ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার খেলাফত

778 0
আহলে সুন্নাতের মাঝে অনৈক্য ও বিসংবাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার শাষন ক্ষমতাকে “খেলাফত” নামে ভ‚ষিত করা। সুন্নী বিদ্বান ব্যক্তিরা যখন হুসাইনী ঐতিহাসিক বিপ্লব সম্পর্কে পর্যালোচনা করেন, স্বাভাবিকভাবেই তারা ইয়াযিদ ও তার শাষন ক্ষমতার বৈধতা ও বৈধতার মূল সুত্রের উপর চিন্তা বিবেচনা এবং সেটাকে মূল্যায়ন ও বিচার বিশ্লেষন করে থাকেন।
 
প্রথম থেকেই তাদের একদল ইসলামী খেলাফতকে রাসূল(সা.) এর পর চারজন খলীফা ও ইমাম হাসান-এর মধ্যে নির্দিষ্ট করেছেন এবং ইমাম হাসানের খেলাফতের পর এর বৃত্তকে যে কোন ধরনের বৃদ্ধিকরণের বিষয়টি বাতিল বলে গণ্য করেছেন। এ দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থকগণ রাসূল(সা.) এর একটি হাদিস থেকে প্রমাণ পেশ এবং বুযুর্গ সাহাবী ও তাবেয়ীদের বক্তব্যকেও ব্যবহার করে থাকেন। এক্ষেত্রে আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতি বলেন: “ইবনে আবি শাইবাহ তার আল মুসান্নিফ গ্রন্থে সাঈদ ইবনে জামহান থেকে একটি বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, আমি সাফিনাকে বললাম বনি উমাইয়্যা মনে করে খেলাফত তাদেরই অধিকার। তিনি উত্তরে বলেন, যারক্বার সান্তানরা(বনি উমাইয়্যা) মিথ্যা বলে। তারা বাদশাহ। তাদের বাদশাহদের মধ্যে প্রথম বাদশাহ ছিল মুয়াবিয়া।” (আব্দুর রাহমান সুয়ুতি, তারিখুল খুলাফা, পৃ: ১৯৯; ইবনে সাব্বাগ¦ মালিকী, আল ফুসুলুল মুহিম্মা, পৃ: ১৫৫; মুহাম্মাদ আল মুবারাক, নিযামুল ইসলাম, পৃ: ৫৯; ইবনে তাইমিয়্যা, মিনহাজুস্ সুন্নাহ্, খন্ড ২, পৃ: ২৩৮-২৩৯; আস সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হাসান আত্ তারহিনী আল আমিলী, আন্ নিহযাতুল হুসাইনিয়্যা ওয়ান নাওয়াসিব, পৃ: ২৯-৩০)।
 
উপরোক্ত দলের বিপরীতে আহলে সুন্নাতের কিছু ব্যক্তি খেলাফতকে সময়ের দৃষ্টিকোন থেকে সীমাবদ্ধ করতে চাননি। আর এ কারণে তারা ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার খেলাফতের বৈধতা ও শরীয়তসম্মত হওয়ার ব্যাপারে জোড়ালো বক্তব্য পেশ করেছেন এবং ব্যক্তি খলীফার(ইয়াযিদ) বিশেষ পরিস্থিতি ও মুসলমানদের বাইয়াতের কারণে তার শাষনকে সমর্থন ও স্বীকৃতি দিয়েছেন। এ দলটি বিশ্বাস করেন মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধভাবে ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত হয়েছিলেন এবং খুব অল্প সংখ্যক লোক ছাড়া অন্য কোন মুসলমান এ বাইয়াতের বিরোধীতা করেনি। সর্বপ্রথম শ্যাম প্রদেশের জনগণ বা ঐ নগরীর আহলে হাল ওয়াল আক্বদ(বিশেষ ব্যক্তিবর্গ) বাইয়াত করেছিলেন। অত:পর বিভিন্ন শহর ও আশপাশের অঞ্চলগুলোর জনগণ বাইয়াতে অংশগ্রহণ করে। এ বিষয়টি ইবনে খালদুনও গ্রহণ করেছেন। তিনি তার গ্রন্থের যে অংশে মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে পরবর্তি খলীফা হিসেবে ইয়াযিদের নিয়োগের বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেখানে তিনি স্পষ্ট উল্লেখ করেন যে, যেহেতু ইয়াযিদের ব্যাপারে জনগণ ঐক্যবদ্ধ মতামত ব্যক্ত করেছে সেহেতু মুয়াবিয়া তার পুত্রের খেলাফতের ব্যাপারে অনুরাগ দেখিয়েছেন। তৎকালীন সময়ে আহলে হাল ওয়াল আক্বদ বনি উমাইয়্যার বংশের লোকেরাই গণ্য হতো, তাই তারা সকলে ইয়াযিদের স্থলাভিষিত্তির ব্যাপারে সমরায় ও ঐক্যবদ্ধ ছিলেন এবং ইয়াযিদ ব্যতিত তারা অন্য কারো খেলাফতের অধিনে যেতে আগ্রহী ছিলেন না। (আব্দুর রাহমান ইবনে খালদুন, মুক্বাদ্দিমাঃ তারিখে ইবনে খালদুন, অনুবাদ(ফারসী): মুহাম্মাদ পারভিন গোনাবাদী, পৃ: ৪০৩)।
তারিখুল উমাম আল ইসলামিয়্যা-এর গ্রন্থকার ইয়াযিদের বিরুদ্ধে ক্বিয়াম প্রসঙ্গে ইমাম হুসাইনের সিদ্ধান্তকে ভুল আখ্যায়িত করে বলেন: “ইমাম হুসাইন এমন সময়ে ইয়াযিদের বিরোধীতা করেছেন যখন জনগণ ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত হয়েছিলেন। তখন ইয়াযিদের পক্ষ থেকে কোন অত্যাচারের বহি:প্রকাশ ঘটেনি এবং কোন (ইসলাম) বিরোধী কাজ প্রকাশ পায়নি।” (মুহাম্মাদ আল খিযরী, তারিখুল উমাম আল ইসলামিয়্যা, খন্ড ২, পৃ: ১২৯, ১৩০)। তার চেয়েও আরো বেশী সুস্পষ্টভাবে বলেছেন মুহাম্মাদ ইযযা দারুযা। তিনি কারবালার বিপ্লবকে প্রশ্নের সমুক্ষীন করেন এবং ইয়াযিদের খেলাফত সম্পর্কে বলেছেন: “প্রকৃতপক্ষে হুসাইনের প্রতিবাদ ছিল ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার আধিপত্যের বিরোদ্ধে অসহযোগীতামূলক আন্দেলন ও ভীতি প্রদর্শন। ইয়াযিদের ক্ষমতা বিভিন্ন শহরের জনসাধারণের বাইয়াতের মাধ্যমে, দৃষ্টান্তস্বরূপ ইরাকের জনগণের মাধ্যমে অনুমোদিত হয়েছিল।” এ লেখকের বক্তব্যানুসারে তিনি ইমাম হুসাইনের বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ও দর্শন এবং ইয়াযিদের বিরোধীতা করার শরীয়তের কোন বৈধতা খুঁজে পাননি। আর ধীরে ধীরে আরেকটু আগে বাড়িয়ে বলেন, ইমাম হুসাইনও বাইয়াতকারীদের অন্যতম এবং ইয়াযিদের খেলাফতকে তিনি স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তার এ বক্তব্যের জন্যে প্রমাণ পেশ করেছেন এভাবে: “হুসাইন ইবনে আলী, মুয়াবিয়ার যে খেলাফত আহলে হাল ওয়াল আক্বদ ও সাধারণ জনগণের সমর্থনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা শরীয়তসম্মত বলে স্বীকার করেছিলেন এবং ইমাম হাসানের দাবী ত্যাগ আর মুয়াবিয়ার সাথে হুসাইন ও তার ভ্রাতাদের বাইয়াতের মাধ্যমে মুয়াবিয়ার শাষন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তদ্রুপ হুসাইন স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, ইয়াযিদের খেলাফতের ব্যাপারেও এ ধরনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। … আল্লাহর রাসূলের সাথে তার আত্মীয়তা ও খেলাফতের ব্যাপারে ইয়াযিদের মোকাবেলায় নিজেকে শ্রেষ্ঠতর মনে করার কারণে সে ইয়াযিদের মুখোমুখী হওয়া ও বাইয়াত ভঙ্গ করার সাহস পেয়েছে।” (মুহাম্মাদ ইযযা দারুযা, তারিখুল জিনস আল আরাবী, খন্ড ৮, পৃ: ৩৮২-৩৮৭)।
 
ইদানিংকালে যারা উপরোক্ত বক্তব্যের সাথে একমত পোষন করেছেন তাদের মধ্যে ড. ইব্রাহিম আলী শুউত অন্যতম। তিনি কারবালার বিপ্লবের মূল ভিত্তিসমূহকে দূর্বল করা ও ইয়াযিদের পক্ষে সমর্থন ঘোষনার লক্ষ্যে লিখেছেন: “যারা কারবালার বিপ্লবকে সমর্থন করেন না তাদের প্রথম প্রমাণ হচ্ছে যে, ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়া খলীফা ছিলেন এবং তৎকালীন ইসলামী রাষ্ট্রের মহাকেন্দ্রের (দামেশক) মুসলমানরা তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছিলেন। দামেশক মদীনার ন্যায় এবং তার অধিবাসীরা মুহাজির ও আনসারদের ন্যায় আহলে হাল ওয়াল আক্বদ ছিলেন।” (ইব্রাহিম আলী শুউত, আবাতিলু ইজিব আন তামহি মিনাত তারিখ, পৃ: ২৪৭)।
 
অন্য আরেক লেখক আরো সামনে এগিয়ে এসেছেন। তিনি ইয়াযিদের সাথে আহলে বাইতের সদস্যদের বিরোধীতা ও তাদের বিদ্রোহকে অস্বীকার করেছেন। (মুহাম্মাদ ইব্রাহিম, বারায়াতু ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়া মিন দামিল হুসাইন, পৃ: ২৩)।
উপরোক্ত বক্তব্যসমূহের সঠিক ও পরিস্কার উপলব্ধি এবং এ সম্পর্কীত মূল রহস্য উদঘাটনের জন্যে আহলে সুন্নাতের ফিকাহ্ শাস্ত্র ও ইতিহাসে ব্যবহৃত খেলাফত শব্দের অর্থ সমন্ধে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা প্রয়োজন। আর এভাবেই আমরা এ বিষয়ে অবহিত হবার পর ঐতিহাসিকভাবে অস্বীকারের অযোগ্য দলীল-প্রমাণ ও মূল পাঠসমূহের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করবো এবং ইয়াযিদের ক্ষমতা আরোহনের পথ ও পেক্ষাপটসমূহ, ইসলামী খেলাফতের সংজ্ঞা ও শর্তসমূহের সাথে তার কর্মতৎপরতা মিলিয়ে দেখে তার ব্যক্তিত্ব ও চিন্তাধারা সম্পর্কে পর্যালোচনা করবো আর পরিশেষে সত্যকে জাল ও বিকৃতির বেড়াজাল থেকে বের করে আনবো ইনশাআল্লাহ।

Related Post

খেলাফত শব্দের অর্থ-পরিচয়

Posted by - September 22, 2019 0
ঐতিহাসিক উৎসসমূহে খেলাফত ও খলীফা শব্দদ্বয়ের কোন সংজ্ঞা প্রদান করা হয়নি। আর খলীফা শব্দের ব্যাপারে শুধুমাত্র ব্যক্তিদের উপমা পেশ, তাদের…

খেলাফত হস্তান্তরের পদ্ধতি

Posted by - October 2, 2019 0
খেলাফত সমন্ধে যে সকল বিষয় মুসলিম সম্প্রদায় বিশেষত: আহলে সুন্নাতের আলেম ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে তন্মোধ্যে খেলাফতের হস্তান্তরের…

খোলাফায়ে রাশেদিন-এর খেলাফতের আসনে উপবিষ্ট হওয়ার গুণাবলী ও পন্থা

Posted by - October 4, 2019 0
অন্ত:তপক্ষে আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে খোলাফায়ে রাশেদিন বিভিন্ন দিক থেকে খেলাফতের আসনে উপবিষ্ট হওয়ার শর্তাবলী পূরণ করেছেন এবং শরয়ী পন্থা ও…

খেলাফত লাভ ও হস্তান্তরের পদ্ধতি

Posted by - October 14, 2019 0
ইয়াযিদ বনাম খেলাফতের পদপ্রাপ্তির জন্যে উল্লেখযোগ্য শর্তঃ সকল মুসলমানদের ঐক্যমতের সিদ্ধান্ত ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার পাপাচার স্পষ্ট হওয়ার মাধ্যমে আর তার…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *