🌹ঈদুল মুবাহালা সম্পর্কে ঐতিহাতিক পর্যালোচনাঃ🌹
✔ ২৪শে যিলহজ্জ্ব, মুসলিম উম্মাহ-র এক ইসলামী-ঐতিহাসিক ও ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক গুরুত্বপূর্ণ দিন। দশম হিজরীর ২৪শে যিলহজ্জ্ব-এ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম মদীনাতে আগত নাজরান প্রদেশের খৃষ্টান পাদ্রীদের প্রতিনিধি দলের প্রস্তাবে পরস্পরের প্রতি অভিশাপ বর্ষনে সাড়া দিয়ে তাদের সামনে স্বয়ং তিনি ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের সদস্যরা হাজির হন। কিন্তু খৃষ্টান পাদ্রীদের প্রতিনিধি দলটি অভিশাপ প্রাপ্ত হবার ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আল্লাহর রাসূলের কাছে নতি স্বীকার এবং জিজিয়া কর দেয়ার অঙ্গিকার করে। তখন এই বিজয়ের ফলে ইসলামের সত্যতার বিষয়টি সমগ্র আরব দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং ইসলামের শান্তির বার্তা বিস্তারে এক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছিল।
🌷ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপঃ
মক্কা ও তায়েফ অঞ্চল বিজয় এবং ইয়ামেন ও ওমানের অধিবাসীরা মুসলমান হবার পর জাযিরাতুল আরাব তথা আরব উপদ্বীপ-এর অধিকাংশ অঞ্চল ইসলামের পতাকাতলে ও আল্লাহর রাসূলের তাওহিদী হুকুমতের অধিনে চলে এসেছিল। কিন্তু এরপরো এমন কিছু আরব গোষ্ঠী ও গোত্র রয়ে গিয়েছিল, যারা ইসলামের কাছে আনুগত্য স্বীকার না করে বিভিন্ন প্রকার বিশৃংখলা ও শত্রুতামূলক কর্মকান্ড অব্যাহত রেখেছিল।
🌷নাজরান অঞ্চল হিজায ও ইয়ামেনের মধ্যবর্তি এলাকায় অবস্থিত, যা ছিল আল্লাহর রাসূলের আমলে হিজাযের একমাত্র খৃষ্টান অধ্যুষিত অঞ্চল। সেখানকার খৃষ্টানরা শ্যাম, আফ্রিকা ও রোমের কাইসার-এর সমর্থনে তখনো তাদের ভ্রান্তময় ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে টিকে ছিল। এ কারণে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম অত্র অঞ্চলের নেত্রবৃন্দের কাছে ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত পত্র প্রেরণ করেন। সেই পত্রে এও উল্লেখ ছিল যে, ইসলাম গ্রহণ করতে সম্মতি না হলে তারা বাৎসরিক জিযিয়া কর দিতে বাধ্য থাকবে।
🐪নাজরানের খৃষ্টান নেতৃবৃন্দ আল্লাহর রাসূলের পত্র সম্পর্কে পরামর্শ সভার আহ্বান জানালো এবং আরো অনেকের সাথে এ নিয়ে শলা-পরামর্শ করলো। কিন্তু অত্র অঞ্চলে ইসলামের বিরোদ্ধে অপপ্রচার ও খৃষ্টানদের দৌড়াত্বের কারণে কেউ নবীজীর প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। আর এই অচলবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে নাজরানের তিনজন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যথাক্রমে আবু হারিস ইবনে আলক্বামাহ (নাজরানের শীর্ষস্থানীয় আর্চবিশপদ এবং হিজাযে রোমের গীর্জাসমূহের আনুষ্ঠানিক প্রতিনিধি), আব্দল মাসিহ ইবনে শারাহবিল ওরফে আক্বিব (অত্র অঞ্চলের নেতা) ও আহতাম (অন্য উচ্চারণে আইহাম) ইবনে নু’মান ওরফে সাইয়িদ (একজন আশীতপর বৃদ্ধ এবং নাজরানবাসীদের সম্মানিত ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি), দশজন ব্যক্তিকে, কোন কোন প্রতিবেদন অনুযায়ী ত্রিশ জন আবার অন্য এক প্রতিবেদন অনুযায়ী নাজরানের ষাট জন খৃষ্টানকে নিয়ে মদীনাতে উপস্থিত হন যেন সরাসরী আল্লাহর রাসূলের সাথে আলোচনা করে তারা একটা সমাধানে উপনীত হতে পারেন।
সাক্ষাত অনুষ্ঠানে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে একক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদত এবং হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহর পুত্র সম্বলিত বিশ্বাস ত্যাগ করার আহ্বান জানালে তারা আল্লাহর রাসূলের সাথে অযথা বিতর্কে লিপ্ত হয়। ফলে তারা ইসলাম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। এ অচলাবস্থা থেকে বের হওয়ার একমাত্র উপায় হিসাবে তারা আল্লাহর রাসূলের কাছে মুবাহালার প্রস্তাব দেয় অর্থাৎ উভয় পক্ষ বলবে, “যারা মিথ্যাবাদী তাদের উপর আল্লাহর লানত বর্ষন হোক।” তখন হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম মুবাহালার আয়াত নিয়ে অবতীর্ণ হয়ঃ
بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمـَنِ الرَّحِيمِ.
فَمَنْ حَاجَّكَ فِيهِ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَأَبْنَاءَكُمْ وَنِسَاءَنَا وَنِسَاءَكُمْ وَأَنْفُسَنَا وَأَنْفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَلْ لَعْنَةَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ
✍উচ্চারণঃ
“ফামান্ হা-জ্ জ্বাকা ফীহি মিম্ বা’দি মা- জ্বা – আকা মিনাল্ ‘ইল্মি ফাক্বুল্তা আ’ -লাও নাদ্উ’ আব্ না- আনা ওয়া আব্ না- আকুম্ ওয়া নিসা- আনা- ওয়া নিসা- আকুম্ ওয়া আন্ ফুসানা- ওয়া আন্ ফুসাকুম্ ছুম্মা নাব্ তাহিল্ ফানাজ্ব আ”ল্ লা’নাতাল্লা-হি আ’লাল্ কা-যিবীন্।”
✍বাংলা অনুবাদঃ
“অতঃপর তোমার কাছে (ওহির মাধ্যমে) জ্ঞান আসার পর যারা [=নাজরানের খৃষ্টান পাদ্রীরা] তোমার সাথে তাঁর [=হযরত ঈসা (আ.)-এর] বিষয়ে বিতর্ক ও বিরোধ করবে (এবং শেষ নবী ও রাসূল হিসেবে তোমার প্রতি ঈমান না আনবে) তাদেরকে তুমি বলে দাওঃ “(তাহলে চুড়ান্ত সমাধান হিসেবে) এসো! আমরা আমাদের সন্তানদের [=ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন]-কে ডেকে আনি আর তোমরাও তোমাদের সন্তানদেরকে ডেকে আনো। আমরা আমাদের মেয়েদের [=হযরত ফাতেমা]-কে ডেকে আনি আর তোমরাও তোমাদের মেয়েদেরকে ডেকে আনো এবং আমরা আমাদের আপন সত্ত্বা সমতুল্য ব্যক্তিদের [=ইমাম আলী]-কে ডেকে আনি আর তোমরাও তোমাদের আপন সত্ত্বা সমতুল্য ব্যক্তিদেরকে ডেকে আনো। অবশেষে (এসো!), (তাদেরকে নিয়ে) আমরা পরস্পর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হই এবং মিথ্যাবাদীদের উপর আল্লাহ লানত বর্ষন করি।” (সূরা আলে ইমরান, সূরা নং ৩, আয়াত নং ৬১)।
🌷সতরাং উভয় পক্ষ মুবাহালাতে সম্মতি প্রকাশ করলো এবং সিদ্ধান্ত হলো অন্য একটি দিনে মদীনা শহরের বাইরে একটি ময়দানে উপস্থিত হয়ে মুবাহালায় অবতীর্ণ হবেন। নাজরানের প্রতিনিধি দলের নেতারা তাদের অনুসারীদেরকে বল্লোঃ “যদি মুহাম্মাদ সেনাপতি ও সাথীদের নিয়ে মুবাহালা করতে আসে তাহলে বুঝতে হবে, তার দুনিয়াবী উদ্দেশ্য আছে এবং নবুয়্যত ও রেসালতের কোন বিষয় এখানে নেই। তখন আমরা মুবাহালাতে অবতীর্ণ হবো। কিন্তু যদি তাঁর সন্তান ও আহলে বাইতকে নিয়ে মুবাহালা করতে হাজির হন তাহলে বুঝা যাবে তার দুনিয়াবী কোন উদ্দেশ্য নেই এবং আমাদের হেদায়াতের জন্যেই এ দাওয়াত দিয়েছেন। তখন আমরা হয় মুসলমান হয়ে যাবো অথবা অন্তঃতপক্ষে তার সাথে সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হবো।”
✔সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৪শে যিলহজ্জ্ব পৌছে গেল। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম হয়রত আলী আলাইহিস সালাম, হযরত ফাতিমা আলাইহাস সালাম, ইমাম হাসান আলাইহিস সালাম এবং ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-কে সাথে নিয়ে মদীনা নগরী থেকে বের হয়ে গেলেন এবং মদীনার বাইরে মুবাহালার জন্য নির্দিষ্ট উন্মুক্ত মরু প্রান্তরে পৌছে যান। মদীনার মুসলমানরা হযরতের পিছু পিছু আসতে লাগলেন। তখন তারা তকবীর এবং দরুদ ও সালাওয়াত-এর ধ্বণির মাধ্যমে নবীজীর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করছিলেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম শিশু ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে কোলে নিয়েছিলেন এবং ইমাম হাসান আলাইহিস সালাম-এর হাত নিজের হাতের মুঠোয় রেখেছিলেন। এ অবস্থায় ইমাম আলী আলাইহিস সালাম এবং হযরত ফাতিমা আলাইহাস সালাম নবীজীর পিছু পিছু হাঁটছিলেন। মুবাহালার ময়দানে প্রবেশের আগেই নবীজী তাঁর আহলে বাইতকে বলেছিলেনঃ “যখন আমি লানত দিবো, তখন তোমরা সাথে সাথে আমীন বলবে।”
✔নাজরানের খৃষ্টানরা আল্লাহর নবীর পূর্বেই নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হয়ে গিয়েছিল। নাজরানের প্রতিনিধি দল যখনি দেখতে পেল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নিজের সাথে তাঁর কলিজার টুকরা নিস্পাপ আপনজনদের এবং নিজের একমাত্র কন্যা সন্তানকে মুবাহালার ময়দানে নিয়ে এসেছেন তখন তারা আশ্চর্য্যাম্বিত হয়ে বিপদের সমুক্ষীন হতে যাচ্ছে এই ভয়ে মুবাহালা থেকে বেরিয়ে আসলো এবং বাধ্য হয়েই নবীজীর সাথে সন্ধি চুক্তিতে স্বাক্ষর দিল। এভাবে তারা ইসলামের মহান সত্যতার সামনে নতি স্বীকার করলো এবং জিযিয়া কর দিতে সম্মত হলো।
✔কেননা, নাজরানের খৃষ্টান প্রতিনিধি দল স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম তাঁর আহ্বান ও দোয়ার ব্যাপারে অত্যন্ত আস্থাশীল। আর তা না হলে তিনি নিজের আপনজনদেরকে কখনোই আসমানী গজবের মুখোমুখী দাঁড় করাতে পারেন না। নাজরানের প্রধান ধর্মযাজক তখন তার সঙ্গীদের উদ্দেশ্য করে বলেছিল, “আমি এমন সব পবিত্র মুখমণ্ডল দেখতে পাচ্ছি যারা দোয়া করলে অবশ্যই কবুল হবে। তারা যদি পাহাড়কে উপড়ে ফেলতে বলেন, আল্লাহ তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের দোয়ায় সাড়া দিবেন। সুতরাং এ সব আলোকিত মুখমণ্ডল এবং সুমহান মর্যাদার অধিকারী ব্যক্তির সাথে আমাদের মুবাহালা করা কখনই ঠিক হবে না। কারণ এতে করে আমাদের ধ্বংস অনিবার্য। ফলে বিশ্বের সব খৃষ্টানকে সমূলে ধ্বংস করে দিতে পারে।”
🔴 এ ঘটনা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম-এর মুজিযা প্রমাণ করার পাশাপাশি রাসূলের পবিত্র আহলে বাইত তথা আলী, ফাতিমা, হাসান ও হুসাইন আলাইহিমুস সালামের নিষ্পাপতা ও সত্যতারও সাক্ষী-প্রমাণ বহন করে।
[ইরশাদুল ক্বুলুব, হযরত শেইখ মুফিদ (রহঃ), পৃঃ নং ১৫১; আল ইক্ববাল বিল আ’মালিল হাসানাহ, হযরত সাইয়্যিদ ইবনে তাউস (রহঃ), খণ্ড ২, পৃঃ নং ৩১০; তারিখ ইবনে খালদুন, খণ্ড ১, পৃঃ নং ৪৫১; আ’লামুল উরা, আল্লামা তাবারসী (রহঃ), (ফারসী অনুবাদ), পৃঃ নং ১৯০; মুন্তাহাল আমাল, হযরত শেইখ আব্বাস কুম্মি (রহঃ),খণ্ড ১, পৃঃ নং ৯৩।]
↯↻↯↻↯