নূরনবী মোস্তফা (সা.)
🌹👉[“আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি সালাম যারা হেদায়াত লাভ করেছে এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের ওপর ঈমান এনেছে আর সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, তিনি ব্যতীত আর কোনো ইলাহ নেই। আমি আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী ইসলামের পথে সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি।”
উপরের এ কথাগুলো রাসূলের(সা.) লেখা একটি চিঠির অংশবিশেষ। লিখেছিলেন তাঁর সমকালীন ক্ষমতাশালী নেতৃবৃন্দকে। কোরআনের দৃষ্টিতে রাসূলে খোদা (সা.) হলেন রাহমাতুল্লিল আলামীন। “খাতামুন নাবিয়্যিন” বা সর্বশেষ নবী হিসেবে তাঁর ওপর অর্পিত হয়েছিল এক মহাদায়িত্ব। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বহুবার তাঁকে সম্বোধন করে বলেছেন, “হে মুহাম্মাদ! আমরা তোমাকে বিশ্বমানবতার জন্যে প্রেরণ করেছি! তুমি তাদেরকে খোদায়ী পুরস্কারের সুসংবাদ দাও এবং তাঁর পক্ষ থেকে শাস্তির ব্যাপারে ভয় দেখাও!”
(সূরা সাবা, আয়াত নং ২৮)।
অন্যত্র বলা হয়েছেঃ “এই কোরআন বিশ্ববাসীর জন্যে উপদেশ বা জাগরণের মূল উৎস।”
(সূরা ক্বালাম, আয়াত নং ৫২)।
কুরাইশদের সাথে সংঘাতের কয়েক বছর পর হিজরী সপ্তম বছরে রাসূল (সা.) বৃহৎ দেশগুলোর শাসক, খ্রিষ্টান নেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন গোত্রের নেতাদেরকে চিঠি লিখে ইসলাম গ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানান। এই আমন্ত্রণ জানানোর পর মদীনায় মুসলমানদের অবস্থান কিছুটা স্থিতিশীল হয়। রাসূল (সা.) বিভিন্ন শাসক ও বাদশাহকে এবং আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক পদস্থ কর্মকর্তাদেরকে যেসব চিঠি লিখেছেন, তা থেকে ইসলাম প্রচারে তাঁর কর্মকৌশল কিছুটা ফুটে ওঠে। বর্তমানে ইসলাম প্রচারের জন্যে লেখা তাঁর ১৮৫টি চিঠি সংরক্ষিত আছে। এসব চিঠি থেকে প্রমাণিত হয় যে, রাসূল (সা.) সব সময় যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে পরকালীন সুসংবাদ ও ভীতির কথা উল্লেখ করে বিশ্ববাসীর কানে ইসলামের বার্তা পৌঁছাতেন। রাসূল (সা.) বিভিন্ন দেশের শাসকবৃন্দকে দাওয়াত দেওয়ার জন্যে তাঁর সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে একটা পরামর্শ সভায় বসেন এবং সবার সামনে তাঁর ঐ কর্মসূচি তুলে ধরেন। তারপর একদিন ফজরের নামায শেষে তাঁর ঐ কর্মসূচি বাস্তবায়নকল্পে যাঁদের পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেইসব প্রতিনিধিদের ডেকে পাঠালেন এবং বললেনঃ
‘‘আল্লাহর বান্দাদেরকে নসীহত করবে। যারা জনগণের দায়িত্বশীল হয়েও জনগণকে সঠিক পথ প্রদর্শন করে না, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের জন্যে বেহেশত হারাম করে দিয়েছেন। তোমরা উঠে দাঁড়াও ! রাসূলের দূত হিসেবে দূর-দূরান্তে তৌহিদের বার্তা বয়ে নিয়ে যাও। বিশ্ববাসীর কাছে তৌহিদের ঐ বার্তা পৌঁছে দাও।”
রাসূল রূপার আংটি দিয়ে একটা সীল বানানোর নির্দেশ দেন যাতে প্রত্যয়নের স্বার্থে ঐ আংটি বা সীলকে তাঁর নামের উপর ব্যবহার করা যায়। তিনি চিঠিগুলোতে সীল লাগালেন এবং চিঠির খামগুলোকে একটা বিশেষ মোম দিয়ে আটকালেন। তারপর কয়েকজনকে তাঁর দূত হিসেবে বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠালেন। রাসূলের দূতগণ একদিনে ইরান, রোম, ইথিওপিয়া, মিশর, ইয়ামামা, বাহরাইনসহ আরো বহু অঞ্চলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
সাসানী যুগের প্রতাপশালী শাসক খসরু পারভেজকেও চিঠি লেখা হয়েছিল। রাসূলে খোদা তাঁর এক চিঠিতে খসরু পারভেজকে পারস্যের বড় কেসরা বলে অভিহিত করে লিখেছেন: ‘আল্লাহর প্রেরিত রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে ইরানের মহান কেসরাকে, তাদের প্রতি দরুদ যারা বাস্তবতা ও সত্যকামী এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে আর সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, তিনি ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই, তাঁর কোনো সমকক্ষ ও শরীক নেই, মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। আমি আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী তোমাকে তাঁর দিকে আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি আমাকে সকল মানুষের হেদায়াতের জন্যে প্রেরণ করেছেন যাতে তাদেরকে আল্লাহর ভয় সম্পর্কে অবহিত করি এবং কাফেরদের সামনে তাঁর হুজ্জাত বা যুক্তি-প্রমাণাদি তুলে ধরি। তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ করো তাহলে তুমি নিরাপদ, আর যদি তুমি ইসলাম গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকো, তাহলে অগ্নিপূজারীদের পাপের দায়ভার তোমার উপর।’
রাসুলের এই চিঠি পড়া শেষ না হতেই কেসরা উত্তেজিত হয়ে চীৎকার করে উঠলো এবং চিঠিটা ছিঁড়ে ফেললো। আর বাজান নামের তার এক সভাসদকে আদেশ দিলো নবুয়্যতের দাবীদার মক্কার ঐ কুরাইশ বংশীয়কে যেন তার ঐ দাবীর জন্যে তওবা করতে বাধ্য করা হয়। যদি তওবা না করে তাহলে যেন তার মস্তক কেটে তার কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু ইতিহাস বলছে যে, বাজান রাসূলের চিঠি পড়ার পর কেসরার আদেশ পালন না করে উল্টো রাসূলে খোদার জন্যে উপহার সামগ্রী পাঠিয়ে দেয়।
মিশরের শাসক মাকুকাসকে আরেকটি চিঠি লিখেছেন রাসূল(সা.)। মাকুকাস ছিল খ্রিষ্টান। সেজন্যে তাকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে চিঠিটাকে এই আয়াত দিয়ে অলঙ্কৃত করলেন: “হে আহলে কেতাব বা ঐশীগ্রন্থধারীগণ! এসো! তোমাদের এবং আমাদের মাঝে যে কথাটি অভিন্ন বা সমানভাবে গ্রাহ্য, তার অনুসরণ করি। আর তাহলো আমরা আল্লাহ ব্যতীত আর কারো উপাসনা করি না এবং কোনো কিছুকেই তাঁর শরীক করি না। আর আমাদের কেউ অন্য কাউকে খোদা হিসেবে গ্রহণ করে না।”
(আলে ইমরান, আয়াত নং ৬৪)।
হাতেব নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে এই চিঠিটি মিশরের খ্রিষ্টান বাদশাহর হাতে পৌঁছে। মাকুকাস অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার সাথে চিঠিটা পড়েন এবং দূতকে বলেন রাসূলের অবয়ব সম্পর্কে বর্ণনা দিতে। তারপর বললেন যে, নবীর আবির্ভাবের অপেক্ষায় ছিলেন ঠিকই তবে ভেবেছিলেন নবী হয়তো সিরিয়া থেকেই আবির্ভূত হবেন। কেননা পূর্ববর্তী বহু নবী সিরিয়াতেই আগমন করেছিলেন। মাকুকাস রাসূলে খোদার কাছে একটা চিঠি লিখলেন এবং সেইসাথে দুইজন দাসী পাঠালেন রাসূলের খেদমতে। রাসূল ঐ দুই দাসীকে মুক্তি দিয়ে দিলেন।
রোমের কায়সারকেও রাসূল চিঠি লিখেছিলেন। রাসূলের চিঠি যখন কায়সারের হাতে গিয়ে পৌঁছে, তখন তিনি ইরানের সেনাবাহিনীর উপর বিজয়ী হওয়ার আনন্দে শোকর আদায় করার উদ্দেশ্যে বাইতুল মোকাদ্দাস যিয়ারতে যাচ্ছিলেন। কায়সারকে লেখা রাসূলের চিঠিটি শুরু হয়েছিল এভাবে:
“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে রোমের মহান হেরাকেলকে……।”
কায়সার যখন চিঠির উপরাংশে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম দেখতে পেলো ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বললো, “আমি (হযরত) সোলায়মান (আ.)- এর চিঠি ছাড়া আর কারো চিঠি এ পর্যন্ত খোদার নামে শুরু হতে দেখিনি।” মক্কায় যারা বসবাস করতো, তাদের কাছ থেকে তিনি মুহাম্মাদ সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিলেন। কায়সার নিজেও নবীজীর আগমনের অপেক্ষায় ছিল। তাই এ সম্পর্কে রোমের এক জ্ঞানী পন্ডিতের কাছ থেকে জানতে চাইলো। ঐ পন্ডিত কায়সারের উদ্দেশ্যে লিখলেন: “তিনি সেই পয়গম্বর, বিশ্ব যাঁর অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।” কায়সার একটা আশ্রম বা মঠে রোমের নেতাদের একটি সমাবেশের আয়োজন করেন এবং রাসূলের পাঠানো চিঠিটা তাদের উদ্দেশ্যে পাঠ করে বলেন: “তাঁর ধর্ম ও কর্মসূচি কি তোমরা গ্রহণ করতে প্রস্তুত?” কায়সারের এই প্রস্তাবে সমাবেশে গোলযোগের সৃষ্টি হয় এমনকি তাঁর প্রাণনাশের আশংকা দেখা দেয়। তাই দ্রুত তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন: “এই প্রস্তাবের মাধ্যমে আসলে আমার উদ্দেশ্য ছিল তোমাদের পরীক্ষা করা।” যাই হোক, রোমের বাদশা শেষ পর্যন্ত রাসূলের দূতকে যথাযোগ্য সম্মান জানালেন এবং উপহার সামগ্রীসহ রাসূলের চিঠির জবাব দিলেন। চিঠিতে তিনি রাসূলের প্রতি ঈমান আনার বিষয়টি প্রতিবিম্বিত করলেন।
ইয়ামামার শাসকের উদ্দেশ্যেও রাসূল (সা.) একটি চিঠি লিখেছিলেন। তিনি রাসূলের চিঠি পড়ার পর এবং রাসূলের দূতের সাথে কথাবার্তা বলার পর ভীষণভাবে প্রভাবিত হন এবং এক চিঠিতে তিনি নবীজীকে লেখেন: “আমাকে আপনি সর্বোৎকৃষ্ট ধর্মের দাওয়াত দিয়েছেন! আমি একজন কবি এবং বক্তা। আরব জাতির মাঝে আমার একটা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। আমি আপনার ধর্ম গ্রহণ করতে প্রস্তুত রয়েছি এই শর্তে যে, আমাকে আপনি ধর্মীয় বড় কোনো কর্মকর্তা বা স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নিয়োগ দেবেন।” ইয়ামামার শাসকের পক্ষ থেকে এই পত্র সহ রাসূলের কাছে একটা প্রতিনিধিদল পাঠানা হলো। কিন্তু রাসূল (সা.) ঐ পত্রের জবাবে বললেন: “তার ঈমান যদি শর্ত সাপেক্ষে হয়, তাহলে হুকুমাত বা খেলাফতের কোন যোগ্যতা তার নেই, আল্লাহ আমাকে তার বিড়ম্বনা থেকে রক্ষা করুন।” বড় বড় দেশগুলোর প্রধানদেরকে রাসূলে খোদা (সা.)- এর এই চিঠি লেখা থেকে প্রমাণিত হয় যে, ইসলামের আহ্বান বা দাওয়াত একটা বিশ্বজনীন ব্যাপার। অন্যদিকে আমরা রাসূলের কর্মপদ্ধতি পর্যালোচনা করলে দেখতে পাবো যে, জনগণকে কিংবা নেতাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর মৌলিক পদ্ধতি ছিল, তিনি যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে সবকিছু উপস্থাপন করতেন এবং তাদের চিন্তাশক্তি জাগিয়ে তুলতেন। রাসূলের নবুয়্যতির দায়িত্ব পালনের পুরো সময়টায় এই পদ্ধতিটি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে অনুসৃত হয়েছে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি প্রাঞ্জল ভাষায় উপদেশ কিংবা কোরআনের দাওয়াত দিয়েছেন। মদীনা থেকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এভাবেই অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ইসলাম বিস্তৃতি লাভ করে। মদীনার লোকজনও এই পদ্ধতির অনুসরণ এবং কোরআনের আয়াতের চমৎকারিত্বে উদ্বুদ্ধ হয়েই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। যেমনটি প্রসিদ্ধি আছে যে, কোরআনের মাধ্যমেই মদীনা জয় হয়েছিল।]