গত প্রায় ৭০ বছর ধরে ইহুদিবাদী ইসরাইল ফিলিস্তিন ভূখণ্ড জবর দখল করে আছে। ফিলিস্তিন জবর দখলের এতো বছর পরও ইসরাইল বর্বর নির্যাতনের ধারা অব্যাহত রেখেছে। ইহুদিবাদী ইসরাইলের এই ন্যক্কারজনক আগ্রাসনের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমা শক্তিগুলো।
তা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনের মজলুম জনতা তাদের দেশের ভূখণ্ডকে স্বাধীন করার তথা ইহুদিবাদী দখলমুক্ত করার দৃঢ় ইচ্ছা বাস্তবায়নে বিন্দুমাত্রও হাল ছাড়ে নি। বরং ফিলিস্তিনিদের মনোবল ও সংগ্রাম আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেগবান হয়েছে। ইরানের জনগণ সেই বিপ্লব বিজয়ের আগে থেকেই ফিলিস্তিনের মজলুম জনগোষ্ঠীকে সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছে। কিন্তু ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের মাধ্যমে ইসলামী সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। ইরানের ইসলামী বিপ্লব বিজয় ছিল ইহুদিবাদী ইসরাইলের জন্য চপেটাঘাত। কেননা ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেনী (রহ) কেবল ইরানের জনগণকেই নয় বরং বিশ্বের সকল মুসলমান ও স্বাধীনচেতা মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন ফিলিস্তিনদের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য। ইমামের ওই ডাকে সাড়া দিয়ে প্রতি বছর রমজানের শেষ শুক্রবার বিশ্ব কুদস দিবস পালিত হয়।
ইরানে ইসলামী বিপ্লবের রূপকার মরহুম ইমাম খোমেনী (রহ) ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যের বুকে বিষাক্ত টিউমার বা ক্যান্সার বলে অভিহিত করেছেন। ফিলিস্তিনের সংগ্রামী জনগণের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা এবং তাদের অধিকারের প্রতি সাহায্য-সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার জন্যে রমযানের শেষ শুক্রবারে নানা কর্মসূচি, অনুষ্ঠান ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের প্রতি পরিপূর্ণ সমর্থন ঘোষণার আহ্বান জানান। বিশ্ববাসী বিশেষ করে মুসলিম বিশ্ব তাঁর এই আহ্বানে ব্যাপক সাড়া দেয় এবং এই দিনকে কুদস দিবস হিসেবে পালন করতে থাকে। এই দিনে বিশ্বজুড়ে জনগণের এই ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি ফিলিস্তিনিদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে জাগ্রত রাখা এবং ইহুদিবাদী ইসরাইলের প্রতি বিশ্ব মুসলমানের ঘৃণা প্রকাশের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।
এ বছর এমন সময় বিশ্ব কুদস দিবস পালিত হতে যাচ্ছে যখন মার্কিন নতুন ষড়যন্ত্রের কারণে ফিলিস্তিন সংকট অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে তীব্র আকার ধারণ করেছে। আন্তর্জাতিক সমাজের ব্যাপক প্রতিবাদ সত্বেও তেলআবিব থেকে বায়তুল মোকাদ্দাসে দূতাবাস স্থানান্তর করে আমেরিকা। আমেরিকার এ পদক্ষেপ দখলদার ইসরাইলের সম্প্রসারণকামীতাকে পূর্ণতা দিয়েছে যা কিনা মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা বিশ্বের জন্য অত্যন্ত বিপদজনক পরিণতি ডেকে আনবে। বায়তুল মোকাদ্দাসে দূতাবাস স্থানান্তরের মাধ্যমে আমেরিকা ফিলিস্তিনিদেরকে এ বার্তাই পৌঁছে দিয়েছে যে, ইসরাইলের স্থিতিশীলতা ও দখলদারিত্বের প্রতি ওয়াশিংটনের সমর্থন রয়েছে। আল আকসা মসজিদ ইসলাম ও ফিলিস্তিনিদের আসল পরিচিতি। এটি মুসলমানদের প্রথম কেবলা হওয়ার কারণে শুধু ফিলিস্তিন নয় বরং সারা বিশ্বের মুসলমানদের কাছে এর ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। মুসলমানদের সবচেয়ে তিনটি পবিত্র স্থানের মধ্যে বায়তুল মোকাদ্দাস হচ্ছে অন্যতম। অথচ আমেরিকা দূতাবাস স্থানান্তরের মাধ্যমে শুধু যে মুসলমানদের অবমাননা করেছে তাই নয় একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক রীতি ও জাতিসংঘের ২৩৩৪ ও ৪৭৮ নম্বর প্রস্তাবও লঙ্ঘন করেছে।
দূতাবাস স্থানান্তরের মাধ্যমে আমেরিকা দু’টি লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করছে। প্রথমত, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে বৃহৎ মধ্যপ্রাচ্য গঠনের যে পরিকল্পনা রয়েছে সেটা বাস্তবায়ন করা। আর দ্বিতীয় লক্ষ্য হচ্ছে, লেবানন ও ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগ্রামীদেরকে নির্মূল করা যাতে দখলদার ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
বর্তমানে আমেরিকার পূর্ণ সমর্থন নিয়ে দখলদার ইসরাইল পূর্ব বায়তুল মোকাদ্দাসের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। ইসরাইল গাজার নারী, পুরুষ ও শিশুদের ওপর যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে তা তারা গত সাত দশক ধরে চালিয়ে আসছে। অথচ জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী আগ্রাসীদের মোকাবেলায় অস্ত্র ধারণা করার অধিকার ফিলিস্তিনিদের রয়েছে।
আমেরিকা তেলআবিব থেকে বায়তুল মোকাদ্দাসে দূতাবাস স্থানান্তর করায় এর প্রতিবাদে গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। ইসরাইলি সেনাদের হামলায় প্রথম দিনেই ৬০ জন ফিলিস্তিনি শহীদ হন। প্রকৃতপক্ষে, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলি অপরাধযজ্ঞের প্রধান শরীক হচ্ছে আমেরিকা। এ কারণে ফিলিস্তিনের স্বশাসন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস গাজা উপত্যকায় ইহুদিবাদী ইসরাইলের গণহত্যার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, “ফিলিস্তিনি জনগণ আর তাদের সংকট সমাধানের জন্য আমেরিকাকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মেনে নেবে না।” তিনি বলেন, “এই অপরাধযজ্ঞের ঘটনায় ‘ফিলিস্তিন শান্তি প্রক্রিয়ায়’ আমেরিকার মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা কার্যত শেষ হয়ে গেছে।” তবে সব ধরনের আন্তর্জাতিক চাপ ও অন্যায় আচরণ সত্ত্বেও ফিলিস্তিনিরা তাদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ চালিয়ে যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম ইমাম খোমেনি দখলদার ইসরাইলের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র ও মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভালোভাবেই অবহিত ছিলেন। বিশ্ব কুদস দিবস পালন সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “কুদস দিবস কেবল ফিলিস্তিনিদের দিবস নয়। এটি এমন একটি দিবস যে, বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোকে এটা বুঝিয়ে দেয়া, তারা আর কোনো মুসলিম ভূখণ্ডকে এভাবে গ্রাস করতে পারবে না।” ইমাম খোমেনি(র.) আরো বলেছিলেন, “বিশ্ব কুদস দিবস পালনের মাধ্যমে আমরা বলদর্পী শক্তিগুলোকে এমন একটি হুঁশিয়ারি সংকেত দিতে চাই যে তারা মুসলমানদের ওপর আর আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে না এবং কুদস দিবস বিশ্ব মুসলমানদের প্রেরণা ও বেঁচে থাকার দিবস।”
ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, “ফিলিস্তিনিদের রক্ষা করা সব মুসলমানের দায়িত্ব।”
ইহুদিবাদী ইসরাইলের নির্যাতনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে যে, আলোচনার মাধ্যমে তাদেরকে কখনোই দমানো যায় নি বরং কুদস দিবস পালন কিংবা মুসলিম দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ চাপের মাধ্যমে তাদেরকে কিছুটা দমানো সম্ভব হয়েছে। এবারের বিশ্ব কুদস দিবস ইসরাইল ও তাদের মিত্রদের জন্য এ বার্তাই পৌঁছে দেবে যে, ফিলিস্তিনের ওপর দখলদারিত্ব ও জুলুম নির্যাতনের দিন শেষ হয়ে এসেছে। সারা বিশ্বের মুসলমানদের উচিত মুসলমানদের প্রথম কেবলা আল আকসা উদ্ধারে বিশ্ব কুদস দিবসে শরীক হওয়া যাতে ইসরাইলের দখল থেকে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড উদ্ধারকে আরো তরান্বিত করা যায়।#
পার্সটুডে