প্রেমের খেলা

1033

হযরত ইব্রাহিম (আঃ) বসে বসে তার দুম্বাগুলোর ঘাস খাওয়া দেখছিলেন। তার এই শত শত দুম্বা এই পাহাড়ী এলাকার দৃশ্যকে আরো বেশী মনোরম করে তুলছিলো। তার আশে পাশে ছোট-বড় পাহাড়, টিলা ও পাহাড়ী জঙ্গল সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান। ইব্রাহিম (আঃ) কি চিন্তা করছিলেন? তিনি কি মনে মনে তার দুম্বার সংখ্যা গণনা করছিলেন? নাকি সৃষ্টিকর্তার বিস্ময়কর সৃষ্টি নিয়ে ধ্যানমগ্ন ছিলেন?
তার দৃষ্টি ছিল এমন একটি বাড়ীর দিকে যেখানে চতুর্দিকে শুধু আলোক রশ্মিই প্রতিফলিত হয়। মনে হয় তিনি কোন গোপন রহস্যের উদ্ঘাটন অথবা ধাঁধার সমাধান করতে চিন্তামগ্ন হয়েছেন। না তার দুম্বা, না সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, তাঁরা, না কোন কিছুই তার প্রেমিক হৃদয়ে স্থান করতে পারেনি। শুধুই আল্লাহ। আর আল্লাহ তার প্রনয়সিক্ত মনে অন্য সব সময়ের চেয়ে এ মুহূর্তে আরো বেশী করে অবস্থান নিয়েছিলেন।
দুম্বাগুলো আপন মনে পদচারণা করছিল। কেউ বাধা দেয়ার ছিল না। তবুও ইব্রাহিম (আঃ) তাঁর আপন মা’বুদ পরওয়ারদেগারের স্মরণ হতে এক মুহূর্তও দূরে সরে আসেননি। হঠাৎ বিকট এক শব্দ এসে তার কর্ণকুহরে আঘাত হানলো। এ শব্দ কোথা থেকে! এটা তো ছিলো তার বহু বছরের আকাঙ্খা! যা শুনার করার জন্যে তার জাতির কাছ থেকে তিনি আশা করেছিলেন। কিন্তু তার জাতির লোকেরা মূর্তি পূঁজা ছাড়া অন্য কিছুই তাকে উপহার দিতে পারেনি। শব্দটি তার কর্ণকুহরে বলে দিচ্ছে এটা তার মা’শুকের নাম। হ্যাঁ, শব্দটি বাতাসের স্পন্দে ভেসে এসে হযরত ইব্রাহিমের মা’শুকের নামটিই উচ্চারণ করছে।
ইয়া কুদ্দুস (হে পুতঃ পবিত্র)! ইয়া কুদ্দুস!
ইব্রাহিম (আঃ) এ নাম শুনে আত্মহারা হয়ে গেলেন এবং এই হৃদয়স্পশী ও মর্মভেদী নামের স্বাদ তার মন-মগজকে এমনভাবে আপ্লুত করে দেয় যে তিনি মুহূর্তের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে যান। যখন তার জ্ঞান ফিরে এলো তখন দেখতে পেলেন একজন লোক এক খণ্ড বড় প্রস্তরের উপর বসে আছেন।
ইব্রাহিম (আঃ) বললেন : “হে আল্লাহর বান্দা! আরেকবার যদি তুমি এ মধুর নাম উচ্চারণ কর তাহলে আমি আমার দুম্বাগুলোর একাংশ তোমাকে দান করে দিবো।” তৎক্ষনাৎ ‘ইয়া কুদ্দুসের’ ধ্বনিপ্রতিধ্বনি আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুললো। পর্বত ও মরুভূমিতে সবদিকে শুধু শোনা যায় ইয়া কুদ্দুস, ইয়া কুদ্দুস।
ইব্রাহিম (আঃ) এই সীমাহীন সু-স্বাদের সাগরে আবারো ডুব দিলেন। বন্ধুর নাম শ্রবনের আনন্দ তাঁর অস্তিত্বে এমনি প্রভাব বিস্তার করেছে যে দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বার ও বহুবার এই নাম শ্রবনের চিন্তা ছাড়া অন্য কিছুই তার মস্তিষ্কে জায়গা করে নিতে পারছিল না। তিনি বললেন : “আবারো এই নাম পড়। আমি আমার দুম্বাগুলোর আরেক অংশ তোমাকে দান করে দিবো।” বল : ‘ইয়া কুদ্দুস!’ আবারো বল : ‘ইয়া কুদ্দুস!’ এভাবে হযরত ইব্রাহিমের সকল দুম্বা শেষ হয়ে গেল। তবুও তার অন্তর এই পবিত্র মধুর নাম শোনার জন্যে ব্যকুল হয়ে ওঠে। কোন ক্রমেই তৃপ্তি হচ্ছিল না। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেলো তার দুম্বাগুলো পাহারা দেওয়ার জন্যে যে কুকুর তার সাথে এসেছিল তার গলায় ঝুলানো আছে একটি সোনালী শিকল। এবার তিনি সে অচেনা লোকটিকে বললেন, আর একবার তার বন্ধুর নাম উচ্চারণ করতে, তাতে তার শেষ সম্বলটুকুও যদি যায় যাক। লোকটি পড়লো : ‘ইয়া কুদ্দুস!’ পাহাড়-পর্বত সর্বত্র একই নাম প্রতিধ্বনিত হলো। ইব্রাহিম (আঃ) পুনরায় উদ্বেলিত হয়ে উঠলেন। কিন্তু এবার তাঁর দেয়ার মত আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না। কি করে আবার এই মধুর নাম শোনা যায়। এর আনন্দ ও স্বাদের যে শেষ নেই। কি করা যায় ভেবে পেলেন না। আকষ্মিকভাবে মনে পড়ে গেল তার শেষ সম্বলের কথা। লোকটিকে তিনি বললেন : “আরেকবার তুমি সে নামটি উচ্চারণ কর। আমার শেষ সম্বল আমার প্রাণ তোমার জন্য উৎসর্গ করে দিবো।”
অচিন লোকটির মুখে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠলো। আস্তে আস্তে তিনি হযরত ইব্রাহিমের কাছে আসলেন। ইব্রাহিম তো তার মা’শুকের নাম শোনার জন্যে উদ্গ্রীব। কিন্তু মনে হলো ইব্রাহিমের সাথে সেই লোকটির অন্য কিছু বলার আছে। লোকটি বললেন : ‘‘আমি জিব্রাঈল! আল্লাহর নিকটতম ফেরেস্তা। আসমানী জগতে তোমার ব্যাপারে অনেক কথার অবতারণা হয়েছিল। সবাই তোমার কথাই বলতো। অবশেষে আমরা সকলে আল্লাহর কাছে অনুরোধ করেছিলাম, ‘হে ইলাহ্, মৃত্তিকার তৈরী তোমার ইব্রাহিম কেন এবং কিভাবে ‘খলিলুল্লাহ্ ‘-এর মাক্বামে পৌছুলো? তখন আল্লাহ আমাকে হুকুম দিলেন তোমার কাছে আসতে এবং তোমাকে পরীক্ষা করতে। এখন আমার কাছে স্পষ্ট যে কেন তুমি আল্লাহর খলিল বা বন্ধু খেতাব লাভ করেছো। কেননা তুমি আশেক, তাই পূর্ণতার শিখরে পৌছেছো। হে ইব্রাহিম! এই দুম্বাগুলো আমাদের কোন কাজে আসবে না। তোমার দুম্বা তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে গেলাম।”
ইব্রাহিম (আঃ) উত্তর দিলেন : “কোন কিছুকে দান করে সেগুলোকে পুনরায় ফিরিয়ে নেয়া মহত্বের শর্ত ও মুক্ত মানুষদের নীতি আদর্শ নয়। আমি ওগুলোকে দান করে দিয়েছি। ফিরিয়ে নিতে পারবো না।” হযরত জিব্রাইল (আঃ) বললেন : “তাহলে ওগুলোকে যমিনের বুকে ছড়িয়ে দিই। ওরা যেখানে খুশি সেখানে বিচরণ করে বেড়াক। কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ এই দুম্বাগুলোকে শিকার করবে তারা সবাই তোমার মেহমান।” (আত্তার নিশাপুরী; তায্কিরাতুল আওলিয়া, পৃঃ নং ৫০৮; আবুল ফাদল রাশিদুদ্দীন মুবিদী; কাশফুল আসরার ওয়া উদ্দাতুল আবরার, খণ্ড ১, পৃঃ নং ৩৭৭; আবু ইসহাক্ব ইব্রহিম ইবনে মানসুর নিশাপুরী; ক্বিসাসুল আন্বিয়া, পৃঃ নং ৬৫।

Related Post

অনুগত দুই দাস

Posted by - ডিসেম্বর ২২, ২০১৯
বর্ণিত যে, একদা বাদশাহ্ ইস্কান্দার মাকদুনী (আলেকজান্ডার) বাক্যালাপের উদ্দেশ্যে দিভ্জান্স-এর খেদমতে আগমন করেন। দিভ্জান্স ছিলেন একজন নির্জনবাসী ও আধ্যাত্মিক সাধক।…

শত্রুর সাথে যাত্রা

Posted by - ডিসেম্বর ২৭, ২০১৯
[জনাব ইলিয়াস ছিলেন নিশাপুরের আমির এবং প্রধান সেনাপতি। চতুর্থ শতাব্দিতে নিশাপুর পারস্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহত্তম নগরী হিসেবে পরিগণিত ছিল।…

বাদশাহীর মূল্য

Posted by - ডিসেম্বর ২৯, ২০১৯
[হযরত শাক্বিক বালখী (রহঃ) হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দি ও আব্বাসীয় শাষক হারুন-আর-রাশীদের সমসাময়িক কালের একজন স্বনামধন্য সুফী ও আরেফ ছিলেন। তার…

ধীশক্তির পরিচয়

Posted by - ডিসেম্বর ২২, ২০১৯
[হযরত আবুল কাসেম জুনাইদ বিন মুহাম্মাদ বিন জুনাইদ, উপাধি : সাইয়্যেদুত্ তায়িফাহ, ইরফান ও আধ্যাত্মিক সাধনার জগতে একজন উজ্জল নক্ষত্র।…

লজ্জা

Posted by - ডিসেম্বর ২০, ২০১৯
হাবসা (ইথিওপিয়া) অধিবাসী এক ব্যক্তি রাসূলে খোদা (সা.)-এর খেদমতে হাজির হয়ে বললো : “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার পাপ অনেক। আমার জন্যেও…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »