নূরনবী হযরত মোস্তফা (সা.) পর্ব-তের

616

নূরনবী মোস্তফা (সাঃ)

✍ [রাসূল(সা.) যখন ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছিলেন, তখন কুরাইশ গোত্রের মুশরিকরা রাসূলের বিরুদ্ধে সকল প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। এমনকি তারা রাসূলের কাছে যাতে কেউ আসতে না পারে সেজন্যে মানুষজনকে বাধা দিত। কিন্তু মুশরিকদের এতো বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করেও মানুষ কোরআনের মোহনীয় মাধুর্যে বিমুগ্ধ হয়ে যেত। এর ফলে মুশরিকদের মনে একটা প্রশ্ন জাগলো, এমন কী আছে কোরআনে যে, যে ব্যক্তিই শোনে সে-ই মুগ্ধ হয়ে যায়। মক্কার মুশরিক নেতৃবৃন্দের মধ্য থেকে আবু জেহেল, আবু সুফিয়ান এবং আখনাস দিনের বেলা ঠিকই অন্যদেরকে রাসূলের কাছে যেতে বাধা দিত। কিন্তু রাতের বেলা নিজেরাই গোপনে কোরআন তেলাওয়াত শোনার জন্যে রাসূলের ঘরের পাশে গিয়ে লুকিয়ে থাকতো।

এক রাতের ঘটনা। তারা তিনজনই যার যার মতো লুকিয়ে লুকিয়ে কোরআন তেলাওয়াত শোনার পর যখন  বেরিয়ে আসছিল, তখন পরস্পরের মুখোমুখী হয়ে যায় এবং সবার কাছেই সবার গোপনীয়তা প্রকাশ হয়ে পড়ে। এ কারণে তারা পরস্পরকে তিরস্কার করে এবং শপথ করে যে, এই ঘরে আর কখনো আসবে না। মুখে বললেও তাদের কাছে কোরআনের আয়াতের আকর্ষণ ছিল শপথের অনেক উর্ধ্বে। তাই পরের রাতেও তিনজনই রাসূলের নিজ মুখে আল্লাহর বাণী শোনার জন্যে বাইরে বেরিয়ে এলো। পরপর তিনবার এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল এবং প্রত্যেক বারই তারা শপথ নিয়েছিল যে, এই স্থানে আর পা রাখবে না। এগুলো আসলে কোনো কাহিনী বা গল্পের কথা নয় বরং এটা হলো বাস্তব ইতিহাস। আর সেই বাস্তবতা হলো, মক্কার মুশরিকরা কোরআনের আয়াতের বিস্ময়কর সৌন্দর্য ও অলঙ্কারিত্বে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারা এর সত্যতা বুঝতে পেরেছিল ঠিকই, কিন্তু তাদের ঈর্ষাপরায়নতা ও গোঁড়ামির কারণেই সেই সত্য গ্রহণ করা থেকে তারা বিরত ছিল। অন্যান্য নবীদের মতো মুহাম্মাদ (সা.)- এরও মোজেযা বা অলৌকিকত্ব ছিল, যাতে ঐ মোজেযা দেখে জনগণ তাঁর বার্তা বা দাওয়াতের সত্যতা উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু যারা অলৌকিকত্ব দেখার অপেক্ষায় ছিল রাসূল সবকিছুর আগে কোরআন এবং কোরআনের জীবন্ত শিক্ষার দিকে তাদের মনোযোগ ও দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। তিনি মক্কার পরিবেশটাকে কোরআনের আধ্যাত্মিক সুগন্ধিতে ভরপুর করে দেন। আসলে কোরআনের আধ্যাত্মিকতা এবং গভীর আকর্ষণই ইসলামের আহ্বানে জনগণের সাড়া দেওয়ার প্রধান কারণ। সে সময় আরবের লোকেরা সাহিত্য বা কবিতার ক্ষেত্রে ভীষণ বাকপটু ছিল। সাহিত্যের শৈলীগত বৈচিত্র্য এবং অলঙ্কারী দিক থেকে তারা ছিল খুবই দক্ষ। সে কারণেই যখন কোরআনের আয়াত তেলাওয়াত করা হতো, তখন তারা কোরআনের সাহিত্যিক মাহাত্ম্য এবং আলঙ্কারিক ঐশ্বর্যের বিষয়টি বুঝতে পারতো। তারা এটাও বুঝতো যে কোরআনের আয়াতের অলৌকিকত্ব কেবল এর শব্দ বা বাণী দিয়ে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কোরআনের শব্দমালার সুরেলা বিন্যাস এবং এর আয়াতের সাহিত্যিক মূল্যই শ্রোতার অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করতো।
রাসূল (সা.) সব সময়ই কোরআনের আয়াতগুলোকে মুখস্থ করা এবং জনগণের সামনে সেগুলো তেলাওয়াত করার চেষ্টা করতেন। ওহীর আয়াতগুলো শেখার ওপর তিনি ভীষণ গুরুত্ব দিতেন এবং খুব দ্রুতই সেগুলো আয়ত্ত করে ফেলতেন। রাসূলের ওপর যখন কোরআনের আয়াত নাযিল হতো, তখন অনেক সাহাবী স্বেচ্ছায় কিংবা রাসূলের নির্দেশে সেই আয়াতগুলোকে কাঠ, খেজুর পাতা, পাথর কিংবা চামড়ার ওপর লিখে রাখতেন। এভাবে আয়াতগুলোকে সংরক্ষণ করা হতো। রাসূল যখন মসজিদে বসতেন, সাহাবীরা তাঁকে ঘিরে অধীর আগ্রহ ও কৌতূহল সহকারে আন্তরিকতার সাথে বৃত্ত তৈরী করতেন, তবে পেছনে কেউ বসতেন না। ধীরে ধীরে কোরআন শেখার এই আসর বা বৃত্ত বড়ো হতে লাগলো। রাসূল বলেছেন: “তোমাদের মধ্যে সেই শ্রেষ্ঠ, যে কোরআন শেখে এবং অপরকে শেখায়।” তিনি এর গুরুত্ব বোঝাতে বলেছেন, এমনকি তুমি যদি অন্তত একটি আয়াতও জানো, তা-ই অপরের কাছে পৌঁছে দাও এবং প্রচার করো। যে সমাজকে জাহেলিয়াতের গোঁড়ামি আর অজ্ঞতা পরিপূর্ণভাবে গ্রাস করে ফেলেছিল, কোরআনে কারীমের মাধ্যমে রাসূল সেই সমাজে তৌহিদের বার্তা প্রচার করলেন। কোরআনের সূরাগুলো মানুষকে নোংরামি আর কদর্য থেকে দূরে সরিয়ে রেখে মনুষ্যত্ব, স্বাতন্ত্র্য চেতনা ও নিজেকে চেনা এবং জীবনের সঠিক বোধ ও উপলব্ধি এককথায় জীবনের সঠিক মাপকাঠির দিকে আহ্বান জানালো। একইভাবে কোরআনের আয়াতগুলো চমৎকার প্রকৃতি যেমন সূর্য ওঠা ভোর, তারাভরা রাতের আকাশ, ভূমি ও আকাশ সৃষ্টির বিভিন্ন পর্যায় বা স্তর প্রভৃতির প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। এইসব আয়াতের সাহিত্যিক গুণ যেমন অসাধারণ তেমনি এগুলোর জ্ঞানগত মূল্যও বিস্ময়কর। রাসূলের মতো একজন নিষ্পাপ ও মহান ব্যক্তিত্বের মুখে যখন এইসব আয়াত উচ্চারিত হতো, তখন আয়াতের ঐশ্বর্য সবাইকে আন্দোলিত করতো।
কোরআনের আয়াতের বার্তা দিয়ে রাসূল জনগণের দৃষ্টি খুলে দিলেন। কোরআন হলো চিন্তা-গবেষণার জন্যে অলৌকিকতাপূর্ণ একটি গ্রন্থ, সে কারণেই মানুষের বুদ্ধি-বিবেক ও বিচক্ষণতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোরআনের দর্শনীয় প্রভাব পড়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ কোরআন একদিকে যেমন মানুষকে আল্লাহর পথ দেখিয়েছে, অপরদিকে মুসলমানদের উন্নতিও নিশ্চিত করেছে। কোরআনের আয়াতের আলো দিয়েই রাসূল তাঁর দাওয়াতী কাজ চালিয়েছেন এবং এভাবেই একটা বৃহৎ ইসলামী সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়।

রাসূলের নজীরবিহীন বক্তব্যের প্রভাব জনগণের ওপর এতো বেশী মাত্রায় পড়তে শুরু করে যে, মক্কার মুশরিকরা তা বন্ধ করতে ওয়ালিদের কাছে যায়। ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা ছিলেন আরবের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সমালোচক। তাই সে ভাষার গুণমান, বক্তব্যের গুরুত্ব প্রভৃতি খুব ভালোভাবেই বুঝতো। কুরাইশদের একটি দল এই ওয়ালিদকে একদিন নিয়ে গেল রাসূলের কাছে। তারা অপেক্ষায় ছিল এই বুঝি ওয়ালিদ রাসূলকে পরাস্ত করে বসলো। রাসূল কোরআনের একটি আয়াত তেলাওয়াত করলেন। ওয়ালিদ প্রথম দিকে অহঙ্কারের সাথে আয়াত শুনছিলো। কিন্তু পরক্ষণে দেখা গেল রাসূলের মুখে তেলাওয়াতের শব্দ যতোই বৃদ্ধি পেতে লাগলো, ওয়ালিদ ততোই শান্ত এবং আত্মসমর্পিত হতে শুরু করলো। ওয়ালিদ বললো: “কী মধুর! এটা কিছুতেই মানুষের বানানো বক্তব্য হতে পারে না।” আয়াতের মাধুর্য ওয়ালিদের ভেতর এতোটাই প্রভাব বিস্তার করলো যে, সে পরিবর্তিত হয়ে গেল। মুশরিকরা তাকে ভয় দেখালো, সাবধান করে দিল। কিন্তু ওয়ালিদ বললো, “মুহাম্মাদের কাছ থেকে যেসব কথা আমি শুনেছি, সে সব কথা এতো আকর্ষণীয় যে, অন্য কারো কথার সাথে তার তুলনা হয় না। তার বক্তব্যকে ঠিক কবিতাও বলা যায় না, আবার গদ্যও বলা যায় না, গদ্য-পদ্যের উর্ধ্বে তাঁর বক্তব্য গভীর অর্থপূর্ণ, মিষ্টি-মধুর, কল্যাণময় ও প্রভাব বিস্তারকারী। তাঁর বক্তব্য এতোই উচ্চমার্গের যে, কোনো কিছুই তার চেয়ে উন্নত হতে পারে না।”

আর এ কারণেই ইসলামের শত্রুরা পর্যন্ত কোরআনের আকর্ষণে বিমোহিত হয়ে পড়েছিল। কালের পরিক্রমায় যদিও তারা রাসূলের বিরুদ্ধে, কোরআনের বিরুদ্ধে কেবল অপবাদ আর কুৎসাই রটিয়েছে, তারপরও রাসূলের অগ্রযাত্রা, কোরআনের অগ্রযাত্রা কিন্তু ব্যাহত হয়নি। বরং শত্রুদের ষড়যন্ত্রই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। কেননা আল্লাহর ভাষ্য অনুযায়ী কোরআনে কোনোরকম মিথ্যা বা সন্দেহের স্থান নেই। রাসূলের পরেও কোরআনের আয়াতগুলো নিষ্প্রাণ অন্তরগুলোকে সুগন্ধি স্নিগ্ধ বাতাসের পরশ বুলিয়েছিল। মানব উন্নয়ন তথা জ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে কোরআনের অজানা রহস্যগুলোও একের পর এক উন্মোচিত হয়েছে। ইমাম সাদেক (আ.) যেমনটি বলেছেন: “কোরআন চিরন্তন ও জীবন্ত। কোরআন কখনো নিশ্চিহ্ন হবে না। বহমান কালের মতো কিংবা সূর্যের আলোর মতো চিরদিন এই কোরআন থাকবে এবং বিশ্ববাসীকে নিরন্তর আলোকিত করে যাবে।”

আজকাল অমুসলিম চিন্তাবিদদের মাঝেও যাঁরা কোরআন নিয়ে গবেষণা করেছেন, তাঁরা মনে করেন যে, এই গ্রন্থটি হলো কর্ম ও নীতির প্রজ্ঞাপন এবং কোরআনের বার্তা বা শিক্ষাগুলো হলো ইসলামের বিকাশ ও উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। মার্কিন চিন্তাবিদ ইরভিং বলেছেন: “এই গ্রন্থ আটলান্টিক মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত সকল জনগণকে শান্তি ও সুখ-সমৃদ্ধির পবিত্র ছায়াতলে আশ্রয় দিয়েছে।”]

Related Post

নূরনবী হযরত মোস্তফা (সা.) পর্ব-৬

Posted by - নভেম্বর ৪, ২০২০
নূরনবী হযরত মোস্তফা (সা.) (৬ষ্ঠ পর্ব) [হযরত খাদীজা ভোরে আশ্চর্য এক স্বপ্ন দেখেন। তিনি স্বপ্নরাজ্যে দেখলেন যে, অন্ধকারাচ্ছন্ন শহরে আকাশের…

জাশনে জুলুস উদযাপনের ইতিহাস

Posted by - অক্টোবর ৪, ২০২২
মহানবী(সা.)-এর এ পৃথিবীতে আগমনে ফেরেশতাকুল, বৃক্ষরাজি, পশুপাখিসহ এ সৃষ্টি জগতের সকল বস্তু আনন্দে আন্দোলিত হয়েছিল। আকাশে উল্কারাজি নিক্ষিপ্ত করে শয়তান…

নূরনবী হযরত মোস্তফা (সা.) পর্ব-নয়

Posted by - নভেম্বর ৬, ২০২০
নূরনবী মোস্তফা (সা.) (৯ম পর্ব) 🌹[আল্লাহর রাসূলরা হচ্ছেন সমগ্র বিশ্বমানবতার জন্যে এমন পথপ্রদর্শক, যাঁরা সঠিক দিক-নির্দেশনা দিয়ে মানুষকে তাদের প্রকৃত…

নূরনবী হযরত মোস্তফা (সা.) পর্ব-দশ

Posted by - নভেম্বর ৭, ২০২০
নূর নবী মুহাম্মাদ মোস্তফা (সা.) (১০ম পর্ব) 🌻👉[নবী-রাসূলগণ হলেন বিশ্ব মানবতার জন্যে সর্বোত্তম ঐশী উপহার, তাঁদের নূরের আলোয় মানুষ জীবনের…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »