খুমসের বিধান

968 0

খুমস বুঝতে হলে সবার আগে যে বিষয় গুলো জানতে হবে তা হলঃ

১। যাকাত, সাদাকা ও খুমসের বিধান
২। তাকলিদ ও মার্জাইয়াত
৩। আয়াতে তাফাক্কুহ ফিদ্দিন
৪। বেলায়াতে ফকিহ

যাকাত,  সাদাকা ও খুমসের বিধান আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য ফরজ করেছেন। কাজেই এই যাকাত ও খুমস এর সাথে সংশ্লিশঠ সকল বিষয় খুবই মনযোগের সাথে এবং গুরুত্ত দিয়ে অনুধবান করতে হবে। তা না হলে ফারজিয়াত/ ওয়াজিবাত/আবশ্যকতা গুলো লঙ্ঘিত হবার মত পাপ হতে পারে।

যাকাতের আয়াতঃ

আর পৃথিবীতে এবং আখেরাতে আমাদের জন্য কল্যাণ লিখে দাও। আমরা তোমার দিকে প্রত্যাবর্তন করছি। আল্লাহ তা’আলা বললেন, আমার আযাব তারই উপর পরিব্যাপ্ত। সুতরাং তা তাদের জন্য লিখে দেব যারা ভয় রাখে, যাকাত দান করে এবং যারা আমার আয়তসমুহের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে।৭:১৫৬

উক্ত আয়াতে আল্লাহ যাকাতকে বিশ্বাসীদের জন্য পৃথিবী ও আখিরাতের কল্যানের মাধ্যম হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এটি নামাজ কায়েম করার মতই একটি ফরজ প্রদেয়।
যেহেতু যাকাতের ৯ টি উৎসের বিধান রয়েছে সেহেতু সেই সব উৎস গুলো আমাদের চিনে রাখা দরকার। এই উৎস সমুহে কারো যদি নিসাব পরিমান মাল থাকে তবে তাঁকে যাকাত দিতে হবে।
উৎস গুলো এইঃ
১ঃ সোনা ও রুপার পয়সা
২। উট, গরু, ছাগল বা ভেড়া
৩। যব, গম, খেজুর এবং কিশমিশ
এই নয়টি উৎসের বাইরে যাকাত নেই।

সাদাকার আয়াতঃ

দান  তো কেবল অক্ষকমদের াজন্য, আর  অভাবগ্রস্তদের, আর এর জন্য নিযুক্ত কর্মচারীিদের, আর যাদের হৃদয় ।ঝোঁকোনো হয় তাদের, আর দাস-মুক্তির, আর ঋণগ্রস্তদের, আর আল্লাহ্‌র পথে, আর পর্যটকদের জন্য, — আল্লাহ্‌র তরফ থেকে এই বিধান। আর আল্লাহ্ সর্বজ্ঞাতা, পরমজ্ঞানী। ৯ঃ৬০

লক্ষণীয় যে এই আয়াতে আল্লাহ সাদাকার টাকা কে পাবে তা উল্লেখ করে দিয়েছেন। অর্থাৎ এতে নবির(সাঃ) এবং তাঁর আহলে বাইতের (আঃ) কোন এখতিয়ার নেই। এটি নিতান্তই গরিব গুরাবাদের জন্য এবং সেই সকল বিপদ্গ্রস্তদের জন্য যারা এই আয়াতের আওতাধীন। তবে এখানেও একটি বিষয় উল্লেখ না করলে পুরো ব্যাপারটি ঘোলাটে রয়ে যাবে তা হোল সাদাকাও ইমামের নায়েবের কাছে পৌছে দিতে হবে।

খুমসের আয়াতঃ

وَاعْلَمُوا أَنَّمَا غَنِمْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَأَنَّ لِلَّهِ خُمُسَهُ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ إِنْ كُنْتُمْ آمَنْتُمْ بِاللَّهِ وَمَا أَنْزَلْنَا عَلَىٰ عَبْدِنَا يَوْمَ الْفُرْقَانِ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ ۗ وَاللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
“আর এ কথাও জেনে রাখ যে, কোন বস্তু-সামগ্রীর মধ্য থেকে যা কিছু তোমরা গনীমত হিসাবে পাবে, তার এক পঞ্চমাংশ হল আল্লাহর জন্য, রসূলের জন্য, তাঁর নিকটাত্নীয়-স্বজনের জন্য এবং এতীম-অসহায় ও মুসাফিরদের জন্য; যদি তোমাদের বিশ্বাস থাকে আল্লাহর উপর এবং সে বিষয়ের উপর যা আমি আমার বান্দার প্রতি অবতীর্ণ করেছি ফয়সালার দিনে, যেদিন সম্মুখীন হয়ে যায় উভয় দল। আর আল্লাহ সব কিছুর উপরই ক্ষমতাশীল।” ৮:৪১

উক্ত আয়াতটি একটু ভালভাবে পড়লে দেখা যায় এখানে আল্লাহ গনিমতের মালকে পাচ ভাগে ভাগ করেছেন এবং এর প্রতিটি কিভাবে বন্টিত হবে তা উল্লেখ করে দিয়েছেন। সবার আগে বুঝতে হবে গনিমত কি?

আমাদের দেশে জনসাধারনের মধ্যে একটি আম ধারনা রয়েছে যে গনিমত মানে হল কেবল মাত্র, কোন পক্ষ যুদ্ধে বিজয়ী হলে পরাজিত পক্ষের ফেলে যাওয়া মাল নিজ মালিকানায় নিয়ে আসাই হল গণিমত।

আসলে বেপারটী তা নয়। আরবিতে গণিমত শব্দের অর্থ দাঁড়ায় “সেই মাল যা মানুষ অর্জন করে নিজের জন্য সম্পদ হিসাবে”। এই সম্পদ নগদ অর্থ ও হতে পারে আবার খনির হিরাও হতে পারে। এই সম্পদ যুদ্ধলব্ধ শত্রু সম্পত্তিও হতে পারে আবার নিজ পরিশ্রমে উপার্জিত ব্যবসায়িক মুনাফাও হতে পারে। কাজেই সম্পদ মাত্রেই তার উপর খুমস নির্ধারিত হবে। তবে সেই সব সম্পত্তি যা উপহার হিসাবে প্রদেয় হয় যেমন বিয়েতে স্ত্রিকে দেয়া স্বামীর দেন মোহর খুমসের অন্তর্ভুক্ত হবে না এবং একবার আদায় কৃত খুমসের মালে দিতিয়বার আর খুমস নির্ধারিত হয় না।

গণিমত একটি আরবি শব্দ। যাদের আরবি সম্পর্কে ধারনা আছে তারা জানবেন এবং যারা জানেন না তারা লিসানুল আরাবি বা এই ধরনের ডিকশনারি থেকে গনিমতের অর্থ দেখে নিবেন। গনিমতের প্রাথমিক ও মূলগত অর্থ হল মুনাফা যা খরচের পর অবশিষ্ট থাকে এবং একক মালিকানাধিন হয়। যদিও এর আরেকটি অর্থ যুদ্ধলব্ধ মালও হয় বটে। কাজেই আমরা উপসঙ্গহারে বলতে পারি এই আয়াতে কারিমায় গনিমতের মাল বলতে শুধু যুদ্ধে প্রাপ্ত শত্রুপক্ষের ফেলে যাওয়া মাল বুঝানো হয়নি। বরং, মানুষ যা সম্পদ হিসাবে নিজের আয়ত্তাধিন করে তাকে বুঝানো হচ্ছে। অর্থাৎ নিজের জরুরত(প্রয়োজন) পুরন করে যা কিছু অবশিষ্ট থাকে তাঁর উপর খুমস ফরজ হয়।

এই আয়াত গুলোতে একটা জিনিস পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে তা হল আল্লাহ প্রতিটি বিধান সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন। কি দিতে হবে, কখন দিতে হবে আর কাকে দিতে হবে। কোনটা সাদাকা আর কোনটা খুমস সেটাও পরিষ্কার বলে দিয়েছেন। আরও সুনির্দিষ্ট করে কোন কোন আইটেমের উপর যাকাত, সাদকা ও খুমস হয় সেটা আমরা সাহিহ হাদিস দ্বারা এবং আহলে বাইয়তের ইমামগণের দেখানো পথে প্রমান পেয়ে যাই।

একবার এক ব্যাক্তি ইমাম সাদিক আঃ এর কাছে এসে বলল আমাদের কাছে যাকাতের আইটেমগুলোর বাইরেও অনেক শস্য আছে যা আমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত। আমরা কি ওগুলোর উপর যাকাত বের করব? ইমাম বলেছেন, যাকাতের জন্য যে নয়টি আইটেম নবি সাঃ নির্ধারন করে গেছেন তাঁর বাইরে অন্য কোন নতুন আইটেমের উপর যাকাত নির্ধারনের সুযোগ নেই। তদ্রুপ যাকাত ও খুমস যার কাছে দেবার তাঁকে ব্যাতিত অন্য কাউকে দেবার অনুমতি বা সুযোগ ইসলামে নেই।

খুমস ফরজ হয় এমন আইটেম সমুহঃ

১। বাৎসরিক আয় থেকে খরচের পর যে মুনাফা রয়ে যায়।
২। যুদ্ধে পরাজিত বাহিনির ফেলে যাওয়া মাল
৩। গুপ্তধন, খনি থেকে প্রাপ্ত পাথর ও অন্যান্য সম্পদ
৪। বৈধ মালের সাথে অবৈধ মাল মিশে গেলে
৫। মুসলমানের সম্পদ যা একজন কাফের কিনে নেয়
৬। সমুদ্রের তলদেশের সম্পদ।

এবার আসি, এই ফরজ প্রদেয়গুলো কিভাবে ও কার কাছে পৌছে দিতে হবেঃ
সবার আগে একটা জিনিস পরিষ্কার করে নিতে হবে তা হল এই সকল প্রদেয়গুলো আবশ্যিক। কাজেই কেউ যদি এগুলো দিতে অস্বীকার করে তবে সে ইসলামি ফরজের একটি বিধানকে অস্বীকার করার দায়ে কবিরা গুনাহ করল। এরপর আসি, এই ফরজ প্রদেয় গুলো কিভাবে দিতে হবে? যাকাত এবং খুমসের কিছু সুনির্দিশট বিধান রয়েছে। সাদাকাতে তেমন কোন বিধান নেই। যদিও উত্তম হচ্ছে একজন মুমিন অভাবগ্রস্তকে সাদাকা দেয়া তবে মানবতার খাতিরে সেটা অন্য গায়রে মুমিন কাউকে দেয়া গেলেও অধিকারের জায়গা থেকে একজন মুমিনের সম্পদে আরেকজন অভাবগ্রস্ত মুমিনেরি প্রথম হক রয়েছে। কাজেই এই ফরজ প্রদেয়গুলো অবশ্যই মুমিনদের কাছে বণ্টিত হতে হবে। আর এই বন্টন নিজের খেয়াল খুশি মত করার সুযোগ নেই। ঠিক যেমন উপরে উল্লিখিত ঘটনায় ইমামের কাছে সে লোকটি বলল যে, তাঁদের কাছে যাকাতের উতসের বাইরেও কিছু শস্য রয়েছে যা প্রয়োজনের অতিরিক্ত, তারা কি এর উপর জাকাত বের করবে? ইমাম আঃ তাঁকে তিরস্কার করে বলেছিলেন নবিজি সাঃ যেখানে সুনির্দিষ্ট করে দিয়ে গেছেন সেখানে আর কোন সুযোগ নেই এর মধ্যে কোন সংযোজন বা বিয়োজন করার।

কাজেই খুমসের অর্থ যেহেতু আল্লাহর নবির কাছেই পৌছানোর কথা বলা হয়েছে সেহেতু খুমস নবিজি জিবিত থাকা অবস্থায় উনার কাছেই পৌঁছান হত। উনার ইন্তকালের পর আহলে বাইতের ইমামগনের কাছে উক্ত অর্থ পৌঁছান হত। ইমাম হাসান আল আস্কারি আঃ এর ইন্তেকালের পর ইমামে সাহেবুল আসরী ওয়ায জামান যেহেতু নির্বিঘ্নে জীবন পার করতে পারেন্নি এবং আল্লাহর মহান ইশারায় উনাকে গায়েব করে দেয়া হয় সেহেতু উনার গায়েবাতকালিন সময়ে খুমসের অর্থ খাস চার জনের কাছে পৌছে দেবার আদেশ দেন। উক্ত চার জনই ছিলেন ইমামের “উলিল আমর”। এঁরা ইমামের পক্ষ থেকে সকল কাজ আঞ্জাম দিতেন। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সকল লেনদেন এই চারজনের সাথেই করা হত।
ইমাম আঃ পুনরায় কিছুদিনের জন্য জনসম্মুখে এলেন কিন্তু অবস্থা আগের চেয়েও খারাপ থাকায় তিনি দির্ঘকালিন গায়েবাতে চলে যান পাক রাব্বুল ইজ্জতের হুকুমে। এই লম্বা সময়ে তিনি সুনির্দিষ্ট কাউকে আর উল্লেখ করে যাননি, বরং তিনি একটি সঙ্গা দিয়েছেন যার মাধ্যমে উনার গায়েবাতকালিন সময়ে ইমামতের কাজ পরিচালিত হবে। উক্ত সঙ্গায় তিনি তাঁহার নায়েবের যোগ্যতা বর্ননা করেছেন। এই নায়েবদেরকেই প্রতিটি মুমিনের জন্য অনুসরন করতে ফরজ করে দিয়েছেন। এখান থেকেই মার্জাইয়াত ও তাক্লিদের উৎপত্তি। তাক্লিদ শব্দের অর্থ হোল অনুসরন করা। কিন্তু এই অনুসরন কোন পর্যায়ের অনুসরন এবং কাকে অনুসরন করতে হবে সেটারই একটা প্রাথমিক বিশ্লেষন নিচে দেয়া হোল।
ইমামের নায়েব কেমন হবেন সে বিষয়ে ইমামে জামানা (আঃ) নিজেই কিছু যোগ্যতা বলে দিয়েছেন যার মধ্যে অন্যতম হোল ইসলামের মুল উসুলি ও ফুরুই জ্ঞানে পান্ডিত্য অর্জনকারি হওয়া। কাজেই যে কেউ উক্ত জ্ঞান অর্জন করে এবং নিজেকে তাঁর নফসের উপর বিজয়ী করার সংগ্রামে লিপ্ত হয় এবং নিজ জাতিকে ভয় দেখায় আল্লাহর পথে ফিরে আসার জন্য তিনিই ইমামে জামানা আঃ এর রেখে যাওয়া সঙ্গা মতে আম নায়েব হবেন। উক্ত নায়েব কেবল আরবদের মধ্য থেকে হবেন না। পৃথিবীর সকল জাতি সত্তারই জাতিগত চাহিদা হচ্ছে ইমামের কাছে নিজেকে নিজ জাতির পক্ষ হয়ে উপস্থাপন করা। আর এটাই হচ্ছে নিজ নিজ জাতির পক্ষ থেকে আলেম তৈরি করার আল্লাহর হুকুম।

আর মুমিনদের পক্ষে সঙ্গত নয় যে তারা একজোটে বেরিয়ে পড়বে। সুতরাং তাদের মধ্যের প্রত্যেক গোত্র থেকে কেন একটি দল বেরিয়ে পড়ে না ধর্মে জ্ঞানানুশীলন করতে, যার ফলে তারা যেন নিজ নিজ সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে যখন তারা ফিরে আসে তাদের কাছে যাতে তারা সাবধান হতে পারে? [৯: ১২২]

খুমস কার কাছে আদায় করতে হবে?

চলবে……….

Related Post

ক্বাজা নামাজ আদায়ের নিয়ম

Posted by - January 15, 2020 0
ফজর, মাগরিব ও এশার নামাজে জোরে জোরে কেরআত পড়তে হয়। যোহর ও আসর নামাজে আস্তে আস্তে পড়তে হয়। ক্বাজা নামাজের…

ওযুর মাসআলা

Posted by - September 1, 2019 0
ওযুর ফরজ চারটিঃ ১। মুখমন্ডল ধৌত করা ২। হাত ধোয়া ৩। মাথা মাসেহ করা ৪। পা মাসেহ করা   মাসআলাঃ…

রোযার মাসআলা

Posted by - March 24, 2023 0
❇️রোযার মাসআলা নং ০১: ✍️ রমজানের পূর্ব মাস তথা শা’বান মাসের ৩০ তারিখ হচ্ছে “ইয়াওমুশ্ শাক” বা “সন্দেহের দিন”। এ…

হারাম ও মাকরুহ রোযা

Posted by - June 1, 2022 0
হারাম ও মাকরুহ রোযাঃ👇 ☆ ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন রোযা রাখা হারাম এবং যেদিন কেউ জানে না যে,…

আল-কোরআন ও হাদীসের আলোকে ইফতারের সহিহ্ সময়সীমা

Posted by - March 24, 2023 0
রোযা সম্পর্কে কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ আয়াত: يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *