বিশ্বনবীর প্রেমময় স্ত্রী হযরত খাদিজা (সাঃ আঃ)

798 0

💞দশই রমজান ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম নারী ও সর্বশেষ্ঠ নবীর প্রিয়তম সহধর্মিনী হযরত খাদিজা (সাঃ আঃ)-র মৃত্যুবার্ষিকী। মক্কাবাসীর কাছে ‘তাহিরা’ বা ‘পবিত্র’ নামে খ্যাত খাদিজা (সাঃ আঃ)-র ইন্তেকালের পর রাসূল (সাঃ) আরও একা হয়ে পড়েন।

কারণ এর কিছু দিন আগে রাসূল তার প্রিয় চাচা আবু তালিবকে হারান। দুই প্রিয় মানুষকে হারিয়ে রাসূল(সাঃ) এত বেশী শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন যে, ঐ বছরকে তিনি ‘শোক বর্ষ’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। খাজিদা(সাঃআঃ)-র ইন্তেকালের পর রাসূল (সাঃ) ভীষণ কেদেছেন। তিনি কেঁদে কেঁদে বলেছেন, “খাদিজা তুলনাহীন। সবাই যখন আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, সে সময় আমি তার সর্বাত্বক সমর্থন পেয়েছি, পেয়েছি সার্বিক সহযোগিতা। ইসলাম প্রচার ও প্রসারে খাদিজা তার অর্থ-সম্পদ দিয়ে আমাকে সহযোগিতা করেছে।

আরবের কোরাইশ বংশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন হযরত খাদিজা (সাঃ আঃ)। কিন্তু তার পরও খাদিজা (সাঃ আঃ) অত্যন্ত সাধারণ জীবন-যাপন করতেন। তিনি জন্মের পর থেকেই একত্ববাদী ছিলেন। ইসলাম আবির্ভাবের আগে তিনি ইব্রাহিম (আঃ)-র ধর্মে বিশ্বাস করতেন। তৎকালীন সমাজে সৎকর্ম ও দানশীলতার ক্ষেত্রে হযরত খাদিজার সমকক্ষ কেউ ছিলেন না। তিনি ছিলেন হিজাজের অন্যতম বড় ব্যবসায়ী। বিজ্ঞ ও সুদূর প্রসারী দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী খাদিজা (সাঃ আঃ)-র আধ্যাত্মিকতার প্রতি ব্যপক ঝোঁক ছিল। খাদিজা (সাঃ আঃ) সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)এর আবির্ভাবের অপেক্ষায় ছিলেন এবং তিনি আরবের সচেতন ও শিক্ষিত প্রবীণদের কাছে শেষ নবীর নিদর্শন সম্পর্কে মাঝেমধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। কিন্তু কি সৌভাগ্য নবুয়্যতপ্রাপ্তির আগেই রাসূলের সাথে পরিচয় ঘটল হযরত খাদিজার। তিনি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে নিজের ব্যবসায়িক কাজ সম্পাদনের উদ্দেশ্যে সিরিয়ায় পাঠালেন। এরপরই বিবি খাদিজার কাছে রাসূলের সৎ গুণাবলীগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠলো। খাদিজা (সাঃআঃ) বুঝতে পারলেন, সমাজের অতুলনীয় ও পবিত্রতম পুরুষ হচ্ছেন মুহাম্মদ (সাঃ)।

হযরত খাদিজা আরও বুঝতে পারলেন, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মানবিক গুণাবলীতে অনন্য এবং তিনি বঞ্চিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠা চান। রাসূলের এসব গুণাবলী হযরত খাদিজাকে আকৃষ্ট করে। এরপরই তিনি রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তোমার আমানতদারি, সচ্চরিত্র, সত্যবাদিতা, ভদ্রতা ও মর্যাদা আমাকে তোমার প্রতি আকৃষ্ট করেছে। এরপরই তিনি রাসূলের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান এবং দু’জনের মধ্যে দাম্পত্য জীবন শুরু হয়।

বিবি খাদিজা জানতেন যে, রাসূলের সাথে বিয়ে হলে তিনি তাকে ঐশী পথে পরিচালিত করবেন। তবে খাদিজা (সাঃ আঃ)-র বিয়েকে তৎকালীন সমাজ স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। তৎকালীন অন্ধকার যুগে সামাজিক সম্পর্কের মাপকাঠি ছিল অর্থ-সম্পদ। এ কারণেই খাদিজা (সাঃ আঃ) সম্পদহীন রাসূল (সাঃ)-কে বিয়ে করায় অনেকেই তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে। কুরাইশ বংশের এক দল অহংকারী ও নিন্দুক মহিলা খাদিজা (সাঃ আঃ) কটাক্ষ করে বলতো, তোমার এতো আভিজাত্য ও সম্পদের অধিকারী হবার পরও কেন দরিদ্র এক যুবককে বিয়ে করলে?

খাদিজা (সাঃ আঃ) এর জবাবে বলেছিলেন, “এই সমাজে মুহাম্মদ (সাঃ)-র মতো আর কেউ কি আছে? তার মতো সচ্চরিত্রবান ও মর্যাদাবান দ্বিতীয় কোন ব্যক্তিকে কি তোমরা চেন? আমি তার সৎ গুণাবলীর কারণেতাকে বিয়ে করেছি।” কিন্তু সেই সমাজের গোড়া ও মুর্খ মানুষের কাছে বিবি খাদিজার যুক্তি বোধগম্য ছিলো না। এ কারণে হিজাজের জেদি মহিলারা হযরত খাদিজার সাথে শত্রুর মতো আচরণ করেছে। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-র নবুয়্যত প্রাপ্তির পর ঐসব মহিলার বিদ্বেষ আরও বেড়ে যায় এবং এই বিদ্বেষের মাত্রা এত বেশি ছিল যে, খাদিজা (সাঃ আঃ)-কে তারা তার সন্তান প্রসবের সময় বিন্দু পরিমাণ সহযোগিতাও করেনি। সবমিলিয়ে হযরত খাদিজা(সাঃআঃ) ঐ সমাজে একা হয়ে পড়েছিলেন। তৎকালীন সমাজের নারীরা তাকে সহযোগিতা না করলেও আল্লাহ তার সহযোগিতায় পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানিত মহিলাদেরকে পাঠিয়েছিলেন।

বিপুল সম্পদের মালিক এবং সমাজে ব্যাপক প্রভাবশালী হবার পরও রাসূলের সাথে খাদিজা (সাঃ আঃ)-র ব্যবহার ছিল অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ। তার আচার-ব্যবহারে অহমিকার লেশ মাত্র ছিল না। আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীর প্রতি রাসূলের ব্যাপক আগ্রহের বিষয়ে তিনি ভালো ভাবে অবহিত ছিলেন। একারণে বিবি খাদিজা তার সাথে এমন ভাবে আচরন করতেন যে, রাসূলের ইবাদত-বন্দেগীতে কোন ব্যাঘাত না ঘটে। নবুয়্যত লাভের আগে রাসূল (সাঃ) প্রতিমাসে কয়েক বার করে নূর পাহাড়ের চূড়ায় হেরা গুহায় যেতেন। আর মহিয়সী নারী বিবি খাদিজা হাসি মুখে রাসূলকে বিদায় জানাতেন। হযরত আলী (আঃ)-কে দিয়ে তিনি গুহায় নিয়মিত খাবার পাঠাতেন। কখনো কখনো তিনি নিজেও আলী (আঃ)-র সাথে হেরা গুহায় যেতেন। নবুয়্যত লাভের পর রাসূলের অনেক আত্মীয়-স্বজন তাকে প্রত্যাখ্যান করলেও বিবি খাদিজা, রাসূল (সাঃ)-কে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়েছেন। হযরত খাদিজা (সাঃ আঃ) বিনা বাক্যে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি শুধু মুখে ঈমান আনেননি সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত হন। তিনি ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তার সকল সম্পদ রাসূলকে উপহার দিয়েছিলেন। শোয়াবে আবু তালিব নামক উপত্যকায় মুসলমানরা যখন বিচ্ছিন্ন ও অবরোধের শিকার হয়েছিল, তখন বিবি খাদিজার আর্থিক সহযোগিতা মুসলমানদের টিকে থাকতে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছে। অর্থনৈতিক সংকট দূর হবার পরও হযরত খাদিজার সহযোগিতা মুসলমানদের পথ চলতে সহযোগিতা করেছে।

খাদিজা (সাঃ আঃ) ছিলেন অত্যন্ত ধৈয্যশীল ও সহিষ্ণু। মানব মুক্তির দূত সর্বশেষ নবী রাসূল (সাঃ)-র প্রতি তার পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস ছিল। এ কারণে নবুয়্যত প্রাপ্তির আগে ও পরে রাসূলের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে তিনি সর্বদায় সচেষ্ট ছিলেন। কোন কারণে রাসূল (সাঃ)-র মন খারাপ থাকলে তিনি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিতেন। রাসূলের সকল কাজে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। বলতে গেলে হযরত খাদিজা ছিলেন, রাসূলের এক যোগ্য উপদেষ্টা। মুসলিম ইতিহাসবিদ ইবনে হেশাম লিখেছেন, হযরত খাদিজা রাসূলের প্রতি ঈমান আনেন। রাসূলের বক্তব্যকে সমর্থন করেন এবং তাকে সর্বাত্বক সহযোগিতা দেন। আল্লাহতায়ালা হযরত খাদিজার মাধ্যমে রাসূলকে প্রশান্তি দিতেন। রাসূলের কানে কখনোই দু:সংবাদ পৌছানো হতো না যতক্ষণ না পর্যন্ত আল্লাহ খাদিজার মাধ্যমে ঐ খবর শ্রবনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতেন।

ইতিহাসে এসেছে মক্কার মুশরিকরা একদিন পাথর নিক্ষেপ করে রাসূলকে আহত করে এবং তারা পেছনে পেছনে হযরত খাদিজার বাড়ী পর্যন্ত আসে। এর পর খাদিজা (সাঃ আঃ)-র ঘরেও পাথর নিক্ষেপ করে। এ সময় খাদিজা (সাঃ আঃ) ঘর থেকে বেরিয়ে মুশরিকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, “লজ্জা করেনা তোমরা তোমাদের বংশের সবচেয়ে মহানুভব মহিলার ঘরে পাথর নিক্ষেপ করছো? এ কথা শুনে মুশরিকরা লজ্জিত হয়ে চলে যায়। এরপর বিবি খাদিজা রাসূলের জখমের চিকিৎসা করেন। এ সময় রাসূল (সাঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত খাদিজার প্রতি সালাম পৌছান এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত করার সুসংবাদ দেন। হযরত খাদিজা (সাঃ আঃ)-কে বেহেশতের মধ্যে কারুকার্যখচিত একটি বিরাট অট্রালিকা দেয়া হবে বলে আল্লাহতায়ালা জানিয়ে দেন, যেখানে কোন দুঃখ-কষ্টের অস্তিত্ব থাকবে না ।

আসলে মুসলমানদের উপর অবরোধ আরোপিত হবার পর হযরত খাদিজা (সাঃ আঃ) অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। এ সময় সম্পদ ও আভিজাত্যের মধ্যে বেড়ে উঠা বিবি খাদিজা দীর্ঘ দিন ধরে শুষ্ক এক উপত্যকায় কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করেছেন। ইসলামের জন্য তার অঢেল সম্পদ বিলিয়ে দিয়েছিলেন। ঐ উপত্যকায় কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করার কারণে হযরত খাদিজার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। তিনি মারাত্বক অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর ফলেই তার মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়।

হযরত খাদিজা (সাঃআঃ) মৃত্যুশয্যায় সর্বশেষ যে কথাটি রাসূল (সাঃ)কে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন তা হলো, “হে রাসূল আমি আপনার সব অধিকার পরিপূর্ণ ভাবে রক্ষা করতে পারিনি, আমাকে ক্ষমা করে দিন।” আল্লাহর রাসূল ও ইসলামের জন্য এত ত্যাগ-তিতিক্ষার পরও যেন তার মনে ভরেনি। তিনি ইসলাম ও রাসূলের জন্য আরও কষ্ট করতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু মানুষের আয়ু তো নির্দিষ্ট। কাজেই রাসূলকে ছেড়ে তার চলে যেতেই হয়েছে। ইসলামের এই মহীয়সী নারী ৬১৭ খ্রিস্টাব্দের ১০ই রমজান ৬৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।💞

উম্মুল মু’মেনীন খাদিজা আত-তাহিরা (রা.)

 

Related Post

মা আয়শার বিয়ের বয়স

Posted by - August 16, 2019 0
হযরত আয়েশার সাথে আল্লাহর রাসূলের বিয়ের তারিখ সমন্ধে ১। ঐতিহাসিক ও হাদিসের ইমামরা বলেছেনঃ দৃষ্টান্তস্বরূপঃ মা আয়েশা থেকে বর্ণিতঃ حدثنا…

হযরত ফাতেমা (আ.)-এর শাহাদাত

Posted by - February 3, 2020 0
মহানবী (সা.) ইন্তেকালের পর বিভিন্ন রকম দুঃখ-কষ্ট হযরত ফাতেমার অন্তরে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল এবং বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ তাঁর জীবনটাকে তিক্ত…

নবীর (সাঃ) স্ত্রীগণ

Posted by - August 15, 2019 0
হযরত মুহাম্মাদ (সা.) পঁচিশ বৎসর বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত ছিলেন এবং সেই বৎসরেই হযরত খাদিজা বিনতে খুওয়াইলাদ-কে বিয়ে করেন। পঞ্চান্ন বৎসর…

সর্বগু‌ণে গুণান্বিতা!!

Posted by - January 25, 2020 0
বয়স পাঁচ কি ছয়, হারা‌লেন জন্মদাত্রী মা কে! ক‌চি ম‌নে পু‌রো আকাশ ভে‌ঙ্গে পড়ার ম‌তো, সান্তনা প্রবোধ স্নেহ সবই পিতার…

হযরত ফাতিমা আলাইহাস সালামের প্রতি যিয়ারতনামা

Posted by - January 27, 2020 0
হযরত ফাতিমা আলাইহাস সালামের প্রতি যিয়ারতনামাঃ السَّلاَمُ عَلَیْکِ یَا بِنْتَ أَفْضَلِ أَنْبِیَاءِ اللَّهِ وَ رُسُلِهِ وَ مَلاَئِکَتِهِ‏ আসসালামু আলাইকি ইয়া…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »