নবী (সাঃ) কর্তৃক হযরত আলীর মনোনয়ন

1644

নবী পাক (সা.) এর নবুয়্যত লাভের তিন বৎসর পর নিম্ন আয়াতটি অবতির্ণ হয়ঃ

وَأَنذِرْ‌ عَشِيرَ‌تَكَ الْأَقْرَ‌بِينَ

অর্থাৎঃ “(হে নবী) তোমার নিকটতম আত্মীয়-স্বজনকে (দোযখের আযাবের প্রতি) ভয় প্রদর্শন কর।”৪৭

প্রায় সকল তাফসীরকারক ও ঐতিহাসিকদের মতে মহানবী (সা.) তখন বনি হাশেম গোত্রের ৪৫জন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে দুপুরের আহারের নিমন্ত্রণ দেন । আপ্যায়ন শেষে তিনি মেহমানদের মুখোমুখী দাড়িয়ে মহান আল্লাহর প্রশংসার মধ্য দিয়ে তিনি তার বক্তব্য শুরু করেন । তিনি সুস্পষ্টভাবে তার রেসালাতের সুমহান বার্তা সকলের সামনে ব্যক্ত করেন ।

তিনি বলেনঃ

ان الرائد لا یکذب اهله و الله لا اله الا هو انی رسول الله الیکم خاصة و الی الناس عامة و الله لتموتن کما تنامون و لتبعثن کما تستیقظون و لتحاسبن بما تعملون و انها الجنه ابدا و النار ابدا

অর্থাৎঃ এটা অতি সত্যি কথা যে কোন এক জনগোষ্ঠির পথ প্রদর্শক তার লোকজনদের নিকট মিথ্যা বলতে পারেনা । আল্লাহর শপথ তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই, আমি বিশেষভাবে তোমাদের জন্যে আর সাধারণভাবে সবার জন্য রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি । আল্লাহর শপথ তোমরা নিদ্রার ন্যায় মৃত্যুমুখে ঢলে পড়বে এবং জাগ্রত ব্যক্তিদের ন্যায় পুনরুত্থিত হবে একদিন । তোমরা তোমাদের কর্মের ফলাফল ভোগ করবে সেদিন । নিশ্চয় জান্নাত চিরস্থায়ী আবাসস্থল (সৎ লোকদের জন্যে) আর জাহান্নামের অগ্নি হবে চিরস্থায়ী আবাস (অসৎ লোকদের জন্যে)।৪৮

অতঃপর তিনি বলেনঃ হে লোকসকল আমার মত উত্তম জিনিষ তোমাদের জন্যে অন্য কেউ আনেনি । আমি তোমাদের জন্যে ইহকাল ও পরকালের মঙ্গল নিয়ে আগমন করেছি । আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন তোমাদেরকে সেই মঙ্গল কাজের দিকে আহবান জানাতে ।

অবশেষে তিনি বলেনঃ

فایکم یوازرنی علی هذا الامر علی ان یکون اخی و وصی  وخلیفتی فیکم

অর্থাৎঃ “তোমাদের মধ্য থেকে আমার সাহায্যকারী হবার মত এমন কে আছো ? যার ফলে সে আমার ভ্রাতা, উত্তরাধীকারী ও খলিফা হিসাবে পরিগনিত হবে?”

যখন মহানবীর বক্তব্য এখানে এসে সমাপ্তি ঘটে তখন সমাবেশে নিঃশব্দ বিরাজ করছিলো । কেউ টু শব্দটুকু করেনি । ইত্যবসরে একজন যুবক হাত উচু করে নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে দ্ব্যার্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করলো “তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন শেরে খোদা হযরত আলী (আ.)। রাসূল (সা.) তাকে বসতে বললেন । আবারো তিনি পূর্ব প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তি করেন । কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া গেলনা । আলী ছাড়া কারো কাছ থেকে । পুনরায় তিনি আলীকে বসতে বললেন । এভাবে তিন বার তিনি পুনরাবৃত্তি করেন এবং প্রতিবার আলীই হাত উচু করে তাকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন ।

এ পর্যায়ে রাসূল (সা.) তার ঐতিহাসিক ঘোষণা প্রদান করেন । তিনি বলেনঃ

ان هذا اخی وصی و خلیفتی علیکم فاسمعوا له اطیعوا

অর্থাৎঃ “নিশ্চয় এই যুবক (আলী) আমার ভাই, আমার উত্তরাধীকারী এবং তোমাদের মাঝে আমার খলিফা । তোমরা সকলে তার কথা শ্রবণ করো এবং তার আনুগত্য করো।”৪৯

পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে যে নবী (সা.) এর দাওয়াত তার নবুয়্যত লাভের তিন বৎসর পর সংঘটিত হয়েছির । তার দাওয়াতী মিশনের প্রথম ভাগেই এ ঘটনাটি সংঘটিত হয় । তখনও তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে তৌহীদ ও নবুয়্যতের দাওয়াতই দিয়ে যাচ্ছিলেন ।

আল-কোরআনের ভাষায়ঃ

قولوا لا اله الا الله تفلحوا

অর্থাৎঃ তোমরা বল আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই তাতেই তোমরা সফলকাম হবে । এবং

ان محمدا رسول الله

মোহাম্মদ আল্লাহর রাসূল ।

তবে এ ঐতিহাসিক দাওয়াতের ব্যবস্থাপনা, প্রিয় নবীর বক্তৃতা ও তৌহীদ-নবুয়্যতের ঘোষণার পাশাপাশি দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে হযরত আলী ইবনে আবি তালিবের খেলাফতের ঘোষণা খেকে এটাই উপলদ্ধি করতে পারি যে, মহানবীর দাওয়াতের সূচনা পূর্বেই তিনি তার পরবর্তী খলিফা ও উত্তরাধীকারী নিযুক্তিতে ত্রুটি করেন নি । এটা এমন একটি বিষয় যা তৌহীদ ও নবুয়্যত থেকে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় । তৌহীদ ও নবুয়্যতের স্থায়িত্বের জন্যে ইমামতের ঘোষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধায় সেদিন মহানবী (সা.) সবার সম্মুখে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছিলেন পরবর্তী নেতার মনোনয়নের বিষয়টি । এ দু’টি পদ তথা নবুয়্যত ও খেলাফত, মর্যাদার ক্ষেত্রে একটি বৃক্ষের দু’টি শাখার ন্যায় । রেসালাত দ্বীন ইসলামের প্রবর্তক এবং ইমামত বা খেলাফত সেই প্রবর্তীত দ্বীনের সংরক্ষক । সকল হাদীসবেত্তা ও ঐতিহাসিক তাদের স্ব-স্ব গ্রন্থে নিম্নোক্ত ঘটনাটি লিপিবদ্ধ করেছেন ।

মুহাম্মদ (সা.) তাবুকের যুদ্ধে যাবার প্রাক্কালে লোকজন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্যে তাকে সংঙ্গ দিয়েছিল । এ যুদ্ধে তিনি হযরত আলী ইবনে আবি তালিবকে মদীনার গভর্নর করে তার উপর দায়িত্বভার অর্পন করে যান । মদিনার আভ্যন্তরীন অবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে তিনি এ ব্যবস্থা নিয়ে ছিলেন। কিন্তু আলী জেহাদের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আবেদন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আমি কি যুদ্ধে যেতে পারবো না? নবী (সা.) উত্তরে বললেন, না । তৎক্ষণাৎ আলী ক্রন্দন শুরু করে দিলেন । তখন নবী (সা.) হযরত আলী ইবনে আবি তালিবকে উদ্দেশ্য করে বলেনঃ

انت منی بمنزلة هارون من موسی الا لا نبی بعدی

অর্থাৎঃ “(হে আলী) তুমি আমার কাছে সে স্থানে অবস্থান করছো যে স্থানে হারুন মুসার কাছে ছিলো । তবে পার্থক্য হলো আমার পরে আর কোন নবী আগমন করবে না।”৫০

মহানবী (সা.) এর উপরোক্ত উক্তি থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, নবুয়্যত ব্যতীত হযরত হারুনের সকল পদমর্যাদাই হযরত আলীর জন্যে সংরক্ষিত। আল-কোরআন উল্লেখ করছে, মুসা (আ.) আল্লাহর কাছে মুনাজাত করে বলেছিলেনঃ

اجعل لی وزیا من اهلی هارون اخی اشدد به ازری و اشرکه فی امری

অর্থাৎঃ  “(হে আল্লাহ) তুমি আমার জন্যে আমার বংশ থেকে আমার ভাই হারুনকে আমার পরামর্শদাতা ও সাহায্যকারী হিসাবে নিয়োগ করো । তার মাধ্যমে আমার কোমর শক্তিশালী করে দাও এবং তাকে আমার কাজ কর্মে অংশীদার কর।”৫১

Related Post

ইসলামী মাযহাব ও তার বৈশিষ্ট্য

Posted by - জুন ১, ২০২০
ইত্যপূর্বেকার আলোচনা থেকে এটা দিব্যলোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, নবী (সা.) কর্তৃক মনোনীত খলিফা ব্যতীত মানুষের নির্বাচিত খলিফাদের অনুসরণ…

মানব জীবনে নেতার গুরুত্ব

Posted by - নভেম্বর ২৫, ২০১৯
পবিত্র আল কোরআনে আল্লাহ বলেন, يَوْمَ نَدْعُو كُلَّ أُنَاسٍ بِإِمَامِهِمْ অর্থাৎঃ-“ক্বিয়ামতের দিবসে প্রত্যেক জনগোষ্ঠিকে তাদের ইমামদের সাথে ডাকা হবে ।”১…

খলিফা নির্বাচনের পদ্ধতি

Posted by - নভেম্বর ২৫, ২০১৯
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর পরলোকগমণের পর সাহাবীগণ কর্তৃক প্রথম খলিফা হিসাবে হযরত আবু বকরের নিয়োগ এবং তার পক্ষে…

আহলে বাইত

Posted by - জুন ২, ২০২০
নবী করিম (সা.)-এর আহলে বাইতকে ভালবাসার ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই । তবে আহলে বাইত কারা– এ ব্যাপারে যথেষ্ট…

হযরত আবু বকরের খেলাফত লাভ ও খেলাফতের প্রতি মা ফাতিমার অস্বীকৃতি

Posted by - নভেম্বর ২৯, ২০১৯
হযরত আবু বকরের খেলাফত লাভ: কথিত যে, নবী করিম (সা.) হযরত আবুকবরকে খেলাফত দিয়ে গেছেন । তিনি হযরত আবুবকরকে নামাজের…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »