢ় ও অবশিষ্ট থাকতো তাহলে হয়তো সে ন্যায়বাদিতা অর্জন ও অনুবর্তনের মাধ্যমে হাদিস বর্ণনাকারীদের মধ্যে গণ্য হতে পারতো আর এ পথে হাদিস বর্ণনাকারী ও রাসূল(সা.)-এর বিভিন্ন উক্তি- যদিও অন্য কারো মাধ্যম দিয়ে, তাঁর উক্তি বর্ণনাকারীদের মধ্যে গণ্য হতে পারতো।

পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে যে, আহলে সুন্নাতের প্রতিবেদন ও বর্ণনাসমূহ ইয়াযিদের ইসলাম গ্রহণ ও তার দ্বীনি বিশ্বাসের বিষয়টি নাকচ করে থাকেন এবং আহলে সুন্নাতের বহু বুজুর্গ আলেম কারবালার ঘটনা সংঘটিত হবার পূর্ব পর্যন্ত তার মুসলমান হওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। কারবালাতে মহা অপরাধ ঘটানোর পর আহলে সুন্নাতের অধিকাংশ ব্যক্তিবর্গ এ বিশ্বাসের দিকে ধাবিত হয়েছেন যে, যদিও ধরে নেয়া হয় সে মুসলমান ছিল তারপরও সে আশুরার নজিরবিহীন অপরাধ সংঘটনের কারণে সে কাফের ও অভিশাপের যোগ্য ব্যক্তিরূপে পরিগণিত হয়েছে।

এর উপর ভিত্তি করে- যা পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে, আহলে সুন্নাতের অনেক রিজাল শাস্ত্রবিদ ও গবেষক ইয়াযিদের কাছ থেকে কোন ধরনের হাদিস বা রেওয়্যাত বর্ণনা করাকে জায়েয মনে করেন না এবং তারা সরাসরী উল্লেখ করেছেন: “ইয়াযিদের ন্যায়পরায়নতা অস্বীকার করা হয়েছে, উক্ত ব্যক্তি এমন কোন যোগ্যতা রাখে না যে, তার কাছ থেকে রেওয়্যাত বর্ণনা করা হবে।” (শামসুদ্দিন যাহাবী, মিযানুল ই’তিদাল, খন্ড ৭, পৃ: ২৪২ ; ইবনে হাজার আসক্বালানী, লিসানুল মিযান, খন্ড ৬, পৃ: ২৯৩)। এ প্রতিবেদনগুলো খুব ভালভাবে পরিদর্শন করে যে, আহলে সুন্নাতের কারো দৃষ্টিতে ইয়াযিদ ফিক্বাহ শাস্ত্রবিদ(ফক্বিহ) ছিল না। এক্ষেত্রেও খেলাফতের পদের জন্যে তার যোগ্যতা এবং মুসলিম খলিফা ও দ্বীনি নেতা হিসেবে কারবালার বিষয়ে তার সত্যতা আহলে সুন্নাতের আলেমবৃন্দ ও নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক উৎসসমূহের অস্বীকারের সম্মুক্ষীন হয়েছে। পরবর্তি অধ্যায়ে এ ব্যাপারে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

খেলাফত হস্তান্তরের পদ্ধতিঃ

পূর্বে আলোচিত হয়েছে যে, ইসলাম ও খোলাফায়ে রাশিদীনের জীবন চরিতের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর একটি বিশেষ পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়েছিল যা আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে দ্বীনি ও ইসলামী মূল্যবোধের অন্তভর্‚ক্ত। এক্ষেত্রে দু’টি বিষয় অন্যান্য সকল কিছু থেকে অনেক বেশী গুরুত্বের দাবীদার:

১. পূর্বের আইনসঙ্গত ও শরীয়তসম্মত খলিফা কোন মূল্যবোধহীন বিষয়ের দিকে ভ্রæক্ষেপ না করে উক্ত বিষয়ে পদক্ষেপ নিবেন। আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে চার জন খলিফার শাসন পদ্ধতি থেকে এটাই হস্তগত হয় যে, সন্তান ও অত্মীয়স্বজনকে খেলাফতের উত্তরাধিকার করা একটি অবৈধ কাজ। এক্ষেত্রে তাক্বওয়া, অতিত নেক কাজ, পরিচালনার ক্ষমতা ও দক্ষতা, সাহসিকতা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেই ব্যক্তির ন্যায়পরায়নতা ও ফিক্বাহ্ শাস্ত্রে পান্ডিত্য প্রভৃতি খেলাফতের আসন লাভের জন্যে অবশ্যই মনে রাখতে হবে।

২. খেলাফতের উত্তরাধিকারের জন্যে পূর্ববর্তি খলিফার মনোনয়নের পরপরই মুসলমানদের বাইয়াত অত্যন্ত জরুরী ও অত্যাবশ্যকীয় বিষয় যাতে সেই মনোনয়ন কার্যকরী রূপে পরিগ্রহ হয়। আর বাইয়াতও স্বত:স্ফ‚র্তভাবে এবং সন্তুষ্টিচিত্তে ও আকৃষ্ট মনোভাবে আর যে কোন চাপশুণ্য অবস্থায় সংঘটিত হতে হবে। ইবনে খালদুন বলেন: “বাইয়াত হচ্ছে অনুসরণ ও আনুগত্যের ওয়াদাবদ্ধতা। বাইয়াতকারী তার আমীরের সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতো যে, তার নিজের ও মুসলমানদের ব্যাপারে নেতার কথায় আত্মসমার্পন করবে। … আর এটা চালু ছিল যে, যখনি নেতার সাথে বাইয়াত করতো এবং একটা ওয়াদায় আবদ্ধ হতো তখন তাদের হাতগুলো চুক্তিবদ্ধতার উপর তাগিদ প্রদানের লক্ষ্যে ও দৃঢ়তার নিদর্শন হিসেবে তাদের নেতার হাতের উপর স্থান দিতো।…” (ইবনে খালদুন, অবতরণিকা(মুক্বাদ্দিমা), অনুবাদ: মুহাম্মাদ পারভীন গুণাবাদী, খন্ড ১, পৃ: ৪০০)।
যখন বাইয়াত বাধ্য করে অথবা ধোকা দিয়ে বা লোভ দেখিয়ে সম্পাদন করা হবে তখন সে বাইয়াতের কোন মূল্য অবশিষ্ট থাকে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, আবু হানিফা, আব্দুল হামিদ ইবনে জা’ফার, ইবনে আজালান ও অন্যান্য আহলে সুন্নাতের বিখ্যাত ফক্বিহবৃন্দ আবু জা’ফার আব্দুল্লাহ্ আল মানসুর(আব্বাসীয় বংশের দ্বিতীয় খলিফা)-এর সাথে বাইয়াত করার পরও তার বিরোদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন এবং যখন তাদেরকে বলা হলো: “আমরা খলিফা আল মানসুরের সাথে বাইয়াতে আবদ্ধ হয়েছি”, তখন মালিক ইবনে আনাস বলেন: “চাপের মুখে ও বাধ্য হয়ে কোন বাইয়াত কার্যকরী হয় না ও এর কোন মূল্য নেই”। (আব্দুর রাহমান সুয়ূতি, তারিখুল খোলাফা, পৃ: ২৬১)।

Related Post

খোলাফায়ে রাশেদিন-এর খেলাফতের আসনে উপবিষ্ট হওয়ার গুণাবলী ও পন্থা

Posted by - অক্টোবর ৪, ২০১৯
অন্ত:তপক্ষে আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে খোলাফায়ে রাশেদিন বিভিন্ন দিক থেকে খেলাফতের আসনে উপবিষ্ট হওয়ার শর্তাবলী পূরণ করেছেন এবং শরয়ী পন্থা ও…

ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার খেলাফত

Posted by - সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৯
আহলে সুন্নাতের মাঝে অনৈক্য ও বিসংবাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার শাষন ক্ষমতাকে “খেলাফত” নামে ভ‚ষিত করা। সুন্নী…

খেলাফত হস্তান্তরের পদ্ধতি

Posted by - অক্টোবর ২, ২০১৯
খেলাফত সমন্ধে যে সকল বিষয় মুসলিম সম্প্রদায় বিশেষত: আহলে সুন্নাতের আলেম ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে তন্মোধ্যে খেলাফতের হস্তান্তরের…

খেলাফত শব্দের অর্থ-পরিচয়

Posted by - সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৯
ঐতিহাসিক উৎসসমূহে খেলাফত ও খলীফা শব্দদ্বয়ের কোন সংজ্ঞা প্রদান করা হয়নি। আর খলীফা শব্দের ব্যাপারে শুধুমাত্র ব্যক্তিদের উপমা পেশ, তাদের…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »