হযরত আবু বকরের খেলাফত লাভ:
কথিত যে, নবী করিম (সা.) হযরত আবুকবরকে খেলাফত দিয়ে গেছেন । তিনি হযরত আবুবকরকে নামাজের ইমামতি করার দায়িত্ব দিয়ে বিশ্ব মুসলিমকে এটাই বুঝাতে চেয়েছেন যে হযরত আবু বকরই খেলাফতের আসন অলংকৃত করার জন্যে অন্য সবার চাইতে বেশী যোগ্য । আর তাই বনি সাক্বিফার সমাবেশে সাহাবীরা তাকে খলিফা হিসেবে নির্বাচিত করেছেন ।”
কিন্তু ইতিহাস স্বীকৃত সত্য যে, বনি সাক্বিফাতে খলিফা নির্বাচনের প্রসংঙ্গ নিয়ে মোহাজের ও আনসারদের মধ্যে যে বাক-বিতন্ডা ও তর্ক বিতর্ক হয়েছিলো সেখানে কখনো নামাজের প্রসংঙ্গ উত্থাপিত হয়নি । উপস্থিত কেউ হযরত আবু বকরের খেলাফত লাভের জন্যে নামাজের ইমামতির যুক্তি উপস্থাপন করেন নি । সেখানে আমরা দেখতে পাই আনসাররা খেলাফতের জন্যে নিজেদেরকে সর্বাধিক যোগ্য হিসেবে তুলে ধরেছিলেন । আর মোহাজেররা খেলাফতের জন্যে নিজেদেরকে উপস্থাপন করেছিলন । তারা সেখানে কোন ক্রমেই আবুবকরের নামাজের ইমামতের ঘটনা তুলে ধরেননি । বরং হযরত ওমর সেখানে এগিয়ে এসে ঝগড়া ও মতভেদ এড়িয়ে ঘোষণা করলেন, “আমি আবু বকরের হাতে বাইয়াত গ্রহন করলাম।” এভাবে সেদিন বনি সক্বিফাতে উপস্থিত সাহাবীরা হযরত আবুবকরের হাতে বাইয়াত গ্রহন করেছিলেন ।
তখনও রাসূলের পবিত্র লাশ দাফন করা হয়নি খেলাফতের ব্যাপারে সাহাবীদের মধ্যে অনৈক্য শুরু হয়ে গিয়েছিল । বনি সক্বিফার সমাবেশে সাহাবীদের মাঝে উত্তপ্ত মতদগ্ধ কি প্রমাণ করে না যে তাদের মধ্যে খেলাফতের ব্যাপারে কোন প্রকার ঐক্যমত ছিল না ? ৫৫
মুলতঃ বনি সক্বিফার নির্বাচনী সমাবেশেরই বা কি প্রয়োজন ছিল ? নবী (সা.) তো হযরত আবু বকরকে খলিফা মনোনীত করে গেছেন-ই ! আর যদি তিনি নবী (সা.) কর্তৃক খলিফা মনোনীত হয়েই থ্কবেন তাহলে সেখানে সেদিন কারো মনে ছিলো না কেন ?
হযরত আব্বাস থেকে বর্ণিত যে, তিনি হযরত আবু বকর ও হযরত ওমরকে জিজ্ঞেস করেন, “খেলাফতের ব্যাপারে নবী (সা.) আপনাকে কি কিছু বলে গেছেন ? তারা উভয়েই বললেন না । অতঃপর তিনি হযরত আলীকে বলেন, “ হে আলী তোমার হাত বাড়িয়ে দাও, আমি তোমার হাতে বাইয়াত গ্রহন করি ।”৫৬
বস্তুতঃপক্ষে নবী (সা.) কর্তৃক খেলাফতের মনোনয়ন হযরত আলী ইবনে আবি তালিবকেই প্রদান করা হয়েছিল যা গাদীরে খুমের ঘটনায় আমরা স্পষ্ট উপলদ্ধি করতে পারি ।
আর নামাজে ইমামতির বিষয়টা কি করে খেলাফতের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে ? সাহাবী ও তাবেয়ীনের যুগে কখনো এ ধরণের ব্যাখ্যার অবতারণা করা হয়নি । তাবেয় ও তাবেয়ীনের যুগে যখন হযরত আবু বকরের খেলাফতের বৈধতার ব্যাপারে বিভিন্ন প্রশ্ন ও সংশয় উত্থাপিত হতে থাকে তখন তার নির্বাচনের বৈধতা প্রমাণের জন্যে নামাজে ইমামতির যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে । আর হযরত আয়েশা থেকে বর্ণিত হযরত আবু বকরের নামাজে ইমামতির হাদীস ছাড়াও হযরত হাফসা থেকে বর্ণিত হাদীসও বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে । তিনি বলেছেন, “আবু বকর নামাজে ইমামতি করেন নি, বরং ওমর নামাজে ইমামতি করেছেন ।”৫৭
অন্যদিকে এমন সব হাদীস বিদ্যমান যেখানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, অসুস্থ অবস্থায়ও প্রিয় নবী (সা.) স্বয়ং নামাজে ইমামতি করেছেন ।৫৮
সুতরাং নামাজে ইমামতির বিষয়টা কোনক্রমে খেলাফত লাভের বৈধ কারণ হতে পারে না ।
আর যদি হযরত আবু বকর রাসূলের খলিফা হিসেবে মনোনীত হয়ে থাকবেন তাহলে এত সাহাবীদের বিরোধীতার কারণ কি ?
হযরত আবু বকরের খেলাফতের প্রতি মা ফাতিমার অস্বীকৃতি:
হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহ আলাইহি তার দুনিয়া ত্যাগের পূর্বমূহুর্ত পর্যন্ত হযরত আবু বকরকে খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন নি ।৫৯
তিনি কি জানতেন না যে নবীজি বলেছেনঃ
مَنْ ماتَ وَلَمْ يَعْرِفْ إمامَ زَمانِهِ ماتَ مَيْتَةً جاهِلِيَّةً
অর্থাৎঃ “যে ব্যাক্তি তার যামানার ইমামকে না চিনে মৃত্যু বরণ করলো সে জাহেলিয়াতের সাথে মৃত্যু বরণ করল।৬০
নিশ্চয়ই নবী করিম (সা.) এর প্রিয় কন্যা হযরত আবু বকরের খেলাফতের প্রতি অস্বীকৃতি প্রদানের কারণে জাহেলিয়াতের মৃত্যু বরণ করতে পারেন না । কেননা প্রিয়নবী (সা.) তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেনঃ
فاطمه سیدة نساء العالمین
অর্থাৎঃ “ফাতিমা বিশ্ব নারীদের নেত্রী।”
তিনি আরো বলেছেনঃ
فاطمه سیدة نساء اهل الجنّة
অর্থাৎঃ “ফাতিমা বেহেশতের নারীদের নেত্রী।”৬১
তিনি কখনো এমন কাজ করতে পারেন না যাতে তিনি জাহেলী মৃত্যু বরণ করতে পারেন । তাহলে তো নবীজীর কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে যায় । হযরত ফাতিমার ব্যাপারে তিনি বলেছেন,
“ফাতিমা আমার দেহের অংশ, যে ফাতিমাকে কষ্ট দেয় সে আমাকে কষ্ট দেয় ।”৬২
যদি হযরত ফাতিমার (সা.আ.) বেহেশতে যাওয়ার ব্যাপারটা নিশ্চিত হয়ে থাকে তাহলে কি হযরত আবু বকরের খেলাফতের অস্বীকার করেও বেহেশতে যাওয়া যায় ? হযরত আবু বকর যদি সত্যিই ইমাম বা খলিফা হয়ে থাকেন তাহলে তো হযরত ফাতিমার (সা.আ.) জন্য ফরজ ছিল ইমামের আনুগত্য করা । আর ফাতিমার (সা.আ.) বিরোধীতাই প্রমাণ করছে যে, তিনি হযরত আবু বকরকে বৈধ খলিফা হিসেবে মান্য করতেন না । তিনি নিশ্চয় তার যমানার ইমামকে চিনে মৃত্যু বরণ করেছেন । আর এভাবেই তিনি বেহেশতের নারীদের নেত্রী হিসেবে গন্য হবেন । তিনি তো কোন ভুল-ত্রুটি করতে পারেন না । আর খেলাফতের অস্বীকার করার মত ভুল ! মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা আহযাবের ৩৩ নং আয়াতে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন যে তিনি আহলে বাইতকে সব ধরণের অপবিত্রতা বা পাপ –পংকিলতা থেকে মুক্ত রেখেছেন । অতএব এটা পরিস্কার হয়ে যায় যে নবী (সা.) এর ইহলোক ত্যাগের পর তিনি আবু বকর ব্যতীত অন্য কাউকে ইমাম হিসেবে মানতেন । তিনি মসজিদে নববীতে ফাদাক বাগান কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদে হযরত আবু বকরের বিরুদ্ধে আর হযরত আলীর ন্যায্য খেলাফতের স্বপক্ষে যে ঐতিহাসিক বক্তব্য রেখেছেন তা থেকে স্পষ্ট প্রতিয়মান হয় যে তিনি হযরত আলীকেই তার ইমাম বা নেতা হিসেবে মান্য করতেন ।৬৩
হযরত ফাতিমার ব্যাপারে মহানবী (সা.) আরো বলেছেনঃ
فاطمة مهجة (بهجة) قلبي، وابناها ثمرة فؤادي، وبعلها نور بصري، والأئمّة من ولدها أمناء ربي وحبل الممدود بينه و بين خلقه، من اعتصم بهم نجا ، ومن تخلف عنه هوى
অর্থাৎঃ-“ফাতিমা আমার হৃদয়ের উল্লাস, তার দু’ ছেলে আমার অন্তরের ফসল এবং তার স্বামী আমার নয়নের জ্যোতি আর তার সন্তানদের মধ্যে থেকে ইমামরা হচ্ছেন আমার রবের আমানত রক্ষাকারী । তারা সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টিকুলের মাঝে (সমন্বয় সাধনকারী) দীর্ঘ রশ্মি । যে তাদের শক্ত করে আকড়ে ধরলো সে নাযাত পেল আর যে তাদের কাছ থেকে দুরে সরে থাকলো সে ধ্বংস হলো ।”৬৪
উক্ত হাদীসে নবী করিম (সা.) হযরত ফাতিমা ও তার স্বামী-সন্তানদের গুরুত্ব এবং তাদের অনুসরনের ব্যাপারে স্পষ্ট দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন । হযরত ফাতিমাকে হৃদয়ের উল্লাস বলার কারণ কোন মতেই শুধুমাত্র সন্তান হওয়ার কারণে নয় বরং তিনি ফাতিমার ভিতর এমন সব মহৎ গুনাবলীর সমাবেশ দেখতে পেয়েছিলেন যার কারণে এতসব বিশেষণ উল্লেখ করেছেন । তার স্বামী ও সন্তানদের অনুসরণ নাজাত ও মুক্তি বয়ে আনবে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন । সুতরাং এটা বুঝতে আর বাকী থাকার কথা নয় যে নেতৃত্ব ও নাজাতের প্রশ্নে হযরত ফাতিমাও তার স্বামীকে অনুসরন করতেন তার সম্মানিত পিতার ইন্তেকালের পর । কেননা তাতেই রয়েছে নাজাত ও মুক্তি ।