বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি

903 0

শিশু জন্মলগ্ন থেকেই তার চার পাশে অনেককে দেখতে পায়। সর্বপ্রথম যার সাথে সাক্ষাৎ ঘটে তিনি হলেন নবজাত শিশুর মা। ধীরে ধীরে যখন শিশু বড় হতে থাকে তখন সে মা ছাড়াও আরো অনেকের সাখে পরিচয় লাভ করে। আস্তে আস্তে বিভিন্ন ধরনের বস্তুর সাথেও পরিচিত হতে থাকে। এভাবে শুরু হয় একটি শিশুর জীবনযাত্রা।

মানুষ স্বভাবগত ভাবেই কৌতুহলী। তার চারপাশের বিভিন্ন বস্তু ও ব্যক্তি সন্বন্ধে জানার কৌতুহলী মনোভাব শৈশবেই প্রতিটি শিশুর মাঝে পরিলক্ষিত হয়। প্রথমে সে ক্ষুদ্র জিনিষ থেকেই শুরু করে,পরে বয়স যতই বৃদ্ধি পেতে থাকে ততই জীজ্ঞাসার মাত্রা ও পরিমাপও বেশী হতে থাকে।

একটি শিশু যখন পাঠশালায় গমন করে তখন সে তার চতুষ্পার্শ্বে অনেক ধরনের সৃষ্টির সাথে পরিচয় লাভ করে। আর প্রথম থেকেই তো এ আকাশ তার মাথার উপর ছেয়ে আছে। অক্সিজেন অনবরত গ্রহণ করছে। পানি পান করছে। এভাবে সে ধীরে ধীরে পাহাড়-পর্বত ও নদ-নদী এবং অনেক ধরনের গৃহপালিত পশু-পাখির সাথে পরিচয় লাভ করতে থাকে। ঐ শিশুর কৌতুহলী মনে একটি মাত্র জিজ্ঞাসা এত সব কিছু,কে সৃষ্টি করলো? সৃষ্টির পেছনে কি উদ্দেশ্য নিহিত আছে? সূর্য প্রভাতে পূর্বাকাশে উদয় হয় আবার সন্ধ্যাবেলা পশ্চিমাকাশে অস্ত যায় প্রতিদিন,এ নিয়ম-শৃঙ্খলা কে তৈরী করলো? রাত্রে যখন সে আকাশের তারকারাজীর দিকে তাকায় তখন আবারও তার মনে প্রশ্নের উদেয় ঘটে,এত সুন্দর মনোরম নক্ষত্রমণ্ডলীকে কনো অভিজ্ঞ চিত্রকর আকাশের বুকে সাজিয়ে রেখেছে? এসব প্রশ্নের উত্তরই হল বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি। বিশ্ব অস্তিত্ত্ব ও ব্যবস্থাপনা এবং মানুষ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিই হল অন্তরের এতসব প্রশ্নের উত্তর।

অনেকে বিশ্বাস করেন এ বিশ্বের সৃষ্টির পেছনে কোন পরিকল্পনা প্রণেতার প্রয়োজন নেই। এর পেছনে কোন উদ্দেশ্যও নেই। স্বয়ংক্রিয়ভাবে উদ্ভব হয়েছে এ সৃষ্টিজগত। প্রকৃতিই স্বয়ং সকল বস্তুর সৃষ্টিকর্তা। আর একেই বলে বস্তুবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি। প্রাক ইসলামী যুগে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারীদের বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করা হতো। তন্মোধ্যে প্রাকৃতিবাদী,যিনদিক,দাহরী ও নাস্তিক অন্যতম। কিন্তু বর্তমান আধুনিক,শিল্পোন্নত ও ইলেকট্রোনিক্স যুগে তাদের মুখোশ পরিবর্তন হতে দেখা যায়। বর্তমান বিশ্বে বস্তুবাদীদের বিভিন্নমুখী মতাদর্শের মধ্যে অতি পরিচিত নামটি হচ্ছে “যুক্তিবাদী বস্তুবাদ” বা “Dialectic Materialism”। আর মার্ক্সবাদী দর্শন এরই উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে।

আবার অনেকে বিশ্বাস করেন এ বিশ্ব জগতের বালু কণা থেকে শুরু করে প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে একটি নির্দিষ্ট কার্যকারণ ও উদ্দেশ্য রয়েছে। কোন কিছুই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি হয়নি। বরং প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে কোন স্বাধীন সত্তার শক্তিমত্তা কাজ করছে। এ ধরনের চিন্তা ভাবনার নাম বিশ্ব সম্পর্কে আস্তিকবাদী দৃষ্টিভঙ্গি।

আমাদের মনে রাখতে হবে বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি আর বিশ্ব পরিচিতি এক কথা নয়। এরা দুটি পৃথক পরিভাষা। দৃষ্টান্তস্বরূপ,পৃথিবীতে পানির পরিমান মাটির চেয়ে কতগুণ বেশী? অথবা সৌর জগতে বিরাজমান গ্রহের সংখ্যা কত? ইত্যাদি সৃষ্টি জগতের পরিচয় নিয়ে আলোচনা মাত্র। এগুলোতে বিশ্ব সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত নয়। আর যখন আমরা সমগ্র বিশ্ব প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করি,যেমন ধরুন যদি বলি যে,সমগ্র বস্তুজগত কোন অবস্তুগত সৃষ্টিকর্তার উপর নির্ভরশীল -তাহলে এ বিষয়টি বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির অন্তর্ভুক্ত বলে পরিগণিত হবে।

অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন,“আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে,তা তো আছেই। আমাদের বিভিন্ন প্রকার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এগুলোর তো কোন পরিবর্তন আসবে না। তাহলে এ বিষয়ে এত আলোচনার কি প্রয়োজন? এর আলোচনা আমাদের জন্যে কি ফলাফল বয়ে আনতে পারে?

উক্ত প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়,হ্যাঁ,আমাদের চারদিকে কোন সৃষ্টির উপর প্রভাব ফেলবে না সত্য,কিন্তু তাই বলে আমাদের কাজ-কর্ম,আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত হবে না এটা বলা মনে হয় সঠিক হবে না।

অধিকন্তু বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাবিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিষয়টির স্পষ্টতার জন্যে নিন্মে কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা গেল।

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও বিজ্ঞানের উন্নতিঃ

চিন্তা করে দেখুন,আপনার বন্ধু সফর থেকে ফিরে এসেছে। সে আপনাকে একটি বই উপহার দিয়ে বললো এ চমৎকার বইটির লেখক একজন বড় চিন্তাবিদ ও দার্শনিক,বুদ্ধিমান ও বিজ্ঞ এবং উচ্চজ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অধিকারী। নিশ্চয়ই আপনি সে বইটা হালকাভাবে রিডিং পড়েই ক্ষান্ত হবেন না। বরং এর প্রতিটি শব্দ,বাক্য ও তাদের গঠন বর্ণনা ও পরিবর্তন সবকিছুকে খুব সূক্ষ্মভাবে মনযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করবেন। যদি কোথাও না বুঝে থাকেন তা’হলে ঘন্টার পর ঘন্টা,দিনের পরদিন মোট কথা সুযোগ পেলেই এ বিষয় সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করবেন,বোঝার চেষ্টা করবেন। সাধ্যমত পরিশ্রম করতেও আপনি কুন্ঠাবোধ করবেন না। কেননা,এ বইয়ের গ্রন্থকার কোন সাধারণ লোক নন। তিনি একজন শীর্ষস্থানীয় গবেষক,চিন্তাবিদ। তার কোন কথাই অযথা নয়। কোন বাক্যই তার অপরিকল্পিত নয়।

অপরদিকে যদি আপনাকে বলা হয় এ বইটা যদিও বাহ্যিকভাবে চমৎকার বলে মনে হবে কিন্তু এর পুস্তকার একজন অজ্ঞ,মুর্খ,নির্বোধ ও বুদ্ধিহীন ব্যক্তি। আপনি নিখুত ভাবে এ বইটার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করবেন নাকি শুধুমাত্র একটু চোখ বুলিয়ে রেখে দিবেন? কেননা আপনি জানেন এ বইয়ের কোন মূল্য নেই। কোন জ্ঞান-গর্ভ আলোচনা এ বইতে নেই। মোট কথা এ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করা অযথা সময় নষ্ট করারই নামান্তর বলে বিবেচনা করবেন। এ বিশ্বজগতও একটি বৃহৎ গ্রন্থের ন্যায়। এ জগতের প্রতিটি সৃষ্টি এক একটি বাক্য,যার সমম্বয়ে গঠিত হয়েছে এ বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের।

যদি আমরা আস্তিকবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির অনুগামী হই তাহলে এ বিশ্বের প্রতিটি বস্তু,প্রতিটি সৃষ্টিকেই আমরা মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করবো আর খুব মনোযোগ সহকারে তাঁর প্রতিটি বিষয়ের অধ্যায়নে গুরুত্বারোপ করবো এবং কৌতুহলী অন্তঃকরণ নিয়ে প্রতিটি সৃষ্টির অন্তর্নিহিত রহস্যাবলী উদ্ঘাটনের জন্যে উদ্গ্রীব হবো। কেননা আমরা বিশ্বাস করি প্রতিটি সৃষ্টি বস্তুর পেছনে নিশ্চয়ই কোন শক্তিশালী ও বিশাল বুদ্ধিমান শক্তিমত্তা বা সৃষ্টিকর্তা ক্রিয়শীল রয়েছেন। তিনি অতিশয় বুদ্ধিমান,প্রজ্ঞাবান,শিল্পী ও জ্ঞানী। তিনি মহাবিজ্ঞানী ও দার্শনিক। সুতরাং তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার প্রয়োজন রয়েছে। আর এ দৃষ্টিভঙ্গির কারনেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও উন্নতি সম্ভব হয়েছে।

আর যদি আমরা বস্তুবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হই তা’হলে এ বিশ্বের রহস্যময় সৃষ্টিকুলের ব্যাপারে সামান্যতম চিন্তা-ভাবণা করারও মনোভাব তৈরী হবে না। কেনান,বস্তুবাদীরা এ বিশ্বজগতের সৃষ্টিকারক হিসেবে বুদ্ধি ও জ্ঞানহীন প্রকৃতিকেই মনে করেন। আর এতসব কিছুর স্রষ্টা যদি এক নির্বোধ ও জ্ঞানহীন প্রকৃতি হয়ে থাকে তা’হলে তার সৃষ্টির-ই বা কি মূল্য হতে পারে?

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যাশাঃ

কথায় বলে,“নদীর এপাড় ভাঙ্গে ওপাড় গড়ে -এই তো নদীর খেলা।” আর এ খেলা মানুষের জীবনেও ঘটে থাকে অহরহ। সাধারণতঃ মানুষের এ ক্ষণকালীন জীবনও বহু চড়াই-উৎরাই এর মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়। তাই কখনো একজন মানুষের জীবনের দ্বারে কিছু অনাকঙ্খিত বিপদও কড়া নাড়তে পারে। অনেক সময় এমনও হয় যে এ অপ্রত্যাশিত সমস্যা থেকে তার পালানের কোন পথ থাকে না। তখন চতুর্দিকে পথরুদ্ধ অবস্থায় পড়ে যায় সে। এমতাবস্থায় সে নিজেকে অতিশয় দুর্বল ও অসহায় অবস্থার মুখোমুখি দেখতে পায়। আর এরকম কঠিন বিপদের মুহুর্তে একমাত্র আস্তিকবাদী দৃষ্টি-ভঙ্গিই তাকে মুক্তির সন্ধান দিতে পারে। কেননা,সে তখন তার চেয়ে বড় ও বিশাল কোন অস্তিত্বের আশ্রয়ের সন্ধান খুঁজে পায়। তিনি জানেন এ বিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টিই একজন পরম পরাক্রমশালী ও বুদ্ধিমান সৃষ্টিকর্তার অধীন। আর আমাদের পরিত্রানদাতাও তিনি। ফলে একজন আস্তিক ব্যক্তি এ ধরনের কঠিন ও অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মোকাবলা করার জন্যে যথেষ্ট দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে থাকেন।

অপর দিকে একজন বস্তুবাদী ব্যক্তি এ ধরনের পরিস্থিতিতে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। হতাশা ও ভয় তাকে অক্টোপাসের মত ঘিরে ফেলে একটি ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের ন্যায়। এমতাবস্থায় সে নিরাশ্রিত অবস্থার সম্মুখীন হয়ে পড়ে। আর এ কারনেই বস্তুবাদীরা এহেন তহাশাগস্থ অবস্থায় আত্মহত্যার ঘৃন্য পথের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। পক্ষান্তরে আস্তিকবাদীরা সর্বাবস্থায় তাদের মহাপরাক্রমশালী পরিত্রানদাতার আশ্রয় কামনা করে থাকেন। আর এ কারনেই তারা কখনো আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারেন না।

আর এক ন্যায়সংগত কারণে ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যা মহাপাপ বলে পরিগণিত। কেননা আত্মহত্যা হতাশা ও পরাজয়ের মনোভাব থেকেই জন্ম লাভ করে থাকে।

Related Post

এ বিশ্ব ও সৃষ্টিজগতের বিষ্ময়কর উপমা

Posted by - December 1, 2019 0
এ বিশ্ব বিশ্ব-সৃষ্টি কতই না সুন্দর! মনোরম সব কিছু। নিখুঁত ভাবে সাজানো রয়েছে এ জগতের প্রতিটি বস্তু। নভোমন্ডল,গ্রহসমূহ,নক্ষত্ররাজি,বায়ুমন্ডল,নদ-নদী,সাগর-মহাসাগর,বন-জঙ্গল ও পাহাড়-পর্বত…

তক্বদীরে বিশ্বাস

Posted by - December 6, 2019 0
তক্বদীরে বিশ্বাস স্থাপন করা আমাদের সকলের জন্যে অবশ্য কর্তব্য। বিবেক প্রসূত বিষয়াদির অন্যতম এটি। কিন্তু তক্বদীরের ব্যাপারে বিভ্রান্তমূলক ব্যাখ্যা আমাদের…

স্বাধীনতা বনাম পরাধীনতা

Posted by - December 6, 2019 0
যারা বিশ্বাস করেন,‘মানুষের সকল ভাল-মন্দ কাজের মূলে আল্লাহর শক্তিমত্তা কাজ করছে এবং সকল কিছুর স্রষ্টাও তিনি’-তারা তাদের বক্তব্যের স্বপক্ষে কোরআনের…

আল্লাহ সর্বশক্তিমান

Posted by - December 13, 2019 0
আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। অসীম ক্ষমতাধর প্রভু তিনি। তিনি যা ইচ্ছা করতে পারেন। তাঁর ক্ষমতার পরিমাপ করা সম্ভব নয় কারো…

মুক্তির পথে

Posted by - December 6, 2019 0
প্রাথমিক কথা হতাশাগ্রস্থ এ পৃথিবী। মুক্তির সন্ধানে দিক-বিদিক ছুটে বেড়াচ্ছে আজকের মানবকুল। ফলে কখনো পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদের মরিচিকায় আট্কে পড়ছে আবার…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »