নূরনবী হযরত মোস্তফা (সা.) পর্ব-আট

656

নূরনবী হযরত মোস্তফা (সা.)

(৮ম পর্ব)

🌷[হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এখন চল্লিশ বছরে পা রেখেছেন। ছোটোবেলা থেকে যে প্রকৃতির সাথে তাঁর নিবীড় সম্পর্ক ছিল সেই সখ্যতা এখনো অটুট রয়েছে তাঁর। শহরের কোলাহল থেকে দূরে প্রকৃতির কাছাকাছি চলে যেতেন তিঁনি এবং অপেক্ষমাণ কৌতূহলী দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। তিঁনি সূক্ষ্মদর্শী ছিলেন বলে প্রকৃতির গ্রন্থে শিক্ষণীয় অনেক কিছু খুঁজে পেতেন। রাতের আকাশ ছিল তাঁর জন্যে বিস্ময়কর ও রহস্যময় শিক্ষার আধার। হেরা গুহা এখনো তাঁর নিঃসঙ্গতার পরম সহচর। নূর পাহাড়ের এই চূড়া থেকে তিনি লক্ষ্য করতেন মানুষের আদর্শহীন চিন্তাধারা আর আচার-আচরণ। মুর্খ লোকেরা অশালীন সব নিয়ম-কানুন পালন করেই সন্তুষ্ট ছিল। নিজেদের তৈরি মূর্তিগুলোকে তারা সেজদা করতো। সাধারণ কোনো ঘটনার জের ধরে খুনাখুনিতে লিপ্ত হতো। মোটকথা, সমগ্র বিশ্ব তখন আশ্চর্য এক অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। মানুষের জীবনবৃক্ষ সবুজ-শ্যামল চিত্র হারিয়ে ঝরা পাতার মতো হলুদ হয়ে গিয়েছিল। হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এসব দেখে দেখে দুঃখ করতেন আর কষ্ট পেতেন।

তিঁনি এখন আগের চেয়েও বেশি বেশি হেরা গুহায় যান। দিনের পর দিন তিনি হেরা গুহায় কাটান। হযরত খাদীজা এরকম দেরী দেখলে রাসূলের চাচাতো ভাই আলীর সাথে খাদ্য সামগ্রী নিয়ে গুহার দিকে যেতেন। অনেক দিন স্বামীর সহচর্য থেকে বঞ্চিত হবার কারণে হযরত খাদীজা তাঁর বিষন্নতা নিয়ে কথা পাড়েন। চাচাতো ভাই আলীও রাসুলের প্রতি তার ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করলেন। কিন্তু হযরত তাঁদের কথার জবাবে বললেন: “হ্যাঁ, সবই জানি আমি এবং আমিও যে তোমাদেরকে কতোটা ভালোবাসি, তোমরাও সে ব্যাপারে সচেতন। কিন্তু ঘটনাক্রমে এই ক’টা দিন আশ্চর্যরকমভাবে বিশ্ব স্রষ্টার স্মরণ ছাড়া অন্য কোনো কিছুতে মন বসছে না।”

যাই হোক, অবশেষে সেই রহস্যময় রাত এলো। নূর পাহাড়ের ওপর এবং তার দক্ষিণ প্রান্তরে চাঁদ যেন তার কোমল জ্যোৎস্না বিছিয়ে রেখেছিল। মক্কা ও তার আশেপাশের পরিবেশ যেন গভীর নিদ্রায় অচেতন। চারদিকে সুনসান নিরবতা। পৃথিবী ও কাল যেন ঐ রাতে বিশাল কোনো ঘটনার অপেক্ষায় ছিল। হযরত মুহাম্মাদ (সা.) অধিকাংশ রাতই জেগে কাটিয়ে দিতেন। ঐ রাতে পর্বতের কোথাও কোনো সাড়া-শব্দ ছিল না। এই নিরবতা, এই শান্ত-নিবীড় মুহূর্তের একটা প্রতীয়মান অর্থ ছিল। রহস্যময় ঐ মুহূর্তে হঠাৎ আকাশে অচেনা এক বিদ্যুচ্ছটা দেখা গেল। হযরতের স্থির দৃষ্টি সেদিকে পড়লো। তিঁনি তাঁর দেহমনে এক ধরনের কম্পন অনুভব করলেন। তাঁর বিনম্র অন্তরাত্মা যেন বিশালত্ব খুঁজে পেল। তিঁনি জ্বলজ্বলে এক বিশাল কিছুর অস্তিত্ব দেখতে পেলেন। তিঁনি প্রথমত ভেবেছিলেন যে হয়তো স্বপ্ন দেখছেন, কিন্তু না, এখন আরো স্পষ্টভাবে দেখতে পেলেন সেই বিশাল অস্তিত্ব। তাঁর বাহ্যিক আকৃতিতে এক ধরনের গাম্ভীর্য ও আকর্ষণ ছিল। হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আকাশের যে দিকেই তাকালেন ঐ বিশাল অস্তিত্ব তাঁর মাথার উপরে দেখতে পেলেন। এই অস্তিত্বটি আর কেউ নন, স্বয়ং ওহীবাহক হযরত জিব্রাঈল(আ:)। হযরত জিব্রাঈল ফেরেশতা কাছে এসে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)- কে বললেন: “হে মুহাম্মাদ! পড়!”

হযরত মুহাম্মাদ মনোযোগের সাথে দেখলেন তাঁর অন্তরে কিছু একটা লেখা প্রদর্শিত হচ্ছে। পুনরায় শব্দ হলো, পড়! তোমার প্রতিপালকের নামে।
হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বিচলিত কণ্ঠে বললেন: “কী পড়বো!” তারপর ফেরেশতা জিব্রাইল বললেন: “পড়! তোমার প্রভুর নামে, যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। যিনি আলাক বা জমাট রক্ত থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। পাঠ কর! সেই মহান প্রভুর নামে, যিনি কলমের সাহায্যে মানুষকে সেইসব বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছেন, যেসব বিষয় তারা জানতো না।”

হযরতের সকল অস্তিত্বে ঐশীপ্রেম যেন উপচে পড়ছিল। তিনি ফেরেশতার সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে পড়তে শুরু করলেন। শূন্যে আবারো ধ্বনিত হলো :
“হে মুহাম্মাদ ! তুমি আল্লাহর রাসূল এবং আমি তাঁরি ফেরেশতা জিব্রাঈল।”

ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ.)- এর এই গুরুগম্ভীর উচ্চারণ হযরতের কানে যেন প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। হ্যাঁ, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আবারো তাঁর বান্দাদের সাথে কথা বলতে চেয়েছেন এবং তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকূলের মধ্য থেকে হযরত মুহাম্মাদ(সা.)-কেই তাঁর অহীর বার্তা গ্রহণ করার উপযুক্ত মনে করলেন। হযরত মুহাম্মাদ(সা.) নিজেই মানুষকে সকল গোমরাহী আর বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করার চিন্তায় এতদিন ব্যস্ত ছিলেন। এখন বিশাল একটি দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত হলো। তাঁর সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে বিস্ময়কর এক অনুভূতি জাগ্রত হলো। ভীষণ এক উষ্ণতায় তাঁর সমস্ত শরীর যেন পুড়ে যাচ্ছিল। এক ধরনের উত্তেজনায় তাঁর পবিত্র কাঁধ দুটি কাঁপছিলো। তিঁনি উঠতে চাইলেন কিন্ত ওঠার মতো শক্তি তাঁর ছিল না। মাটিতে কপাল রেখে কাঁদলেন। আবেগময় ঐ মুহূর্তে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) নবুয়্যতির দায়িত্বে অভিষিক্ত হলেন।

কঠিন এই পরিস্থিতির কিছুক্ষণ পর হযরত মুহাম্মাদ (সা.) শক্তি ফিরে পেলেন। হেরা গুহা থেকে এবার বাইরে পা রাখলেন তিঁনি। তারা ভরা আকাশ, সরু নতুন চাঁদ আর মক্কার শান্ত শহর তাঁর সামনে দেখতে পেলেন। কিন্ত ঐ নিরবতার পর সমগ্র বিশ্ব যেন পুনরায় প্রাণস্পন্দন ফিরে পেল। বিশ্বব্যাপী নতুন করে প্রাণ সঞ্চারিত হলো। চারদিকে আবেগময় এক গুঞ্জরণ সৃষ্টি হলো। পাহাড়-পর্বত, মরুভূমি এক কথায় আকাশ আর যমীনে যা কিছু ছিল সবাই ফিসফিস করে বললো: “হে খোদার মনোনীত নবী! তোমার প্রতি সালাম!”

হযরত মুহাম্মাদ (সা.) অত্যন্ত ধীরে সুস্থে চিন্তা-ভাবনা করে পা ফেলছিলেন। বিস্ময়কর ঐ ওহীর বাণী তাঁর কানে একটা বিশেষ সুর সৃষ্টি করছিল: “পড় তোমার প্রভুর নামে!” এভাবে তাঁর অন্তর প্রশান্তি পেলো। এক সমুদ্র অনুভূতি আর আবেগ নিয়ে তিঁনি তাঁর একান্ত সহচর খাদীজার কাছে রহস্যময় ঘটনাটি বলে আবেগ প্রশমিত করতে চাইলেন।

হযরত খাদীজা (আ.) যখন দরোজা খুললেন, হযরত মুহাম্মাদ (সা.)- এর চোখে একটা বিশেষ ঔজ্জ্বল্য দেখতে পেলেন। চেহারার এই ঔজ্জ্বল্য দেখে খাদীজা বুঝতে পেরেছেন যে, কিছু একটা ঘটেছে। হযরত মুহাম্মাদ (সা.) কয়েক মুহূর্ত বিশ্রাম নিয়ে হযরত খাদীজাকে পুরো ঘটনা খুলে বললেন। ঘটনা শুনে হযরত খাদীজার অন্তর অপূর্ব এক আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লো। অশ্রুজড়িত কণ্ঠে তিনি বললেন:

“হে মক্কার আমীন ! তুমি ছিলে সবার বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন, সৎ ও ন্যায়বান এবং সত্যভাষী! তুমি ছিলে মজলুম ও অত্যাচারিতদের ডাকে সাড়াদানকারী এবং সত্য-ন্যায়ের পৃষ্ঠপোষক! তোমার দয়ার কথা, তোমার উত্তম স্বভাব চরিত্রের কথা, আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে তোমার প্রচেষ্টার কথা সবার মুখে মুখে। এ কারণেই সমগ্র বিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তোমাকে তাঁর নবী হিসেবে মনোনীত করেছেন। তুমি শান্ত হও ! খোদার শপথ, এটা তোমার দুঃখ-কষ্ট আর পরহেজগারীর পুরস্কার। হে আল্লাহর রাসূল ! তোমার প্রতি সালাম !”

এভাবেই খাদীজা (সা.) সর্বপ্রথম রাসূলের প্রতি ঈমান এনে গৌরবান্বিত হন। যাই হোক, এরপর হযরত মুহাম্মাদ (সা.) একটু ঘুমালেন। হযরত খাদীজা (আ.) দৃঢ় বিশ্বাসী অন্তর নিয়ে তাঁর মনে জাগ্রত কয়েকটি বিষয়ে জানার জন্যে বিজ্ঞ চাচাতো ভাই ওরাকা বিন নাওফালের কাছে গেলেন। তিনি ওরাকার কাছে ঘটনাটা খুলে বললেন এবং এই ঘটনা একান্ত নিজের মনে লুকিয়ে রাখতে বললেন। হযরত খাদীজা ওরাকার কাছে জিব্রাঈল ফেরেশতা সম্পর্কে জানতে চান।

ওরাকা বললেন: “জিব্রাঈল হলো আল্লাহর একজন বড় ফেরেশতা। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলগণের মাঝে সম্পর্ক বা যোগাযোগের মাধ্যম। এই ফেরেশতাই হযরত মূসা এবং ঈসা (আ.)- এর কাছে ওহী নিয়ে আসতেন। তিনি যেখানেই যান সেখানেই জনগণের জন্যে একটা বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়।”
হযরত খাদীজা আনন্দ ঝলমল চোখে বললেন: “জিব্রাঈল হেরা গুহায় আমার স্বামী মুহাম্মাদের কাছে এসেছিল। ভাইজান! বলুন তো, মুহাম্মাদ সম্পর্কে পূর্ববর্তী কিতাবগুলোতে কী বলা হয়েছে?”

ওরাকা হযরত খাদীজার কথায় কিছুটা বিস্মিত হয়ে বললেন: “আমি পূর্ববর্তী কিতাবগুলোতে পড়েছি যে, মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ একজন নবী পাঠাবেন যিনি ইয়াতিম, তিনি আশ্রয় দেবেন এবং কারো মুখাপেক্ষী হবেন না। তিনি হবেন সর্বশেষ নবী। তাঁর পরে আর কোনো নবী আসবে না। আমার কাছে যে ঘটনাটা তুমি বলেছো তা যদি ঘটে থাকে, তাহলে জিব্রাঈল যা বলেছে তা আল্লাহর ওহী। আর মুহাম্মাদ হলো আল্লাহর নবী। তুমি মুহাম্মাদকে বলো সে যেন তার কাজে দৃঢ় ও সুস্থির থাকে।”

হযরত খাদীজা (আ.) অপূর্ব এক আনন্দঘন চিত্তে নিজের ঘরের দিকে রওনা দিলেন। তিনি আশাপূর্ণ হৃদয়ে হযরতের কাছে গেলেন এবং আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতা আদায় করলেন।]🌷

Related Post

রাসুল (সা.) নিজে তাঁর জন্ম বৃত্তান্ত বর্ণনা করেছেন যেভাবে

Posted by - অক্টোবর ৪, ২০২২
🌹রাসুল (সা.) নিজে তাঁর জন্ম বৃত্তান্ত বর্ণনা করেছেন এভাবেঃ “রাসুলে করীম(সা.)- এর চাচা হযরত আব্বাস (রাঃ) বলেন, একদা আমি নবী(সা.)…

নূরনবী হযরত মোস্তফা (সা.) পর্ব-নয়

Posted by - নভেম্বর ৬, ২০২০
নূরনবী মোস্তফা (সা.) (৯ম পর্ব) 🌹[আল্লাহর রাসূলরা হচ্ছেন সমগ্র বিশ্বমানবতার জন্যে এমন পথপ্রদর্শক, যাঁরা সঠিক দিক-নির্দেশনা দিয়ে মানুষকে তাদের প্রকৃত…

নূরনবী হযরত মোস্তফা (সা.) পর্ব-পনের

Posted by - নভেম্বর ১৯, ২০২০
নূরনবী মোস্তফা (সা.) [ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে আপনারা যারা খোঁজ-খবর রাখেন তারা নিশ্চয়ই জানেন যে, সপ্তম হিজরীতে কুরাইশ প্রতিনিধিবৃন্দ এবং রাসূলে…

জাশনে জুলুস উদযাপনের ইতিহাস

Posted by - অক্টোবর ৪, ২০২২
মহানবী(সা.)-এর এ পৃথিবীতে আগমনে ফেরেশতাকুল, বৃক্ষরাজি, পশুপাখিসহ এ সৃষ্টি জগতের সকল বস্তু আনন্দে আন্দোলিত হয়েছিল। আকাশে উল্কারাজি নিক্ষিপ্ত করে শয়তান…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »