ইসলামী মাযহাব ও তার বৈশিষ্ট্য

1216

ইত্যপূর্বেকার আলোচনা থেকে এটা দিব্যলোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, নবী (সা.) কর্তৃক মনোনীত খলিফা ব্যতীত মানুষের নির্বাচিত খলিফাদের অনুসরণ কোনক্রমেই সুন্নতের অনুসরণ বলে গন্য হতে পারে না ।

অতএব নবী (সা.) এর সুন্নতের অনুসারী সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবেয় তাবেয়ীন এবং তাদের পরবর্তীকালের জনগন আহলে বাইতের অনুসারী ছিলেন । আর বর্তমান যুগের ইমাম, আহলে বাইতের বার ইমামের সর্বশেষ মহাপুরুষ । বার ইমামের অনুসারী হওয়ার জন্য নবী (সা.)এরই তাগিদ রয়েছে । তাদের কর্মপন্থা, রীতিনীতি ও জীবন –চরিত সকল কিছুই ছিল নবী (সা.) এর সুন্নাতের-ই চরম পরাকাষ্ঠা । তারা ছিলেন নবীজির সুন্নতের বহিঃপ্রকাশ ।

কিন্তু দূর্ভাগ্যবশতঃ আমরা মুসলমানরা আজ বিভিন্ন মাযহাবে বিক্ষিপ্ত । মুসলমান জাতি আজ শিয়া সুন্নীতে দ্বিধা বিভক্ত । আবার সুন্নীদের রয়েছে চার মাযহাব । আসলে আমরা কি কখনো খুটিয়ে দেখেছি এ সুন্নী মাযহাবসমূহের আবির্ভাব কিভাবে হয়েছে ? এ বিষয়ে ইমামিয়া মাযহাবের কোন গ্রন্থের উদ্ধৃতি না টেনে বাংলাদেশের বহুল পরিচিত ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশনের’ প্রকাশিত একটি পুস্তক থেকে উদ্ধৃতি প্রদান-ই যথাযথ মনে করছি । সেখানে এভাবে বলা হয়েছেঃ

“আব্বাসীয় আমলটা ছিল নানা দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ । এই আমলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন মতবাদ রূপ লাভ করে । সুফী ও শরীয়তের ইমামগন আত্মপ্রকাশ করতে থাকেন । বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুবাদ হয় আরবীতে, গ্রীক দর্শন ইসলামী চিন্তার উপর গভীর ও সূদুর প্রসারী প্রভাব বিস্তার করে । এই সময়ের মধ্যেই ইসলামী সমাজ, রাষ্ট্র ও চিন্তা যে রূপ পরিগ্রহ করে, তাকে অনুসরন করেই শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে মুসলমান গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে চলে । সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও নিচে আমরা সে সব অবস্থার রূপ ও পরিনতি কি হয়েছিলো তা দেখতে প্রয়াস পাব ।

দ্বিতীয় আব্বাসীয় খলিফা মানসুরের সময় ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ইসলাসের অবিকৃত রূপ ও তার সমাজ ব্যাবস্থার পরিবর্তনের উপর মত প্রকাশ করেন । আবু হানিফার জনপ্রিয়তা ও প্রভাব দেখে মনসুর তাকে কুক্ষিগত করার প্রয়াসে বাগদাদের প্রধান বিচারপতির পদ প্রদান করেন । আবু হানিফা (রহ.) এই প্রস্তাব অস্বীকার করায় মনসুর তাকে কারারুদ্ধ করেন, কারাগারেই আবু হানিফার মৃত্যু হয় । সুন্নী মতবাদের আরেক জন প্রচারক ইমাম মালেক (রহ.) কেও বেত্রাঘাতে জর্জরিত করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় । এই ভাবে কুরআন ও রাসুলুল্লাহর অনুসারী দু’জন শরীয়তের ইমামের মুখ বন্ধ করে দেয়া হয় । এই সময় মদীনায় খাটি ইসলামী চিন্তার দার্শনিক ও মর্মগত দিক ব্যাখ্যা করে বলেছেন ইমাম জা’ফর সাদেক (আ.) । হযরত আলীর (আ.) প্রপৌত্রের এমন ধর্ম ব্যাখ্যা মনসুরকে বিচলিত করল । মনসুর ইমাম জা’ফর সাদেকের রাজসভায় আহব্বান করে তাকে হত্যা করার সংকল্প করলেন । কিন্তু ইমাম জাফর সাদেকের সঙ্গে কথা বলে খলিফা যখন বুঝতে পারল যে, সাধকের প্রচেষ্টা প্রধানত সমাজ নয়, ব্যক্তিগত ও আত্মিক উৎকর্ষেরই তিনি প্রচারক, তখন ইমাম জা’ফর সাদেককে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দেওয়াই তার কাছে যুক্তিযুক্ত বলে বিবেচিত হয় । তবে মনসুর সেই সঙ্গে এ কথাও বুঝতে পারলেন যে, তার রাজবংশের স্থায়িত্বের জন্যে প্রয়োজন এক সুদৃঢ় মতবাদের । সেই মতবাদ কুরআন ও সুন্নাহকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করবে যা তার স্বার্থের প্রতিকুল নয় । তেমন মতবাদ তিনি তার অনুগত আইনজ্ঞদের দ্বারা করিয়ে নিলেন ও সেই মতবাদের নাম দিলেন সুন্নী মতবাদ । এই মতবাদের মধ্যে নবী বংশের দাবীর কথা যেমন নেই, তেমনই রাসূলু্ল্লাহর (সা.) ও তার অব্যবহিত দুই খলিফার সময়কার সমাজ ব্যবস্থার কথাও নেই । পরবর্তীকালে খলিফা হারুনুর রশীদের সময়ে সাম্রাজ্যের প্রধান বিচারপতি আবু ইউসুফের নেতৃত্বে এক আইনজ্ঞ দলের সহায়তায় ইমাম আবু হানিফার নাম দিয়ে হানাফী মাযহাবের ধর্মীয় বিধি সুস্পষ্ট আকার ধারন করতে থাকে । তাতেও ব্যক্তিগত আচার অনুষ্ঠান ও এমন সামাজিক সমস্যা প্রাধান্য লাভ করে যাতে রাজবংশের স্থায়িত্ব ও সমাজের সামন্তবাদী প্রকৃতির পরিবর্তন করার কোন প্রচেষ্টার ইঙ্গিতমাত্র নেই । পরবর্তী মাযহাবগুলোকেও এমনি ভাবে রাজতন্ত্রের ও সমাজতন্ত্রের পরিপোষক রূপে ছাটাই করে ছাড়পত্র দেওয় হয় ।৭৯

এখন দেখুন সুন্নী মাযহাবগুলো এমন সব জালেম রাজা বাদশাহরা তৈরী করেছেন যাদের কালো হাত রঞ্জিত হয়েছে ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মালিকের ন্যায় আরো বহু জ্ঞানী গুনী ইসলামী ব্যক্তিদের রক্ত লালীমায় । আর আমরা গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে চলছি আর দাবী করছি নবীর সুন্নতের অনুসারী হিসেবে । তাই আজকে আমাদেরকে আহলে বাইতের তরীতে আরোহন করে ইহকাল ও পরকালের নাযাতের ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজন ।

Related Post

খলিফা নির্বাচনের পদ্ধতি

Posted by - নভেম্বর ২৫, ২০১৯
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর পরলোকগমণের পর সাহাবীগণ কর্তৃক প্রথম খলিফা হিসাবে হযরত আবু বকরের নিয়োগ এবং তার পক্ষে…

হযরত আবু বকরের খেলাফত লাভ ও খেলাফতের প্রতি মা ফাতিমার অস্বীকৃতি

Posted by - নভেম্বর ২৯, ২০১৯
হযরত আবু বকরের খেলাফত লাভ: কথিত যে, নবী করিম (সা.) হযরত আবুকবরকে খেলাফত দিয়ে গেছেন । তিনি হযরত আবুবকরকে নামাজের…

আহলে বাইত

Posted by - জুন ২, ২০২০
নবী করিম (সা.)-এর আহলে বাইতকে ভালবাসার ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই । তবে আহলে বাইত কারা– এ ব্যাপারে যথেষ্ট…

মানব জীবনে নেতার গুরুত্ব

Posted by - নভেম্বর ২৫, ২০১৯
পবিত্র আল কোরআনে আল্লাহ বলেন, يَوْمَ نَدْعُو كُلَّ أُنَاسٍ بِإِمَامِهِمْ অর্থাৎঃ-“ক্বিয়ামতের দিবসে প্রত্যেক জনগোষ্ঠিকে তাদের ইমামদের সাথে ডাকা হবে ।”১…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »