নূরনবী মোস্তফা (সা.)
(২য় পর্ব)
🌺[ইরানী বাদশাহ খসরু আনুশিরভন তাঁর নিজস্ব প্রাসাদ ফিরোযা প্রাসাদে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। কিয়নী রাজবংশের হরিণা নক্সার সোনার মুকুট তাঁর সিংহাসনের পাশেই রক্ষিত ছিল। হঠাৎ যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো। রণবাদ্যের ধ্বনির ফলে তাঁর বিশ্রামে বিঘ্ন ঘটলো। প্রাসাদ থেকে মর্মর পাথরের টুকরো ঝরে পড়তে লাগলো। প্রাসাদের বিভিন্ন কোণ থেকে রক্ষীদের চীৎকার শোনা যাচ্ছিল, ভেঙ্গে গেল, কাসরার দ্বারমন্ডপ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল, প্রাসাদের দেওয়াল ধ্বসে পড়লো ইত্যাদি। বাদশাহ খসরু ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগলো। একবার যায় বাগানের দিকে, আরেকবার যায় বারান্দায়। কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো বিস্ময়ের সাথে চারদিকে চোখ ফেরাতে লাগলো। হঠাৎ দেখতে পেলো বোযোর্গমেহের পন্ডিতকে। তাঁকে বললো: “হে পন্ডিত! কী এক অদ্ভুত রাত্রি। দুই দুটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল। একটা হলো, আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি। দ্বিতীয়টা হলো আমার প্রাসাদ ধ্বসে পড়েছে। স্বপ্নে দেখলাম এই অন্ধকার রাতে হেজাযের দিক থেকে সূর্য উঠেছে। ঐ সূর্যের আলোয় চারিদিক আলোকিত হয়ে পড়েছে। কেবল আমার প্রাসাদের আঁধার দূরীভূত হয়নি। আমি ঐ আঁধার দেখে ভয় পেয়ে যাই। হঠাৎ আমার প্রাসাদ ভেঙ্গে পড়ার শব্দে ঘুম থেকে জেগে উঠি। এই সূর্য ওঠার ব্যাপারটা কী বলুন তো?” বোযোর্গমেহের বললেন, “একজন মানুষের আবির্ভাব ঘটবে যাঁর ক্ষমতা বাদশাহদের চাইতেও অনেক অনেক বেশী, তাঁর জ্ঞানও সকল পন্ডিতের চেয়ে অনেক অনেক বেশী। তাঁর যে আলো, তা আল্লাহ প্রদত্ত। তাঁর কথার নূরে সারা পৃথিবী আলোকিত হবে।
প্রাচীন ধর্মগুলো গাছের হলুদ পাতা ঝরে পড়ার মতো মন্থর হয়ে যাবে। বারান্দা ভেঙ্গে পড়া মানে সেই মহামানবের জন্ম হয়েছে। চল্লিশ বছর পর তাঁর ব্যাপারে জানা যাবে।” ঐদিন সকালবেলা, আনুশিরভনের মাথা থেকে তখনো গতরাতের দুর্ঘটনার চিন্তা যায় নি। এমন সময় একজন ঘোড় সওয়ার এসে বললো: “হে বাদশাহ ! আশ্চর্য এক ঘটনা ঘটেছে। হাজার বছর ধরে জ্বলন্ত পারস্যের অগ্নি মন্দিরের আগুন গতরাতে নিভে গেছে। অগ্নিমন্দির ঠান্ডা হয়ে গেছে। তার চেয়েও আশ্চর্য ঘটনা হলো গতরাতে ক্বাবা কেঁপে উঠেছিল এবং তার ফলে কাবার ভেতরের মূর্তিগুলো মাটিতে পড়ে গেছে।” এমন সময় আরেক দূত এসে বললো: “বাদশাহ ! গতরাতে সভে শহরের হ্রদটি শুকিয়ে গেছে। ফলে যারা সভে হ্রদের পূজা করে, তারা বিস্মিত ও ভীত-বিহ্বল হয়ে পড়েছে। মনে হয় বড়ো ধরনের কোনো ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।” বাদশা আনুশিরভন স্বপ্ন ব্যাখ্যাকারী এবং পূর্বাভাসকারীদের ডেকে পাঠালেন। তাদের সবাই মক্কার আকাশে এক তারকার উদয়ের কথা বললেন। যেই তারকা বিশ্বব্যাপী পরিবর্তন ঘটাবে। এভাবেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর সর্বশেষ প্রেরিত দূতের জন্ম মুহূর্তে বিশ্বকে তাঁর বরকতপূর্ণ পদক্ষেপের জন্যে প্রস্তুত করলেন। ঐ রাতে মা আমেনার আশ্চর্যরকম এক অনুভূতি হয়েছিল। বেশ কয়েকমাস গত হয়ে গেল তাঁর স্বামী আব্দুল্লাহ মারা গেছেন, তিনি দিন-রাত স্বামীর মৃত্যু ভাবনায় ভারাক্রান্ত ছিলেন। এখন তাঁর সন্তানের জন্মলগ্ন এসে গেছে। সুবেহ সাদেকের সময় মা আমেনা যখন তীব্র বেদনা অনুভব করছিলেন তখন স্বগতোক্তি করছিলেন: “আব্দুল্লাহ যদি এই সময় জীবিত থাকতো! যদি তাঁকে একা রেখে না যেতো !” ঠিক এ সময় আল্লাহর মেহেরবাণীতে আমেনার ঘর আলোয় আলোকিত হয়ে গেল। তিনি যা দেখলেন, তা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তাঁর মনে হলো যেন আকাশের সব তাঁরা তাঁর ঘরে অবতরণ করেছে। তাঁর বিস্ময় না কাটতেই আলোকোজ্জ্বল কয়েকজন রমনী এসে তাঁর শিয়রে বসলেন। রমনীদের একজন বললেনঃ আমি আসিয়া! ফেরাউনের স্ত্রী! অন্যজন বললেন, আমি মারিয়াম, ইমরান (আ.)- এর কণ্যা। কিছুক্ষণ পর একটি পুত্র সন্তনের জন্ম হলো। শিশুটির আগমনের সাথে সাথে সারা পৃথিবী যেন আলোকিত হয়ে গেল। এই অবস্থায় আমেনা একটি আওয়াজ শুনতে পেলেনঃ “তোমার এই সন্তানের মাঝে বিগত নবীদের উন্নত বৈশিষ্ট্যগুলো একত্রীভূত হয়েছে। যেমন, তাঁর সত্ত্বায় রয়েছে নূহ (আ:)- এর বীরত্ব ও সাহস, রয়েছে ইব্রাহীম (আ:)- এর আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ নির্ভরতার বৈশিষ্ট্য, রয়েছে ইউসূফ (আ:) এর আকৃতি-প্রকৃতি। আরো আছে মূসা (আ:) এর যথার্থ বাকপটুত্ব ও অবিচল দৃঢ়তা এবং হযরত ঈসা (আ:)- এর পরহেজগারী এবং দয়া-দাক্ষিণ্য।”
ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, মুহাম্মাদ (সা.)- এর জন্মের পর থেকে তাঁর নবুয়্যতি লাভ করা পর্যন্ত একের পর এক ঘটনাবলীর ধারা বিদ্যমান ছিল।
আরবের প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী মরু ধাত্রীদের অনেকেই তাদের জীবিকার অন্বেষণে মক্কায় আসতো দুগ্ধপোষ্য বাচ্চাদেরকে নেওয়ার জন্যে। তারা দুগ্ধপোষ্য বাচ্চাদেরকে নিয়ে দাইমা হিসেবে দুধ খাওয়াতো। কিন্তু মুহাম্মাদ যেহেতু ইয়াতিম এবং গরীব ছিলেন, সেজন্যে তাঁকে মরু নারীদের কেউই গ্রহণ করতে চাইলো না। হালিমা নামের দুর্ভিক্ষ কবলিত এক মরু নারীর ভাষ্য ছিল এ রকম: “কোনো ধনী পরিবারের সন্তান আমার ভাগ্যে জুটলো না। মুহাম্মাদ নামের এক নবজাতক আমার ভাগ্যে জুটলো। তার মা কিংবা দাদা আমাদেরকে কোনো উপহার পর্যন্ত দিতে পারলো না। কিন্তু আমরা মক্কা থেকে খুব বেশী দূরে যেতে না যেতেই আশ্চর্যরকমভাবে উপলব্ধি করলাম, আমার শুষ্ক বুক দুধে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। এই পরিমাণ দুধ এলো, যাতে আমার নিজের সন্তান এবং মুহাম্মাদ উভয়েরই ক্ষুধা মেটে। যখন ঘরে পৌঁছলাম, আমার স্বামী ব্যাকুল হয়ে বললোঃ হালিমা দেখ! দুর্ভিক্ষ সত্ত্বেও আমাদের উষ্ট্রীগুলো কেমন দুগ্ধপূর্ণ হয়ে উঠেছে! সেই থেকেই আমরা বুঝতে পেরেছি, এই সন্তানটি কল্যাণ এবং বরকতপূর্ণ। এই সন্তান নিশ্চয়ই আমাদেরকে সুখী ও সৌভাগ্যশালী করে তুলবে।”
মুহাম্মাদ (সা.) পাঁচ বছর বনী সা’দ গোত্রে তাঁর শৈশবকাল কাটিয়েছেন। সেখানেই তিনি বেড়ে ওঠেন। এই সময়ে নবীজীর শিশুসুলভ আচার-ব্যবহার অন্যান্য শিশুদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা ও স্বতন্ত্র ছিল। একদিন শিশু মুহাম্মাদ হালিমার কাছে এসে অন্য একটি শিশুর সাথে মরুভূমিতে যাবার অনুমতি চাইলেন। হালিমা অনুমতি দিলেন ঠিকই, তবে বেশ উৎকণ্ঠিত হলেন। হালিমা মুহাম্মাদকে সাজিয়ে গুজিয়ে দিলেন। গলায় একটা হার পরিয়ে দিলেন। মুহাম্মাদ জিজ্ঞেস করলেন-এটা কী? হালিমা উত্তর দিলেনঃ “এটা তোমাকে হেফাজত করবে এবং তোমাকে বদ নজর থেকে মুক্ত রাখবে।” শিশু মুহাম্মাদ তখন তার ছোট্ট দুটি হাত দিয়ে মালাটা টেনে ছিঁড়ে ফেলে বললো, আমার এমন কেউ আছেন যিনি আমাকে রক্ষা করবেন। এই বলে মরুভূমির দিকে চলে গেল। কিন্তু হালিমার আর পলক পড়লো না। গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে ভাবলো, এই শিশু কী করে এরকম পন্ডিতের মতো কথা বলে! যাই হোক, এভাবে কিছুদিন মরুতে বসবাস করার পর শিশু মুহাম্মাদ মক্কায় ফিরে আসেন এবং মায়ের অতুলনীয় ভালোবাসা আর স্নেহ-প্রেমের উষ্ণ ছোঁয়ায় কাটাতে থাকেন। মাত্র ছয় বছর বয়সেই মুহাম্মাদ তাঁর মোহনীয় দৃষ্টি, চমৎকার চেহারা আর বিচক্ষণ কথাবার্তার জন্যে সবার কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন। একদিন মদীনার কোন এক আত্মীয়ের সাথে দেখা করার জন্যে মা আমেনা পুত্র মুহাম্মাদকে নিয়ে রওয়ানা দেন। কিন্তু ফেরার সময় মাঝপথে এসে মা আমেনা অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ইহলোক ত্যাগ করেন। তারপর থেকে আব্দুল মুত্তালিব শিশু মুহাম্মাদের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। আব্দুল মুত্তালিব এই শিশুর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অপেক্ষায় ছিলেন। সেজন্যে তার ব্যাপারে বেশ সতর্ক ছিলেন এবং যথাসাধ্য তার যত্ন নিতেন। মুহাম্মাদের প্রতি তাঁর স্নেহ দিনদিনই বৃদ্ধি পেতে লাগলো। কিন্তু আট বছর বয়সেই শিশু মুহাম্মাদ তার পৃষ্ঠপোষক দাদা আব্দুল মুত্তালিবকেও হারান।] চলবে…..🌺