ইমাম হাসান ইবনে আলী আল আসকারী (আঃ)-এর পবিত্র শাহাদাতঃ

702 0

হযরত ইমাম হাসান ইবনে আলী আল আসকারী আলাইহিমাস সালামের পবিত্র শাহাদাতঃ

আব্বাসীয় খলিফারা ও তাদের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা অবগত ছিল যে, আহলে বাইতের ইমামরা সর্বমোট ১২ জন। তাদের মধ্যে দ্বাদশ ইমাম একটা মেয়াদকাল আত্মগোপন করার পর আবির্ভূত হবেন। তিনি অত্যাচারী ও জালিম শাসকদের মুলোৎপাটন করবেন এবং তাদের দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে বিশ্বব্যাপি সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। এ বিষয়টি বিশেষ করে ইমাম হাদী ও ইমাম আসকারী (আ.) আমলে খলিফাদের দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ কারণেই তারা ইমাম আসকারী (আ.)-এর উপর কড়া সতর্ক দৃষ্টি রাখতো এবং ইমাম আসকারী (আ.)-এর স্ত্রীর গর্ভে যেন কোন সন্তান না হয় সেই চেষ্টা চালাতো। সব দিক দিয়েই ইমামের প্রতি কড়া নজর রাখ হতো এমনকি কয়েকবার তাকে বন্দীও করা হয়। অবশেষে আব্বাসীয় খলিফা মু’তামিদ বুঝতে পারে যে, বন্দী করেও ইমামের প্রতি ভালবাসা থেকে মানুষকে দুরে সরানো যাবে না। বরং উত্তরোত্তর ইমামের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও উদ্দীপনা বেড়ে চলছে। অধিকন্তু বন্দীদশা ও কারারুদ্ধতা খেলাফতের জন্য প্রতিকুল পরিবেশ সৃষ্টি করবে ফলে বন্দী করে রাখতে আর সাহস পেল না। অতঃপর ইমামকে হত্যার পরিকল্পনা নেয়। অবশেষে ইমামকে গোপনে বিষ প্রয়োগ করে এবং ইমাম ২৬০ হিজরীর ৮ই রবিউল আউয়াল শাহাদাত বরণ করেন (ইমামের উপর এবং তার পবিত্র বংশের উপর শান্তি বর্ষিত হোক)। সমাজের উপর ইমামের প্রভাব এবং বিশেষ করে আলাভী ও আহলে বাইতের সমর্থকদের ভয়ে আব্বাসীয় খলিফা দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল কারণ ইমামকে হত্যা করার গোপন তথ্য ফাস হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। ফলে সার্বিকভাবে এই অপরাধটি ঢেকে রাখতে চেয়েছিল। ইবনে সাব্বাগ মালেকী তার লেখা বই “ফুসুলুল মুহিম্মাহ”-এ আব্দুল্লাহ্ ইবনে খাকান -এর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেন যে, একজন আব্বাসীয় দরবারী কর্মকর্তা লিখেনঃ

“……. ইমাম আবু মুহাম্মদ হাসান ইবনে আলী আল আসকারী (আ.)-এর নিহত হওয়ার কালে আব্বাসীয় খলিফা মো’তামেদের এমন এক অবস্থা হয়েছিল যে, আমরা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা মোটেই কল্পনা করিনি যে, মুসলিম জাহানের সমগ্র ক্ষমতা যার হাতে তার এমন অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। যখন আবু মুহাম্মদ ইমাম আসকারী (আ.) বিষাক্রান্ত হয়েছিলেন তখন খলিফার ৫ জন বিশেষ দরবারী ফকীহ্ ইমামের বাড়িতে দ্রুত প্রেরিত হয়েছিল। খলিফা তাদেরকে আদেশ করেন ইমাম যে কাজ ও কথাই বলুক ততক্ষনাৎ যেন তা খলিফাকে অবগত করা হয়।”

খলিফার পক্ষ থেকে কয়েকজন সেবক প্রেরণ করা হয় যাতে ইমামের সার্বক্ষনিক পরিচর্যা করা যায়। আব্বাসিয় খলিফা কাজী বখতিয়ারকে আদেশ দেয় ১০ জন বিশ্বস্ত লোক ঠিক করে তাদেরকে সকাল বিকাল দু’বার ইমামের বাড়িতে পাঠিয়ে তার শারীরিক অবস্থার সম্মক ধারণা রাখতে। দুই অথবা তিনদিন পরে খলিফাকে খবর দেয়া হলো যে, ইমামের অবস্থা আশংকাজনক এবং তার ভাল হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। খলিফা ইমামের বাড়িতে সার্বক্ষনিক দৃষ্টি রাখার আদেশ জারী করে। নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ খলিফার আদেশ মত ইমামের বাড়িতে কড়া নজর রাখলো এবং কয়েকদিন পরই ইমাম পরলোকগমন করলেন। যখন ইমামের মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো তখন সমগ্র সামেরার অলি-গলি, রাস্তা-ঘাট জনতায় পরিপূর্ন হয়ে গেল। সর্বত্র কান্না ও চিৎকার ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। বাজারে দোকান-পাট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বনি হাশেম, প্রশাসনিক কর্মচারী ও কর্মকর্তা, সৈন্য ও কমান্ডার, শহরের বিচারপতি, কবি-সাহিত্যিক সহ আপামর জনসাধারণ শোক জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিল।

যখন লাশ দাফনের সময় হলো তখন খলিফা তার ভাই ঈসা ইবনে মোতাওয়াক্কেলকে জানাজার নামাজ পড়ানোর জন্য পাঠান। যখন জানাজার নামাজ পড়ার জন্য লাশ রাখা হলো ঈসা কাছে গিয়ে ইমামের মুখের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে নিলেন। উপস্থিত জনতা, আব্বাসীয়, আলাভী, বিচারক, লেখক ও অন্যান্যদেরকে সাক্ষী রেখে বলেন, ইমাম আবু মুহাম্মদ আসকারী-এর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। খলিফার অমুক অমুক সহকারী সাক্ষী আছেন। অতঃপর লাশটি আবৃত করে জানাজার নামাজ পড়ান। তারপর লাশ দাফনের আদেশ দেন। ইমাম আবু মুহাম্মদ হাসান আসকারী (আ.) ২৬০ হিজরীর ৮ই রবিউল আউয়াল, শুক্রবার শাহাদাত বরণ করেন। ইমামের নিজস্ব ঘরেই পিতা ইমাম হাদী (আ.)-এর পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়। (ফুসুলুল মুহিম্মাহ্, নাজাফ প্রিন্ট, পৃ. – ২৯৮)।

উপরের বর্ণনা থেকে স্পষ্ট প্রতিয়মান হয় যে, ইমাম কেমন পরিবেশে বাস করতেন এবং ইমামকে হত্যার গোপন তথ্য ফাস হওয়ার আশংকায় খলিফা কি পরিমান আতঙ্কিত ছিল। সত্যিই খলিফারা ভালভাবেই বুঝতো যে, পবিত্র ইমামদের অস্তিত্ব তাদের ক্ষমতার জন্য বিপদজনক। তাই, তারা ইমামদের উপর কড়া নজর রাখতো এবং যথাসম্ভব সমাজ ও জনগণ থেকে ইমামকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করতো।

আব্বাসীয় খলিফা মু’তামিদ, ইমাম আসকারী (আ.)-কে হত্যা করার পর ইমামের সম্পত্তি ও অর্থসমুহ ইমামের মা ও ভাই জা’ফরের মাঝে বন্টন করে জনসাধারণকে বুঝাতে চেয়েছিল যে, ইমামের কোন সন্তান নেই এবং আহলে বাইতের অনুসারীদের আর কোন ইমামই অবশিষ্ট রইলো না। ফলে জনগণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। অন্য দিকে খলিফা গোপনে লোক নিয়োগ করতো যাতে ইমামের পরবর্তী স্থলাভিষিক্ত সন্তানকে খুজে বের করে গ্রেফতার করা হয়। খলিফার প্রতিনিধিরা ইমামের পরিবারবর্গের উপর যথেষ্ট চাপ প্রয়োগ করা সত্তে¡ও ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর কোন সন্ধান তারা নিতে পারেনি। আল্লাহ তা’য়ালা তাকে জালিম শাসকদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। যদিও ইমাম মাহ্দী (আ.) জালিম শাসকদের হাত থেকে নিরাপত্তার অভাবে প্রকাশ্যে জনসাধারণ ও সমাজের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে আল−াহ্র আদেশে আত্মগোপন করেন কিন্তু ইমাম আসকারী (আ.)-এর বিশেষ সাহাবীরা ইমাম মাহ্দী (আ.)-কে একাধিকবার দেখেছেন। ইমামের অস্তিত্বের ব্যাপারে তারা নিশ্চিত ছিলেন। এ ব্যাপারে তাদের কোনরকম সন্দেহের অবকাশ ছিল না। ইমাম আসকারী (আ.)-এর শাহাদাতের পর যখন বাড়ির আঙ্গিনায় জানাজার নামাজ পড়ানোর জন্য জা’ফর ইমামতির লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিয়েছিল তখন ইমাম মাহ্দী (আ.) আবির্ভূত হন এবং জা’ফরকে সরিয়ে নিজেই পিতার জানাজার নামাজ পড়ান। (কামাল উদ্দিন, আখন্দি প্রিন্ট, পৃ. – ৪৭৫)। ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর স্বল্পকালীন আত্মগোপনের যুগে ইমামের মনোনিত নির্দিষ্ট প্রতিনিধিদের মাধ্যমে ভক্তরা তার সাথে যোগাযোগ রাখতেন। ইমাম মাহ্দী (আ.)ও প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই জনগণের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতেন। পরে দীর্ঘকালীন অদৃশ্যতার সময় চলে আসলে ইমাম হক্কানী ফক্বিহ আলেমদের হাতে দায়িত্ব অর্পন করে পর্দার অন্তরালে চলে যান। আমরা আজ এই বৃহৎ অদৃশ্যকালে বসবাস করছি। আল্লাহ আমাদেরকে হক্কানী ফক্বিহ আলেমদের মাধ্যমে ইমামের সাথে সংযোগ রক্ষা করার তৌফিক দান করুন।

Related Post

বেলায়েত সম্রাট মাওলা আলী কনফারেন্স

Posted by - April 23, 2022 0
মাওলা আলীর “বেলায়েত দিবস” উপলক্ষে ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চের বশির মিলনায়তনে আয়োজিত মাওলা আলী (আঃ)-এর কনফারেন্সে বক্তব্য রাখছেন ইমামিয়া পাক দরবার…

সর্বগু‌ণে গুণান্বিতা!!

Posted by - January 25, 2020 0
বয়স পাঁচ কি ছয়, হারা‌লেন জন্মদাত্রী মা কে! ক‌চি ম‌নে পু‌রো আকাশ ভে‌ঙ্গে পড়ার ম‌তো, সান্তনা প্রবোধ স্নেহ সবই পিতার…

এক নজরে চৌদ্দ মাসূম

Posted by - August 17, 2019 0
একঃ হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামঃ📣 🌹 নামঃ  মুহাম্মাদ (সা.)। 🌹 ডাক নামঃ  আবুল ক্বাসেম। 🌹 উপাধিঃ…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *