নূরনবী মোস্তফা (সা.)
(৯ম পর্ব)
🌹[আল্লাহর রাসূলরা হচ্ছেন সমগ্র বিশ্বমানবতার জন্যে এমন পথপ্রদর্শক, যাঁরা সঠিক দিক-নির্দেশনা দিয়ে মানুষকে তাদের প্রকৃত লক্ষ্য ও গন্তব্যে নিয়ে যায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, যেখানেই কোনো সম্প্রদায় পথের দিশা হারিয়েছে কিংবা প্রকৃত গন্তব্যে যেতে অক্ষম হয়ে পড়েছে, তাদের সহযোগিতা করার জন্যে আল্লাহ কোনো না কোনো পয়গাম্বরকে পাঠিয়েছেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ঐ নবী পথের দিশাহীন জনপদটিকে মুক্তি ও গন্তব্যের নতুন নতুন পথের দিশা দিয়েছেন। এই নবী-রাসূলদের মাঝে যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ, তিনি হলেন আমাদের প্রিয়নবী আল্লাহর সর্বশেষ রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সা.)।
নবীদের আগমনের পরম্পরায় দেখা গেছে যে, একজন নবী তাঁর পরবর্তী নবীর আগমনের সুসংবাদ দিয়েছেন। যদিও অধিকাংশ নবীরই দাওয়াতী কাজের ক্ষেত্র ও সময় ছিল নির্দিষ্ট। একইভাবে ইসলামের নবী অর্থাৎ আল্লাহর সর্বশেষ রাসূল, যাঁর দাওয়াত ছিল বিশ্বজনীন, তাঁর ব্যাপারে ধর্মীয় গ্রন্থগুলোতে সুস্পষ্টভাবে সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। ইহুদি জাতি তাদের ধর্মগ্রন্থের ভিত্তিতে এবং তাদের নবীদের বক্তব্য অনুযায়ী সর্বশেষ নবীর অপেক্ষায় ছিল। হযরত মূসা (আ.) ইহুদি সম্প্রদায়কে তাঁর মত আরেক নবী আসার সুসংবাদ দিয়েছেন। তাওরাতে বলা হয়েছে, তোমাদের আল্লাহ তোমাদের মাঝে তোমাদেরই ভাইদের মধ্য থেকে আমার মত একজন নবী পাঠাবেন। তোমাদের উচিত তাঁর কথা মনযোগ দিয়ে শোনা এবং তাঁর আনুগত্য করা। আল্লাহ বলেছেন, “আমি তাদের মধ্য থেকে তোমার মত একজন নবী পাঠাবো এবং তাঁর মুখে আমার বাণী প্রেরণ করবো।”
এই সব সুসংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে ইহুদিদের অনেকেই সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর আবির্ভাব উপলব্ধি করার জন্যে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হেজাযে (যার একটা বিরাট অঞ্চল বর্তমানে ইহুদীবাদী আলে সৌদের দখলে) আগমন করেছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তাদের অনেকেই রাসূলে খোদার নবুয়্যত লাভের পর তাঁকে অস্বীকার করেছে এবং তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। হযরত দাউদ (আ.)-এর প্রার্থনায় এমন কিছু বক্তব্য এসেছে, যা মুফাসসীরদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী তা হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এবং তাঁর পরিবার ও সন্তানদের সাথে বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাঁর প্রার্থনায় এ রকম কিছু বক্তব্য আছে: “তুমি সকল আদম সন্তানের মধ্যে সুন্দরতম, তোমার বাচনভঙ্গি অলঙ্কার সমৃদ্ধ, তোমার ঠোঁট থেকে দয়া আর অনুগ্রহ বর্ষিত হয়, আল্লাহ তোমাকে অনন্তকালের জন্যে পবিত্র করেছেন। তোমার সকল পোশাকে সুগন্ধি মিশিয়ে দিয়েছেন। হে বাদশাহ! তুমি বহু সন্তানের অধিকারী হবে, তারাও তাদের পূর্বপুরুষদের মতো দায়িত্বভার মাথায় তুলে নেবে এবং তুমি তাদের বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন শাসনকার্যে নিযুক্ত করবে। তোমাকে সকল প্রজন্মের কাছে বিখ্যাত করে তুলবে। সকল মানুষ চিরকাল তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।”
ইতিহাসের বিভিন্ন বর্ণনায় দেখা যায় যে, হযরত ঈসা (আ.)ও তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে তাঁর পরে একজন নবীর আবির্ভাবের সুসংবাদ দিয়েছেন। যিনি নিজেই ছিলেন আল্লাহর এক বিশাল মো’জেযা, তিনিই আরবে আল্লাহর সর্বশেষ দূতের আগমণ সম্পর্কে কথা বলতেন। তাঁর আগমণের বিভিন্ন নিদর্শন ব্যাখ্যা করতেন এবং জনগণের অন্তরে তাঁর প্রতি ভালোবাসার অগ্নিশিখা জ্বালিয়ে দিতেন। যতদূর পর্যন্ত ঈসা (আ.)- এর ধর্মীয় অনুশাসন চালু ছিল ততদূর পর্যন্ত তাঁর এই সুসংবাদগুলোও প্রচারিত হয়েছিল। মসীহ নামক গ্রন্থে জার্মানীর বিখ্যাত দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানী কার্ল ইয়াসেপ্রস বলেছেন: “মসীহ-এর পক্ষ থেকে আমরা যে বিষয়টা বেশী জানতে পেরেছি তা হলো, শেষ নবী সম্পর্কে সুসংবাদ বার্তা।”
এ কারণেই খ্রিষ্টিয় সপ্তম শতাব্দীতে সর্বশেষ নবীর জন্যে অপেক্ষমানরা আরব উপদ্বীপের উল্লেখযোগ্য অংশে বসবাস করছিল। ইয়েমেন থেকে সিরিয়া এবং ফিলিস্তিন থেকে মিশর পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ডের খ্রিষ্টানরা সর্বশেষ নবীকে দেখার জন্যে ব্যাকুল হয়ে গিয়েছিল। এমনকি ইরানেও অপেক্ষমান এই দর্শনার্থীদের একটি ছোট্ট দলের অস্তিত্ব ছিল। তাদের মধ্যকার পরিচিত একজন হলেন সালমান ফারসী। সালমান তাঁর জীবনোতিহাসের একাংশে বলেছেন: “খ্রিষ্টান থাকাকালে যখন আমুরিয়াতে ছিলাম, তখন ধর্মীয় কাজের জন্যে পাদ্রীর কাছে যাওয়া-আসা করতাম। পাদ্রী তখন দিবারাত্রি নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর ইবাদাত করতো। কিছুদিন পর পাদ্রী অসুস্থ হয়ে পড়লো। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সে আমাকে বললো: “আমি এমন কাউকে চিনি না, যার কাছ থেকে ফয়েজ হাসেল করার জন্যে তোমাকে বলতে পারি। কিন্তু শেষ যামানার নবীর আবির্ভাবের সময় ঘনিয়ে এসেছে। ইব্রাহীমের বংশধর আরবদের মধ্য থেকে আসবেন তিনি। মক্কায় তিনি আবির্ভূত হবেন। তিনি উপহার গ্রহণ করবেন কিন্তু সদকা গ্রহণ করবেন না। তাঁর কাঁধে নবুয়্যতির চিহ্ন থাকবে। তাঁকে যদি চিনতে পারো, উপলব্ধি করতে পারো, তাহলে তাঁর প্রতি ঈমান এনো।”
আমি বললাম: “সে যদি আপনার ধর্মকে ত্যাগ করার আহ্বান জানায়, তারপরও কি তাঁকে গ্রহণ করে নিবো?”
পাদ্রি বললো: “হ্যাঁ ! কেননা, তাঁর কথাই সত্য-সঠিক এবং তাঁর বিজয়ের মধ্যে রয়েছে আল্লাহর সন্তষ্টি।”
সালমান তাঁর স্মৃতিকথায় আরো বলেন: “এই পাদ্রীর মৃত্যুর পর আমাকে আরবের বনী কেলাব গোত্রের একটি বাণিজ্য কাফেলার সাথে আরব উপদ্বীপে পাঠানো হলো। সেখানে এক ইহুদির দাস হিসেবে কাজ করতাম। একদিন ঐ ইহুদি লোকটিকে অপর এক লোকের সাথে কথা বলতে শুনলাম। সে লোকজনকে গালিগালাজ করতে করতে বলছিল, জনরব উঠেছে যে, কোনো এক ব্যক্তি নাকি নিজেকে নবী বলে দাবী করছে। এই কথা শুনে হঠাৎ মনে হলো, বছরের পর বছর ধরে অভিবাসী আর উদ্বাস্তু জীবন যাপনের পর বুঝি শেষ পর্যন্ত সুফল এলো। আমার অন্তরে কম্পন সৃষ্টি হয়ে গেল। অত্যন্ত আগ্রহের সাথে আমি ঐ লোকটির কাছে গেলাম এবং ঐ পয়গম্বর সম্পর্কে জানতে চাইলাম। আমার মনিব এ ব্যাপারে আমার আগ্রহের কথা জানতে পেরে আমার সামনে এলো এবং আমার গালে সজোরে থাপ্পর মারলো।” সালমান সর্বশেষ নবীকে ভালোবাসার কারণে যতো অত্যাচার-নিপীড়ন ভোগ করেছিল, এই চপেটাঘাত ছিল তার সূচনা।
ইহুদি এবং খ্রিষ্টান ধর্মগ্রন্থগুলো যদিও এখন বিকৃত হয়ে পড়েছে, তারপরও সর্বশেষ নবীর ব্যাপারে দেওয়া সুসংবাদ বা ইঙ্গিতগুলো এখনো দেখতে পাওয়া যায়। ইঞ্জিলে এসেছে: “এবং আমি তার কাছে আবেদন জানাবো, আর তিনি তোমাদের জন্যে আরেকজন সান্ত্বনাদাতা পাঠাবেন যাতে তোমাদের সাথে সবসময় থাকে।”
ইঞ্জিলের কয়েক জায়গায় ঈসা (আ.) তাঁর পরে প্যারাকলিত্স অর্থাৎ”আহমদ”- এর আসার কথা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন। হযরত ঈসা (আ.) বলেন: “আমি না যাওয়া পর্যন্ত তিনি আসবেন না। যদি আমাকে তোমরা ভালোবাসো, তাহলে আমার ওসিয়তগুলো সংরক্ষণ করো। তিনি আল্লাহর সেই পবিত্র আত্মা যিনি তোমাদেরকে সকল সত্যতা এবং বাস্তবতার সাথে পরিচিত করাবেন।”
ইথিওপিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশির হাতে যখন ইসলামের নবীর দাওয়াতী পত্র পৌঁছলো, তখন নাজ্জাশি বলেছিল: “আল্লাহর কসম! ইনিই সেই নবী, আহলে কেতাব বা খ্রিষ্টানরা যাঁর অপেক্ষায় রয়েছে।”
পূর্ববর্তী নবীগণের মাধ্যমে তৌরাত এবং ইঞ্জিলে যে সর্বশেষ নবীর আগমণের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে, কোরআনের অসংখ্য আয়াতে সে ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন জাগে যে, এরকম সুস্পষ্ট আয়াত থাকা সত্ত্বেও বহু সম্প্রদায় কেন সর্বশেষ রাসূলকে অস্বীকার করলো? সূরা “আস সাফ”- এর ছয় নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “স্মরণ করো! যখন মারিয়াম পুত্র ঈসা (আ.) বললো, হে বনী ইসরাইল! আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল, আমি আমার পূর্ববর্তী তৌরাতের সত্যায়নকারী এবং আমি এমন একজন রাসূলের সুসংবাদদাতা যিনি আমার পরে আসবেন। তাঁর নাম আহমাদ। অবশেষে যখন তিনি সুস্পষ্ট প্রমাণাদি নিয়ে এলেন, তখন তারা বললো-এটাতো এক সুস্পষ্ট যাদু।”
সূরা আ’রাফের ১৫৭ নম্বর আয়াতেও সর্বশেষ পয়গাম্বরের গুণাবলীর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনার কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন: “যারা আল্লাহ প্রেরিত এমন এক নিরক্ষর নবীর আনুগত্য করছে, যাঁর গুণাবলীর বর্ণনা তাদের নিজেদের কাছে রক্ষিত তৌরাত এবং ইঞ্জিলেই রয়েছে। যেমন তাঁর গুণাবলী হচ্ছে, তিনি সৎ কাজের আদেশ দেন এবং অসৎ কাজ করতে নিষেধ করেন। তিনি যাবতীয় পবিত্র বস্তু তাদের জন্যে হালাল ঘোষণা করেন এবং অপবিত্র বস্তুগুলোকে হারাম ঘোষণা করেন। তিনি তাদের ওপর বিদ্যমান সকল বোঝা এবং বন্দীত্বের জিঞ্জির অপসারণ করেন। সুতরাং যারা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছে, তাঁকে সমর্থন ও সহযোগিতা করেছে এবং তাঁর সাথে অবতীর্ণ নূর তথা কোরআনের অনুসরণ করেছে, তাঁরাই মুক্তি লাভ করেছে।”]