মানব জাতির সহজাত বৈশিষ্ট্য হল শক্তিশালী কোন সত্তার সম্মুখে নিজেকে অবনত রাখা। শৈশব থেকে যখন মানব বিচার-বুদ্ধি উন্নতি লাভ করতে থাকে তখন থেকেই প্রকৃতগতভাবে তার মনে এ চিন্তার উদ্রেক হয় যে,এতসব আশ্চর্য ও বিষ্ময়কর সৃষ্টির কি কোন শক্তিশালী সৃষ্টিকর্তা নেই? তখন থেকে শুরু হয়ে যায় তার কৌতুহলী জিজ্ঞাসা। সে খুজতে থাকে প্রকৃত সৃষ্টিকারককে। ক্রমশঃই তার কাছে সবকিছুর-ই কোন সৃষ্টিকারক আছে বলে ধারণা হতে থাকে। এ ব্যাপারে প্রতিটি মানব প্রকৃতিই বলে দেবে পৃথিবীর জন্যেও অবশ্যই কোন সৃষ্টিকারক আছেন। তাই স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা সর্বকালেই অধিকাংশ বলে পরিগণিত হয়ে আসছে। আল্লাহকে চেনার ক্ষেত্রে মানুষের তেমন কোন বেগ পেতে হয় না,কেননা তার প্রকৃতিই তাকে দিক নির্দেশনা দিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসের পর তার বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী চিহ্নিত করতে গিয়ে মানুষ প্রচুর ভুলের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। আল্লাহ যেহেতু আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোন সত্তা নয় সেহেতু তার বৈশিষ্ট্যাবলী চিহ্নিত করতে অনেকাংশে মানুষ বিভ্রান্তির শিকার হয়ে পড়ে। কেননা,বস্তুগত সত্তার বৈশিষ্ট্য আমাদের জন্যে বোধগম্য নয়। আর সেজন্যে এক্ষেত্রে খুব ভেবে চিন্তে আল্লাহর বৈশিষ্ট্য নিরূপন করা একান্ত প্রয়োজন।
মানব সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাসে আমরা বিভিন্ন মতবাদে বিশ্বাসী মানুষের অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করি। কেউ একত্ববাদী,আবার কেউ দ্বিত্ববাদী। কেউ আবার বহুত্ববাদে বিশ্বাসী। কেউ অগ্নিপূজক আবার কেউ মূর্তিপূজক।
যখন কেউ প্রকৃতির তাড়নায় বিশ্ব বিধাতার অবস্থান অন্বেষণ করে তখন তার দৃষ্টিগোচর হয় এক বিশালাকৃতির মহাকাশ,বিরাটাকার সূর্য যা সমস্ত পৃথিবীকে আলোকিত ও উত্তপ্ত করে। রাত্রের অন্ধকারে প্রত্যক্ষ করে আকাশের বুকে চন্দ্র ও তারকারাজী। বৃহদাকার পাহাড়-পর্বত,গাছ-পালা,নদ-নদী প্রভৃতি আরো শক্তিশালী ক্রিয়া-কর্মের নিদর্শন পরিলক্ষিত হয় প্রতিটি মানুষের দৃশ্যপটে। এক্ষেত্রে কোরআনে উল্লেখিত হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন,‘সূর্য প্রভাতে উদয় হয় আবার সন্ধ্যাবেলা অস্তমিত হয়ে যায়। তেমনি চন্দ্র রাত্রে প্রকাশিত হয় আবার প্রত্যুষে সূর্যের আলোর সম্মুখে বিলিন হয়ে যায়। এ সব কিছুই পরিবর্তনশীল। যে সত্তা সর্বদা পরিবর্তনশীল ও বস্তুজাত সত্তা তা কখনো মূল স্রষ্টা বা আদি সত্তা হতে পারে না। আমাদের স্রষ্টার কখনো অনস্তিত্বের রূপ ছিল না যে,পরবর্তীতে সময়ের আবর্তনে অস্তিত্বের আকার ধারণ করেছে। সৃষ্টিকুলের সৃষ্টিকারক এমন পরাক্রমশালী সত্তা যার নির্দেশে পরিচালিত হবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল কিছু।’
লক্ষনীয় যে,এ বিশ্ব সৃষ্টির শৃঙ্খলা বিন্যাস ও বিরাজমান ভারসাম্য দর্শনে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের পরিচয় লাভ যেমনি অত্যন্ত সহজ,তার বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করা তেমনি কঠিন। কেননা,তিনি তো আমাদের ন্যায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোন সত্তা নন। সুতরাং আল্লাহর বৈশিষ্ট্য পরিচয়ের জন্যে প্রাকৃতিক জগতের সমস্ত জীব ও জড় পদার্থের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য থেকে তাকে আলাদা করে ভাবতে হবে। তার কারণ,তিনি প্রকৃতির কোন বস্তুর জাত ও বৈশিষ্ট্যের সাথে সংগতিপূর্ণ নন। তিনি আমাদের সকল কল্পনা,রূপকথা ও কল্প কাহিনীর বহির্ভুত এক সত্তা। এ বস্তু জগতের কোন কিছুর সাথে তাকে তুলনা করা চলে না।
এ কারণে আল্লাহর অস্তিত্বের পরিচয়ের পর তার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে বহু মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। তার প্রকৃত কারণ হল,মানুষ তার সৃষ্টিকর্তার গুণাবলীকে প্রকৃতির ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য ও দর্শনীয় জীব ও জড় পদার্থের সাথে তুলনা দিয়ে নির্ণয় করতে সচেষ্ট। আর এ জন্যেই এতসব মতবাদের উদ্ভব হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবে মানব মনে প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে,‘এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধিকর্তা কি একক নাকি একাধিক?’
উক্ত প্রশ্নের উত্তরের জন্যে আমাদের পরবর্তী আলোচনা ফলদায়ক প্রমাণিত হতে পারে।
আল্লাহর একত্বের প্রমাণ:
শৃঙ্খলার দৃষ্টান্ত:
কেউ যদি আপনাকে প্রশ্ন করে,‘আপনার দেশের জন্যে কি দু’জন রাষ্ট্রপ্রধান প্রয়োজন?’ নিশ্চয়ই কোন বিবেকবান ব্যক্তি একটি রাষ্ট্রের জন্যে দু’জন রাষ্ট্রপ্রধানের কথা ব্যক্ত করতে পারেন না। একইভাবে যদি প্রশ্ন করা হয়,‘কোন একটি বিষয়ের একটি ক্লাশের জন্যে একই সঙ্গে দু’টি শিক্ষকের প্রয়োজন আছে কিনা?’ আপনি অবশ্যই ইতিবাচক উত্তর দিতে পারেন না। কেননা,একজন সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি ও বিচার বিবেচনা সম্পন্ন ব্যক্তি এটা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হবেন যে,কখনো একই কাজে একই সময়ে একই পরিধিতে একাধিক দায়িত্বশীলের অস্তিত্ব,শৃঙ্খলা সৃষ্টিতে সহায়ক হতে পারে না। প্রতিটি বুদ্ধিমান ব্যক্তিই স্বীকার করবেন,এর ফলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে বাধ্য।
আমরা বিশ্ব জগতের কোথাও কোন বিশৃঙ্খলার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাই না। সর্বত্র সুশৃঙ্খলতা ও ভারসাম্য বিরাজমান। সর্বক্ষেত্রে জীব ও জড়বস্তুতে আমরা সুসামঞ্জস্যতা পরিলক্ষিত । বস্তুজগতের একটি অণু-পরমাণু থেকে সর্ববৃহৎ ছায়াপথ পর্যন্ত সর্বস্থানে আমরা প্রত্যক্ষ্য করি একটি মাত্র নির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি। কোথাও নির্ধারিত নীতির বরখেলাফ হচ্ছে না। এ থেকে কি এটা প্রমাণ হচ্ছে না যে,যদি সৃষ্টিজগতের জন্যে একাধিক স্রষ্টার অস্তিত্ব বর্তমান থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই এ ধরণের শৃঙ্খলা,সামঞ্জস্য ও নিখুত পরিমাপ সর্বত্র পরিলক্ষিত হতো না। তাই ন্যায়সঙ্গতভাবে স্বীকার করে নিতে হয় যে,এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি ও পরিচালনায় একাধিক সত্তার প্রভুত্ব নিতান্তই একটি ভিত্তিহীন বিশ্বাস মাত্র,যা কোন ক্রমেই একজন স্বাধীন বিবেকবান মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
নিম্নলিখিত উদাহরণটি বিষয়টিকে স্পষ্ট করতে সাহায্য করবে :
ধরুন ৫০০ পৃষ্ঠার একটি বই আপনার সামনে। আপনি এখনো পড়ে দেখেননি। আপনি জানেন না যে এ পুস্তকের সব অধ্যায় একজন গ্রন্থকারের লেখনীর মাধ্যমে সমাপ্ত হয়েছে,নাকি প্রতিটি অধ্যায়ের জন্যে পৃথক পৃথক লেখকের প্রয়োজন হয়েছে? এর প্রকৃত বিষয় উদ্ঘাটনের জন্যে নিশ্চয়ই আপনাকে সমস্ত পুস্তক অধ্যয়ন করতে হবে। অধ্যয়ন করে যদি দেখেন এ গ্রন্থের মূল বিষয়াদি,বাক্য গঠন,ব্যাখ্যা-রচনা,যুক্তি-প্রমাণের পদ্ধতি ও পন্থা একই রকম আর প্রতিটি বিষয়ের মধ্যে এক প্রকার সামঞ্জস্য বিদ্যমান তাহলে নিঃসন্দেহে আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন যে এ গ্রন্থের সকল বিষয় ও অধ্যায়ের রচয়িতা একজন ব্যক্তি। কেননা যদি উক্ত গ্রন্থ রচনা দু’জন বা ততোধিক গ্রন্থকারের মাধ্যমে সংগঠিত হতো তা’হলে যে কোন প্রকারে পুস্তকের মধ্যে অনৈক্য ও অসামঞ্জস্যতা পাঠকের সামনে ফুটে উঠতো।
তদ্রুপ মহান আল্লাহর সৃষ্টিকুলকে যদি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান পুস্তকের সাথে তুলনা করি তা’হলে দেখতে পাব যে এ বইতে কোন প্রকার খুঁত নেই। সমগ্র বিশ্ব জুড়ে দৃষ্টিগোচর হবে এক বিস্ময়কর শৃঙ্খলা-বিন্যাস,পরস্পরিক সহযোগীতা ও ঐক্য-সামঞ্জস্য। শত-কোটি নক্ষত্র ভিন্ন ভিন্ন কক্ষপথে দ্রুত গতিতে ধাবমান থাকা সত্ত্বেও কখনো পথভ্রষ্ট হয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে না। তারা সর্বত্র একটি মাত্র পরিচালকের কর্তৃত্ব মেনে চলছে,যা তাদেরকে দিয়েছে এক ও অভিন্ন পথের নিশানী। যদি সৃষ্ট বস্তুসমুহের সৃষ্টি ও পরিচালনায় একাধিক স্রষ্টার প্রভুত্ব বিরাজমান থাকতো তাহলে কখনো এ ধরনের শৃঙ্খলা ও সহযোগীতা পরিদৃষ্ট হতো না। তিনি আল্লাহ্ এক ও অদ্বিতীয়। তিনিই চুড়ান্ত পরিচালক ও অভিভাবক। সৃষ্টি জগতের সকল কিছুর ব্যবস্থাপক তিনিই। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ বলছেন :
قُلْ هُوَ اللَّـهُ أَحَدٌ اللَّـهُ الصَّمَدُ لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُن لَّهُ كُفُوًا أَحَدٌ
অর্থাৎ : বল (হে মুহাম্মাদ,আল্লাহ্ এক ও অদ্বিতীয়,আল্লাহ্ কারো মুখাপেক্ষী নন। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং জন্ম লাভও করেন নি। এবং তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। (আল্ ইখ্লাস,আঃ নং-১-৪।)
সারসসংজ্ঞা ও সত্তাশীল অস্তিত্ব:
বাস্তব ক্ষেত্রে আমাদের সামনে অসংখ্য জীব ও জড়বস্তু দৃশ্যমান। বস্তুনিচয়ের মুখোমুখী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা প্রতিটি বস্তুর মধ্যে দু’টি দিক অবলোকন করি। একদিকে জীব ও জড় বস্তুসমূহের নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন ধরণ ও পার্থক্যসহ প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য দৃষ্টিগোচর হয়। অপরদিকে তারা সকলে সত্তাশীল,অস্তিত্বমান। এ সত্তাশীলতা সবার মধ্যে সমান-ভাবে বিরাজমান,সার্বজনীন বিষয়। অন্যভাবে বলা যায়,নিঃসন্দেহে বহির্জগতের দৃশ্যমান বস্তুসমুহ যেমন : সত্তাশীল মানুষ,সত্তাশীল ঘোড়া,বৃক্ষ ইত্যাদি জড় ও জীব পদার্থ বিদ্যমান। অতএব,বহির্বিশ্বের প্রতিটি বস্তু দু’টি জিনিসের সমন্বয়ে দৃশ্যমান। একটি হচ্ছে ঐ বস্তুর সার সংজ্ঞা যার মাধ্যমে বস্তুনিচয়ের পরস্পরের পার্থক্য ও ভিন্নতা নির্ণয় করা যায়,যেমন আমরা বলে থাকিঃ এটা মানুষ,ওটা ঘোড়া,এটা বৃক্ষ ইত্যাদি। অপরটি হচ্ছে সত্তাশীলতা। প্রতিটি দৃশ্যমান বস্তুর উপর এ সত্তাশীলতা আরোপ করা যেতে পারে। কিন্তু সারসংজ্ঞা বিভিন্ন বস্তুর জন্যে পৃথক পৃথকভাবে আরোপিত। দৃষ্টান্তস্বরূপ বস্তুনিচয়ের একটা অংশ মানুষ,আরেকটি অংশ ঘোড়া ইত্যাদি। অর্থাৎ প্রতিটি সারসংজ্ঞা পৃথক পৃথকভাবে বস্তু জগতের এক একটি অংশের জন্যে প্রযোজ্য,একই সারসংজ্ঞা সবার জন্যে নয়। কিন্তু সত্তাশীলতা এ রকম নয়। সত্তাশীল বস্তু জগতের প্রতিটি বস্তুর উপর একক সত্তাশীলতার বৈশিষ্ট্য আরোপ করা যায়। তবে পৃথক পৃথকভাবে সত্তাশীল বস্তুর সার সংজ্ঞা বিরাজমান।
অতএব,এক কথায় বলা যেতে পারে যে,সম্ভাব্য নির্ভরশীল সত্তার মূল বিষয় বস্তুই হল সারসংজ্ঞা। কেননা সারসংজ্ঞা ব্যতীত কি করে একটি বস্তুর সাথে অন্যটির পার্থক্য নির্ণয় সম্ভব? সকল দৃশ্যমান বস্তুর আলাদা নামকরণের কারণ-ই হচ্ছে এ সারসংজ্ঞা। প্রতিটি বস্তুর জন্যে পৃথক পৃথক সারসংজ্ঞা থাকার কারণেই তো আমরা তাদের নামকরণ করতে পারি। তা’হলে বুঝা গেল,বস্তুজগতের কোন কিছুই সারসংজ্ঞা বহির্ভূত নয় বরং এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রতিটি সারসংজ্ঞাধারী বস্তুই সম্ভাব্য ও নির্ভরশীল সত্তা। কেননা,কোন স্ব-নির্ভর,অপরিহার্য,শাশ্বত ও আদি সত্তার জন্যে তা কোন সারসংজ্ঞার প্রয়োজন হয় না। যদি কোন কিছুর উপর সারসংজ্ঞা আরোপ করা হয় তা’হলে সেটা বস্তুগত সত্তার রূপ পরিগ্রহ করবে। আর আল্লাহ্ তো কোন বস্তুগত সত্তা নন কেননা বস্তুগত সত্তা সত্তাশীল হওয়ার জন্যে নিজেই অন্যের উপর নির্ভরশীল। সে কি করে বস্তু জগতের সব কিছুকে অস্তিত্ব দান করতে পারে? সুতরাং যে সত্তা আপন থেকে সৃষ্ট,স্বনির্ভর ও অমুখাপেক্ষী তার কোন সারসংজ্ঞার প্রয়োজন নেই। তাঁর জাত বা সারসত্তাকে কোন সংজ্ঞার বাধনে আবদ্ধ করা সম্ভব নয়। তাঁর সারসত্তা মানে সত্তাশীলতা। অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্বকে তাঁর সারসত্তা থেকে কোনরূপে পৃথক করা সম্ভব নয়। যেহেতু তাঁর কোন সারসংজ্ঞা নেই তাই তিনি শুধুই অস্তিত্বমান। তিনি কোন যৌগিক সত্তা নন। যদি সারসংজ্ঞা ও সত্তাশীলতার সংমিশ্রনে তিনি অস্তিত্বমান হতেন তা’হলে তিনি হয়ে পড়তেন একটি যৌগিক সত্তা। আর সব যৌগিকই তার অংশসমুহের উপর নির্ভরশীল।
যেহেতু অপরিহার্য সত্তার জন্যে কোন সারসংজ্ঞার প্রয়োজন হয় না তাই তিনি স্বয়ংসৃষ্ট,স্বাধীন এবং একক। কেননা,বহুত্বের ধারণার অর্থ হলো সত্তাশীল বাস্তবতার জগতে একটি অন্যটি থেকে পৃথক,তাদের প্রত্যেকে আপন বৈশিষ্ট্যবলে বিরাজমান। আর এ বহুত্বের সঙ্গে সারসংজ্ঞাহীন সত্তাশীলের ধারণা সংগতিপূর্ণ নয়। সুতরাং কোন অপরিহার্য ও পরম সত্তাশীল অস্তিত্বের কাছে একাধিকতা ও বহুত্ব সম্পূর্ণ অগ্রহণীয় ও পরিত্যাজ্য।
আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণে নবী বংশের ষষ্ঠ পুরুষ (আঃ)-
এক : জনৈক ব্যক্তি ইমাম জাফর বিন মুহাম্মদ -এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে অনুরোধ জানালো, আল্লাহকে চেনার জন্যে আমাকে দিক নির্দেশনা দিন।
ইমাম প্রতিত্তোরে বললেন,
‘জাহাযে কখনো আরোহণ করেছো?’
‘হ্যাঁ’ উত্তর দিল লোকটি।
ইমাম বললেন,
‘কখনো কি এমনটি হয়েছে যে তোমাদের জাহাযের পাটাতন ভেঙ্গে গিয়েছিল? আর তুমি সাতারও জানতে না?’
‘হ্যাঁ’ এমনটি হয়েছিল,লোকটি বলল,‘ঐ সীমাহীন হতাশা ও অনন্ত নিরাশার মাঝেও কি তোমার অন্তরের গভীরে কোন অজানা শক্তির ঝংকার শব্দ হয়নি,যে তোমাকে এ মহাবিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে?’
ইতিবাচক উত্তর দিলো লোকটি এবং বললো,
‘আমি তখন অন্তর থেকে অনুভব করছিলাম যে,এমন একটি শক্তি আছে যিনি আমাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারবেন’।
লোকটিকে উদ্দেশ্য করে ইমাম বললেন,‘তুমি যে শক্তির উপস্থিতি অনুভব করছিলে তিনি-ই মহান আল্লাহ,সকল কিছুর স্রষ্টা।১৮
দুই : একদা মুফায্যাল নামক ইমাম জাফর বিন মুহাম্মাদের একজন ঘনিষ্ট ছাত্র ইমামের খেদমতে আরজ পেশ করলো,
‘আমরা যখন এ বিশ্বজগতের শৃঙ্খলা-বিন্যাসের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পেশ করতে চেষ্টা করি তখন একদল নাস্তিক ও বস্তুবাদী লোক বলে উঠেন …ওসব কিছুকে প্রকৃতি সৃষ্টি করেছে’।
ইমাম বলেন,‘ঠিক আছে,যদি প্রকৃতির উদ্দেশ্য ও অর্থ এমন কোন সত্তাকে বুঝানো হয়ে থাকে যিনি জ্ঞানী,শক্তিশালী,স্বাধীন ও প্রজ্ঞাবান,তাহলে তিনিই মহান আল্লাহ। ভুলবশত : তারা নামকরণ করেছেন প্রকৃতি। আর যদি প্রকৃতির অর্থ এমন কোন অস্তিত্বের কথা বোঝানো হয়ে থাকে যার জ্ঞান,ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতা নেই তবে সে তো এক কল্পনার বস্তু। বিশ্বজগতের এতসব বিষ্ময়কর শৃঙ্খলা-বিন্যাস ও ঐক্য সামঞ্জস্য ব্যবস্থাপনা কখনো প্রকৃতি নামক কোন নির্বোধ জ্ঞানহীন ও অন্ধ-বধির সত্তার মাধ্যমে পরিচালিত হতে পারে না’।১৯