মাযহাবের প্রসঙ্গ

880
নবী করিম (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর প্রায় দুই শতাব্দী পর্যন্ত কোন মাঝহাবের অস্তিত্ব ছিল না। কেননা হযরত আবু হানীফার জন্ম ৮০ হিজরী সনে এবং মৃত্যু ১৫০ হিঃ তে সংঘটিত হয়। হযরত মালিক বিন আনাস (ইমাম মালিক) ৯৫ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৭৫ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। হযরত মুহাম্মাদ বিন ইদ্রিস শাফেয়ী ১৫০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ আর ২০৪ হিজরীতে পরলোকগমন করেন। হযরত আহমাদ বিন হাম্বাল হিজরী ১৬৪ সনে ভূমিষ্ঠ হন এবং হিজরী ২৪১ সনে ইহলোক ত্যাগ করেন। আর আবুল হাসান আশআরী ২৭০ হিজরী সনে পৃথিবীতে আগমন করেন এবং ৩৩৫ হিঃ তে পরলোকগমন করেন। বর্তমান চার মাঝহাব সৃষ্টি হওয়ার পূর্বে মুসলমানগণ কোন মাঝহাব অনুসরণ করতেন? নিশ্চয়ই চার মাঝহাবের মধ্যকার কোন মাঝহাবের অনুসরণ করতেন না কেউ। তাহলে দুইশত বৎসরের মুসলমানদের আমলের হিসাব কিভাবে হবে? সুতরাং মাযহাব মানা যে ফরজ, এ কথাটি সঠিক নয় এবং মাযহাব মানুষের সৃষ্টি।
 
আসলে আমরা কি কখনো খুটিয়ে দেখেছি এই সুন্নী মাঝহাবসমূহের আবির্ভাব কিভাবে হয়েছে? এ বিষয়ে বাংলাদেশের বহুল পরিচিত “ইসলামিক ফাউন্ডেশন”- এর প্রকাশিত জনাব মনির উদ্দিন ইফসুফ-এর লেখা “কারবালা একটি সামাজিক ঘূর্ণাবর্ত” পুস্তক থেকে উদ্ধৃতি প্রদানই যথেষ্ট মনে করছি। লক্ষ্য করুন! তিনি লিখেছেনঃ
 
[আব্বাসীয় আমলটা ছিল নানা দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই আমলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন মতবাদ রূপ লাভ করে। সুফী ও শরীয়তের ইমামগন আত্মপ্রকাশ করতে থাকেন। বিভিন্ন জ্ঞান বিজ্ঞানের অনুবাদ হয় আরবিতে, গ্রীক দর্শন ইসলামী চিন্তার উপর গভীর ও সুদূর প্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। এই সময়ের মধ্যেই ইসলামী সমাজ, রাষ্ট্র ও চিন্তা যে রূপ পরিগ্রহ করে, তাকে অনুসরণ করেই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলমান গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে চলে। সংক্ষীপ্ত আকারে হলেও নিচে আমরা সে সব অবস্থার রূপ ও পরিণতি কী হয়েছিল তা দেখতে প্রয়াস পাব।
 
দ্বিতীয় আব্বাসীয় খলিফা মনসুরের সময় ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) ইসলামের অবিকৃত রূপ ও তার সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের উপর মত প্রকাম করেন। আবু হানীফার জনপ্রিয়তা ও প্রভাব দেখে মনসুর তাকে কুক্ষিগত করার প্রয়াসে বাগদাদের প্রধান বিচারপতির পদ প্রদান করেন।
 
আবু হানিফা (রহঃ) এই প্রস্তাব অস্বীকার করায় মনসুর তাকে কারারুদ্ধ করেন, কারাগারেই আবু হানিফার মৃত্যু হয়। সুন্নী মতবাদের আরেক জন প্রচারক ইমাম মালিক (রহঃ)-কেও বেত্রাঘাতে জর্জরিত করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। এই ভাবে কুরআন ও রাসূলুল্লাহর অনুসারী দু’জন শরীয়াতের ইমামের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই সময় মদীনায় খাটি ইসলামী চিন্তার দার্শনিক ও মর্মগত দিক ব্যাখ্যা করে বলেছেন ইমাম জা’ফর সাদেক (রাঃ)। হযরত আলী (রাঃ)- এর প্রপৌত্রের এমন ধর্ম ব্যাখ্যা মনসুরকে বিচলিত করলো। মনসুর ইমাম জা’ফর সাদেককে রাজসভায় আহ্বান করে তাকে হত্যা করার সংকল্প করলেন। কিন্তু ইমাম জা’ফর সাদেকের সঙ্গে কথা বলে খলিফা যখন বুঝতে পারলেন যে, সাধকের প্রচেষ্টা প্রধানত সামাজিক নয়, ব্যক্তিগত আত্মিক উৎকর্ষেরই তিনি প্রচারক, তখন ইমাম জা’ফরকে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দেওয়াই তার কাছে যুক্তিযুক্ত বলে বিবেচিত হয়। তবে মনসুর সেই সঙ্গে এই কথাও বুঝতে পারলেন যে, তার রাজবংশের স্থায়ীত্বের জন্যে প্রয়োজন এক সুদৃঢ় মতবাদের। সেই মতবাদ কুরআন ও সুন্নাহকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করবে যা তার স্বার্থের প্রতিকূল নয়। তেমন মতবাদ তিনি তার অনুগত আইনজ্ঞদের দ্বারা করিয়ে নিলেন ও সেই মতবাদের নাম দিলেন “সুন্নী মতবাদ”। এই মতবাদের মধ্যে নবী বংশের দাবির কথা যেমন নেই, তেমনই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও তাঁর অব্যবহিত দুই খলিফার সময়কার সমাজ ব্যবস্থার কথাও নেই। পরবর্তীকালে খলিফা হারুণ আর রশীদের সময়ে মাম্রাজ্যের প্রধান বিচারপতি আবু ইউসুফের নেতৃত্বে এক আইনজ্ঞ দলের সহায়তায় ইমাম আবু হানীফার (রহঃ) নাম দিয়ে হানাফী মাঝহাবের ধর্মীয় বিধি সুস্পষ্ট আকার ধারন করতে থাকে। তাতেও ব্যক্তিগত আচার অনুষ্ঠান ও এমন সামাজিক সমস্যা প্রাধান্য লাভ করে যাতে রাজ বংশের স্থায়ীত্ব ও সমাজের সামন্তবাদী প্রকৃতির পরিবর্তন করার কোন প্রচেষ্টার ইঙ্গিত মাত্র নেই। পরবর্তী মাঝহাবগুলোকেও এমনিভাবে রাজতন্ত্রের ও সামন্ততন্ত্রের পরিপোষকরূপে ছাটাই করে তবে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। (কারবালা একটি সামাজিক ঘূর্ণাবর্তঃ মনির উদ্দিন ইউসুফ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, প্রথম ও দ্বিতীয় প্রকাশ যথাক্রমে ডিসেম্বর -১৯৭৯ ও ডিসেম্বর ১৯৯২, পৃঃ ১০, ১১)।]

There are 1 comments

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »