নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) পর্ব-এক

905

নূরনবী মোস্তফা (সা.)

(১ম পর্ব)
[বিশ্বের বুকে বিদ্যমান অসাধারণ সকল সোন্দর্যকে তুলে ধরা অত্যন্ত কঠিন কাজ। তার চেয়েও কঠিন কাজ হলো এমন কোনো মহান ব্যক্তিত্বের জীবনচিত্র আঁকা, যাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছে বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী হিসেবে। যিনি এরকম কোনো ব্যক্তিত্বের জীবনচিত্র আঁকতে চান, তিনি আসলে অসীম সমুদ্রকে ছোট্ট একটি আয়নার মাঝেই প্রতীকায়িত করতে চান। আজ দীর্ঘরাত্রি বিদূরিত হবার পর প্রভাতের আগমনের ন্যায় ইতিহাস সৃষ্টিকারী বিস্ময়কর এমন এক মহান ব্যক্তিত্বের আলোচনা করা হবে, যিনি অসংখ্য মানুষকে তাঁর হেদায়েতের নৌকায় আরোহণ করিয়েছেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে হেদায়েতের ঐ নৌকা ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ তরঙ্গের মুখে বারবার পড়েছে, তারপরও আজ পর্যন্ত নৌকাটি কালের সাগরে ভাসমান রয়েছে, ডুবে যায় নি। আজো বিভিন্ন স্থানে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”-র পতাকা কোটি কোটি মানুষের মাঝে উড্ডিন আছে। আজো “মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)”-এর সম্মান ও মর্যাদা সুরক্ষিত এবং তাঁর হেদায়াত সমানভাবে প্রবাহমান।তোমার নুরে সূর্য পেলো আলোকের শোভা, আর বার্তাবাহক জিব্রাঈল হলো অপূর্ব দ্যুতিময়, কোরআন তোমাকে পরিয়েছে শ্রেষ্ঠ চরিত্রের মালা, খোদার কৃপায় সজ্জ্বিত হলে শ্রেষ্ঠ এ মহিমায়, ঐশীবাণী, ফেরেশ্তার গান, মুমিনের জিকির আর সকলই উৎসর্গীত মুহাম্মাদ ও তাঁর আলের জন্যে। “আল্লাহর শেষ দূত মুহাম্মাদের উপর নাযিল হয়েছিল মহাগ্রন্থ আল-কোরআন। অব্যাহতভাবে কোটি কোটি মানুষ এই কোরআন অধ্যয়ন করছে এবং মণি- মুক্তাময় মহাসমুদ্র আল-কোরআন থেকে উপকৃত হয়েছে। তবে যুগে যুগে ইসলামের শত্রুরা রাসূল (সা. )- এর সূর্যোদীপ্ত চেহারাকে ধূলো মলিন করে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করার চেষ্টা করেছে। ইসলাম যাতে বিকশিত হতে না পারে, সেটাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। তারপরও অপার রহস্যময় এই পৃথিবীতে এমন কোনো জ্ঞানী-গুণী নেই, যার কানে রাসূলের আহ্বান পৌঁছায়নি।
যুগে যুগে নবী রাসূলগণ এই পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছেন একটি মাত্র উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। তাহলো সত্য ও শান্তির দিকে মানুষকে আহ্বান জানানো। এই সত্যের আহ্বান জানাতে গিয়ে ভৌগোলিক সীমারেখার উর্ধ্বে উঠে নবী-রাসূলগণ এশিয়া-ইউরোপ-আফ্রিকা মহাদেশে দাওয়াতী কাজ চালিয়েছিলেন। যার ফলে এই মহাদেশগুলোর মাঝে সেতুবন্ধন তৈরি হয়েছিল। পঞ্চ পয়গম্বর- যাঁদেরকে একত্রে “উলুল আযম” বলা হয়, তাঁরা বিশ্বের কৌশলগত দ্বীপের কেন্দ্র যাকে বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য বলা হয়, সেখানে বিভিন্ন ভাষায় এক এবং অভিন্ন বার্তাই প্রচার করেছেন। তাঁদের মূল লক্ষ্যও ছিল অভিন্ন। তাহলো, এক আল্লাহর ইবাদাত করা এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীতে ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠা করা।
নূহ (আ.)- এর সময় ভয়াবহ প্লাবন হয়েছিল। তাঁর নৌকা জুদি পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গিয়েছিল। নূহ (আ.) এবং তাঁর কজন অনুসারী ঐ নৌকায় আরোহন করেছিলেন, যাতে তাঁদেরকে দিয়ে নতুন পৃথিবী গড়া যায় এবং ইতিহাস নতুনভাবে শুরু করা যায়। তাঁর পরে ইব্রাহীম (আ.) ব্যাবিলন ভূখন্ডে তৌহিদের সেই বাণীর প্রতিধ্বনি করেন। অত:পর মূসা (আ.) লাঠির মুজেযা দিয়ে তাঁর কওমকে ফেরাউনের কবল থেকে বাঁচান। এই ফেরাউন জনগণকে তার নিজের বান্দা বলে মনে করতো। মূসা (আ.)- এর পর ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেই আল্লাহর অপার করুনায় কথা বলেন এবং সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)- এর আগমনের সুসংবাদ দেন। শেষ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রের মধ্যে যখন অসংখ্য খোদার পূজা করার ঘটনা দেখা দিল এবং সর্বত্র অজ্ঞতার আঁধার ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মাদ (সা.) মক্কায় আবির্ভূত হন। তিনি অপূর্ব সত্যের সুস্পষ্ট বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছান। সেই সাথে মানব মর্যাদা, মানবাধিকার, স্বাধীনতা এবং ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠা করেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা তওবার ১২৮ নম্বর আয়াতে তাঁর সম্পর্কে বলেছেন: “তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়।”
মহৎ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ইসলামের নবী সবসময় মানব সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তিনি মানুষের মাঝে অসীম ক্ষমতাময় এক আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরে তাদেরকে শেরক, মূর্তি পূজা, যাদু-মন্ত্রসহ বিচিত্র কুসংস্কারের জিঞ্জির থেকে মুক্তি দিয়েছেন। তিনি মানব জীবনের অন্ধকার স্তরগুলোর মাঝে আলোকের জানালা খুলে দিয়ে শিখিয়েছেন যে, মানুষ যদি সত্য, জ্ঞান ও বাস্তবতার আলোকের পেছনে ছোটে, তাহলে অজ্ঞতা এবং অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতে পারে। তিনি সবসময়ই বিরোধী পক্ষের সামনে যুক্তি তুলে ধরতেন এবং আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী তাদেরকে তাদের দলীল-প্রমাণ দেখাতে বলতেন। যেমনটি কোরআনে বলা হয়েছে: “বল ! তোমাদের প্রমাণ নিয়ে আসো!” আধুনিক বিশ্বের নতুন নতুন ভূখন্ডে ইসলাম বিস্তারের কারণে ভীত হয়ে কোনো কোনো স্বার্থবাদী মহল ইসলামের এই মহান নবী সর্বশেষ রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সা.)- এর নিষ্কলুষ চরিত্রের ওপর কলঙ্ক লেপনের অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। ২০০৬ সাল থেকে কলঙ্ক লেপনের এই ধারা নবরূপ ধারণ করেছে। কিছু পশ্চিমা গণমাধ্যম তাদের সরকারগুলোর সহযোগিতায় সম্পূর্ণ পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মহানবী এবং ইসলাম বিকৃতির চেষ্টা চালিয়েছে। তাদের এইসব বিকৃতি ও অপপ্রচারের কারণে মুদ্রার একপিঠে যদিও মুসলমানরা হিংস্র এবং চরমপন্থী বলে পরিচিত হয়েছে, অপরপিঠে কিন্তু ইসলাম এবং নবীজী সম্পর্কে জানতে জনমনে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। ইংরেজী ভাষী একজন অমুসলিম গবেষক মিসেস কার্ন আর্মস্ট্রং তাঁদেরই একজন। তিনি নবীজীর বিরুদ্ধে অপবাদ আর অভিযোগের মাত্রা বৃদ্ধির ফলে বিশেষ করে সালমান রুশদীর অপবাদের কারণে মুহাম্মাদ নামক গ্রন্থটি লেখেন। এই গ্রন্থটি লেখার কারণ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “প্রকৃত ইসলামকে তুলে ধরা এবং ইসলামের নবীর ব্যাপারে পাশ্চাত্য খ্রিষ্টানদের স্মৃতিশক্তিকে জাগিয়ে তোলাই ছিল এই গ্রন্থ রচনার মূল উদ্দেশ্য।” তিনি লিখেছেন, “পশ্চিমাদের উচিৎ রঙীন এই পৃথিবীর গোলকধাঁধায় সত্য ও সঠিক পথে পরিচালিত হবার জন্যে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)- এর শিক্ষা গ্রহণ করা।”
২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে আমেরিকার বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রে হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইসলাম ও মহানবীর শানে আঘাত হানার ঘটনা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে মিসেস আর্মস্ট্রং তাঁর পূর্বলিখিত মুহাম্মাদ বইটির ভূমিকা পুনরায় লেখেন। নতুন করে লেখা ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, “বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রে হামলার মতো সহিংস ঘটনা ইসলাম এবং মুহাম্মাদের আত্মা ও স্বভাব চরিত্রের সম্পূর্ণ বিরোধী।” তাঁর ভাষায় ইসলাম শব্দটির অর্থ হচ্ছে আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পিত ও অনুগত। শব্দটি সালাম অর্থাৎ শান্তি থেকে এসেছে। রাসূলের বাস্তব জীবন পদ্ধতিও এই নীতির উপরেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। রাসূলের যুগে রক্তপাত, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ পরায়নতার মতো জাহেলী যুগের বদ অভ্যাসগুলো সমূলে অপসারিত হয়ে গিয়েছিল। যে কোনো পরিস্থিতি বা ঘটনাকে তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বিশ্লেষণ করতেন এবং তাঁর সমকালীন অন্যান্য ব্যক্তিদের তুলনায় অনেক বেশী উন্নত ও যুক্তিপূর্ণ সমাধান দিতেন। মিসেস আর্মস্ট্রং বলেন: “হযরত মুহাম্মাদ (সা.)- এর সমগ্র জীবন প্রমাণ করে যে, সবকিছুর আগে আমাদের উচিত আমাদের মাঝ থেকে স্বার্থপরতা, ঘৃণা, অন্যদের চিন্তা ও বিশ্বাসকে উপেক্ষা করার প্রবণতাগুলো দূর করা। আর তা সম্ভব হলে আমরা বিশ্ববাসীর জন্যে একটি সুন্দর, দৃঢ় ও নিরাপদ পৃথিবী গড়তে সক্ষম হবো। যেই পৃথিবীতে মানুষ সুখে শান্তিতে বসবাস করবে। যেখানে থাকবে না কোনো জুলুম-নির্যাতন কিংবা কোনোরকম বৈষম্য।”
বিশ্ববাসীর পক্ষে আজ তাঁকে চেনার ও বোঝার সময় এসে গেছে। তাঁর শিক্ষাকে কাজে লাগানো আজ বিশ্ববাসীর জন্যে খুবই প্রয়োজন। আল্লাহ আমাদেরকে এই শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিত্বের জীবনাদর্শ থেকে উপকৃত হবার তৌফিক দান করুন।📚🌹🌷

Related Post

জাশনে জুলুস উদযাপনের ইতিহাস

Posted by - অক্টোবর ৪, ২০২২
মহানবী(সা.)-এর এ পৃথিবীতে আগমনে ফেরেশতাকুল, বৃক্ষরাজি, পশুপাখিসহ এ সৃষ্টি জগতের সকল বস্তু আনন্দে আন্দোলিত হয়েছিল। আকাশে উল্কারাজি নিক্ষিপ্ত করে শয়তান…

দুই ঈদ ব্যতীত আর কোন ঈদ নেই” বলে ভ্রান্ত মতবাদের শরিয়াহ্ জবাব

Posted by - অক্টোবর ৪, ২০২২
✍️ “দুই ঈদ ব্যতীত আর কোন ঈদ নেই” বলে ওহাবীদের ভ্রান্ত মতবাদের শরিয়াহ্ জবাব। 👇 🌷[ঈদে মীলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি…

নূরনবী হযরত মোস্তফা (সা.) পর্ব-পনের

Posted by - নভেম্বর ১৯, ২০২০
নূরনবী মোস্তফা (সা.) [ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে আপনারা যারা খোঁজ-খবর রাখেন তারা নিশ্চয়ই জানেন যে, সপ্তম হিজরীতে কুরাইশ প্রতিনিধিবৃন্দ এবং রাসূলে…

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) মুসলিম বিশ্বের ধর্মীয় ও সংস্কৃতিক ঐতিহ্য

Posted by - অক্টোবর ৩, ২০২২
মাহে রবিউল আওয়াল প্রত্যেক মুমিনের কাছে অত্যন্ত প্রিয় একটি মাস। কারণ, এ মাসে ধরাধামে আগমন করেছেন আমাদের প্রাণের চেয়ে প্রিয়…

নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) পর্ব-তিন

Posted by - নভেম্বর ৪, ২০২০
নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) (৩য় পর্ব) হযরত মুহাম্মাদ(সা.) তরুণ বয়সে পৌঁছুলেন। তাঁর বিশেষ যেসব বৈশিষ্ট্য ছিল, সে সবের জন্যে তিনি তাঁর…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »