ইরানের গণ বিষ্ফোরণ ও তৃতীয় বিপ্লব

912

বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম।

প্রথম বিপ্লবঃ তাগুতী ও মার্কিনীদের দোসর রেজা শাহ পাহলাভীর রাজত্ব উৎখাত করে ইসলামী বিপ্লবকে সফলতায় পৌছানো।

দ্বিতীয় বিপ্লবঃ তেহরানস্থ মার্কিন দুতাবাস (মার্কিনী গুপ্তচরদের আড্ডাখানা) দখল এবং দূতাবাসের কর্মচারীদের (মার্কিনী গুপ্তচরদের) বিতাড়িত করে ইরানকে আভ্যন্তরীন ষড়যন্ত্র থেকে মুক্ত করার মাধ্যমে দ্বিতীয় বিপ্লবে সফলতা।

তৃতীয় বিপ্লবঃ শহীদ জেনারেল কাসেম সোলাইমানীর শাহদাতের কারণে ইরানীদের মধ্যে গণজাগরণ সৃষ্টি এবং এমেরিকানদের সাথে সকল ধরনের আপোষ চীরদিনের জন্যে বন্ধের মাধ্যমে আরেকটি বিপ্লবের সফলতা।

৩রা জানুয়ারী ২০২০ থেকে আজ ৮ জানুয়ারী ২০২০ সকাল পর্যন্ত ইরানের সর্বস্তরের জনগণ প্রতিটি ছোট বড় শহর- বন্দরে দিন-রাত সর্বাত্মক উপস্থিতি প্রদর্শন করেছে যা বিশ্বে সত্যি একটি বিরল বিষ্ফোরণ ও বিপ্লব। এ গণ বিষ্ফোরণ শুরু হয়েছিল ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করণে এ অঞ্চলে বিশ্ব খেদক, আগ্রাসী ও সন্ত্রাসী মার্কিন বাহিনীর ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের বিরোদ্ধে সকল প্রতিরোধ আন্দোলনের আবিসংবাদিত নেতা এবং ইরানী দেশ ও জাতীর প্রাণপ্রিয় ও নিংস্বার্থ সেবক ও সর্দার জেনারেল কাসেম সোলাইমানীর নির্মম শাহাদাতের মাধ্যমে।
জেনারেল কাসেম সোলাইমানী ইরানের অন্যতম সর্বোচ্চ শক্তিধর ব্যক্তি হবার পরও ছিলেন জাতির প্রতি নিংস্বার্থ সেবক। তিনি তার জাতিকে অন্তর দিয়ে ভালবাসতেন। তাঁর শিষ্টাচার ছিল নমনীয়তায় পরিপূর্ণ। তার সাদাসিদে ও নিরহঙ্কারী জীবন ছিল অত্যন্ত অকার্ষনীয় একটি দিক।

অন্যদিকে নিষ্ঠুরতার চরম সীমায় পৌছে আন্তর্জাতিক সকল আইন লংঘন করে ইরাকে নিয়োজিত বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী ও সন্ত্রাসী মার্কিন সামরিক বাহিনীকে জেনারেল সোলাইমানীর হত্যার নির্দেশ দেয় সরাসরী সন্ত্রাসী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প।

এসব কারণে ইরানী জাতি যখন দেখতে পায়, তাদের জাতির অহংকার, গৌরব ও গর্বের উপর আঘাত করেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের ভালবাসার মানুষটির উপর নৃশংস ও নিষ্ঠুর হামলা করেছে বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি মদখোর ও জুয়া খোলোয়াড় ট্রাম্প, তখন আর ইরানীরা সহ্য করতে পারে নাই। তারা তখন নিজেদের ভিতরকার সকল রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে রাজপথে নেমে এসেছে। আট কোটি ইরানীই ছিল রাজ পথে। সর্বস্তরের মানুষের এরকম গণ বিষ্ফোরণ ইরানী ইতিহাসে নজিরবিহীন।

রাজপথে ইরানিদের মধ্যে কমন কতগুলো বিষয় প্রদর্শিত হয়েছে যা আমরা নিচে তুলে ধরছিঃ

১। সব ইরানীদের অশ্রু ঝরেছে।

২। সবার মধ্যে ছিল এমেরিকার প্রতি ক্ষোভ ও আক্রোশ।

৩। সবাই অবাক হয়ে দেখেছে, তাদের জেনারেলের প্রতি এত ভালবাসা যে, তারা নিজেরাও কখনো আগে এমনটি ভাবেনি। সেই ভালবাসা প্রকাশ পেয়েছে রাজপথে নেমে।

৪। সবার একটি কথাই ছিল, কঠিন প্রতিশোধ নিতে হবে।

যদিও ইরানী ও মুসলিম জাতিসমূহের জন্যে কাসেম সোলাইমানীর শাহাদাত একটি অপূরণীয় ক্ষতি, তারপরো বলতে হয়, যেমনি তিনি তাঁর জীবদ্দশায় ছিলেন সকল মুক্তিকামী সন্ত্রাস বিরোধী মানুষের জন্যে রহমতস্বরূপ তেমনি তার শাহাদাতও ইরানী জাতি ও প্রতিরোধ আন্দোলন ও তাদের সমর্থকদের জন্যে আরো রহমতে পরিপূর্ণ ও বরকতময়। এর কয়েকটি বরকত নিচে উল্লেখ করছিঃ

১। ইরানী জাতির মধ্যে নজিরবিহীন ঐক্য সৃষ্টি।

২। আহলে বাইত ও সর্বোচ্চ নেতার অনুগত আল্লাহওয়ালা ও দেশপ্রেমী একজন জেনারেল ও তাঁর শাহাদাতের প্রতি সর্বস্তরের মানুষের সম্মান প্রদর্শন- ইরানী জাতির মধ্যে এর নজীর থাকলেও, এরকম সর্বোচ্চ পর্যায়ের ঐক্য, ভালবাসা, জোশ ও প্রতিশোধ স্পৃহা একটি ভাল প্রথা ও দৃষ্টান্ত হিসেবে ইরানী জাতির মধ্যে বিরাজ করবে।

৩। ইসলামী বিপ্লব পন্থি ও দেশ প্রেমিক ইরানীদের মধ্যে এমেরিকাকে নিয়ে আর কোন মতনৈক্য থাকলো না। মার্কিনীদের আর কেউ বিশ্বাস করবে না। তারা সবাই মার্কিন সরকার ও তাদের দোসরদের চিরশত্রু হিসেবে গণ্য করবে। যে কাজটি বছরের পর বছর সর্বাত্মক প্রচার করেও অর্জন করা সম্ভব ছিল না, তা জেনারেল কাসেম সোলাইমানীর শাহাদাতের পবিত্র রক্তের বদৌলতে সম্ভবপর হয়েছে।
৪। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর এমেরিকা বিশ্ব শক্তিধর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে । তখন থেকে এ পর্যন্ত এমেরিকা এককভাবে সামরিক ও অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে তার গায়ে কেউ আচড় দিতে পারেনি। কিন্তু ইরানের আট কোটি জনগণ সম্মিলিতভাবে এক কণ্ঠে যে প্রতিশোধের আওয়াজ তোলে তা বাস্তবায়ন করার জন্যে ইরানী সামরিক বাহিনী আর কোন দ্বিধাদন্দে থাকলো না। এই প্রতিশোধ শুরু হয়ে আজ সকাল থেকে। এটা একটা বরকতময় অর্জন।

৫। ইরানের জনপ্রিয় জেনারেল কাসেম সোলাইমানীর শাহাদাতের মাধ্যমে এমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে তার শয়তানী শক্তি খর্বের দিন শুরু হলো। অপমানজনকভাবে মার্কিনীদের ইরাকের ভুমি ত্যাগ করার পর্ব শুরু হয়েছে। এমেরিকার গায়ে ইরানীদের চপাটোঘাতের পর যদি মার্কিনীরা কোন ধরনের পাল্টা সামরিক আক্রমনের চিন্তা করে তাহলে তাদের তাসের ঘরের ন্যায় পরাশক্তি থাকার কথা ভুলে যেতে হবে। এ ধরনের অবস্থা ঘটানোর মত শক্তি এতদ অঞ্চলে প্রতিরোধ আন্দোলনের আছে। যার সামান্য দৃষ্টান্ত ইরাকের আল আনবার প্রদেশে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাটি “আইনুল আসাদ”-এ কয়েক ডজন ব্যালেষ্টিক মিসাইল দিয়ে আক্রমন করে ইরান দেখিয়েছে। যদিও মার্কিনীদের জন্যে এহেন অবস্থা অত্যন্ত অপমানজনক, তবুও পাল্টা আক্রমন করার সাহস তাদের নেই বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

৬। ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের পর এই প্রথম দেখা গেল, ইরানী জাতি, সরকার ও পার্লামেন্ট কোন একটি বিষয়ে একক কণ্ঠে জোড়ালোভাবে কথা বলছেন। আর তা হলো এমেরিকার সন্ত্রাসী আক্রমনের প্রতিশোধ নেয়া। এই প্রথম ইরানী পার্লামেন্টে অভিভাবক পরিষদের উপস্থিতিতে সকল সদস্যদের মাধ্যমে দ্রুত একটি বিল পাশ হওয়া। সেই বিলটি হলোঃ “এখন থেকে জেনারেল কাসেম সোলাইমানীকে হত্যার নির্দেশদাতারা, নির্দেশ পালনকারীরা, যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগণ সবাইকে টেরুরিষ্টদের লিষ্টে অন্তর্ভুক্ত করা হলো।” এটা যুগান্তকারী একটি বিল, যার ব্যাপারে কোন সদস্য বিরোধীতা করেনি।

৭। ইরানীদের মধ্যে গত শুক্রবার থেকেই শহীদ হাজী কাসেম সোলাইমানীকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তন্মোধ্যে গান, কবিতা, প্রবন্ধ, টক শো, সিনেমার স্ক্রিপ্ট তৈরী, জীবনী গ্রন্থ রচনা উল্লেখযোগ্য।

বিশ্বগ্রাসী বৃহৎ শয়তান এমেরিকার শক্তি খর্ব করে একটি শান্তিময় বিশ্ব উপহার দেয়ার লক্ষ্যে ইরান ও প্রতিরোধ আন্দোলনসমূহ সফল হোক- আল্লাহর কাছে এ দোয়া-প্রার্থনা করছি।

ইসলামী বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনীর প্রতি আমাদের হাজারো শ্রদ্ধা ও ভালবাসা অর্পন করে ইতি টানছি।

– ডঃ নূরে আলম মোহাম্মাদী

Related Post

সৌদি আরব, আমেরিকা ও ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষা করছে

Posted by - আগস্ট ১, ২০১৯
🔊সৌদি আরব, আমেরিকা ও ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষা করছে।⬅️   টেলিভিশনে দেয়া এক ভাষণে ইয়েমেনের ইসলামী বিপ্লবের নেতা আব্দুল মালিক হাওসি…

ইরান যে কারণে সিরিয়া কে সমর্থন দিচ্ছে

Posted by - আগস্ট ১৪, ২০১৯
➡️ইরান যে কারণে সিরিয়া কে সমর্থন দিচ্ছে⬅️   👉ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ি বলেছেন, “সিরিয়া বর্তমানে প্রতিরোধ সংগ্রামের ফ্রন্ট…

ইয়েমেনে সৌদির সামরিক আগ্রাসন

Posted by - আগস্ট ১৪, ২০১৯
👆👆👆ঐতিহাসিক ইয়েমেন দেশটির সামাজিক ও মানবিক সকল অবকাঠামোর উপর আক্রমন চালাচ্ছে হিজাজ দখলকৃত অভিশপ্ত সোউদ পরিবারের শাসিত সরকার সৌদী আরব।…

ইয়ামানে জাসনে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন

Posted by - নভেম্বর ১০, ২০১৯
দীর্ঘ পাঁচ বছর সৌ‌দি-আমেরিকা জো‌টের চা‌পি‌য়ে দেয়া য‌ুদ্ধ-অব‌রোধের কার‌ণে সৃষ্ট ক্ষুধা-কষ্ট নবী প্রে‌মিক ইয়া‌মেনীদের দমা‌তে পা‌রে‌নি। তাঁরা প্র‌তি বছ‌রের ন্যায়…

মদিনা লুণ্ঠন

Posted by - আগস্ট ১৫, ২০১৯
ইয়াযিদের নির্দেশে ও তার জল্লাদ সেনাবাহিনীর হাতে মদীনা নগরী আক্রমন, লুন্ঠন ও মদীনাবাসীদের নিধন এবং মদীনার কয়েক হাজার নারীকে ধর্ষন,…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »