হাদিস বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে বেলায়েতের সম্রাট ইমাম আলীর বক্তব্য

1010

হাদিস বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে ইমাম আলী সালামুল্লাহি আলাইহি-র বক্তব্যঃ

ইমাম আমিরুল মুমিনিন আলি ইবনে আবি তালিব সালামুল্লাহি আলাইহি-র কিছু ঐতিহাসিক বক্তৃতা, চিঠি ও বাণীর সঙ্কলন যা নাহজুল বালাগ্বা নামে সমাধিক পরিচিত, নিঃসন্দেহে এ কিতাব একটি পথ নির্দেশমূলক হেদায়াতের আলোকবর্তিকা। বাংলায় এই কিতাবের ভাল কোন অনুবাদ পাওয়া যায় না। যে কয়টি অনুবাদ পাওয়া যায় তার অধিকাংশই মুল গ্রন্থের প্রতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমানতদারীতা রক্ষা করা হয়নি। বরং অনেক অনুবাদে ক্ষেত্র বিশেষে কায়েমি স্বার্থবাদীদের চক্রান্তে ইমাম আলীর বক্তব্যকে বিকৃত করে প্রকাশ করেছে। অনেক ক্ষেত্রেই অনুবাদকের জ্ঞানের দুর্বলতা, আরবি ভাষায় অনভিজ্ঞতা, নাহজুল বালাগ্বার মত উচ্চমার্গের গবেষণাযোগ্য কিতাবের ব্যাপারে কোন ধরনের পড়ালেখা না থাকার কারণে গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য বাংলা অনুবাদ নেই বললেই চলে। তবে জেহাদুল ইসলাম অনূদিত বাংলায় নাহজুল বালাগ্বা বইটি একটি পুর্নাঙ্গ অনুবাদ বিধায় অপর একটি গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য পুর্নাঙ্গ অনুবাদ না আসা পর্যন্ত এই বই-ই আমাদের জন্যে “নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল”-এর মত। এ কিতাবে প্রায় প্রতিটি খুতবা ও চিঠির পরেই ইংরেজী অনুবাদক যে টিকা দিয়েছেন বাংলা অনুবাদে তারও অনুবাদ করা হয়েছে। আমিরুল মুমিনিন্ ইমাম আলী সালামুল্লাহি আলাইহি হাদিসের বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন উক্ত কিতাবের ২০৯ নম্বর খুৎবার টিকায় ইংরেজী অনুবাদক যা উল্লেখ করেছেন তা নিচে তুলে ধরছিঃ

আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী সালামুল্লাহি আলাইহি হাদিসের বর্ণনাকারীদেরকে চার শ্রেনিতে বিভক্ত করেছেন। তন্মোধ্যে

 ১. প্রথম শ্রেণী হলঃ “যারা বানোয়াট হাদিস বর্ননা করে রাসুলের নামে চালিয়ে দিয়েছে।”
 একথা অস্বীকার করার কোন জো নেই যে, রাসুলের সহি হাদিস যখন প্রকাশ পেতে লাগলো তখন বিভিন্ন দল তাদের স্বার্থে মিথ্যা হাদিস রাসুলের নামে চালিয়ে দিয়েছিল। এ কথা কেউ অস্বীকার করলে সে তা জ্ঞানের ভিত্তিতে নয়-শুধু তর্কের খাতিরে অস্বীকার করবে। একবার হযরত আল্লামা আলামুল হুদা সাইয়েদ মুরতাজা (রহ.) কিছু সংখ্যক সুন্নি উলামার সাথে তর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন। তিনি ঐতিহাসিক ঘটনাবলী বর্ণনা করে প্রমাণ করলেন যে, সাহাবাদের মর্যাদা সম্পর্কে প্রচলিত হাদিসগুলোর সব ক’টি বানোয়াট ও মিথ্যা। সুন্নি আলেমরা যুক্তি দেখালেন যে, কেউ মিথ্যা হাদিস রচনা করে রাসুলের নামে চালিয়ে দেবার সাহস করবে, একথা অবিশ্বাস্য ও অসম্ভব। তখন আল্লামা সাইয়েদ মুরতাজা(রহ.) একটা সহি হাদিসের কথা উল্লেখ করে বলেন যে, রাসুল (সা.) বলেছেনঃ “আমার মৃত্যুর পর আমার নামে অসংখ্য মিথ্যা বিষয় প্রচলিত হবে এবং যে কেউ আমার নাম দিয়ে মিথ্যা প্রচার করবে সে দোযখে নিজ আবাস তৈরি করবে।” ( সহি আল বুখারী, খণ্ড ১, পৃঃ নং ৩৮; খণ্ড ২, পৃঃ নং ১০২; খণ্ড ৪, পৃঃ নং ২০৭; খণ্ড ৮, পৃঃ নং ২২৯; আস সুনান, খণ্ড ৩, পৃঃ নং ৩১৯-৩২০; সহি আত্ তিরমিযী, খণ্ড ৪, পৃঃ নং ৫২৪; ৫ম খণ্ড, পৃঃ নং ৩৫-৩৬, ৪০, ১৯৯, ৬৩৪; ইবনে মাযাহ, খণ্ড ১ম, পৃঃ নং ১৩-১৫)।
 
যদি কেউ মনে করে এ হাদিসটি সত্য তা হলে সে অবশ্যই একমত হবে যে, রাসুলের (সা.)-এর নামে অনেক মিথ্যা বিষয় চালিয়ে দেয়া হয়েছে। আবার যদি কেউ মনে করে এ হাদিসটি মিথ্যা তাহলে রাসূলের (সা.)-এর নামে মিথ্যা বিষয় চালিয়ে দেয়ার প্রমাণ এ হাদিসটিই বহন করে। যা হোক, যাদের হৃদয় ছিল মুনাফেকিতে পরিপূর্ণ, যারা দ্বীনে ফেতনা ও বিভেদ সৃষ্টি করে দুর্বল ঈমানসম্পন্ন মুসলমানদেরকে পথভ্রষ্ট করে স্বীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য দলে ভিড়েছিল তারাই রাসুলের নামে মিথ্যা হাদিস রচনা করেছিল। এ ধরনের লোক রাসুলের জীবদ্দশায়ও ছিল যারা মুমিনদের সাথেই মিশে থাকতো এবং সারাক্ষণ মুসলমানদের অকল্যাণ ও ক্ষতির চিন্তায় ব্যস্ত থাকতো। রাসুলের ইন্তেকালের পর এ ধরনের লোকের সংখ্যা আরো বেড়ে গিয়েছিল এবং অসৎ কর্মতৎপরতায় তারা আরো মনযোগী হয়ে পড়েছিল। এরা ইসলামের মহান শিক্ষা ও আদর্শের নানা প্রকার বিকৃতি ও পরিবর্তন করতে দ্বিধা করতো না। কারণ রাসুলের জীবদ্দশায় তারা কিছুটা ভয়ে থাকতো পাছে তিনি তাদের মুনাফেকি ফাঁস করে দিয়ে লজ্জায় ফেলে দেন। কিন্তু রাসুলের পর তাদের সে ভয় কেটে গেছে। বিভিন্নভাবে এরা ক্ষমতাধর হয়ে স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য এ রকম মুনাফেকি করার পরও জনগণ তাদেরকে অবিশ্বাস করতো না। কারণ তারা দাবী করতো যে, তারা রাসুলের সাহাবা এবং যা বলে তা সত্য ও সঠিক। এরাই নিজেদের জন্য হাদিস বানিয়ে নিলঃ “রাসুলের সাহাবারা যে কোন প্রকার সমালোচনা ও প্রশ্নের উর্ধে। তাদের কোন কাজের আলোচনা-পর্যালোচনা করা যাবে না।” আমিরুল মোমেনিন এহেন উক্তির মুখ থুবড়ে দিয়ে বলেনঃ
“এসব লোক গোমরাহীর নেতার কাছে মর্যাদা লাভ করেছে এবং এরা মিথ্যা ও অপবাদের মাধ্যমে দোযখের দিকে আহ্বানকারী। সুতরাং এসব নেতারা মুনাফিকদেরকে উচ্চপদে আসীন করে জনগণের মাথার ওপর বসিয়ে দিয়েছিল। মুনাফিকরা ইসলামের ক্ষতি সাধনের পাশাপাশি সম্পদও স্তূপীকৃত করেছিল। মুসলমানদের মুখোশ পরে তারা যথেচ্ছভাবে বানোয়াট হাদিস বর্ণনা করে এবং ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলীতে বিভেদ সৃষ্টি করে তারা তাদের স্বার্থসিদ্ধি করেছিলো।”
 
হযরত ইবনে আবিল হাদিদ (রহ.) লিখেছেনঃ
“যখন তারা যথেচ্ছভাবে চলার সুযোগ পেল তখন তারা ইসলামের অনেক কিছু পরিত্যাগ করেছিল। যখন মানুষ তাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকতো তখন তারাও ইসলাম সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকতো। কিন্তু তারা তলে তলে মিথ্যার জাল বুনায় তৎপর থাকতো যা আমিরুল মুমিনিন পরোক্ষভাবে উল্লেখ করেছেন। এ সব লোক রাসুলের হাদিসে অনেক মিথ্যার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে, যাদের লক্ষ্য ছিল মানুষের ইমানে ফাটল ধরিয়ে গোমরাহির দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া। অপরপক্ষে এদের কারো লক্ষ্য ছিল কোন বিশেষ দলের উচ্চ প্রশংসা করা, যাদের সঙ্গে এদের জাগতিক বিষয়াবলীর সার্থ সংশ্লিষ্ট ছিল।”
 
এ সময় অতিবাহিত হবার পর যখন মুয়াবিয়া ধর্মের নেতৃত্ব ও ইহকালীন কর্তৃত্বের সিংহাসন দখল করেছিল তখন সে মিথ্যা হাদিস রচনা করে তাতে জনমত গঠন করার জন্য একটা সরকারী বিভাগ খুলেছিল। সে তার অফিসারদেরকে নির্দেশ দিয়েছিল যেন তারা (অফিসারগণ) উসমান ও উমাইয়াদের উচ্চকিত প্রশংসা চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়। এ কাজের জন্য সে পুরস্কার ঘোষণা করে এবং জমি বরাদ্ধ দেয়। ফলে হাদিস গ্রন্থগুলোতে অসংখ্য স্বঘোষিত বানোয়াট বক্তব্য স্থান লাভ করে। আবুল হাসান আল মাদায়নীর ‘কিতাবুল আহদাছ’ হতে ইবনে আবিল হাদীদ উদ্ধৃত করেছেনঃ “মুয়াবিয়া তার অফিসারদের কাছে লেখেছিল যে, তারা যেন সেসব লোকের প্রতি বিশেষ যত্নশীল থাকে যারা উসমানের কথা বলে, তার শুভাকাঙ্ক্ষী ও তাকে ভালোবাসে। যারা উসমানের উচ্চ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে হাদিস বর্ননা করে তাদেরকে যেন বিশেষ পদমর্যাদা ও সম্মান প্রদান করা হয় এবং বর্ণনাকারীর নাম, পিতার নাম ও গোত্র পরিচয়সহ যেন হাদিসটি তার কাছ থেকে প্রেরণ করা হয়। মুয়াবিয়া কর্তৃক প্রদত্ত সরকারী মর্যাদা, জমি, পোষাক ও নানাবিধ পুরস্কারের ফলে উসমানের প্রশংশাসূচক হাদিস স্তূপীকৃত হয়ে গেল।”
 
উসমানের উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কীয় এসব বানোয়াট হাদিস যখন রাজ্যময় ছড়িয়ে দেয়া হল তখন পুর্ববর্তী খলীফাদের মর্যাদা যাতে ক্ষুণ্ণ না হয় সেজন্য মুয়াবিয়া তাঁর অফিসারদের লিখেছিলঃ “আমার এ আদেশ পাওয়া মাত্র তোমরা জনগণকে বলো যেন তারা সাহাবা ও অন্য খলীফাদের প্রশংসাসূচক হাদিস তৈরী করে এবং সাবধান থেকো, যদি কোন লোক আবু তুরাব (আলী) সম্পর্কে কোন হাদিস বলে তাহলে তোমরাও অন্য সাহাবাদের সম্বন্ধে অনুরূপ হাদিস রচনা করো। মনে রেখো, এতে আমি আনন্দিত হবো এবং আমার চক্ষু শীতল হবে। এতে আবু তুরাব ও তার দলের মর্যাদা ক্ষীণ হয়ে পড়বে এবং উসমান বিশেষভাবে মর্যাদাশীল হবে।”
 
মুয়াবিয়ার এ পত্রের বিষয় জনগণকে জানানোর পর সাহাবাদের উচ্ছসিত প্রশংসাসূচক অসংখ্য বানোয়াট হাদিস লোকেরা বর্ণনা করেছিল, সত্যের সাথে যেগুলোর কোন সংশ্রব ছিল না। (শারহু নাহজিল বালাগ্বা, খন্ড ১১, পৃঃ ৪৩-৪৭)।
 
এ বিষয়ে প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ আবু আবদুল্লাহ ইব্রাহীম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আরাফাহ (ডাক নাম নিফতাওয়াহ- হিঃ২৪৪-৩২৩ সন)-এর উক্তি হযরত ইবনে আবিল হাদীদ (রহ.) উদ্ধৃত করেছেনঃ “সাহাবাদের মর্যাদা সম্পর্কিত অধিকাংশ মিথ্যা হাদিস মুয়াবিয়ার সময় রচিত হয়েছিল। এসব বানোয়াট হাদিস দ্বারা সে জনগণের কাছে মর্যাদা লাভে কৃতকার্য হয়েছিল। তার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল বনি হাশিমকে অমর্যাদাকর ও হেয় করে দেখানো।” (প্রাগুক্ত)
 
এরপর মিথ্যা ও বানোয়াট হাদিস বর্ণনা করা মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। দুনিয়াদার ব্যক্তিরা খলিফা ও রাজা-বাদশাহদের কাছে মর্যাদা ও ঐশ্বর্য অর্জনের উপায় হিসাবে হাদিস বর্ণনাকে বেছে নিয়েছিল। উদাহরণ স্বরূপ, হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীতে গিয়াস ইবনে ইব্রাহীম আন-নাখাই আব্বাসিয় খলিফা আল-মাহদি ইবনে আল-মনসুরকে খুশি করে মর্যাদা লাভের আশায় কবুতর উড়িয়ে দেয়া সম্পর্কে একটা বানোয়াট হাদিস বর্ণনা করেছিল (বাগদাদী, খন্ড ১২, পৃঃ নং ৩২৩-৩২৭; যাহাবি, খন্ড ৩, পৃঃ নং ৩৩৭-৩৩৮; আসকালানী, খন্ড ৪, পৃঃ নং ৪২২)। আবু সাঈদ মাদায়নী ও অন্যান্যরা বানোয়াট হাদিস বর্ণনাকে জীবিকা উপার্জনের উপায় হিসাবে বেছে নিয়েছিল। এসময় সীমালঙ্ঘনের পর্যায় এতদূর এগিয়েছিল যে, কাররামিয়াহ ও কতিপয় মুতাসাওয়াফাহ ফতোয়া জারি করে বলেছিল, পাপ থেকে বিরত রাখার জন্য অথবা আনুগত্যের প্রতি প্রলুব্ধ করার জন্য মিথ্যা ও বানোয়াট হাদিস বর্ণনা করা জায়েয।
 
এ ফতোয়ার ফলে প্রকাশ্যে যথেচ্ছভাবে হাদিস বর্ণনা জারী হয়ে গেল এবং একে নৈতিক ও ধর্মীয় বিধানের পরিপন্থী মনে করা হতো না। বরং যাদেরকে বাহ্যিক আচার-আচরণে পরহেজগার বলে মনে করা হতো এবং যারা সারাদিন নামাজরত থাকতো তারা সারারাত বিভিন্ন বানোয়াট হাদিস লেখে তাদের খাতা-পত্র ভরে ফেলতো। এ ধরনের বানোয়াট হাদিসের সংখ্যার বিষয়ে কতিপয় ঘটনা অনুমান করা যাবে। ইমাম বুখারি ছয় লক্ষ হাদিস সংগ্রহ বরেছিলেন। তিনি সেখান থেকে মাত্র দুই হাজার সাত শত একষট্টিটি হাদিস গ্রহণ করেছিলেন। (বাগদাদী, খন্ড ২, পৃঃ নং ৮; কাস্তালানী, খন্ড ১, পৃঃ নং ২৮; হাম্বালি, খন্ড ৪, পৃঃ নং ১৪৩)। ইমাম মুসলিম নিশাবুরী তিন লক্ষ হাদিস থেকে মাত্র চার হাজার হাদিস গ্রহণ করেছিলেন। (বাগদাদী, খন্ড ১৩, পৃঃ নং ১০১; হাম্বালি, খন্ড ৫, পৃঃ নং ৩২; যাহাবি, খন্ড ২, পৃঃ নং ১৫১-১৫৭; খাল্লাক্বান, খন্ড ৫, পৃঃ নং ১৯৪)। আর ইমাম আবু দাউদ পাঁচ লক্ষ হাদিস থেকে মাত্র চার হাজার আট শত হাদিস গ্রহণ করেছিলেন। (বাগদাদী, খন্ড ৯, পৃঃ নং ৫৭; যাহাবি, খন্ড ২, পৃঃ নং ১৫৪; হাম্বালি, খন্ড ৫, পৃঃ নং ৯৭, খাল্লাক্বান, খন্ড ২, পৃঃ নং ৪০৪)। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল প্রায় দশ লক্ষ হাদিস থেকে মাত্র ত্রিশ হাজার হাদিস গ্রহণ করেছিলেন। (বাগদাদী, খন্ড ৪, পৃঃ নং ৪১৯-৪২০; হাম্বালি, খন্ড ২, পৃঃ নং ১৭; খাল্লাক্বান, খন্ড ১, পৃঃ নং ৬৪; আসকালানী, খন্ড ১, পৃঃ নং ৭৪)। এসব বাছাইকৃত হাদিসগুলোর মধ্যে কিছু কিছু মিথ্যা ও বানোয়াট হাদিস যে এসে পড়েনি সে কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এ বিষয়ে আরো অধিক জানতে হলে হযরত আল্লামা আমিনী (রহ.) লিখিত আল-গাদীর কিতাবের ৫ম খণ্ডের ২০৮-৩৭৮ পৃষ্ঠা পড়ার সুপারিশ করা গেল।
 ২. আর দ্বিতীয় প্রকার বর্ণনাকারী হলো-
যারা বিষয় বা উপলক্ষ বিবেচনা না করে শুদ্ধ ও অশুদ্ধ যা কিছু মনে ছিল তাই বর্ণনা করেছেন। উদাহরণ সরূপ, খলিফা উমর যখন আহত হলেন তখন সুহায়েব তাঁর কাছে এসে কাঁদতে লাগলো। এতে উমর বল্লেনঃ “হে সুহায়েব, তুমি আমার জন্য কাঁদছো অথচ রাসুল (সা.) বলেছেন যে, মৃত ব্যক্তির অবশিষ্ট লোকেরা তার জন্য কান্নাকাটি করলে তার (মৃত ব্যক্তির) শাস্তি হয়।” (বুখারি, খন্ড ২, পৃঃ নং ১০০-১০২; নিশাবুরী, খন্ড ৩, পৃঃ নং ৪১-৪৫; তিরমিযী, খন্ড ৩, পৃঃ নং ৩২৭-৩২৯; নাসাঈ, খন্ড ৪, পৃঃ নং ১৮; ইবনে মাজাহ, খন্ড ১, পৃঃ নং ৫০৮-৫০৯; আনাস, খন্ড ১, পৃঃ নং ২৩৪; শাফীঈ, খন্ড ৭, পৃঃ নং ২৬৬; আশআস, খন্ড ৩, পৃঃ নং ১৯৪; আহমাদ ইবনে হাম্বাল, খন্ড ১, পৃঃ নং ৪১-৪২; শাফীঈ, খন্ড ৪, পৃঃ নং ৭২-৭৪)।
 
খলিফা উমরের মৃত্যুর পর উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়শা কাঁদছিলেন। তখন তাঁকে উমরের বর্ণিত উক্ত হাদিস বলা হলে তিনি বললেনঃ “আল্লাহ উমরকে মাফ করুন। আত্মীয়-স্বজন কাঁদলে মৃতের শাস্তি হয় আল্লাহর নবি এমন কথা বলেননি।” এরপর তিনি বলেন: “যেখানে কুরআন বলেছে, একজনের বোঝা অন্যজন বহন করবে না সেখানে কি করে জীবিতের কান্নার জন্য মৃত ব্যক্তি শাস্তি পেতে পারে?!” এরপর তিনি কোরআনের আয়াত উদ্ধৃত করলেনঃ “কারো পাপের বোঝা অন্য কেউ বহন করবে না।” (৬:১৬৪, ১৭:১৫, ৩৫:১৮, ৩৯:৭, ৫৩:৩৮)।
 
তারপর হযরত আয়েশা বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বললেনঃ “একদিন রাসুল (সা.) এক ইহুদী মহিলার কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি দেখেন সেই কবরবাসীর আত্মীয়-স্বজন তার জন্য কান্নাকাটি করছে। তখন রাসুল (সা.) বলেছিলেনঃ “তার লোকেরা তার জন্য কাঁদছে। অথচ কবরে তার শাস্তি চলছে।” রাসুলের (সা.) এ কথার অর্থ এ নয় যে, আত্মীয় স্বজনের কান্নার জন্য তার শাস্তি হচ্ছে। বরং তিনি বুঝাতে চেয়েছেন কৃতকর্মের শাস্তির জন্য আত্মীয়-স্বজনের কান্না কোন কাজে আসছে না।]
৩. তৃতীয় প্রকার হাদিস বর্ণনাকারী হল তারা, —-
যারা রাসুলের (সা.) কাছ থেকে এমন কিছু শুনেছে যা হয়তো পরবর্তীকালে রদ হয়ে গেছে। কিন্তু রাসুল (সা.) কর্তৃক এহেন রদ করার বিষয়টি শোনার সৌভাগ্য হয়নি বলে এরা সে বিষয়ে অনবহিত। উদাহরণ স্বরূপ, রাসুলে আকরাম (সা.) বলেছেনঃ “কবর যিয়ারত করতে আমি তোমাদেরকে নিষেধ করেছিলাম কিন্তু তোমরা এখন তা করতে পারো।” (নিশাবুরী, ৩য় খণ্ড, পৃঃ৬৫; তিরমিযী, ৩য় খণ্ড, পৃঃ৩৭০; আশাআস, ৩য় খণ্ড, পৃঃ২১৮ ও ৩৩২; নাসাঈ, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ৮৯, ইবনে মাযাহ, পৃঃ৫০০-৫০১; আনাস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৪৮৫; আহমাদ ইবনে হাম্বাল, ১ম খণ্ড, পৃঃ১৪৫ ও ৪৫২, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৩৮, ৬৩, ৬৬, ২৩৭ ও ৩৫০; ৫ম খণ্ড, পৃঃ ৩৫০, ৩৫৫, ৩৫৬, ৩৫৭, ৩৫৯ ও ৩৬১; নিশাবুরী, ১ম খন্ড, পৃঃ ৩৭৪-৩৭৬)। এ হাদিস থেকে বুঝা যায় যে, রাসুল (সা.) কোন সময়ে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলেন। এ হাদিস দ্বারা সেই নিষেধাজ্ঞা রদ করেছেন। কিন্তু যারা এ হাদিসটি শোনেনি তারা পূর্বের নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী কাজ করেছে এবং সেটাই প্রচার করে বেড়াচ্ছে।
৪. চতুর্থ প্রকার বর্ণনাকারী হচ্ছে তারা,
যারা ন্যায়নীতি সম্পর্কে ওয়াকেবহাল এবং যাদের বুদ্ধিমত্তা এবং প্রজ্ঞা রয়েছে তারা হাদিসের উপলক্ষ সম্বন্ধে সম্পুর্ণ অবহিত এবং তাঁরা বাতিলকৃত হাদিস ও তার স্থলে প্রতিস্থাপিত হাদিস সম্পর্কে অবহিত। তারা সাধারণ (আম) ও বিশেষ (খাস) ভাবধারা ও হাদিসের স্থান, কাল ও পাত্র বিষয়ে সবিশেষ অবহিত। তারা কোন প্রকার বাড়াবাড়ি, মিথ্যা, অতিরঞ্জন ও বানোয়াট কথার ধার ধারেনি। তারা যা কিছু শুনেছে তাদের স্মৃতিতে তা অবিকল ধারণ করে রেখেছে এবং সামান্যতম পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ব্যতিরেকে সম্পুর্ন অবিকলতা রক্ষা করে তা মানুষের কাছে বর্ণনা করেছে। এদের বর্ণিত হাদিসই ইসলামের অমূল্য সম্পদ এবং এ ধরনের হাদিস অনুযায়ীই আমল করতে হবে। এ ধরনের হাদিসগুলোর মধ্যে আমিরুল মুমিনিন কর্তৃক বর্ণিত হাদিসগুলো প্রধান। জ্ঞান ও মর্যাদায় আমিরুল মুমিনিনের অবস্থান রাসুলের (সা.) নিম্নের হাদিসগুলো থেকে সহজেই অনুমেয়। আমিরুল মুমিনিন, জাবির ইবনে আবদুল্লাহ, ইবনে আব্বাস ও আবদুল্লাহ ইবনে উমর থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুল (সা.) বলেছেনঃ “আমি জ্ঞানের নগরী এবং আলী তার দরজা। যে কেউ আমার জ্ঞান অর্জন করতে চায় তাকে অবশ্যই এ দরজার মধ্য দিয়ে আসতে হবে।” (নিশাবুরি, ৩য় খন্ড, পৃঃ নং ১২৬-১২৭; ইবনে আসির, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ নং ২২; বাগদাদী, ২য় খন্ড, পৃঃ নং ৩৭৭, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ নং ৩৪৮, ৭ম খন্ড, পৃঃ ১৭২; ১১শ খন্ড, পৃঃ ৪৮-৫০; যাহাবি, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ নং ২৮; ইমাম শাফিঈ, ৯ম খন্ড, পৃঃ নং ১১৪; আসকালানী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃঃ নং ৩২০; ৭ম খন্ড, পৃঃ নং ৩০৭; আসকালানী, ২য় খন্ড, পৃঃ ১২২-১২৩; সুয়ূতি, পৃঃ নং ১৭০; হিন্দি, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃঃ নং ১৫২, ১৫৬ ও ৪০১; হানাফি, ৭ম খন্ড, পৃঃ নং ৬৩১; যুরক্বানি, ৩য় খন্ড, পৃঃ নং ১৪৩)।”
আমিরুল মুমিনিন ও ইবনে আব্বাস থেকে বর্নিত আছে যে, রাসুলে খোদা (সা.) বলেছেনঃ
“আমি প্রজ্ঞার ভান্ডার এবং আলী তার দরজা। যদি কেউ প্রজ্ঞাবান হতে চায় তবে তাঁকে এ দরজা দিয়েই আসতে হবে।”( ইসফাহানী, ১ম খন্ড, পৃঃ নং ৬৪; ইমাম শাফীঈ, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৭৫; বাগদাদী, ১১শ খন্ড, পৃঃ নং ২০৪; হিন্দি, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃঃ নং ৪০১; ইমাম শাফিঈ, ২য় খন্ড, পৃঃ নং ১৯৩)।
 
এসব হাদিস থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, রাসুলের (সা.) জ্ঞান সাগরে পাড়ি দিয়ে তাঁর অনুকম্পা লাভের উপায় হল আহলুল বাইতের মাধ্যমে প্রবাহিত ধারা অনুসরণ করা। আর মানুষ যদি তা করতো তবে তা কতই না উত্তম হতো। কিন্তু ইতিহাসের এক বিষাদময় অধ্যায় হল- আহলুল বাইতের শত্রুগণের বর্ণিত হাদিস ক্ষমতাসীনগণ সাদরে গ্রহণ করেছে অথচ হাদিস বর্ণনাকারীদের নামের তালিকায় যখনই আহলুল বাইতের কোন সদস্যের নামোল্লেখ করা হয়েছে অমনি সে হাদিস বাতিল করে দেয়া হয়েছে।
[১৮ই যিলহজ্ব তথা ঈদুল গ্বাদীর-এর দিনে ইমাম আলীর বেলায়েত প্রাপ্তির দিবস উপলক্ষে সকল দ্বীনদার ও ঈমানদার নবীজীর আহলে বাইত প্রেমিক মুসলমানকে জানাই আন্তরিক মুবারকবাদ।]

Related Post

পনেরটি কঠোর আযাব

Posted by - আগস্ট ১৬, ২০১৯
দয়াল নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সাঃ) এরশাদ করেছেনঃ ✍“যে ব্যক্তি নামাজের ব্যাপারে অবহেলা করে তার জন্যে পনেরটি কঠোর আযাব নির্ধারিত…

নফস

Posted by - সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৯
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম একটি বিখ্যাত হাদিসে উল্লেখ আছেঃ مَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ فَقَدْ عَرَفَ رَبَّهُ  অর্থঃ “যে ব্যক্তি তার নফসকে চিনলো…

ধর্মীয় জ্ঞানের প্রকারভেদ

Posted by - আগস্ট ১৭, ২০১৯
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। رسول(ص): العلم علمان علم الادیان و علم الابدان হযরত মুহাম্মাদ (সা.): “ জ্ঞান দুই প্রকার। একঃ ইলমুল…

আধ্যাতিক বাবা

Posted by - আগস্ট ১৯, ২০১৯
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। ✍️ قال رسول الله ص: انا و علي ابوا هذه الامه وَ عَلِيٌّ أَبَوَا هَذِهِ الْأُمَّة ؛…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »