অধুনা কালের একক ও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব, শিক্ষাগুরু ও আধ্যাত্মিক সাধক হযরত আয়াতুল্লাহ মারেফাত (রহ:)
ভূমিকাঃ
“যাঁকে হিকমত বা প্রজ্ঞা দান করা হয়েছে তিনি প্রচুর কল্যাণের অধিকারী”। প্রচুর ‘কল্যাণ’ অর্থাৎ কুরআনের তাফসীরের সক্ষমতা, কুরআনের অর্থোপলব্ধি ক্ষমতা। কুরআনের ভাষায় যাঁরা কুরআনের সাথে প্রেম ভালোবাসা স্থাপন করতেন তাঁরা, কুরআনের আয়াতসমূহকে কেন্দ্্র করে চিন্তা-ভাবনা ও অনুশীলন করার কারণে আধ্যাত্মিক ও স্বর্গীয় বৈশিষ্ট্য ধারণ করা ছাড়াও ঐশরীক ব্যক্তিতে পরিণত হবেন। কুরআনী চরিত্র, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও মন-মানসিকতা অর্জন করবেন। এ ব্যাপারে আমরা “বিশেষত্ব” অংশে আয়াতুলাহ মা’রেফাত সম্পর্কে সংক্ষিপ্তাকারে আলোচনা করব। আমরা এ প্রবন্ধে তাঁর বিখ্যাত কোরআনী তিনটি গ্রন্থের ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পেশ করেছি। অত:পর আহকামের আয়াতের ব্যাপারে তাঁর মতামত পেশ করেছি। আশা করি কোরআনিক বিদ্যার শিক্ষার্থীগণ তা থেকে উপকৃত হবেন।
আয়াতুল্লাহ মা’রেফাতের ব্যক্তিগত ও জ্ঞানগত বিশেষত্বসমূহ:
আয়াতুল্লাহ মা’রেফাত স্বীয় অস্তিত্বে কুরআনের সমূহ শিক্ষাকে বাস্তবায়িত করেন। শিক্ষাগুরু মা‘রেফাত জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় স্বতন্ত্র মতের অধিকারী ছিলেন। গবেষণায় ছিলেন ক্লান্তিহীন । তিনি এমনই যৌক্তিক ও জ্ঞানগ্রাহ্য কলমের অধিকারী ছিলেন যে, স্বীয় জীবন ব্যাপি এবং রাষ্ট ব্যবস্থা, রাজনীতি, উলুমে কুরআন ও তাফসীর বিষয়ক তাঁর বিভিন্ন লিখনীতে কখনই যুক্তিগ্রাহ্য পরিধি ডিঙ্গাঁন নি এবং সাধারণের অনুভুতিসমূহকে উদ্বেলিত করেন নি। কুরআনী জ্ঞানের বিস্তার ঘটানোর জন্যে তাঁর সীমাহীন উৎকন্ঠা ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, কুরআন ও তৎসম্পর্কিত জ্ঞান জনসমাজ থেকে বাইরে রয়েছে এবং তাকে জনসমাজের নিকট তুলে ধরতে হবে।
আয়াতুল্লাহ মা’রেফাত বিভিন্ন জ্ঞানে স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি রাখতেন। তাঁর সর্বশেষ লিখনী “আত্ তাফসীর আল্ আছারী আল্ জামে’” যা তাঁর ৫০ বছরের কুরআনী কর্ম তৎপরতা ও জ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতারই ফলস্বরুপ। গবেষনায় ক্লান্তিহীনতা এবং যৌক্তিক ও জ্ঞানগ্রাহ্য লেখনী ছিল তাঁর বৈশিষ্টের অন্যতম। জ্ঞানের ও সামর্থের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্বেও তিনি ফিক্হ, রাষ্ট্র ব্যবস্থা, কুরআনী জ্ঞান ও রাজনীতির মত যাবতীয় অঙ্গঁনে কলম চালাতেন এবং স্বীয় লিখনীর ক্ষেত্রে কখনই যৌক্তিক ও সংশ্লিষ্ট পরিমন্ডল অতিক্রম করেননি।
দ্বীনি ও ধর্মীয় আলেমগণের অন্যতম বৃহৎ দায়িত্ব ঐশী কিতাবের সীমারেখা (পবিত্রতা) রক্ষা করা এবং তার সুপ্ত রহস্যগুলিকে উন্মোচিত করা। কুরআনের জ্যোর্তিময় শিক্ষাসমূহকে বিষদভাবে তুলে ধরা, সেগুলোকে যুগোপযোগী ভাষায় বর্ণনা করা, সন্দেহের নিরসন করা এবং কুরআন সম্পর্কে উত্থিত সন্দেহের উত্তর দান ধর্মীয় আলেমের একান্তদায়িত্ব বলে পরিগণিত। এ কারণে, কুরআন নাযিলের সুদীর্ঘ ইতিহাসে, অদ্যবধি মানবেতিহাসের অধিকাংশ লিখনীই কুরআন ও তৎসংশ্লিষ্ট শিক্ষা সংক্রান্ত। এ দৃষ্টিকোন হতে তিনি (আয়া: মা’রেফাত) মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম মহৎ শিক্ষক ছিলেন যিনি মূল্যবান একাধিক কুরআনী কীর্তি রচনা করেছেন এবং তা কুরআনী সমাজকে উপহার দিয়েছেন। তিনি যৌবন কাল থেকেই দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণ করার পাশাপাশি স্বীয় কতিপয় শিক্ষকের পরামর্শক্রমে কুরআনের শিক্ষার প্রতি মনোনিবেশ করেন এবং কারবালা ও নাজাফে থাকাকালীন এবং ইরানে আসার পরও এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে তিনি নিয়োজিত থাকেন। আয়াতুল্লাহ মা’রেফাত বিশেষ কতকগুলি বিশেষত্বের অধিকারী হওয়ার কারণে ব্যক্তির সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে আসেন এবং কুরআনী প্রবাহের ব্যপ্তিতে রূপান্তরিত হন। তিনি এমন একজন সংগ্রামী পুরুষ ছিলেন যিনি স্বীয় বরকতময় জীবনের সুদীর্ঘ ইতিহাসে কাজ ও শিক্ষাকে কেন্দ্র করে কখনই ক্লান্ত হননি। তিনি মূল্যবান পুস্তকাদি লিখার জন্যে ব্যাপক পদক্ষেপ নেন।
প্রফেসর মা’রেফতের পান্ডিত্যপূর্ণ লিখনীগুলি কুরআনী জ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশেষতঃ শিয়া সমাজে এক মূল্যবান উৎস। তিনি এ পথেই কুরআন অট্রালিকার প্রতিরক্ষা এবং বেলায়াত ও শিয়া সমাজের পবিত্রতা প্রতিরক্ষার সংকল্প গ্রহণ করেন। তাঁর পান্ডিত্যপূর্ণ ও অনুসন্ধীৎসুমূলক চরিত্র এবং কুরআনী জ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর দায়িত্বানুভূতি, আধুনিক কুরআনের জ্ঞানপিপাসু ও গবেষকদের জন্যে নমূনা হওয়া বাঞ্চনীয়।
তাঁর অন্যতম বিশেষত্ব ছিল জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ। তাঁর জীবনের সত্তর বছরাধিক কাল অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও তিনি তরুনদের মত চিন্তা করতেন। তরুণদের সাথে স্ফীত হতেন এবং তাদেরকে মূল্য দিতেন। তাঁর এই আচরণটি, তাঁর জীবনের সূচনালগ্ন থেকেই বিদ্যমান ছিল। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর পূর্বে কারবালা শহরে অনুষ্ঠিত সর্বাধিক সুন্দর ও মনোরম সভাগুলির একটি ছিল তাঁরই সভা (আশুরা সভা)। যুবশ্রেনীই সেখানে বেশী বেশী অংশ নিতেন। প্রফেসর মা’রেফাত স্বীয় জীবনের অন্তিমকাল পর্যন্ত আগ্রহ ও উদ্দীপনা সহকারে নিজ শিষ্যদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতেন। তিনি এরূপ পছন্দ করতেন না যে, শিষ্যদের কোনো সন্দেহ-সংশয় নিরুত্তর থেকে যাক।
আয়াতুল্লাহ মা’রেফাতের লিপিবদ্ধ পুস্তকসমূহ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদনঃ
১.“আত্ তাফসীর আল্ আছারী আল্ জামে’-”:
এ গ্রন্থখানা আয়াতুল্লাহ মা’রেফাতের সর্বশেষ লেখনী গ্রন্থ। তিনি স্বীয় জীবনের শেষ সাতটি বছর এ গ্রন্থখানা লিখার অনুশীলন করেন। এ গ্রন্থের নামকরণই এর বিশেষত্ব ও বিষয় বস্তুর সাক্ষ্য বহণ করে। “আছার” অর্থ খবর ও রেওআয়াত (হাদীছ)। তাফসীরুল আছারী, অর্থ তাফসীরে রেওয়াত। “জামে” অর্থ শিয়া ও সুন্নী মতাবলম্বী বিভিন্ন দল- উপদলের রেওআয়াতগুলোর সমবেতকারী। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের প্রথম তিন শতাব্দিতে কুরআন সম্পর্কে যা কিছু আলোচিত হয়েছে তা এই ইসলামী বিশ্বকোষটিতে সন্নিবেশ করা হয়েছে। সহস্র রেওয়ায়েত (হাদীছ) সংগ্রহ করতঃ এ গ্রন্থের মাঝে তা সন্নিবেশ করা হয়েছে। বিভিন্ন বই-পুস্তকে কুরআনের আয়াত সম্পর্কে যে বিভিন্ন মতামত এসেছে সেগুলিকে এতে তুলে ধরা হয়েছে এবং তৎসম্পর্কে বিচার করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। অর্নিভরযোগ্য রেওয়াআত-গুলোকে(হাদীছ) পরিহার করা হয়েছে এবং অনুরূপভাবে আহলে বাইতের (আ.) চিন্তাধারাগুলোর বিস্তৃতি ঘটানো এই ”তাফসীর আল্আছারী আল্ জামে’- ” এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট।
তিনি তাফসীর পদ্ধতির ক্ষেত্রে দু’প্রকার পদ্ধতির প্রবক্তাঃ
(ক) তাফসীরে আসারী এবং (খ) তাফসীরে ইজতেহাদী। তিনি তাঁর শেষ গ্রন্থে (তাফসীর আল্ আছারী আল্ জামে’) উভয় প্রকারের তাফসীর পদ্ধতিই ব্যবহার করেছেন এবং তৎসঙ্গে এ দু’য়ের শাখা-প্রশাখাগুলোকেও কাজে লাগিয়েছেন।
অপরাপর তাফসীর গ্রন্থের সাথে তাফসীর আল্ আছারী আল্ জামে’-এর পার্থক্যঃ
এ সংকলনটিই সর্ব প্রথম একখানা তাফসীর সংকলন যা ইসলামের বিভিন্ন মাযহাব (দল) -এর পারস্পরিক নৈকট্য অর্জনের বাসনায় প্রনয়ন করা হয়েছে। ইসলামের সূচনাকাল হতে অদ্যাবধি লিখিত শতাধিক তাফসীর গ্রন্থের মাঝে এটি এমন একক তাফসীর গ্রন্থ যা সমস্ত রেওয়ায়াতকে (হাদীছ) একত্রে উপস্থাপন করেছে। এ তাফসীর সংকলনটি দু’টি দলের (শিয়া-সুন্নী) রেওয়ায়াতগুলির (হাদীছ) উপর ভিত্তি করে দুই পর্বে রচিত হয়েছে।
প্রথম পর্বে হাদীস সংকলন করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় পর্বে হাদীসগুলোর আলোচনা-পর্যালোচনা করা হয়েছে। এ গ্রন্থে সংকলিত হাদীসগুলো শিয়া সমাজের তাফসীর গ্রন্থ ‘নূরুছ্ ছাক্বালাঈল’ এবং আহলে সুন্নাতের ‘দুররুল মানছূর’ গ্রন্থদ্বয় থেকে নেয়া হয়েছে। এ দু’গ্রন্থে নিরঙ্কুশ উৎস সহকারে উভয় দলের প্রায় ষাট হাজার হাদীস সংকলন করা হয়েছে। এ পুস্তক প্রনয়নের উদ্দেশ্য হচ্ছে কুরআনের উপর সংকলিত হাদীসগুলো উপস্থাপন করা এবং মুসলিম বিশ্বের নিকট আহলে বাইতের (আঃ) হাদীসি কথাগুলো রপ্তানি করা।
আয়াতুল্লাহ মা’রেফাত তাফসীরের আলোচনায় “তাফসীরে আসারী ও তাফসীরে ইজতেহাদী” (হাদীছানুসারে তাফসীর ও গবেষণাকারে তাফসীর) এ দু’পদ্ধতিতে তাফসীর করা শ্রেয় জ্ঞান করতেন। কুরআন সহযোগে কুরআনের তাফসীর, সুন্নত সহযোগে কুরআনের তাফসীর, সাহাবীর বক্তব্য সহযোগে কুরআনের তাফসীর এবং তাবেঈনের বক্তব্য সহযোগে কুরআনের তাফসীর। এসব ‘তাফসীরে আছারী’ পদ্ধতির অর্ন্তভুক্ত বিষয়। তিনি ‘তাফসীরে আছারী’ পদ্ধতিকে খোদার কুরআনের আদেশের প্রতি নিকটবর্তী হওয়ার জন্যে সর্বোত্তম মাধ্যম জ্ঞান করতেন। এ তাফসীরই শুধুমাত্র একক অবদান যা কুরআনের সমীপে সমস্ত হাদীসকে একত্রে উপস্থাপন করা হয়েছে আর এতে করে গাইরে সহীহ্ থেকে সহীহ্ (অশুদ্ধ থেকে শুদ্ধ) হাদীসগুলো চেনা সম্ভব ওঠে।
২. আত্ তাফসীর ওয়াল মুফাসসিরুন ফী ছাওবেহিল ক্বাছীবঃ
আয়াতুল্লাহ মা’রেফাত (রহঃ) এই গ্রন্থে তাফসীর ও মুফাসসিরগণের ইতিহাসের আলোচনা ছাড়াও এ জ্ঞানের পূর্ণ এক গুচ্ছ এবং তার বিভিন্ন মতাদর্শ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। “তাফসীর ওয়া মুফাসসিরান” গ্রন্থখানা প্রকৃতপক্ষে উপরোক্ত গ্রন্থের অনুবাদ, যা তাঁর দুইজন শিষ্য ফার্সী ভাষায় অনুবাদ করেছেন। মূল গ্রন্থের চেয়ে এ গ্রন্থে কিছুটা বিষয় সংযোজন করা হয়েছে। অত:পর “আত্ তামহীদ সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশন” কর্তৃক তা ছাপানো হয়েছে। আয়াতুল্লাহ মা’রেফাত (রহঃ) এতে কিছুটা নতুনত্ব এনেছেন এবং কিছু সংযোজন ও পরিমার্জন করেছেন। এই অনুবাদের উপর একটি ‘ভূমিকা’ লিখা হয়েছে এবং এতে উক্ত গ্রন্থের বৈশিষ্ট্যগুলি তুলে ধরা হয়েছে। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য এ যে, এ গ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত বিষয় বস্তুগুলোকে উন্নততর করার জন্যে গ্রন্থকার, যেসব উৎসকে উপযুক্ত ভেবেছেন সে সবের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। এ গ্রন্থে অন্যদের বক্তব্য ও মতামতগুলোকে সংকলন করার পাশাপাশি পান্ডিত্যপূর্ণভাবে তার আলোচনা-পর্যালোচনা করা হয়েছে। এ গ্রন্থের অনন্যতা হচ্ছে নতুনত্ব ও সৃজনশীলতা। এতে মোট ১৪টি অধ্যায় বিদ্যমান।
অধ্যায় শিরনামগুলো নিম্নরুপঃ
তাফসীর, কুরআনী বর্ণনা ভঙ্গি, কুরআনের অনুবাদ, তফসীরের সূচনা, তাবেঈনদের পরবর্তীতে প্রসিদ্ধ মুফাসসিরগণ, তাফসীরের ক্ষেত্রে আহলে বাইতের (আঃ) ভূমিকা, বুদ্ধিবৃত্তিক তাফসীর, উদ্ধৃতি ভিত্তিক প্রসিদ্ধ তফসীর গ্রন্থসমুহ, গবেষণাধর্মী তাফসীর, আধ্যাত্মিক তাফসীর, আধুনিক যুগের তাফসীর এবং বিষয়ভিত্তিক তাফসীর। উপরোক্ত বিষয়গুলির প্রত্যেকটিই নিজ নিজ শিরোনামের আওতায় আলোচিত-পর্যালোচিত হয়েছে এবং তৎসঙ্গে আরও একাধিক বিষয়বস্তু আলোচনায় স্থান পেয়েছে।
বলা যায় উক্ত গ্রন্থখানা, ইসলামের উপর প্রাচ্যবিদদের এবং শিয়া সমাজের উপর আহলে সুন্নতের আপত্তি-অভিযোগ বিষয়ে পর্যবেক্ষক স্বরূপ। “গোল্ডযীহার” (১৮৫০-১৯২০খৃ:) কুরআনের তাফসীর পদ্ধতি ও তাফসীর মতবাদ বিষয়ে একখানা প্রসিদ্ধ গ্রন্থ প্রনয়ন করেছেন। এ গ্রন্থখানা ডক্টর নাজ্জারের মাধ্যমে “মাযাহিবুত্তাফসীরিল ইসলামী” শিরনামে আরবী ভাষায় অনুদীত হয়েছে। “নোল্ডকে”- এর বিস্ময়কর গবেষণাধমী কাজের পর “গোল্ডযীহার”- এর কাজগুলো মুসলিম গবেষকদের নিকট অতীব গুরুত্ব পেয়েছে। নোল্ডকে কুরআনের ভাষা, শব্দাবলী, আয়াত ও সূরাসমূহের শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতি সম্পর্কে অধিক মাত্রাই আলোচনা করেছেন। কিন্ত গোল্ডযীহার তার বিপরীতে কুরআনের তাফসীরের উপর অধিক গুরুত্বারোপ এবং সামগ্রিকভাবে তাফসীর অধ্যয়নের উপরই আলোচনা করেছেন। তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী জ্ঞান; যেমনঃ প্রাচীন আরবী ভাষার উপর তাঁর দক্ষতা, প্রাচীন ইয়েমেনী উচ্চারণভঙ্গি(স্বরধণি) সম্পর্কে অবগতি, হাবশী (ইথিওপিয়া) ভাষা, সনাতন হিব্রু ও আরামী প্রভৃতি ভাষার উপর তাঁর দখল। এসব তাঁর কাজকে এক বিশেষ গুরুত্ব দান করেছে। অবশ্য মুসলমানদের পক্ষে থেকে আজও অবধি তাঁর উক্ত গ্রন্থখানা ও তাঁর সৃষ্ট সন্দেহ সংশয়ের কোনো উত্তর দেয়া হয়নি।
গোল্ডজিহারের পর ডঃ মোহাম্মদ হোসাঈন যাহাবী ১৯৭৬ সালে “তাফসীর ও মুফাসসিরুন” নামক একটি বই রচনা করেন। গোল্ডজিহারের বই যদি ইসলামের বিরুদ্ধে তার ভুল-ভ্রান্তি, দ্বিধা-দন্দ, সম্পর্কে হয়, তাহলে বলা যায় যে, যাহাবীর বই শীয়া ইমামিয়াদের বিরুদ্ধে লেখা হয়েছে। এই বইয়ে অনেক অকথ্য ভাষা পরিলক্ষিত হয়। এ ব্যাপারে এটাই যথেষ্ট যে, মু’তাযিলাদের তাফসীরসমূহের সমালোচনা ও পর্যালোচনা অধ্যায়ে হযরত শরীফ মুরতাজার “আমালী” এবং জামাখশারীর “তাফসীর আল কাশশাফ” কিতাব দুটি সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি অধ্যয়ন করা যেতে পারে। শীয়া ইমামিয়া অধ্যায়ে ডঃ যাহাবী অল্প কিছু গোষ্ঠির আকিদা-বিশ্বাসকে যেমন- শাবাঈয়া, বায়ানীয়া, মানসুরীয়া, খেতাবীয়া ইতাদি আরো কিছু শিয়া ফের্কা-যারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, তাদেরকে শীয়া ইমামিয়াদের আকিদা-বিশ্বাস হিসাবে পরিচিত করেছেন। যেমনঃ শাবাঈয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে “তারা বজ্রকে আলী (আঃ)- এর চিৎকার ও বিদ্যুৎকে আলীর (আঃ) চাবুক বা হাসী মনে করেন। যখন বিদ্যুৎ চমকায় ও বজ্রপাতের শব্দ শুনতে পায় তখন বলেঃ আসসালামু আলাইকুম ইয়া আমীরাল মু’মিনীন। বায়ানীয়াদের নেতা ইবনে সাময়ান তামিমী বলছিলেন যে, সে “এটা মানুষের জন্যে বর্ণিত” (ইমরান-১৩৮) আয়াতটির দৃষ্টান্ত হিসেবে ইমাম আলী(আ.)-এর নাম উল্লেখ করেন।
এই অবস্থায় অবশ্যই কাউকে মাঠে আসতে হবে, যে গোল্ডজিহারের উত্তর দিবে আবার যাহাবীরও সমালোচনা করবে। আল হামদুলিল্লাহ আয়াতুল্লাহ মা‘রেফাত (রহঃ) ভাল ভাবেই এই প্রাঙ্গনে প্রবেশ করেছিলেন আবার সফলতার সাথে বের হয়েও এসেছেন। যদিও এই বইয়ে গোল্ডজিহার ও যাহাবীকে সরাসরি ইঙ্গিত করা হয়নি। কিন্তু তাদের প্রায় সব ভুলের জবাব দেয়া হয়েছে। বইয়ের গুরুত্বপূর্ন গবেষনালব্ধ অধ্যায়কে ৩২ ভাগে উপস্থাপন করা হয়েছে। এটা এমন এক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা যা তিনি কোরআনের তাফসীরে ইয়াহুদীদের কল্প কাহিনী সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এই প্রথম দেখা যায় যে, একজন শীয়া আলেম তার তাফসীর গ্রন্থে খোলাখুলিভাবে ইয়াহুদীদের কল্প কাহিনীর সমালোচনা করেছেন। এই অধ্যায় প্রাচ্যবিদদের জন্য গবেষনালব্ধ উত্তর হিসেবে বিবেচ্য হতে পারে।
৩. আত্ তামহিদ ফি উলুমিল কোরআন
যদিও কোরআন অবতীর্নের প্রথম বছরগুলোতেই মুসলমানদের মাঝে এর জ্ঞানসমূহ পরিগ্রহ করেছে, তারপরও চন্দ্র বছরের অষ্টম শতাব্দি পর্যন্ত এমন একটি বই রচিত হয়নি যা উলুমে কোরআনের পূর্নাঙ্গ কলা কৌশল সমৃদ্ধ হবে। তবে এর পর থেকে এ সম্পর্কে অনেক বই রচিত হয়েছে। এই অবস্থায় শীয়াদের মধ্যে কোন গ্রন্থই অনুরূপ সার্বজনীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। এ কারণে এই জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে আয়াতুল্লাহ হাদী মা‘রেফাত (রহঃ) এই বই সংকলনে উদ্যোগী হন। অতঃপর সেটি সংকলন করেন। বর্তমানে যা দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে পাঠ্য পুস্তক হিসেবে পঠিত হচ্ছে। আরবী ভাষার সাবলীলতা, বিশুদ্ধতা ও সার্বজনীনতা ছাড়াও এই বইয়ের আরও বৈশিষ্ট হচ্ছে যে,ওহির প্রেক্ষাপট, কুরআনের অলৌকিক ঘটনাসমূহ, গারানিকের ন্যায় কল্পিত ও মিথ্যা কাহিনী, নাসিখ, মানসুখ, মুহকাম ও মুতাসাবিহাত এবং কুরআনুল কারীমের বিভিন্ন কারাআতসমূহের মুতাওয়াতির (অকাট্যতা) না হওয়া সম্পর্কে আলোচনা। বইটি ৬ খন্ডে ছাপা হয়েছে এবং গবেষকগণ সাদরে তা গ্রহণ করেছেন, যা,কোমের দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের পাঠ্য পুস্তক হিসেবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মাষ্টার্স ও পি.এইচ.ডির জন্য নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে আনষ্ঠানিকভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। অনুরূপভাবে এই বই ফারসি ১৩৬৯ সালে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সেরা বই হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে।
আহকামের আয়াতসমূহ সম্পর্কে আয়াতুল্লাহ মারেফাতের দৃষ্টিভঙ্গিঃ
আহকামের আয়াতসমূহ এমন সব আয়াত যেগুলো ফিকাহর হুকুমের অর্ন্তভূক্ত এবং মুফাসসিরগণ ধারনা করেছেন এ ধরনের আয়াতের সংখ্যা এক শত থেকে দুই হাজারের মধ্যে হতে পারে। আয়াতুল্লাহ মারেফাত এক্ষেত্রে স্বীয় বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিও মাধ্যমে এরকম ধারনা প্রত্যাখান করেন এবং দশ শতক পূর্বের মুফাস্সিরদের দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তন করে দেন। তিনি কুরআনের সকল আয়াতকে আহকামের আয়াত হিসেবে গণ্য করেন। আয়াতুল্লাহ মা’রেফাত কুরআনের আয়াতসমূহকে দুই ভাগে ভাগ করেন।
১. কিছু আয়াত ফিকাহ্ শাস্ত্রের আহকামের ভিত্তি স্বরূপ
২. এবং যেসব আয়াত ফিকাহ্ শাস্ত্রের আহকামের ফল স্বরূপ এসেছে।
কিন্তু আসলে সকল আয়াতই আহকামের আয়াত। তিনি “আত্ তাফসীর আল্ আসার আল্ জামে’-” কিতাবে রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে কিছু সংখ্যক আহকামের প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। আহকামের আয়াতসমূহের তাফসীর কুরআনের আভ্যন্তরীন আহকামের একটি অংশ এবং সেগুলো কুরআনের অভ্যন্তর থেকে আহকাম হিসেবে সাব্যস্ত হয়, সেগুলো ফিকাহর হুকুমসম্পন্ন বলে গণ্য হবে এবং আহকামের আয়াত হিসেবে নামকরণ করা হবে। কিন্তু আয়াতের আহকাম কেবলমাত্র ফিকহী বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত। আয়াতুল্লাহ মা’রেফাতের দৃষ্টিতে কুরআনের আয়াতসমূহের খুব কমই রহিত হয়েছে। আর রহিতকৃত আয়াতসমূহে সামগ্রিক নীতি পরিবর্তিত হয় না, তবে স্থান কাল ও পাত্র ভেদে আহকামের আয়াতসমূহের নীতিতে পরিবর্তন সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সন্দেহ ও সংশয়ের উৎস সম্পর্কে আয়াতুল্লাহ মা’রেফাতের দৃষ্টিভঙ্গিঃ
আয়াতুল্লাহ মা’রেফাত শীয়া জগতে উলূমে কুরআনের ভিত্তি স্থাপনকারী ছিলেন। তিনি কুরআনের ব্যাপারে শীয়া দৃষ্টিভঙ্গিসমূহ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে স্বীয় রচনাবলীর মধ্যে তাফসীরের বিভিন্ন রকম পদ্ধতি প্রদর্শন করে অনেক সন্দেহ-সংশয়ের জবাব দিয়েছেন। তিনি সন্দেহ-সংশয়ের উৎস চেনার ব্যাপারে বলতেনঃ “ওহীর মত বিষয়ের আলোচনায় অনেক সন্দেহ-সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। আর এসব সন্দেহ-সংশয়ের মূল উদ্দেশ্যে হলো এ যে, নবুওয়তের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাদের কাছে সুস্পষ্ট নয়। তারা নবী সম্পর্কে এমন সন্দেহ-সংশয়ের সৃষ্টি করেছেন যা খ্রীষ্টানদের পক্ষেও করা সম্ভব নয়।” তিনি আরো বলতেনঃ “সন্দেহ ও সংশয়ের উৎসসমূহ বৈচিত্রপূর্ণ। তাই সন্দেহ-সংশয়ের উৎসসমূহ চিহিৃত করা এবং তাদের জবাব দেয়ার জন্যে সর্বোত্তম পয়েন্ট বাছাই করা দ্বীনি-ইলম শিক্ষার্থীদের- বিশেষ করে, কুরআন শরীফের ছাত্রদের জন্যে খুবই জরুরী।” তিনি ওহী ও উর্ধ্বজগতের সাথে সাধারণ মানুষের সম্পর্কের পদ্ধতি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সন্দেহ-সংশয়ের প্রতি ইশারা করে বলেনঃ “বস্তুত পক্ষে মানুষের অস্তিত্বের দুইটি দিক রয়েছে। যে দিকটি পৃথিবীতে মানূষ হিসেবে জীবন-যাপন করে তাহলো তার বস্তুবাদী দিক। কিন্তু মানুষের অন্য একটি দিকও রয়েছে, যা তার বস্তুবাদী দেহে খোদায়ী রুহ ফুৎকারের মাধ্যমে উত্থিত হয়। যদি নবীদেরকে এ দুই দৃষ্টিকোণ থেকে লক্ষ্য করি, তাহলে উর্ধ্বজগতের সাথে তাদের সম্পর্ক একটি বাস্তবযোগ্য বিষয় বলে পরিগণিত হবে। অতএব, আপত্তি উত্থাপনারীদের ধারনা অনুযায়ী এ দু’জগতের অসামঞ্জস্যতার কারণে উর্ধ্বজগত থেকে বস্তুজগতে ওহী নাযিল হওয়ার অসম্ভবতার বিষয়টি পুরোপরি বাতিল বলে গন্য হবে। আয়াতুল্লাহ মা’রেফাত পাশ্চাত্য চিন্তা-ভাবনার উপর প্রভাব বিস্তারকারী “লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মাধ্যমসমূহের ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকে”-এ প্রধান ভিত্তিটির উপর সুস্পষ্টভাবে বলেন,“দ্বীন ইসলাম উচ্চমানের শিক্ষা সম্বলিত ধর্ম। অতএব এরকম চিন্তা-ভাবনা ইসলামের যুক্তিবিদ্যার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বাতিল পথের মাধ্যমে সত্যকে প্রমাণিত করা যায় না এবং দূর্বল দলীল প্রমাণের ভিত্তিতে দ্বীনের সবল সত্য বিষয়সমূহকে দৃঢ় করা যায় না।” আয়াতুল্লাহ মা’রেফাতের বিশ্বাস ছিলঃ “ইসলামের নবী বিভিন্ন ধর্ম ও গোত্রের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন। প্রতিটি অমুসলমান যদি ইসলামী হুকুমাতের তত্বাবধানে জীবন-যাপন করতে চায়, তাহলে তার জান, মাল ও ধর্ম-বিশ্বাস সম্মানের যোগ্য এবং তার উপর চড়াও হওয়া অথবা সশস্ত্র ব্যবহার করার অধিকার কারো নেই।”
আয়াতুল্লাহ মা’রেফাত এবং কুরআন গবেষণার প্রয়োজনীয়তাঃ
ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে প্রাচীনকাল থেকে এ রেওয়াজ ছিল যে, যে ব্যক্তি ফিক্হ ও উসূল বিষয়ে লেখাপড়া করত তাকে বড় আলেম হিসাবে চিহিৃত করা হতো । আর পরিশেষে সে-ই মারজাইয়াতের আসনকে অলংকৃত করতে পারত। এর মাঝে যদি কোন ব্যক্তির মারজায়ে তাকলীদ হওয়ার মত ইলমী যোগ্যতা থাকত, ফিকহ ও উসূলের পরিবর্তে দর্শন, ইরফান, কালাম অথবা উলূমে কুরআন ও তাফসীর বিষয়ে লেখাপড়া করত পন্ডিতদের কাছে তারা দ্বিতীয় স্তরের মর্যাদা লাভ করত। আয়াতুল্লাহ মা’রেফাত এমন এক ব্যক্তি ছিলেন, যিনি একজন বড় ধরনের ফকীহ ও মারজা’ হতে পারতেন, কিন্তু সমাজের প্রয়োজনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার কারণে উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কুরআন গবেষণাকে বাছাই করেন। তিনি কুরআনের প্রতি সুক্ষ ও গভীর দৃষ্টি দানের ক্ষেত্রে একজন আদর্শ মানুষ ছিলেন। বর্তমান যুগে কুরআন গবেষনাকারীদের সবাই কোন না কোনভাবে তাঁর ছাত্র। আয়াতুল্লাহ মা’রেফাত-যিনি সকল শিক্ষিত ব্যক্তির সত্যায়নে কুরআন গবেষকের আদর্শ বলে পরিগণিত হতেন। কুরআনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামী সমাজে একটি বড় ধরনের দ্বীনি চাহিদা হিসেবে বিবেচিত ছিল। কুরআনের আয়াতের জ্ঞানগর্ভ তাফসীরসহ অর্থ উপলব্ধির দিকে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের এ যুগে আয়াতুল্লাহ মা’রেফাতের ন্যায় ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয়তা অত্যাধিক।
আল্লাহ্ তার মহান আত্মার প্রশান্তি দান করুক এবং তার পথে মানব সমাজকে পরিচালিত করুক।
নূরে আলম মূহাম্মাদী
১০ অযার ১৩৮৬ ফারসী
২০ জিলক্বদ ১৪২৮ হি:
১২ ডিসেম্বর ২০০৭ইং