নূরনবী মোস্তফা (সা.)
✍[“ইমাম আলী (সালামুল্লাহি আলাইহি) বলেছেনঃ “মুহাম্মাদ আল্লাহর মনোনীত নবী এবং রহমতের রাসূল।….বস্তুতঃ রাসূল আকরাম (সা.) কে নেতা হিসেবে গ্রহণ করাই তোমার জন্যে যথেষ্ট।….. রাসূল হলেন পূত-পবিত্রতম মানুষ, তাঁর অনুসরণ কর, কেননা তাঁর নীতি-পদ্ধতি এমন একটা আদর্শ যা সবার জন্যেই অনুসরণযোগ্য…..আল্লাহর প্রিয়তম বান্দা তিনিই যিনি তাঁর রাসূলের আদর্শ গ্রহণ করেন এবং তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন।”
আগের পর্বে আমরা রাসূল (সা.)-এর তৌহিদের দাওয়াত দেওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে কথা বলেছি। আমরা জেনেছি যে, রাসূল (সা.)-এর স্বভাবগত ভদ্রতা এবং নম্রতার কারণেই জনগণের অন্তরে ইসলামী আদর্শ ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু সমাজের আভিজাত্যবাদী শ্রেণীর সম্পদ এবং শক্তির বিরুদ্ধে রাসূল (সা.) লড়েছেন। এ পর্বে রাসূলের এই সংগ্রামের ধরণ বা বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমরা আলোচনা করবো।
বিশ্বে সব সময়ই লক্ষ্য করা গেছে যে, যারা আশরাফ বা অভিজাত তথা সম্পদশালী, তাদের হাতেই ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল। সাধারণত: যারাই সম্পদশালী অর্থে অভিজাত, সমাজে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব তাদেরই বেশী থাকে। অভিজাতদের জীবনযাপন পদ্ধতিতে বিলাসিতা ও উচ্চাভিলাষ জেঁকে বসে। তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি অন্যদের চেয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। আপামর জনসাধারণ থেকে তাই তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আসলে সুযোগ-সুবিধা অন্বেষণ এবং বিলাসিতা একটা সামাজিক ক্ষত ও ব্যাধি। কোনো ব্যক্তি কিংবা সমাজের কোনো একটি অংশেও যদি এই বিলাসিতার ব্যাধি গ্রাস করে, তাহলে তা ধীরে ধীরে পুরো সমাজেই সংক্রমিত হয়ে পড়ে এবং সামাজিক সুস্থতাকে হুমকিগ্রস্ত করে তোলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা গেছে যে, অভিজাত সমাজ সাধারণত ভোগবাদী ও স্বেচ্ছাচারী হয়ে থাকে।
বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন সমাজে বিলাসিতা এবং আভিজাত্যবাদের প্রচলিত অবক্ষয়ের বিষয়টি সমাজ বিজ্ঞানী এবং ধর্মীয় নেতাগণ পর্যালোচনা করেছেন। মার্কিন সমাজ বিজ্ঞানী ভেবলান মনে করেন, আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)- এর মত ব্যক্তিত্ব খুবই বিরল, একেবারেই হাতে গণা। তিনি তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী স্বভাব-চরিত্র দিয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্যে সকলের কাছে নিজস্ব সম্মান ধরে রাখতে পেরেছেন। যে সমাজে সম্পদশালী ব্যক্তির অভাব ছিল না, যে সমাজে জনসাধারণের কাছে সম্পদশালীদের উচ্চ মর্যাদা এবং যথার্থ স্থান ছিল, যেসময় আভিজাত্যবাদের ব্যাপক প্রচলন ছিল, সে সময় রাসূলের এই গ্রহণযোগ্যতা সত্যিই বিস্ময়কর। মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর বিচক্ষণ নেতৃত্ব দিয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আভিজাত্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন এবং মানুষের মাঝে শ্রেণী বৈষম্য দূর করে দিয়ে সাম্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন। শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে তাঁর আদর্শ ছিল নজিরবিহীন। জাহেলি সমাজে গোত্র, পরিবার, সম্প্রদায় এবং সম্পদের আভিজাত্যের উপর মর্যাদার বিষয়টি নির্ভর করতো। রাসূল (সা.) তাঁর নিজস্ব সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে আভিজাত্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেনঃ “কুরাইশ গোত্রে অভিজাত বলতে তাদেরকেই বোঝাতো, যাদেরকে দেখে জনগণ ভয় পেতো এবং ঐ অভিজাতরা লোকজনকে যা-ই আদেশ করতো, তারা তা-ই করতো। এই অভিজাতরা আত্মপ্রদর্শন ও খ্যাতি কুড়াবার জন্যে যুদ্ধের খরচ বহন করতো এবং ধন-সম্পদ লুটতরাজের মধ্য দিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতো। তারপর সেই বীরত্বগাঁথাকে মহাকাব্য আকারে স্মরণীয় করে রাখতো।” রাসূল (সা.) যখন সিদ্ধান্ত নিলেন খারাশ বিন উমাইয়া কা’বী নামে সমাজের একজন অনভিজাত ব্যক্তিকে অভিজাত সম্প্রদায়ের সাথে আলোচনার জন্যে পাঠাবেন, তখন খারাশ উদ্বিগ্ন হয়ে রাসূলের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন যেন একজন খ্যাতিমান লোককে পাঠানো হয়, যাতে অভিজাত সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে কোনো রকম প্রতিবাদ না আসে। কিন্তু রাসূল খারাশকে নির্বাচন করে বোঝালেন যে, মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হলো মেধা-প্রতিভা এবং যোগ্যতা। মক্কা বিজয়ের পরও ইথিওপীয় দাস বেলাল কাবার ছাদে গিয়ে আযান দিয়েছিলেন। বেলালের আযানের শব্দ শুনে কুরাইশ অভিজাতদের মাঝে যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল, তা প্রমাণ করেছিল যে, তাদের মাঝে আভিজাত্যের চেতনা কতোটা ভয়াবহ আকারে বিরাজ করছিল। একটা নীচু শ্রেণীর লোক এভাবে কাবার উপরে উঠে আযান দেবে, এটা কুরাইশদের অভিজাত সম্প্রদায়ের অনেকে কল্পনাই করতে পারেনি। তাই তাদের চেহারায় বিরক্তির সুস্পষ্ট ছাপ দেখা যাচ্ছিল। অন্যদিকে রাসূল (সা.) বেলালকে দেখে খুশি হলেন এবং বললেনঃ “হে বেলাল! তোমার আযানের মাধ্যমে আমাদের প্রশান্ত ও প্রফুল্ল করো।”
শ্রেষ্ঠত্বের এই অহঙ্কারী দৃষ্টিভঙ্গিকে সমাজ থেকে বিতাড়িত করার জন্যে রাসূল (সা.) প্রথমে ধর্মীয় ভ্রাতৃত্বকে গোত্রীয় ও আভিজাত্যমূলক মূল্যবোধের জায়গায় স্থান দিলেন। রাসূলে খোদা (সা.) তাঁর এক ভাষণে বলেছেন: “এক মুমিনের সাথে অপর মুমিনের সম্পর্ক হলো শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গের মতো, কেননা কোন অংশে ব্যাথা হলে তা সমস্ত শরীরেই অনুভূত হয়।” এমনকি তিনি নিজে নবী হবার পরও অর্থাৎ অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও সমাজের বাদ বাকী জনগণের তুলনায় কোনরকম অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধার অধিকারী ছিলেন না। মদীনায় যখন মানুষের মাঝে উপহার সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছিল, তখন রাসূল এবং তাঁর স্ত্রী উম্মে সালমা অন্যদের সমানই গ্রহণ করেছেন। এভাবে আমরা লক্ষ্য করি যে, একটা সমাজের মানুষকে যে বিষয়টি একই বন্ধনে আবদ্ধ করে এবং ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবার মাঝে অভিন্ন মানবিক বোধের উন্মেষ ঘটায়, তাহলো ইসলামের নবীর সেই সব শিক্ষা যার প্রচার প্রসারে তিনি নিরন্তর চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।
রাসূলের আবির্ভাবের সময় আভিজাতরা কিছু নিয়মনীতিতে বিশ্বাসী ছিলো, যেমন তারা মনে করতো তৎকালীন সমাজের মহিলারা সম মর্যাদাসম্পন্ন শ্রেণীর বাইরে অন্য কোনো শ্রেণীর পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে না। রাসূল (সা.) এই ভ্রান্ত প্রথাটিকে বাতিল করার জন্যে এবং শ্রেণীগত দূরত্ব কমানোর জন্যে রাসূলের আযাদকৃত গোলাম যায়েদের সাথে আব্দুল মুত্তালিবের নাতিন যাইনাবের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। শ্রেণীভেদ প্রথা বা আভিজাত্যবাদের বিরুদ্ধে রাসূলের সংগ্রামের আরেকটি কৌশল ছিল আধ্যাত্মিক মূল্যবোধগুলোর প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করা। রাসূল (সা.) তাকওয়া এবং ঈমানকে সম্মান ও মর্যাদার মাপকাঠি বলে মনে করতেন এবং কর্মস্পৃহা, উদ্যম ও চেষ্টা-প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দিয়ে অলসতা বা কর্মবিমুখতাকে সমাজ থেকে দূর করেছেন। রাসূলের চাচা আব্বাস যখন নবীজীর কাছ থেকে একটা কাজের দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন, রাসূল তখন জবাবে বলেছিলেন: “আপনাকে এমন একটা কাজের দায়িত্ব দেবো যে কাজ থেকে আপনার কোনো আয় হবে না বরং ঐ কাজের জন্যে আপনার আরো খরচ হবে।”
ইসলামী সমাজের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার অধিকারী হয়েও রাসূল (সা.) সর্বপ্রকার গর্ব-অহংকার এবং আভিজাত্যকামিতা থেকে দূরে ছিলেন। তিনি একেবারেই সাদাসিধে ও অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন এবং অপরাপর লোকজনের মতো তিনি নিজেও উৎপাদনধর্মী কাজকর্ম করতেন। কূয়া ও পরীখা খনন করতেন এবং মসজিদ তৈরীর ক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গী-সাথীদেরকে সহযোগিতা করতেন। আভিজাত্যবাদী চেতনার সাথে সংগ্রাম করার ক্ষেত্রে রাসূলের পদ্ধতি ছিল কর্মোদ্যম ও চেষ্টা-প্রচেষ্টার সংস্কৃতির সাথে অভিজাত সম্প্রদায়ের পরিচিতি ঘটানো। তিনি এই ধরনের লোকজনকে পতিত জমি দিতেন যাতে সেখানে তারা কাজ করে এবং তাদের হাতেই ঐ জমি আবাদ হয়। আভিজাত্যের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিশিষ্ট কবি হাসসান বিন সাবেত আনসারীকে রাসূল একবার পতিত জমি দিয়েছিলেন যাতে তিনি ঐ জমিতে আবাদ করেন।
এভাবে মানব সমাজের প্রতি আল্লাহর সর্বশেষ দূত হযরত মুহাম্মাদ (সা.)- এর শিক্ষা ছিল যে, জীবনের সকল ক্ষেত্রে মানুষের উচিত যুক্তি ও ন্যায়সঙ্গত আচরণ করা এবং সকল প্রকার অপব্যয় ও উগ্রতা পরিহার করা। মানুষ যাতে নিজেকে অহংকারের ফাঁদে আটকে না ফেলে, সেইসাথে রুটি-রুযি যেন নিজস্ব চেষ্টায় এবং সঠিক পন্থায় অর্থাৎ হালাল উপায়ে উপার্জিত হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। রাসূল (সা.) বলেছেনঃ “রুটি রুজির ক্ষেত্রে নিজের পছন্দ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তোমাদের জন্যে হালাল এবং হারামের বিধান দিয়ে দিয়েছেন। ফলে যারাই হারাম বা অপছন্দনীয় বস্তুগুলোকে পরিহার করে তারা মূলতঃ নিজস্ব মর্যাদা ও ধর্মকেই হেফাজত করেছে।”]