মৃত মুমিন মুসলমানের জন্যে যে কোন দিন কোন ভাল ও নেক কাজ করে সাওয়াব পাঠানো অত্যন্ত কল্যানকর ও আমাদের জন্যে সাওয়াবের কাজ। বিশেষ করে তার মৃত্যুর পর তৃতীয় দিনে, চল্লিশতম দিনে সাওয়াব রেসানীমূলক যে কোন আয়োজন হাদিস অনুযায়ী উত্তম ও সাওয়াবের কাজ। এর মধ্যে কোরআন তিলাওয়াত, ফকির-মিসকিন খাওয়ানো, দোয়ার মজলিস করে মুমিনদের দিয়ে দোয়া করানো এবং মুমিনদের আপ্যায়ন করানো অন্যতম। জীবিত মানুষদের পক্ষ থেকে মৃত ব্যক্তির কাছে সাওয়াব পৌছলে তার আযাব লাঘব হয় এবং সে খুশী হয়। তবে চল্লিশতম দিনে এই সাওয়াব রেসানীর আয়োজন করতে না পারলে সে বিশেষ সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হলো মাত্র। অন্য যে কোন দিনে এ আয়োজন করলেও কোন ক্ষতি নেই।
তাই, যে কোন মুসলমান মৃত মানুষের চল্লিশা করা ভাল কাজ। তবে শরীয়তের দৃষ্টিতে এটি ফরজ বলে গণ্য নয়।
আল্লাহ তায়ালা ক্বোরআনুল কারিমে উল্লেখ করছেনঃ
«یُنَبَّؤُا الْإِنْسانُ یَوْمَئِذٍ بِما قَدَّمَ وَ أَخَّرَ»؛
সরা আল্ ক্বিয়ামাহ্, সূরা নং ৭৫, আয়াত নং ১৩।
অর্থঃ “সেদিন মানুষকে অবহিত করা হবে যে, সে কি অগ্রে পাঠিয়েছে এবং কি পশ্চাতে পাঠিয়েছে।”
এ আয়াতে “আখ্-খারা” শব্দ থেকে একজন মানুষের মৃত্যুর পর তার জীবিত ওয়ারিস, আত্মীয়-স্বজন ও ভক্তবৃন্দের পক্ষ থেকে যে সকল ভাল কাজের সাওয়াব পাঠানো হয়, আল্লাহ তায়ালা তা বুঝিয়েছেন বলে বিভিন্ন তফসীরকারক ব্যক্ত করেছেন। অথবা সেই মৃত ব্যক্তি ভাল ও মন্দ এমন কিছু কাজ ও প্রতিষ্ঠান ছেড়ে গেছে যার কারণে তার কাছে ভাল অথবা মন্দ আমলের সাওয়াব অথবা গুনাহ তার মৃত্যুর পর পৌছে থাকে।
আল্লাহ তায়ালা ক্বোরআনুল কারিমের অনত্র উল্লেখ করছেনঃ
«رَبَّنَا اغْفِرْ لی وَ لِوالِدَیَّ وَ لِلْمُؤْمِنینَ یَوْمَ یَقُومُ الْحِساب»
সূরা ইব্রাহিম, সূরা নং ১৪, আয়াত নং ৪১।
অর্থঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে ও সকল মুমিনকে হিসাব-নিকাশের দিনে ক্ষমা করো।”
একজন মানুষ এ দুনিয়াতে যে সকল ভাল অথবা মন্দ কাজ ও রেওয়াজ স্মৃতি হিসেবে ছেড়ে যায় এবং অন্য মানুষেরা তার রেখে যাওয়া কর্ম, চিন্তা ও প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির উপর আমল করার কারনে মানুষেরা যে সাওয়াব অথবা গুনাহ হস্তগত করে তার সাওয়াব অথবা গুনাহ সেই প্রতিষ্ঠাতা ও স্থপতির জন্যেও বরাদ্ধ হয়ে থাকে।
আল্লাহ তায়ালা ক্বোরআনুল কারিমে আরো বলেনঃ
«وَ الَّذینَ جاؤُ مِنْ بَعْدِهِمْ یَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنا وَ لِإِخْوانِنَا الَّذینَ سَبَقُونا بِالْإیمانِ»
সূরা আল হাশ্-র, সূরা নং ৫৯. আয়াত নং ১০।
অর্থঃ “যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলেঃ হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এবং ঈমানে অগ্রগামী আমাদের ভাইদেরকে ক্ষমা করো।”
আগামী প্রজন্ম, গত হয়ে যাওয়া মানুষদের জন্যে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করবে এবং তিনি মুমিনদের দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা কবুল করবেন।
হযরত রাসূল(সা.) বলেছেন,
“এ দুনিয়া থেকে মুমিনদের প্রস্থান ঐ শিশুর ন্যায়, যে মায়ের পেট থেকে ভুমিষ্ট হয়। সে অন্ধকার, সংকীর্ণ ও চাপের অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে আলো ও বিস্তীর্ণ জগতে প্রবেশ করে।”
নাহজুল ফাসাহা, আবুল ক্বাশেম পইয়ান্দেহ, হাদিস নং ২৬৪৫।
ইমাম আলী সালাওয়াতুল্লাহি ওয় সালামুহু আলাইহি বলেছেন,
“হে জনগণ! আমরা ও তোমরা টিকে থাকার জন্যে সৃষ্টি হয়েছি, ধ্বংস হবার জন্যে নয়। তোমরা মৃত্যুর মাধ্যমে দুনিয়া থেকে প্রস্থান করো না, বরং এক বাড়ী থেকে অন্য বাড়ীতে স্থানান্তরিত হও মাত্র। সুতরাং যে গৃহের দিকে ধাবিত হবে এবং চিরস্থায়ী অবস্থান গ্রহণ করবে সেই গৃহের জন্যে পাথেয় যোগাড় করো।”
শেইখ মুফিদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি, আল ইরশাদ (ফারসী অনুবাদ), অনুবাদকঃ মুহাম্মাদ বাক্বির সাইদী খোরাসানী, পৃঃ নং ২২৯।
ইমাম হুসাইন সালাওয়াতুল্লাহি ওয় সালামুহু আলাইহি –এর কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, “মৃত্যু কী?” তিঁনি উত্তরে বলেছিলেন, “মৃত একজন মুমিনের জন্যে তার সামনে আগত সর্বোত্তম আনন্দ। মৃত্যু এমন এক সেতু যা তোমাদেরকে এ দুনিয়ার নানাবিধ যন্ত্রনাদায়ক সমস্যা থেকে আরাম-আয়েশ ও আল্লাহর অনুগ্রহের দিকে পৌছিয়ে দেয়। যেমনি করে আল্লাহর শত্রুদের জন্যে প্রাসাদ থেকে কারাগারে স্থানান্তর করা হয়।”
ফাইজ কশনী, মোল্লা মুহাম্মাদ মুহসিন, মাহাজ্জাতুল বাইদ্বা, খণ্ড ৮, পৃঃ নং ২৫৫।
সুতরাং আল্লাহর কালাম ও রাসূল ও তার আহলে বাইতের ইমামদের হাদিস সাক্ষ্য দেয় যে, মৃত্যু ও দেহ পচনের কারণে রুহের কোন ক্ষতি হয় না। বরং রুহ পূর্বের ন্যায় অবশিষ্ট থাকবে এবং তার নিজের জন্যে স্বাধীনতা ও মূল অস্তিত্ব বজায় রাখবে। কেননা, আমাদের অস্তিত্ব ও ব্যক্তিত্ব আমাদের আত্মা ও রুহের কারণে বিরাজমান। আমাদের এই পার্থিব দেহের কারণে নয়। মৃত্যু শেষ, ধ্বংস ও ফানা নয়। বরং এক জগত থেকে অপর জগতে স্থানান্তরের নাম। আর এভাবেই মানুষের জীবন অব্যাহতভাবে চলতে থাকবে। একজন মানুষের মৃত্যুর পর তার আশেপাশের লোকজন ও মুমিনদের উপর কিছু কাজ ফরজ হয়ে যায়। যেমনঃ মৃতের লাশ গোসল দেয়া, কাফন পড়ানো, জানাযার নামাজ ও দাফন করা ইত্যাদি। তাছাড়াও যে সব ফরজ কাজ মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে ক্বাজা রয়ে গেছে তা আদায় করে দেয়া তাদের উপর ফরজ। কিন্তু কিছু কর্তব্য আছে যা ঐচ্ছিক বা মুস্তাহাব। তন্মোধ্যে সদকা দেয়া, দোয়া করা ও কোরআনখানি করা অন্যতম।
হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামঃ
“তোমাদের মৃতদের স্মরণ করো, যারা কবরে শায়িত আছেন। তোমাদের মৃতরা তোমাদের দয়ার প্রতি আশা করে আছে। তোমাদের মৃতরা বন্দি আছেন এবং তারা তোমাদের ভাল ও নেক কাজের মুখোপেক্ষী। তারা কোন কাজ করার শক্তি রাখে না। তোমরা সদকা ও দোয়া তাদের জন্যে হাদিয়া হিসেবে প্রেরণ করো।”
ইয়াযদী, শেইখ হাসান ইবনে আলী, আনওয়ারুল হিদায়াহ, পৃঃ নং ১১৫।
হযরত ইমাম জাফার ইবনে মুহাম্মাদ আস্ সাদিক্ব সালাওয়াতুল্লাহি ওয় সালামুহু আলাইহি বলছেন, “একজন মৃত ব্যক্তির জন্যে আল্লাহর কাছ থেকে রহমত ও ক্ষমা প্রার্থনার কারণে সে খুশী হয়ে থাকে। যেমনি করে একজন জীবত ব্যক্তিকে উপহার দিলে সে খুশী হয়।”
ফাইজ কশনী, মোল্লা মুহাম্মাদ মুহসিন, মাহাজ্জাতুল বাইদ্বা, খণ্ড ৮, পৃঃ নং ২৯২।
হযরত ইমাম আলী ইবনে মুসা আর রিদ্বা সালাওয়াতুল্লাহি ওয় সালামুহু আলাইহি বলছেন, “যে ব্যক্তি কোন মুমিনের কবর যিয়ারত করে এবং তার কবরের পাশে সাতবার সূরা আল ক্বাদ্-র তিলাওয়াত করে, আল্লাহ তায়ালা ঐ যিয়ারতকারী ও কবরবাসী ব্যক্তি উভয়কে ক্ষমা করে দিবেন।”
আল্লামা বাক্বির মাজলিসী, বিহারুল আন্-ওয়ার, খণ্ড ৭৯, পৃঃ নং ১৬৯।
↯↻↯↻↯