নূরনবী মোস্তফা (সা.)
✍[রাসূল (সা.) একদিন মসজিদে গিয়ে আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ একটা পরিবেশ অনুভব করলেন ৷ তাঁর অনুসন্ধানী দৃষ্টি মসজিদের প্রতি নিবদ্ধ ছিল ৷ তিনি দেখতে পেলেন মসজিদের ভেতর দুটি দল বৃত্ত তৈরী করে আছে৷ একদল ছিল আল্লাহর জিকির-আজকার আর দোয়া-দরুদে মশগুল, অন্যদল জ্ঞানের বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত ৷ রাসূলে খোদা (সা.) এ দুটি দলের দিকেই তাকিয়ে বললেন, দুটি দলই মঙ্গল ও কল্যাণের পথে রয়েছে, কিন্তু আমি সেই দলটির সাথেই বসবো যারা জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করছে৷
যতোই দিন যেতে লাগলো, রাসূল (সা.) ততই বিভিন্ন পদ্ধতিতে প্রতিভাবান এবং আগ্রহীদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগলেন ৷ নিঃসন্দেহে এটা ছিল রাসূলের ওপর একটা কঠিন দায়িত্ব৷ তদুপরি তিনি এমন একটা অসচেতন ও পশ্চাদপদ সমাজের মুখোমুখি হলেন, যে সমাজে পূর্ববর্তী ধর্মের ভিত্তিতেই জীবনকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হতো৷ তাদের কাছে যে কোনো কিছুর সত্যতা ও যথার্থতা নির্ণয়ের ভিত্তি ছিল পূর্ববর্তীদের অনুসৃত মানদণ্ড ৷ আর এ বিষয়টাই তাদের উন্নতি ও অগ্রগতির পথে প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ তারা তাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে কোনোরকম পরিবর্তনকে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না৷ অন্যদিকে অজ্ঞতা তাদেরকে তৌহিদে বিশ্বাস এবং এক আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগী করা থেকে ফিরিয়ে রেখেছিল৷ তারা কেবল চোখে যা দেখতো তা-ই গ্রহণ করতো৷ কিন্তু সেই সত্যের প্রতি তারা ঈমান আনতো না, যেই সত্য চিন্তা-চেতনা ও বোধ-উপলব্ধি তথা প্রজ্ঞা দিয়ে উপলব্ধিযোগ্য ৷
সেই সমাজে চিন্তা-চেতনা, জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধির চর্চার বিষয়টিই ছিল অজানা ৷ কারো মর্যাদার বিষয়টি নিরূপিত হতো তরবারীর শক্তিতে৷ সমাজের এই কঠিন ও স্পর্শকাতর অবস্থাই প্রমাণ করে যে, রাসূলের কাজ কতটা কঠিন ছিল৷ তাই, রাসূলে পাক (সা.) সমাজে একটা আমূল পরিবর্তন আনার জন্যে প্রথমত: বিশ্বাস এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনটাকেই প্রাধান্য দিলেন৷ কোরআনের চিত্তাকর্ষক আয়াতে আল্লাহর সৃষ্টি রাজ্যের ব্যাপারে চিন্তা-গবেষণার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে৷ রাসূলের ওপর প্রথম যে আয়াতটি নাযিল হয়েছিল, তাতে পড়া, শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষা প্রদানের কথা বলা হয়েছে৷ রাসূল (সা.) বলেছেন, অজ্ঞতা এবং মূর্খতার ওপর বিজয় লাভের উপায় হলো প্রশ্ন করা৷ রাসূল মানুষের অন্তরে কোরআনের আদর্শ ও শিক্ষাগুলোকে সঞ্চারিত ও প্রোথিত করতে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন৷
আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী করিম (সা.) বলেছেন, আল্লাহর ঘরে যারা কোরআন শেখার জন্যে সমবেত হয় এবং এ লক্ষ্যে নিজেদের মাঝে আলাপ-আলোচনা করে, তাদের ওপর আল্লাহর রহমত ও শান্তির ধারা বর্ষিত হয়৷ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা এবং জ্ঞানার্জন করার জন্যে বারবার উপদেশ দেওয়ায় তৎকালীন সমাজের লোকজনের মাঝে যেন ঝড়ের সৃষ্টি হলো, তারা সবকিছুর আগে জ্ঞান অর্জন করাটাকে অগ্রাধিকার দিল৷ রাসূলের সাহাবীগণ সবসময় তাঁর কাছ থেকে বেশী বেশী জানার জন্যে ব্যাকুল ছিলেন৷ মদীনায় হিজরতকারী একজন মুসলমান বলেন, আমি এবং আমার প্রতিবেশীর মাঝে কথা হয়েছিল যে, একদিন আমি যাবো রাসূলের খেদমতে, আরেকদিন সে যাবে৷ তো রাসূলের কাছ থেকে ওহীর যেসব শিক্ষা আমরা লাভ করবো, তা পরস্পরকে জানাবো৷
রাসূল (সা.) মুয়ায নামে তাঁর একজন সাহাবীকে বললেন: “হে মুয়ায! জেনে রাখো! তোমার প্রচেষ্টায় আল্লাহ যদি কোনো ব্যক্তিকে হেদায়াত দান করেন, তা হবে দুনিয়ার সকল বস্তুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও মূল্যবান৷” উল্লেখ্য যে, রাসূল (সা.) জনগণের হেদায়াতের উদ্দেশ্যে একবার এই মুয়াযকে কোনো এক এলাকায় পাঠিয়েছিলেন৷
নবীজীর দৃষ্টিতে জ্ঞান হলো মানুষের অন্তরে আলো ও সজীবতার উৎস৷ তিনি অন্যত্র বলেছেন: “জ্ঞান হলো মুমিনের হারানো সম্পদ৷” মানুষ যদি কিছু হারায় তাহলে তা উদ্ধার করার জন্যে সকল প্রকার প্রচেষ্টা চালায়৷ জ্ঞান হলো মুমিনের সেই হারানো বস্তু, তাই এই জ্ঞানকে উদ্ধার করার জন্যে অর্থাত্ জ্ঞান অর্জন করার জন্যে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালানো উচিত৷ জ্ঞান হলো মূল্যবান সেই মণি মুক্তোর মতো, যা যতোই জমানো হয় সাধ মেটে না৷ রাসূল (সা.) এই বিষয়টিকে বর্ণনা করেছেন এভাবে: “মুমিনের হারানো বস্তু হলো জ্ঞান৷ জ্ঞানের বৈশিষ্ট্যই হলো যতই তা শেখা হয় ততই আরো শেখার চাহিদা বেড়ে যায়।”
চিন্তা-চেতনা বিকাশে রাসূলের গৃহীত নীতির ফলে জনগণও চিন্তার স্বাধীনতা পেয়ে যায়৷ তারা তাদের পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্য এবং লোকাচারের অন্ধত্ব ও গোঁড়ামীর স্থলে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার সুযোগ পায় এবং তারা জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও যুক্তির ভিত্তিতে নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে৷ এই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনটির কারণে ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শ উপলব্ধির পথ সুগম হয়৷ কেননা, অন্তদৃষ্টি, জ্ঞান ও সচেতনতা ছাড়া ইসলামকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা সম্ভব নয়৷ সাফওয়ান ইবনে গাসসান বলেন: “রাসূলের খেদমতে হাজির হয়ে বললাম, হে রাসূল! আমি জ্ঞান অর্জন করার জন্যে মসজিদে এসেছি৷ রাসূলে খোদা আমাকে বললেন, খুব ভালো! জ্ঞান অর্জনের পেছনে লেগে থাকো! ফেরেশতারা জ্ঞান অন্বেষণকারীদেরকে তাদের পাখা এবং পালক দিয়ে আশ্রয় দেয় এবং তাদের চারপাশে ভালোবাসা ও প্রেমের এমন একটা বৃত্ত তৈরী করে যেমন আকাশ পৃথিবীকে বৃত্তাকারে ঘিরে রাখে।”
একদিন রাসূলে খোদা (সা.) জন সমাবেশে বললেন: “বেহেশতের বাগিচায় ভ্রমণ করো, নিজেকে তার অনুগ্রহ বা নেয়ামত দিয়ে পূর্ণ করো! জনগণ বললো, হে রাসূলে খোদা! বেহেশতের বাগিচা মানে কী? রাসূল বললেন, আলাপ-আলোচনার বৈঠক ৷ কেননা আল্লাহর এমন কিছু ফেরেশতা রয়েছেন যারা ঘুরে ঘুরে জ্ঞান বিষয়ক আলাপ-আলোচনার বৈঠক খুঁজে বেড়ায়৷ তারা এ ধরনের বৈঠকে প্রবেশ করে বৈঠককারীদের ঘিরে রাখে৷”
রাসূলে খোদা (সা.) তৎকালীন জনগণের অবস্থাকে এত দক্ষতার সাথে এমন সুন্দরভাবে বর্ণনা করতেন যে, তারা তাদের অজ্ঞতা বা মূর্খতা কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে উজ্জীবিত হতো৷ রাসূলের এই চিন্তা ও সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টার ফলে অজ্ঞ ও মূর্খ একটি জাতির মধ্য থেকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞাপূর্ণ একটি সমাজের সৃষ্টি হলো৷ জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূলের ছোট্ট একটি বক্তব্যই যথেষ্ট ৷ তিনি বলেছেন: “জ্ঞান হলো আমার এবং আমার পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পদ৷”
একইভাবে তিনি জ্ঞানীদেরকে আঁধার রাতের পথিককে পথ-প্রদর্শনকারী আকাশের তারার সাথে তুলনা করে বলেছেন: “পৃথিবীর বুকে জ্ঞানীদের অবস্থান আকাশের তারার মতো৷ এই তারার মাধ্যমে জল-স্থলের সকল আঁধার দূরীভূত হয়ে যায়৷ এই তারাগুলো যদি হারিয়ে যায়, তাহলে পথের সন্ধান লাভকারীগণ পুনরায় পথ হারিয়ে বসতে পারে।”]