ইয়াযিদের যৌবনকালঃ
আমরা উল্লেখ করেছি যে, পারিবারিক অবস্থা, বংশ, বিশেষ করে পিতা–মাতা, প্রশিক্ষকগণ, বন্ধু–বান্ধব, বসবাসের এলাকার পরিবেশ ইত্যাদি একজন মানুষের আখলাক–চরিত্র এবং মন–মানসকে প্রচন্ড আকারে প্রভাবিত করে। প্রকৃতপক্ষে, একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব, পারিবারিক উত্তরাধিকারের প্রভাবসমূহের কারণে এবং শিক্ষক, বন্ধু–বান্ধব ও পরিচিতদের উপর প্রতিষ্ঠিত পরিবেশ ও পরিস্থিতির মাধ্যমে গড়ে উঠে। এর পরও এমন কিছু লোক আছে যারা যৌবনকালে পদার্পন করার পর অর্থাৎ শৈশবের পর, যখন নতুন ও দিক নির্দেশনাকারী যৌবনের সিঁড়িতে প্রবেশ করে, তখন হঠাৎ করে অথবা ক্রমান্বয়ে দিক পরিবর্তন করে ফেলে এবং তার ব্যক্তিত্বে ও আচার ব্যবহারে ইতিবাচক বা নেতিবাচক মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার ক্ষেত্রেও উক্ত সম্ভাবনা বিরাজমান যে, সে যৌবনকালে প্রবেশের পর উদাসীনতা থেকে বের হয়ে আসতে পারে এবং বিচ্যুতি, কদর্যপূর্ণ ও অইসলামী পথ থেকে প্রত্যাবর্তন করে প্রকৃত ইসলাম ও দ্বীনি সংস্কৃতির দিকে মুখ ফিরাতে পারে।
তবে ঐতিহাসিক দলীল প্রমাণাদি অনুসারে সে তার যৌবনকালে এ ধরনের চিন্তাগত ও ব্যবহারগত পরিবর্তনের অধিকারী তো হয়নি বরং শরীয়তবিরোধী কর্মকান্ড এবং চারিত্রিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা সংঘটনে অতিশয় উদ্ধত হয়ে পড়েছিল। ইসলামী কোন দলীল প্রমাণে ইয়াযিদের তাওবা করা অথবা যৌবনকালে তার চিন্তাগত ও ব্যবহারগত পরিবর্তনের বিষয়টি লিপিবদ্ধ হয়নি। বরং এর বিপরীতে ইয়াযিদ তার খেলাফতকালে যেসব কথাবার্তা ও কর্মকান্ডের বহি:প্রকাশ ঘটিয়েছিল তা থেকে খুব ভালভাবে তার উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত ও জাহেলী আমলের সংস্কৃতি ও আদব–কায়দা স্পষ্ট হয়ে উঠে যা তার সিদ্ধান্তসমূহ ও পদক্ষেপগুলোতে বহি:প্রকাশ ঘটে।
বনি কালব গোত্রের মেয়ের সাথে ইয়াযিদের বিয়েঃ
ইয়াযিদ পরিণত বয়সে পদার্পনের পর তার শৈশব ও কৈশোরকালের কোন অনুরাগ ও চিন্তার কাছ থেকে সে বিদায় গ্রহণ করেনি। সে অব্যাহতভাবে বিভিন্ন পশুর সাথে খেলাধুলায় ব্যাকুল ছিল। তার শৈশবের বন্ধু–বান্ধব ও সাথীরা তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি এবং সে ধারাবহিকভাবে তাদের সাথে সহচর ও সহযাত্রী হয়ে জীবন পরিচালনা করতো।
যেসব বিষয় তার খৃষ্টান গোত্রের প্রতি ইয়াযিদের আগ্রহ ও সংশ্লিষ্টতাকে দৃশ্যমান করে তোলে, সেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর অন্যতম হচ্ছে উক্ত বংশের মেয়ের সাথে তার বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। বিয়ের বিষয়টি বনি কালবের সাথে ইয়াযিদের অব্যাহত সংশ্লিষ্টতা এবং সেই বংশের সমর্থিত গোত্রগত ও খৃষ্টীয় মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও শিষ্টাচারের সাথে তার ঘনিষ্টতারই বহি:প্রকাশ আর পরবর্তিতে সেই রীতি নীতি ও সংস্কৃতির প্রভাব এবং তার চিন্তাগত ও ব্যবহারিক বিচ্যুতির ধারাবাহিকতায় স্ত্রী ও তার আত্মীয় স্বজনের প্রভাবকেই প্রমাণিত করে।
উপরোক্ত ক্ষেত্র ও উপাদানগুলো পরস্পর সম্মিলিত রূপ ধারনের মাধ্যমে ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়া এমন এক ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হয় যার কারণে সে তার অন্যায়, অপরাধ, পাপ ও ব্যভিচার লুকাতে পারেনি। বরং এক রকম বাধ্য হয়েই সে প্রকাশ্যে পাপাচার করে বেড়ায় এবং দ্বীনি, চারিত্রিক ও মানবীয় সকল সীমারেখা লঙ্ঘন করে, যার কিছু অংশ আমরা ইয়াযিদের শাসনামলের অধ্যায়ে তুলে ধরবো।
ইয়াযিদের প্রকাশ্য অনাচার ও পাপাচারঃ
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয় যে, ইয়াযিদের আখলাকি ও চারিত্রিক অনাচার ও পাপাচার তৎকালীন সময়ের জনসাধারণের কাছে পরিস্কার ছিল এবং শ্যাম(সিরিয়া) থেকে প্রাপ্ত সংবাদ ইয়াযিদের অন্যায়–অবিচার ও খেলাফতের আসনে উপবিষ্ট হবার অযোগ্যতার ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহ অবশিষ্ট রাখেনি। যদিও এ বিষয়টি অনেকেই গুরুতের সাথে গ্রহণ করেনি অথবা তারা বিভিন্ন কারণে খেলাফতের পদে অধিষ্ট হওয়ার জন্যে এরকম ব্যক্তির অবতরণের বিরোদ্ধে মুখ খোলেননি। এ ব্যাপারে আল্লামা সুয়ুতি স্পষ্টভাবে স্বীকার করছেন: “মুয়াবিয়া ইয়াযিদকে তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নিয়োগ দিলো আর জনগণ তার এ কাজে সন্তুষ্ট ছিল না।”(সুয়ুতি, তারিখুল খোলাফা, খণ্ড ১, পৃঃ নং ২০৫)। ইবনে খালদুনও ইয়াযিদের পাপাচারকে এমন পর্যায়ে প্রকাশ্য ও প্রতিষ্ঠিত সত্য বলে আখ্যায়িত করেছেন যে, শুধুমাত্র ইমাম হুসাইন ও তাঁর অনুসারীরাই নন, বরং তখন সর্বসাধারণ মানুষ সকলে এ ব্যাপারে অবহিত ছিল। মুহাম্মাদ ইবনে জারির তাবারী বিভিন্ন দিক থেকে ইয়াযিদের স্থলাভিষিক্তির বিষয়ে মুয়াবিয়ার নিয়োগের প্রতিবাদ করে ইয়াযিদের প্রচন্ড সমালোচনা করেছেন এবং মুয়াবিয়ার এ পাপকে অভ‚তপূর্ব বিদআত আখ্যা দিয়ে বলেছেন:
“মুয়াবিয়া এমন চারটি কাজ করেছে যার একটিই তার পাপাচারের জন্যে যথেষ্ট। ১. জনগণের কাছ থেকে কোন প্রকার পরামর্শ ও সম্মতি ব্যতিরকেই তাদের উপর কর্তৃত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ যেখানে রাসূলের(সা.) সাহাবীরা ছিলেন যারা প্রত্যেকেই তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। ২. তার পুত্রকে খেলাফতের স্থলাভিষিক্ত করা। ইয়াযিদ প্রকাশ্যে মদ্য পান করতো এবং কোন ধরনের হারাম ও নিষিদ্ধ কাজ সম্পাদন থেকে বিরত থাকতো না। ৩. যিয়াদ ইবনে আবিহর সাথে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। ৪. হযরত হুজর ইবনে আদি ও তাঁর সাথীদের হত্যা। ক্বিয়ামতের দিনে মুয়াবিয়ার জন্যে আফসোস করছি হযরত হুজর ইবনে আদি ও তাঁর নির্দোষ সাথীদের হত্যার জন্যে!” (মুহাম্মাদ ইবনে জারির তাবারী, তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক, খণ্ড ৩, পৃঃ নং ২৫০)।
আরব ঐতিহাসিক ইয়াকুবীও উক্ত বিষয়ে বর্ণনা প্রদান করেছেন যে, ইয়াযিদ যখন মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে মুসলমানদের ভবিষ্যত খলীফা হিসেবে উপস্থাপিত হলো তখন সে বানরগুলোর সাথে ব্যস্ত ছিল, কুকুরদের সাথে খেলা করছিল, মদ পান করতো এবং অন্যায়, পাপ ও অপরাধমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত ছিল। (ইবনে ওয়াযেহ ইয়াকুবী, তারিখ ইয়াকুবী, খণ্ড ২, পৃঃ নং ২৪১)।
আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছিলাম যে, হাসান বসরী– যিনি আহলে সুন্নাতের অন্যতম প্রসিদ্ধ আলেম, তিনি মুয়াবিয়া সম্পর্কে বলেছেন: “মুয়াবিয়া এমন সব অপরাধযজ্ঞ সংঘটিত করেছে যার একটি যদি দুনিয়াবাসীর কেউ সম্পন্ন করতো তাহলে তার পাপাচারী ও জাহান্নামী হওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট ছিল।” ইয়াকুবী তার লেখার এক পর্যায়ে তাবারীর লিখিত বিষয়গুলো পুনরাবৃত্তি করেছেন এবং তিনি ইয়াযিদের মত ব্যক্তিকে খেলাফতের উত্তরাধিকার হিসেবে নিয়োগকে মুয়াবিয়ার তৎপরতার ফলাফল বলে জ্ঞান করেছেন। (সিবত ইবনে জাওযী, তাযকিরাতুল খাওয়াস, পৃঃ নং ২৮৬–২৮৭ ; ইয্যুদ্দীন ইবনে কাসির, আল কামেল ফিত্ তারিখ, খণ্ড ৩, পৃঃ নং ৩৩৭)।
ইয্যুদ্দীন ইবনে আসির তার বিখ্যাত গ্রন্থ আল কামেল ফিত্ তারিখ –এ নি¤œরূপে বর্ণনা করেছেন:
“মুয়াবিয়া তার পুত্র ইয়াযিদের পক্ষে বাইয়াত গ্রহণের জন্যে দৃঢ়ভাবে সংকল্প গ্রহণ করে এবং জনৈক ব্যক্তিকে যিয়াদ ইবনে আবির নিকট প্রেরণ করে যেনো এ ব্যাপারে পরামর্শ প্রদান করতে সক্ষম হয়। যিয়াদ, উবাইদ ইবনে কা’বকে ডেকে বলে, আমিরুল মু’মিনিন আমার কাছে চিঠি পাঠিয়েছে এবং ইয়াযিদের পক্ষে বাইয়াতের বিষয়ে লিখেছে। … মূলত সে ইয়াযিদের ব্যাপারে জনগণের ঘৃনার বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিল। আর সে জন্যেই সে জনগণকে ভয় পাচ্ছে। … ইয়াযিদ স্বয়ং অবগত যে, সে একজন চপল ব্যক্তি এবং সে শিকার ও বিভিন্ন অন্যায় কাজে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে।” (ইয্যুদ্দীন ইবনে আসির, আল কামেল ফিত্ তারিখ, খণ্ড ৩, পৃঃ নং ৩৫০–৩৫১)।
ইবনে খালদুন ইমামের বিদ্রোহ ও তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন:
“অত:পর হুসাইন এবং যে বিভেদ সংঘটিত হয়েছিল সে সম্পর্কে বলতে হয়, যেহেতু ইয়াযিদের পাপাচার ও দুষ্কর্ম তার আমলের সব মানুষের নিকট স্পষ্ট ছিল তাই কুফাবাসী রাসূলের(সা.) আহলে বাইতের অনুসারীরা এক প্রতিনিধি দল হুসাইনের নিকট প্রেরণ করে যেনো তাঁর কাছে গিয়ে তাঁর নির্দেশে রুখে দাড়াতে পারে।” (আব্দুর রহমান ইবনে খালদুন, অবতরণিকা, অনুবাদ: মুহাম্মাদ পারভিন গোনাবাদী, খণ্ড ১, পৃঃ নং ৪১৫)।
যাহাবী খেলাফত গ্রহণের পূর্বের ইয়াযিদ সম্পর্কে উল্লেখ করছে: “ইয়াযিদ রাসূলের(সা.) আহলে বাইত বিদ্বেষী, পাষান হৃদয়ের অধিকারী ও নির্দয় ছিল। সে সর্বদা মদ্যপায়ী ছিল এবং অন্যায় ও হারাম কাজগুলো বেশী করে সম্পন্ন করতো।” অনুরূপ স্বীকারোক্তি শাযারাতুয যাহাব ফি আখবার মিন যাহাব গ্রন্থের লেখক ইবনে ইমাদ হানবালী বর্ণনা ও সমর্থন করেছেন। (ইবনে ইমাদ হানবালী যাহাবী, শাযারাতুয যাহাব ফি আখবার মিন যাহাব, খণ্ড ১, পৃঃ নং ৬৯)।
মদীনার প্রতিনিধি দলের সাক্ষীঃ
ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার এতসব পাপাচার ও চারিত্রিক অপরাধ যা সকলের জন্যে জানা ছিল, তা সত্তে¡ও মুসলমানদের মধ্যে শুধুমাত্র হাতের আঙ্গুলের সমান সংখ্যক লোক মুয়াবিয়া ও তার নিয়োগকৃত গভর্নরদের অপকৌশলে প্রভাবান্বিত না হয়ে স্পষ্টভাবে ইয়াযিদের স্থলাভিষিক্তির বিরোধীতা করেছিল। তারা কখনো ইসলামী খেলাফতের পদের জন্যে ইয়াযিদকে যোগ্য মনে করতেন না। এসব ব্যক্তিদের মধ্য থেকে আবার কিছু লোক ভয়–ভীতি প্রদর্শনের কৌশলে আটকে পড়ে যায় আর কিছু লোকের মধ্যে লোভের কৌশল কার্যকরী হয়ে যায়। ফলে তারা কিছুদিন পর থেকেই প্রকাশ্য বিরোধীতা অথবা সংগ্রাম থেকে পিছু হটে যায় এবং একমাত্র ইমাম হুসাইন আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে বিরোধীতার পথে অনমনীয় থাকেন।
যেখানে ইমাম হুসাইনের জীবদ্দশায় মদীনার জনগণ ইয়াযিদের স্থলাভিষিক্তির বিপর্যয়ের গভীরতা ও তার চারিত্রিক অনাচারের ব্যাপারে গুরুত্ব প্রদান করেনি, সেখানে অল্প কিছুকাল পরেই তারা একটি প্রতিনিধি দল শ্যামের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করে যেন কাছ থেকে ইয়াযিদের অবস্থার প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে পারে। এ প্রতিনিধি দল হানযালা–রাসূলের(সা.) নেতৃত্বে যুদ্ধে যার শাহাদাতের পর তার লাশ ফেরেস্তারা ধৌত করে এবং তখন থেকে তাকে আরবীতে গ্বাসিলুল মালা–ইকা বলে সম্বোধন করা হতো, সেই হানযালার পুত্র আব্দুল্লাহ্ (আব্দুল্লাহ ইবনে হানযালা) –এর নেতৃত্বে কিছুদিন শ্যামে অবস্থানের পর মদীনাতে প্রত্যাবর্তন করে এবং তাদের দর্শনীয় বিষয়গুলো জনগণের কাছে বর্ণনা করে। ইতিহাসে এসেছে: “তারা ইয়াযিদকে মদ পান করা ও বানরের সাথে খেলারত অবস্থায় দেখে। যখন তারা মদীনায় ফিরে আসলো তখন তারা তাদের দর্শনীয় তথ্য বর্ণনা করে এবং ইয়াযিদকে লানত ও গালমন্দ করতে থাকে। অত:পর তারা তাকে খেলাফতের পদ থেকে বহিস্কার করে এবং মদীনার ইয়াযিদের নির্বাহী উসমান ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবি সুফিয়ানকে মদীনা থেকে বের করে দেয়। তারা বলে: আমরা এমন এক ব্যক্তির কাছ থেকে এসেছি যার কোন দ্বীন ধর্ম নেই, যে মদ পান করে, যে সর্বদা মাতাল থাকে এবং কখনো সালাত আদায় করে না।” মদীনাবাসীরা উক্ত প্রতিবেদনটি শ্রবনের পর আব্দুল্লাহ্ ইবনে হানযালার হাতে বাইয়াত করে। সেও মদীনার জনসাধারণের উদ্দেশ্যে বলে: “হে জনগণ! আল্লাহর কসম করে বলছি, এমন সময় আমরা ইয়াযিদের বিরোদ্ধে ক্বিয়াম করেছি যখন আসমান থেকে (আল্লাহর আযাবস্বরূপ) পাথর নিক্ষেপ হওয়ার ভয় করতে লাগলাম। সে এমন ব্যক্তি যে তার মাহরামদের সাথে যৌন ক্রিয়ায় লিপ্ত হয় এবং এক্ষেত্রে কখনো মুয়াবিয়ার স্ত্রীরা, কন্যারা ও বোনরা ইয়াযিদের হাত থেকে নিরাপদ নয়। সে সর্বদা মদ্য পানে লিপ্ত থাকে এবং সালাত তরক করে। যদি আমরা তার বিরোদ্ধে বিদ্রোহ না করি, তাহলে আল্লাহর কসম! আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে বড় ধরনের বালা–মুসিবতের সমুক্ষীন হবো।” (সিবত ইবনে জাওযী, তাযকিরাতুল খাওয়াস, পৃঃ নং ২৮৮)।
ইয়াযিদের পাপাচারের ব্যাপারে আশুরা বিদ্রোহের বিরোধীদের স্বীকারোক্তিঃ
আহলে সুন্নাতের কতিপয় উচ্চ পর্যায়ের আলেমরা ইমাম হুসাইনের ক্বিয়ামের বিরোধী ছিলেন। তন্মোধ্যে ইবনে আব্বাস, ইবনে উমার প্রমুখদের নাম উল্লেখযোগ্য। এসকল ব্যক্তিরা চেষ্টা করেছিলেন ইমাম হুসাইনকে বিদ্রোহ থেকে সরিয়ে আনতে। তাই, তারা অনবরত তাদের বক্তব্যে ও উপদেশবলীতে ক্বিয়ামের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়নি বলে স্মরণ করিয়ে দিতেন। তবে তারা কখনো ইয়াযিদের ন্যায়পরায়নতা ও তার খেলাফতের বৈধতার ব্যাপারে একটি কথাও বলেননি। তারা ইমাম হুসাইনের ক্বিয়ামের বৈধ্যতা ও শরীয়ত সম্মতির উপর কোন প্রশ্ন তুলেননি। এ সকল বিষয় স্বয়ং ইয়াযিদের পাপাচার এবং ইসলামী খেলাফতের জন্যে তার ন্যায়পরায়নতা ও যোগ্যতার অনুপস্থিতিরই সাক্ষ্য বহন করে।
প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ ইবনে আসাকের– যিনি রাসূলের(সা.) পবিত্র মুখ থেকে ইমাম হুসাইনের বিভিন্ন প্রকার গুণ ও মর্যাদার বর্ণনা করেছেন এবং তার প্রতিবেদন আহলে সুন্নাতের সর্ব বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও রিজালশাস্ত্রবিদগণ দৃঢ়ভাবে গ্রহণ ও বর্ণনা করেছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ সিবত ইবনে জাওযি তাযকিরাতুল খাওয়াস গ্রন্থে, ইবনে হাজার আসক্বালানী লিসানুল মিযান পুস্তকে, যাহাবী তাহযীবুল কামাল কিতাবে ও ইফসুফ মাযি সিয়ারু আ’লামিল নুবালা গ্রন্থে উক্ত প্রতিবেদন উল্লেখ করেছেন। তিনি ইয়াযিদ কর্তৃক আবৃত কবিতার নিম্নেœর পংতিগুলো উল্লেখের পর ইয়াযিদকে কাফের বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং এ কবিতাকে তার কুফুরীর সুস্পষ্ট প্রমাণ ও সন্দেহাতীত দলীল বলে ঘোষনা দিয়েছেন। (ইবনে ইমাদ হানবালী, শাযারাতুয যাহাব, খণ্ড ১, পৃঃ নং ৬৯)। ইয়াযিদের উক্ত কবিতার পংতি দুটি হচ্ছে:
لَيْتَ اَشْيَاخِي بِبَدْرٍ شَهِدُو جَزْعُ اْلْخَزْرَجِ مِنْ وَقْعِ اْلْأَسْلِ
لَعِبَتْ هَاشِمُ بِاْلْمُلْكِ فَلاَ مُلْكٌ جَاْءَ وَ لاَ وَحْيٌ نَزَلَ
অর্থাৎ: “বনি হাশিমরা ক্ষমতা নিয়ে খেলা করেছে
কোন ক্ষমতাই তাদের জন্যে নির্ধারিত না,
কোন প্রত্যাদেশ(ওহি)ও অবতীর্ণ হয়নি।”
ইবনে হাজার আসক্বালানী ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়াকে সাহাবীদের মধ্যে গণ্যকারীদের বক্তব্যকে খন্ডন করে ইবনে আসাকেরের লেখনীর প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। তিনি ইবনে আসাকেরের বক্তব্যকে গ্রহণ করে স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন: “ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়া কখনো ন্যায়বিচারের অধিকারী নয়। এ কারণে সে রেওয়্যাত বর্ণনার যোগ্যতা রাখে না।” তিনি তার লেখনীর এক পর্যায়ে নবী(সা.)- এর নিকট থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন, যা খেলাফতের জন্যে ইয়াযিদের অযোগ্যতা ও দ্বীন ইসলাম হতে তার বিচ্যুতিরই বহি:প্রকাশ মাত্র। (ইবনে হাজার আসক্বালানী, লিসানুল মিযান, খণ্ড ৬, পৃঃ নং ২৯৩–২৯৪)।
কতিপয় ঐতিহাসিক ও ইতিহাস লেখক ইয়াযিদের অন্যায়–অবিচার ও পাপাচারকে এমন নিশ্চিত, অকাট্য ও সন্দেহাতীত একটি বিষয় বলে আখ্যায়িত করেছেন যার ফলে তারা সে ব্যাপারে কোন উক্তিই করেননি। এ দলটি খেলাফতকে কোনক্রমে বনি উমাইয়্যাদের অধিকার বলে গণ্য করেননি এবং তাদেরকে সামগ্রিকভাবে অমুসলমান মনে করতেন অথবা প্রথম থেকেই আবু সুফিয়ান ও তার সঙ্গী–সমর্থকদের ইসলাম গ্রহণকে ধোকাবাজি মনে করতেন। তারা বলেন: “আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণের পরও মুর্তি পূজা থেকে বিরত থাকেনি এবং হুনাইনের যুদ্ধে গোপনে আযলাম (জাহেলী যুগের মূর্তির নাম) নিজের সাথে বহন করেছিল। সে ইয়ারমুক–এর যুদ্ধে কবিতার এমন সব পংতি আবৃতি করেছিল যা তার জাহেলিয়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার বিষয়টিই প্রমাণ করে।
ইবনে মানযুর– যিনি অষ্টম শতাব্দির অন্যতম বিজ্ঞ আলেম ছিলেন, তিনি মুখতাসারু তারিখে দামেশক গ্রন্থে এবং ইবনে আসাকের তার বিখ্যাত গ্রন্থ তারিখে দামেশক–এ ইয়াযিদের ন্যায়বাদিতার(আদালাত) বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে বলেছেন: “সে রেওয়্যাত বর্ণনা করার যোগ্যতা রাখে না এবং এর জন্যে সে উপযুক্ত নয়।” (মুহাম্মাদ ইবনে মুর্কারাম ইবনে মানযুর, মুখতাসারু তারিখে দামেশক, খণ্ড ২৮, পৃঃ নং ১৯–১৯)। যাহাবী, ইয়াযিদের প্রকাশ্য পাপাচার ও অনাচার সবার নিকট পরিস্কার ছিল বলে জ্ঞান করেছেন। তাই, তিনি ইয়াযিদের কুফুরির উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার ব্যাপারে তার আবৃত কিছু কবিতা বর্ণনাই যথেষ্ট মনে করেছেন। তিনি বলেছেন: “বনি উমাইয়্যা বংশের একজন কৃতদাসী ইয়াযিদের উপস্থিতিতে তাকে উদ্দেশ্য করে নিম্নেœর পংতিটি আবৃত করেছিল:
لَسْتَ مِنَّا و لَيْسَ خَالَكَ مِنَّا يَا مُضِيْعَ اْلْصَّلاَةِ لِلْشَّهَوَاْتِ
অর্থাৎ: “হে ইয়াযিদ! তুমি আমাদের মধ্যে নও এবং তোমার মাতার বংশের লোকেরা মুসলমান নয়। হে তুমি! যে যৌন কামনা চরিতার্থ করা ও পাপ কার্য সম্পাদন করার জন্যে সালাত পরিত্যাগ করেছো!” (যাহাবী, তারিখুল ইসলাম, খণ্ড ৫, পৃঃ নং ২৭৩)।
আল আক্বদুল ফারিদ গ্রন্থে মুসাভ্ভার ইবনে মুখরামাহ্– যিনি একজন সম্ভ্রান্ত ও মহৎ ব্যক্তি ছিলেন, তার কাহিনী উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি ইয়াযিদ সম্পর্কে বলতেন: “সে শরাব পান করতো।” এ সংবাদ ইয়াযিদের কানে পৌছলে সে মদীনার গভর্নরকে নির্দেশ দিলো মুসাভ্ভার–এর উপর হাদ্ (শাস্তিমূলক বিধান) জারী এবং বেত্রাঘাতে জর্জরিত করতে। ইয়াযিদের নির্বাহী সে কাজটি সঠিকভাবে সম্পাদন করলো। মুসাভ্ভার বেত্রাঘাত খাওয়ার পর বলে: “ইয়াযিদ মদ পান করে আর মুসাভ্ভার–এর উপর তার শাস্তির মহড়া চলে।”
একই সুত্রে আহনাফ ইবনে ক্বাইস–এর ব্যাপারেও উল্লেখ আছে যে, তিনি এক অনুষ্ঠানে মুয়াবিয়ার সামনে উপবিষ্ট ছিলেন, যেখানে উপস্থিত ব্যক্তিরা ইয়াযিদ সম্পর্কে আলোচনা করছিলো। মুয়াবিয়া আহনাফের দিকে লক্ষ্য করে বলে, হে আবা বাহর! কেন আপনি নিশ্চুপ আছেন এবং কিছু বলছেন না? আহনাফ উত্তরে বলেন: আমি সত্য কথা বলতে আপনাকে ভয় পাচ্ছি আর মিথ্যা বলতে গিয়ে আল্লাহকে ভয় করছি। (আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবদে রাব্বিহ আল আনদালুসী, আল আক্বদুল ফারিদ, খণ্ড ৪, পৃঃ নং ২৮, ৩২, ১৫০)। আহলে সুন্নাতের মূল উৎসগুলোতে উদ্ধৃত উক্ত ঐতিহাসিক বর্ণনাগুলো ইসলামী খেলাফতের জন্যে ইয়াযিদের অযোগ্যতা ও তার পাপাচারের–ই প্রমাণ বহন করে আর এ ব্যাপারে অন্য কোন প্রকার সন্দেহ অবশিষ্ট থাকে না। (আহমাদ আল মাক্বরিযি, আন নিযাওয়াত তাখাসুম ফিমা বাইনা বানি উমাইয়্যা ওয়া বানি হাশিম, পৃঃ নং ২৯)।
ইয়াযিদের কুফুরী ও ধর্মহীনতাঃ
আহলে সুন্নাতের বহু আলেম আরেকটু সামনে এগিয়ে এসে কথা বলেছেন। তারা সরাসরীভাবে ইয়াযিদের কুফুরীর উপর হুকুম দিয়েছেন এবং এ বিষয়টিকে বিভিন্ন প্রকার যুক্তি– দলীলের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন। এ ধরনের জ্ঞানী ব্যক্তিদের মতে ইয়াযিদের উপর অভিশাপ(লানত) দেয়া জায়েয ও বৈধ আর ইয়াযিদের উপর অভিশাপ প্রদানের বিরোধীরা অনাচার(ফাসেক্ব) বলে পরিগণিত।
আবু মুযাফ্ফার শামসুদ্দীন সিবত ইবনে জাওযী হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দির একজন বিজ্ঞ আলেম হিসেবে খ্যাত ছিলেন। তিনি বর্ণনা করেছেন যে, আমার পিতামহ আবুল ফারাজ ইয়াযিদকে তিরস্কার ও তার উপর লানত দেয়ার বিরোধী কিছু ব্যক্তিদের মতামতকে খন্ডন করে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং সেই গ্রন্থের নাম দিয়েছেন আর রাদ্দু আ’লাল মুতাআ’সসেবেল আ’নিদ আল মানেয়’ মিনায্ যাম। তিনি উক্ত গ্রন্থে ইয়াযিদের কুফুরী ও বিশ্বাসহীনতা এবং তার উপর অভিশাপ প্রদানে বৈধতার বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন: “ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার উপর একমাত্র আমিই অভিশাপ বর্ষন করি না, বরং আহলে সুন্নাতের পরহেজগার আলেমরা সকলে বিশেষ করে আহমাদ ইবনে হাম্বাল উক্ত কাজ করতে অনুমতি প্রদান করেছেন। সে প্রকৃতপক্ষে ইয়াযিদ সম্পর্কে এমন কথা বলেছেন যা লানত দেয়ার চেয়েও উর্দ্ধে। আমার পিতামহ আরো বলেন, … ইয়াযিদ সম্পর্কে আমি আহমাদ ইবনে হাম্বালকে প্রশ্ন করলাম, তিনি বলেন, ইয়াযিদ এমন ব্যক্তি যে মদীনা ধ্বংস করেছে। অত:পর তিনি এরকম অপরাধকারীদের ব্যাপারে রাসূলের(সা.) একটি হাদিস উল্লেখ করেন।” (প্রাগুক্ত, পৃঃ নং ২৮৭; ইবনে আসির, আল কামেল ফিত্ তারিখ, খণ্ড ৩, পৃঃ নং ৩৩৭; ইবনে হাজার আসক্বালানী, লিসানুল মিযান, খণ্ড ৬, পৃঃ নং ২৯৩–২৯৪)।
তিনি ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বালের কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আহমাদ ইবনে হাম্বাল কোন ব্যক্তিকে অভিশাপ ও লানত দেয়ার ব্যাপারে এতসব সাবধানতা অবলম্বন ও আত্মসংযম করার পরও ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার উপর লানত দিতেন এবং তাকে হাদিস বর্ণনা করার যোগ্য মনে করতেন না। তদ্রুপ আহলে সুন্নাতের বিভিন্ন মাযহাবের আরো অনেক আলেমরা আছেন যারা মুসলিম ভুখন্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করতেন, তারা সবাই বিভিন্ন সময়ে ইয়াযিদের উপর লানত দিতেন আর ইয়াযিদের উপর লানত দেয়াকে ইসলামী কর্তব্য ও ইবাদত বলে গণ্য করতেন যার ব্যাপারে পরে আলোচনা করা হবে।