কারবালার করুণ শোকগাঁথা

1237

পর্ব একঃ কারবালা ইসলামী আন্দোলনের প্রশিক্ষণ মঞ্চ

🔲⬛🔲⬛🔲⬛🔲⬛🔲⬛🔲⬛🔲⬛

প্রতিবছর মহররম মাস আসলে সারা বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায় কারবালার শহীদদের শোকে মুহ্যমান হয়ে যান। চারিদিকে শোকের যে আবহ তৈরি হয়, তা মুসলমানদের অন্তরকে বিগলিত করে দেয়। আমরা এই মাসে শোকের নানান অনুষ্ঠান আয়োজন করি, দরিদ্রদের মাঝে খাবার বিতরণ করি, দশদিন ব্যপি মজলিস করে এই মাস থেকে ফজিলত হাসিলের আপ্রান চেষ্টা করে থাকি। আহলে বাইতের অনুসারী কতিপয় আলেম এসকল শোকসভায় কারবালার ঘটনা বর্ণনা করে মানুষের চোখের পানি ঝড়ানোর আয়োজন করেন। আর আমাদের মুসলমান ভাইয়েরা সেই সকল বীরদের সাহসিকতার কাহিনি শুনে আশ্রæপাতে বুক ভাসিয়ে দেন। চারপাশের এসকল আয়োজন দেখে আমার কাছে মনে হয়, ইমাম হুসাইন এবং তাঁর সেই সাহসী সন্তানেরা মানুষকে যুগ যুগ ধরে চোখের পানি ঝরানোর খোরাক দেয়ার উদ্দেশ্যেই একটি সংগ্রামের মঞ্চায়ন করেছেন। কিন্তু যখন কারবালার সংগ্রামের বহুমাত্রিকতার দিকে তাকাই, তখন এসকল শোকসভা, আশ্রæপাত কারবালার চাহিদার তুলনায় একেবারে নগন্য মনে হয়।

যে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে ইমাম হুসাইন উমাইয়্যা শাসক ইয়াজিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তাতে কখনও এটা মনে করার কোন সুযোগ থাকে না যে, এই দশদিন শুধুমাত্র শোক পালনের মাধ্যমে কিছু অশ্রæপাতের জন্যে সৃষ্টি করা হয়েছে। যদি এমন হতো তবে এই ঘটনার প্রভাব যুগ যুগ ধরে মানবতার প্রতিটি শাখা উপশাখায় বিস্তার লাভ করতে পারতো না। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে কারবালা নিপীড়িত নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর কাছে যে আহ্বান রেখে চলেছে, তার আবেদন শুধু অশ্রæপাতের দ্বারা সম্পন্ন হওয়া সম্ভব নয়। শুধু দশদিন শোকানুষ্ঠান উদযাপন করে, দরিদ্রদের মাঝে খাবার বিতরণ করে বা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতো দুটি রোজা পালন করে এই বহুমাত্রিক ঘটনার হক আদায় করা যায় না।

মহররম শোকের মাস, এতে কোন সন্দেহ নেই। এই মাসের আকস্মিকতা প্রতিটি মুসলমানের অন্তরে দাগ কাটবে এটাই স্বাভাবিক। যুগ যুগ ধরে আবালবৃদ্ধাবনিতা এই ঘটনা শোকের আবহে বয়ে বেড়াবে এতে আমার কোন দ্বিমত নেই। আমার দ্বিমত এর শিক্ষায়, আমার দ্বিমত এর আবেদনে, আমার দ্বিমত এর গুরুত্বে। কারবালা শোকের মাস, এতে আমি একমত। কিন্তু হায় হুসাইন! হায় হুসাইন! বলে এই মাসে বুক চাপড়িয়ে শরীর থেকে রক্ত ঝরিয়ে বা অঝোরে অশ্রুপাত করে বুক ভাসাতে ভাসাতে এর থেকে ফজিলত হাসিল করবো, আর মহররম শেষে আবার পূর্বের ন্যায় আমি নিজেকে সমাজের অবক্ষয়ের প্রতি ভাসিয়ে নিয়ে যাবো, এর সাথে আমার দ্বিমত আছে। যারা এসকল আয়োজনের দ্বারা এই মাসকে কাটিয়ে দিয়ে তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করতে চান, তাদের কাছে কারবালা শুধু একটি বেলার ঘটনা মাত্র। যেখানে ইমাম হুসাইন ও তাঁর শতাধিক সঙ্গি জীবনের মায়া ত্যাগ করে ইমামের প্রতি তাদের ভালোবাসার প্রমাণ দিয়েছেন। কিন্তু এই ঘটনার শুরু ও শেষ দিকের প্রতি তারা মোটেই দৃষ্টি প্রদান করেন না। ইমামের বিদ্রোহের ঘটনা, মদিনা থেকে তাঁর হিজরত, মক্কা থেকে কুফা’র দিকে আগমন, যাত্রা পথে তাঁর প্রদত্ত খুতবাগুলো, কারবালার প্রান্তরে অবস্থিত ইমামের আচরণ ও কর্মপদ্ধতি, আশুরা দিবসের ঘটনা, যুদ্ধের পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ এসবই কারবালার অংশ। যে ঘটনাটির মূল অংশ কারবালা নামক উষ্ণ মরুপ্রান্তরে হলেও এর শুরু এবং শেষ কিন্তু সেই ১০ই মহররমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ইয়াজিদের ক্ষমতার মসনদে বসা থেকে শুরু করে, সিরিয়া রাজদরবারে আহলে বাইতের প্রতি অবমাননাকর আনন্দ আয়োজন এবং এর পরবর্তীতে অন্যান্য বিদ্রোহের ঘটনাগুলো কারবালারই অংশ। এই সকল ঘটনাগুলোকে সমন্বিত করেই আমাদেরকে কারবালা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। আমরা ধিরে ধিরে কারবালার এই ঘটনাগুলো আলোচনা করেই এর থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করার চেষ্টা করবো।

যে সময়টিতে ইমাম হোসাইন বিদ্রোহ করেছিলেন, তা ছিল ইয়াজিদের শাসনভার গ্রহণ করার প্রারম্ভেই। এই বিরোধিতায় তিনি কোন প্রকার কৌশল অবলম্বন করেননি। এমনকি কোন সহযোগিতার অপেক্ষায় তিনি থাকেননি। যখন যেখানে তিনি আন্দোলনের জন্য সুবিধা মনে করেছেন সেদিকে ছুটেছেন। মদিনা থেকে মক্কা, মক্কা থেকে তাঁর কুফা দিকে চলা থেকেই আমরা বুঝতে পারি যে, ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তাঁর মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল না। কারণ কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য এতটা উতলা হয়ে যাওয়া ব্যক্তি ইমাম হোসাইন নন। তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারলেন, এখন থেকে ইসলামের ইতিহাসের সাথে যুক্ত হবে রাজতন্ত্রের অভিশপ্ত ধারা, যা সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল, ইমাম আলী এবং ইমাম হাসান তাঁদের বক্তব্য এবং নসিহতের মধ্যে সুস্পষ্ট করেছিলেন। তিনি দেখছিলেন, এমন এক ব্যক্তির হাতে মুসলমানদের ভাগ্য এবং ইসলামের রক্ষার দায়িত্ব চলে এসেছে, যার না আছে কোন ইসলামি অনুভ‚তি আর না আছে ইসলামের কোনরূপ জ্ঞান। এই ব্যক্তির হাতে দ্বীনের পরিচালনার দায়িত্ব চলে যাচ্ছে যার পূর্বপুরুষেরা কখনোই ইসলামের সাথে সৌহার্দ রাখেনি। ইয়াজিদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট আমাদের সকলেরই জানা। তার অসভ্যতা যখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সস্তানের আনুগত্যের নিবেদন করল, তখন মাসুমিয়াতের সেই স্বত্বা অস্থির হয়ে পড়েন এবং বিদ্রোহের আগুনে নিজেকে পুড়িয়ে দ্বীনের ভিত্তি পুনঃস্থাপনে অধির হয়ে গেলেন। তাই, ইয়াযিদ কর্তৃক নিযুক্ত মদিনার গভর্নের কাছ থেকে ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত হওয়ার প্রস্তাব শুনেই ইমাম হুসাইন বলেছিলেন, “হুসাইনের মতো লোকেরা ইয়াজিদের মতো লোকদের হাতে বাইয়াত হতে পারে না।” (খাতিব খোরাযমী(মৃত্যু৫৬৮হি.), আল মাক্বতাল, খন্ড-১, পৃ. ১৮৪, কোম, ইরান; সাইয়্যেদ ইবনে তাউস(মৃত্যু ৬৭৩হি.), লুহুফ, পৃ. ১৯, তেহরান, ১৩২১ফারসী)।

ঐতিহসিকদের বর্ণনানুযায়ী তার পরের দিন প্রভাতে মদিনার রাজপথে ইমামের সাথে মারওয়ান বিন হাকামের সাক্ষাত হলে সে পুনরায় ইমামকে ইয়াযিদের হাতে বাইয়াতের প্রস্তাব দেয়। তখন ইমাম সেই প্রস্তাবের উত্তরে বলেছিলেন, “ইন্নাল্লিাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। ইসলাম বিদায় লগ্নে উপনীত হয়েছে।” (খোরাযমী, খন্ড-১, পৃ. ১৮৪; সাইয়্যেদ ইবনে তাউস, পৃ. ২০)।

এখানে হুসাইন যেমন একটি প্রতীক তেমনি ইয়াজিদও একটি প্রতীক। অর্থাৎ, হুসাইন হচ্ছেন সারা দুনিয়ার সকল অধিকার বঞ্চিত ও নিপীড়িত জনতার প্রতীক, যারা সকল অবস্থায় অন্যায়ের সাথে আপোষহীন; আর অপরপক্ষে ইয়াজিদ হচ্ছে সেই সকল লোকদের প্রতীক, যারা জুলুম ও নিপীড়নের দ্বারা মানুষকে দাবিয়ে রাখতে চায় এবং তাদের অধিকার হরণের দ্বারা নিজের আখের গুছাতে চায়।

এই আন্দোলনের প্রতিটি ক্ষন আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। ইয়াযিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কোন সুযোগের অপেক্ষা না করে, কোন বিশাল সাহায্যের অপেক্ষা না করেই ইমাম তাঁর সংগ্রামী মঞ্চের মঞ্চায়নে নেমে পড়েন। সকলের চোখের সামনে দিয়েই তিনি তাঁর লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। মদিনা থেকে বের হওয়ার সময় তিনি কোন গোপন পথের সন্ধান না করে সকলের পরিচিত পথ দিয়ে চলা শুরু করেন। মক্কায় তিনি প্রকাশ্যেই সকলের সামনে ইয়াজিদের তিরস্কার করতে লাগলেন। মক্কা থেকে কুফার পথেও তিনি কোন গোপন পথের আশ্রয় নেননি। তাঁর পথ চলার এই নীতি থেকে আমাদের জন্য শিক্ষা হল, যখন জুলুমের বিরুদ্ধে মজলুম সংগ্রামে লিপ্ত হবে, তখন তার সকল কর্মপদ্ধতি হতে হবে সকলের বোধগম্য। কারণ, কোন আন্দোলনকে জনসাধারণের নিকট গ্রহণযোগ্য করতে হলে, তা জনতার সামনে পরিষ্কার থাকতে হবে।

তিনি তাঁর চলার পথে বলেছিলেন: “আমার এই বিদ্রোহ ক্ষমতার মসনদ হাসিলের জন্য নয়। আমার এই বিদ্রোহ আমার নানার সুন্নতকে সমুন্নত করার জন্য।” (খোরাযমী, খন্ড-১, পৃ ১৮৮; আবদুল্লাহ ইবনে নুরুদ্দিন বাহরানী(হিজরী বার শতকের ঐতিহাসিক), মাক্বতাল আল আওয়ালিম, পৃ. ১৭৯, তেহরান, ইরান)।

তাঁর এই কথার দ্বারাই তাঁর এই সুমহান আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমরা পরিষ্কার হতে পারি। এটা অধিকার আদায়ের সংগ্রামের আরেকটি বৈশিষ্ট। যে আন্দোলন আপামর জনতার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে চালিত হয়, তাঁর উদ্দেশ্য স¤পর্কে অবশ্যই জনতাকে স্পষ্ট থাকতে হবে। তাই অনুসারীদের নিকট তাঁর এই আন্দোলনের উদ্দেশ্যকে পরিষ্কার করা একজন বিচক্ষন নেতার পরিচয় বহন করে।

এবার তাকাব তাঁর কাফেলার দিকে। তাঁর এই বিদ্রোহী বহরে ছিলেন বনু হাশিমের সদস্যরা, তাঁর বোন, স্ত্রী, শিশু সস্তান এবং অন্যান্য সদস্যরা আর সামান্য কিছু অনুসারী। তাঁর কাফেলার দিকে তাকালেই আমরা বুঝতে পারব, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়া একজন নেতার আয়োজন কেমন হওয়া উচিত। যদি তাঁর সাথে আর কেউ না আসে, তবে তাঁর উচিত হাতের নিকট যা পাওয়া যাবে তাই নিয়ে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া। আর সেই কাজটিই করেছেন ইমাম হুসাইন। এর মাধ্যমে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে, জুলুমের বিরুদ্ধে আন্দোলনে এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কখনও দুনিয়ার সরঞ্জাম ও সহায়-সম্বলের অপেক্ষা করে হয় না।

এরপর আমরা দেখব, মক্কা থেকে ইমামের কুফার দিকে এগিয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলোর দিকে। এই যাত্রা পথে তিনি তাঁর কাফেলার সদস্যদেরকে ইয়াহিয়া(আ.) শাহাদাতের ঘটনা বর্ণনা করে উৎসাহিত করতে থাকলেন। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, একজন নেতার দায়িত্ব হল, অনুসারীদেরকে তাঁর আন্দোলনের জন্য প্রয়োজনীয় আত্মিক রসদ যোগান দেওয়া। এই আত্মিক রসদ হবে ঈমানের উপাদানে পরিপূর্ণ, সাহসিকতার অফুরন্ত উৎস আর উদ্দীপনার ফোয়ারা। ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন ইমাম হুসাইন।

এরপর আমরা দেখব, কুফার সন্নিকটে হুর ইবনে ইয়াজিদের বাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ ইমামের আচরণ। সেখানে উমাইয়্যা বাহিনির সৈন্যরা ছিল ক্লান্ত শ্রান্ত ও পিপাসার্ত। ইমাম তাদেরকে পানি দিলেন। তাদের সাথে সৌহার্দপূর্ণ ব্যবহার করলেন। তাদের সাথে সালাত আদায় করলেন। অবরুদ্ধতার এই সময়ে ইমামের একজন সঙ্গী শত্রæবাহিনীর উপর আক্রমণ করে তাদেরকে পরাস্থ করার পরামর্শ দিলে ইমাম তা নাকচ করে দেন এই বলে যে, “আমরা কখনই যুদ্ধ শুরু করবো না।” অর্থাৎ, অবরুদ্ধ ইমাম শত্রæদের সাথে কোনরূপ শত্রæতামূলক আচরণ প্রদর্শন করেননি। এর দ্বারা ইসলামি আন্দোলনের আরেকটি বৈশিষ্ট জানা যায়। তাহলো ইসলামি আন্দোলনের নেতা হবেন সার্বিক দিক থেকে রহমদিল। তাঁর অনুসারীদের জন্য তিনি যেমন হবেন সহনশীল, তেমনি বিরোধীদের প্রতিও হবেন বিনম্র। ইসলামি আন্দোলনের নেতার সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা থাকবে, আন্দোলনের বিরোধীদেরকে বিপ্লবের সপক্ষে নিয়ে আসার। ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন ইমাম হুসাইন।
যুদ্ধের দিনের পূর্বের রাতের ঘটনা। ইমাম যখন উমাইয়্যা বাহিনীর যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন, তখন তিনি তাদের কাছে একরাতের সময় চেয়ে নিলেন। এই রাতে তিনি আল্লাহর ইবাদতের জন্য নির্ধারিত করেন। এখানেই ইসলামি আন্দোলনের মৌলিক শিক্ষা নিহিত। এর দ্বারা তিনি এটাই প্রমাণ করেছেন, একজন ইসলামি আন্দোলনের নেতার সাথে আল্লাহর নিবিড় সম্পর্কের ব্যাপারটি। কারণ ইসলামি আন্দোলন যদি আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত না হয়, তাহলে সেটা দুনিয়ার জন্য লড়াইয়ে পরিণত হতে বাধ্য। এই আন্দোলনের নেতা কর্মীদেরকে হতে হবে সর্বাধিক তাকওয়াবান এবং ইবাদতের প্রতি একনিষ্ঠ। আল্লাহর ইবাদতই ইসলামি আন্দোলনের সারকথা। এখানেই নিহিত আছে এই সংগ্রামের গোপন রহস্য। সুকঠিন বিপদের মুহূর্তে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা এবং তাঁর থেকে নিজেদের অপরাধের ক্ষমা প্রার্থনাই ইসলামি আন্দোলনের মূল বিজয়। সুরা-নসর আমাদেরকে এই শিক্ষাই দিয়ে থাকে। এই সুন্নত আমরা রাসুল(সা.)-এর সময়কার প্রতিটি যুদ্ধে দেখেছি। এভাবেই ইমাম আলী এবং ইমাম হাসান ও তাঁদের সুকঠিন মুহূর্তগুলো আল্লাহর সান্নিধ্যে অশ্রæপাতের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেছিলেন।
আশুরার দিনে সকাল থেকে চলে আসা অসম এক যুদ্ধে যখন একের পর এক ইমামের সৈন্যরা শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করছিলেন, তখন ইমাম সুদৃঢ় ভঙ্গিতে ময়দানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সাথীদের শাহাদাত তাঁকে এক মুহূর্তের জন্যেও ময়দান থেকে চলে যাওয়ার জন্যে প্ররোচনা দেয়নি, যা আমরা অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে দেখতে পাই। সামান্য বাধার মুখে পতিত হয়ে তারা কর্মীদেরকে বিপদের সাগরে ডুবিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। আর ইমাম ছিলেন অবিচল। আর তাঁর অনুসারীদের আচরণ ছিল একটা আদর্শিক আন্দোলনের পরিপূর্ণ উদাহরণ। সেখানে কেউ একবারের জন্য পিছিয়ে যাওয়ার কথা কল্পনাও করেনি। শত্রæদের নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডে তারা প্রতি ধাপেই যেন সাহসী হয়ে উঠেছিলেন। কাফেলার নারী-শিশুরা যেন সেদিন অনন্য এক উপমা সৃষ্টির নেশায় মত্ত হয়েছিল। সেই যুদ্ধের দৃশ্যগুলো আল কোরআনের “বুনিয়ানুম মারসুস”-এর প্রতিচ্ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরেছিল। সেদিন শহিদ হওয়ার যে অমত্ত নেশা তাদেরকে পেয়ে বসেছিল, তা আজও পৃথিবীর কোন আন্দোলনের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। বদর, অহুদ, খন্দক, খায়বার, জঙ্গে জামাল, নাহারওয়ান, সিফফিন সকল দুর্জয় যুদ্ধের ইতিহাসকে সেদিন সেই বাহাত্তর জন সাহসী সস্তান হারিয়ে দিয়েছিল। এজন্যই ইমাম হুসাইন গর্ব করে বলেছিলেন- “আমার মতো এরকম সাহাবি আর কেউ পাননি।” সেদিনের সেই সাহসী সন্তানেরা পৃথিবীর বুকে যে উদাহরণের সৃষ্টি করেছিলেন, তাই আজ পর্যন্ত মুক্তিকামী মানুষের প্রেরনার অফুরন্ত উৎস হয়ে আছে।

এরপরে আসব আশুরা পরবর্তী আহলে বাইতের ভ‚মিকা নিয়ে। পৃথিবীর যে কোন যুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর, পরাজিত দলের অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ ব্যতীত অন্য কোন উদাহরণ আমাদের সামনে নেই। কিন্তু কারবালা ছিল তাঁর বিপরীত চিত্র। যুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে আহলে বাইত যে হয়ে উঠেছিল আরও দুর্দান্ত। উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের দরবার থেকে শুরু করে সিরিয়া যাত্রা পথে এবং ইয়াজিদের দরবারে বিবি যয়নাবের ভ‚মিকা বিশ্ববাসীকে সত্যিই হতবাক করে দিয়েছিল। শত্রæরা ভেবেছিল, হুসাইনের হত্যার সাথে সাথে তাদের মসনদে আর কোন শঙ্কা থাকল না। তারা এখন নিশ্চিন্তে জনগণের সম্পদ ভক্ষন করে পার পেয়ে যাবে। কিন্তু, তর্ক যুদ্ধে ইমাম জয়নুল আবেদিন ও হযরত যয়নাবের সাথে শোচনীয় পরাজয়ের পর উমাইয়্যাদের আর বুঝতে বাকি রইল না যে, তাদের পরাজয়ের যুদ্ধ সবে মাত্র শুরু হল।
মূলত: কারবালার যুদ্ধ শুরু-ই হয়েছিল, আশুরার পর থেকে। আহলে বাইতের দ্বারা এই হত্যাকান্ডের প্রচারই মানবজাতিকে এর স্বরূপ সম্পর্কে অবহিত করেছিল। তাঁদের কথা, কর্ম, বক্তৃতা এবং মানুষের প্রতি নসিহত কারবালাকে আরও বেগবান করেছিল। কারবালা ছড়িয়ে পড়েছিল দিক বিদিক। এই ইতিহাস মানুষের আবেগকে আন্দোলিত করেছিল। আর এই আন্দোলনের ফসলই হল, আজকে আমাদের হুসাইনের শোকে একত্রিত হওয়া। এটাই ছিল কারবালার যুদ্ধ, যা আজও চলছে, আগামিতেও চলবে। যতদিন জাহেলিয়াতের বিচরণ সমাপ্ত হয়ে আলোকের সূর্য উদিত না হবে, ততদিন হুসাইনীরা বসে থাকবে না। বসে থাকার কোন সুযোগ তাদের নেই। এটাই কারবালার আবেদন। এটাই কারবালার হক- যা আমাদেরকে আদায় করতে হবে।

আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, হুসাইনের ত্যাগ আমাদের জন্য যে প্রেরণা সেই প্রেরণার হক তখনই আদায় হবে যখন হুসাইনের সস্তান ইমাম মুহাম্মদ আল-মাহ্দী(আ.)-এর আগমনের ক্ষেত্রকে প্রস্তুত করা যাবে। হুসাইনী আন্দোলনের কর্মীদের এখন একটাই কাজ। তাহলো আরও একটি কারবালার জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করা এবং সেই লক্ষ্য পানে অবিরাম এগিয়ে চলা।

 

পর্ব দুইঃ

কারবালা ভালোবাসার অনন্য এক উদাহরণ

🔲⬛🔲⬛🔲⬛🔲⬛🔲⬛🔲⬛🔲⬛

আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যতগুলো বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে, তার প্রতিটি আন্দোলনের নেতা ও কর্মীদের মধ্যে আত্মিক সম্পর্কের মাধ্যমেই কলেবরে বেড়ে উঠেছে। যেখানে নেতা কর্মীদের কাছে স্বচ্ছ হয়নি বা কর্মীরা নেতার প্রতি আস্থাশীল থাকতে পারেনি, সেখানে সকল আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য।

নেতা এবং কর্মীদের মধ্যকার সম্পর্কের উপযুক্ত উদাহরণ আমরা দেখতে পাই কারবালার ময়দানে। ইমামের প্রতি ভালোবাসা ও আস্থার যে চিত্র সেদিন ঐ তপ্ত দুপুরে চিত্রিত হয়েছিল, তা পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য ও বিরল।

এই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ শুধু যে কারবালার ময়দানেই ঘটেছিল তা নয়। ইয়ায়জিদের দরবার থেকে বাইয়াত গ্রহণের ফরমান আসার পর থেকেই ইমামের সাথীরা কারবালার হত্যাযজ্ঞ পর্যন্ত তাঁকে যেভাবে ভালবেসেছেন, তার নজির আর কোন ইতিহাসে দেখতে পাওয়া যায় না। মদিনা থেকে মক্কা এবং মক্কা থেকে কুফা পর্যন্ত ইমামতের বিশ্বাসীদের ভালোবাসার প্রকাশ আমাদেরকে সত্যিই হতবাক করে দেয়। আমরা এই বিরল ইতিহাসগুলো থেকে সামান্য কিছু উদাহরণ আপনাদের সামনে পেশ করবো, ইনশাল্লাহ।
এই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশে যে নামগুলো ঘুরে ফিরে আমাদের সামনে ভেসে আসে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম কিছু নাম ছিল মুসলিম ইবনে আকিল, কায়েস ইবনে মুসাহহার, সুলাইমান ইবনে খুর্দ খাজাই, হাবিব বিন মাযাহির, হুর ইবনে ইয়াজিদ, আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর।

আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর
তিনি ছিলেন বিবি যয়নাবের স্বামী। তার পিতা ছিলেন জা’ফার বিন আবু তালিব, ইমাম আলীরর ভাই এবং মু’তার প্রান্তরের শহীদ। যার শাহাদাতের ঘটনায় আল্লার রাসুল(সা.) এতটা মর্মাহত হয়েছিলেন যে, আরবের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী মাথায় বালি ছিটিয়ে শোক পালন করেছিলেন। আব্দুল্লাহ ছিলেন মদিনার সম্পদশালীদের মধ্যে অন্যতম। কারবালার যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন অসুস্থ। তাই ইমামের সফরে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। কিন্তু তার ত্যাগ ছিল অপরিসীম। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইব্রাহীম(আ.) থেকে যে কুরবানির কথা বলেছিলেন, তিনি স্বেচ্ছায় সেই কুরবানি দিয়েছেন। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুযায়ী, বিবি যয়নাব যখন প্রাণপ্রিয় ভাই ইমাম হুসাইনের সাথে সফরে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করতে যান তখন আব্দুল্লাহ বলেন, “হে ফাতিমার কন্যা! আপনাকে আমি কখনও কিছুতেই বারন করিনি। আজ যদি আমি সুস্থ্য থাকতাম, তাহলে অবশ্যই হুসাইনের সাথে যেতাম। হায়! আমার সেই ভাগ্য হল না। আপনি তাঁর সঙ্গি হন। সাথে করে আমাদের দুই সন্তানকে নিয়ে যান। যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে এদেও একজনকে আমার পক্ষ থেকে এবং অপরজনকে আপনার পক্ষ থেকে হুসাইনের জন্য কুরবান করে দেবেন।”

হাবিব বিন মাযাহির
শেষ রাতে ইমামের কাফেলা যখন ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্যে আবেগ-আপ্লুত রাত অতিবাহিত করছিল, সেই সময়ে ইমামের জন্য নিবেদিত প্রাণ কিছু সৈনিক আগামি দিনের কার্যক্রম নিয়ে পারস্পরিক আলোচনা করছিলেন। ইতিহাসে এসেছে সে রাতে বিবি যয়নাব প্রতিটি তাবু গিয়ে শুনছিলেন কাদের সাথে কি কথা চলছে। ঘুরতে ঘুরতে তিনি চলে আসলেন হাবিব বিন মাযাহিরের তাবুতে। তিনি তার গোত্রের লোকদেরকে নিয়ে আলোচনা করছেন, আগামি দিন ইমামরে পক্ষে তাদের ভ‚মিকা কি হবে। সেখানে হাবিব বিন মাযাহির বক্তব্য রাখছিলেন, “হে আমার বন্ধুরা! জেনে রেখো, আগামি কাল সকালেই আমরা এমন এক অসম যুদ্ধের মোকাবেলা করতে যাচ্ছি যার পরিণতি শাহাদাত ব্যতীত আর কিছুই নয়। এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়। মনে রেখো যদি ইমাম এবং তার পরিবার আমাদের পূর্বে শাহাদাতের পেয়ালা পান করে নেয়, তাহলে তোমাদের বেঁচে থাকার আর কোন অর্থ থাকতে পারেনা। আমাদের একজনের দেহেও প্রাণ থাকার পূর্বে, আমরা বনু হাশিমের একজনকেও ময়দানে নামতে দেব না। এসো! ওয়াদা করি। জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও আমরা ইমাম এবং আহলে বাইতের জীবন রক্ষা করে যাব। আর এই দায়িত্ব পালন করতে করতেই জান্নাতের দিকে এগিয়ে যাব।” ইতিহাসে এসেছে আশুরার পূর্বের রাতে হাবিব বিন মাযাহিরকে দারুন উল্লাসিত দেখাচ্ছিল। কারণ জানতে চাইলে তিনি জবাব দিতেন, “যার অভিনন্দনের জন্য জান্নাতে হুরেরা অপেক্ষা করছে, তার আমার দুঃখ কিসের!”
হুর ইবনে ইয়াযিদ আর-রিয়াহি
তিনি উমাইয়্যা বাহিনীর একজন সেনা অধিনায়ক। কুফার সন্নিকটে ইমামের কাফেলাকে অবরুদ্ধ করার নায়ক ছিল হুর। সে ছিল সাহসী, সৎ এবং আবেগী। যুদ্ধের আগের দিন তিনি উমার বিন স্বাদ কে জিজ্ঞাসা করলেন, “কাল কি সত্যিই রাসুলের সন্তানের সাথে যুদ্ধ হবে? কোন ভাবেই কি এই যুদ্ধকে এড়িয়ে যাওয়া যায়না?” উমার বিন স্বাদ তাঁকে তিরস্কার করেন। ইমামের কাফেলাকে আটকে দিয়ে হুর ইবনে ইয়াজিদ শান্তিতে থাকতে পারেনি। উমার বিন সাদের নেতৃত্বে থাকা হুর বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। যে ব্যক্তি তাঁর সকল সৈন্যকে এবং ঘোরাগুলোকে পানি পান করিয়েছিল, তাঁর বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করতে হবে! তার উপর তিনি হলেন রাসুল(সা.)-এর আদরের নাতি, কলিজার টুকরা। কোন ভাবেই তিনি এটা মেনে নিতে পারছিলেন না। উমার বিন সাদের সাথে বিতর্ক শেষে তিনি স্বীয় তাবুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে ভাইয়ের সাথে সাক্ষাত হল। তার ভাই হুরকে দেখে বলল, “হে ভাই! আপনাকে আমি আরবের অন্যতম যোদ্ধা বলে জানতাম। কিন্তু আপনার বর্তমান অবস্থা আমাকে এ ব্যাপারে সন্দেহে ফেলে দিচ্ছে। আপনি এতো টালমাটাল অবস্থায় কেন?” খেতে যাওয়ার কথা বলতেই হুর বলে উঠলেন, “তুমি কি শুনতে পাচ্ছ না, হুসাইনের তাবু থেকে তৃষ্ণার্ত শিশুদের আর্তচিৎকার! ক্ষুধার্ত শিশুদের কান্না কি তোমার কানে আসে না! এ অবস্থায় আমি কিভাবে খাবার গ্রহন করতে পারি? আল্লাহর কসম! আমি নিজেকে জান্নাত এবং জাহান্নামের মাঝখানে দেখতে পাচ্ছি। হায়, যদি আমি হুসাইনকে বাধা না দিতাম। হায়, যদি আমি হুসাইনের সাথে দূর্ব্যবহার না করতাম। আমি কাল সকালেই হুসাইনের পক্ষে যুদ্ধ করবো।” ভাই বলল, “এটাই কি ভালো নয় যে, আমরা রাতের আঁধারে হুসাইনের সাথে যোগ দিব?” তিনি বললেন, “না। আমি কাপুরুষ নই। সকলের সামনে দিয়েই আমি স্বর্গের পানে যাব।”
পরদিন সকালে যখন হুর, তার ছেলে এবং ভৃত্য, ইমামের কাফেলার দিকে রওনা হলেন তখন উমার বিন সাদ তাঁকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে হুর দ্রæতবেগে ঘোড়া দৌড়িয়ে যেতে যেতে বললেন কার এতো সাহস যে আমাকে বাধা দিবে? কিছুদুর এগিয়ে যাওয়ার পর হুর পিছু ফিরে তাকালে ছেলে জিজ্ঞাসা করল, “কি হল বাবা! আপনি পিছনে ফিরলেন যে!” হুর বললেন, “ইমামের সাথে আমি যে বেয়াদবি করেছি, তাতে ইমামের সামনে মুখ দেখানোর উপায় নেই। তোমরা আমার হাত এবং চোখ বেধে দাও। আমি ইমামের নিকট ক্ষমা চাইব।” তারা তিনজন এই অবস্থায় ইমামের সামনে হাজির হলেন, ক্ষমা চাইলেন এবং ইমাম তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন।
ইমামের ক্রীতদাস জুন কারবালার শহীদদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন জুন। তিনি ছিলেন আবুযার আল-গিফারির ক্রীতদাস। আবুযার তাঁকে মুক্ত করে দিলে তিনি আহলে বাইতের খেদমতে থেকে যান। এই মহান ব্যক্তি কারবালার প্রান্তরে ইমাম(আ.)-এর কাফেলার সাথে ছিলেন এবং ইমামের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। কারবালায় যুদ্ধ চলাকালীন এক পর্যায়ে এসে তিনি ইমামের কাছে যুদ্ধের অনুমতি চাইলে ইমাম তাঁকে অনুমতি দেননি। তখন জুন বলল, “আমি বুঝতে পেরেছি মাওলা। কেন আপনি আমাকে যুদ্ধের অনুমতি দিচ্ছেন না। আমি কালো। আমার শরীর থেকে গন্ধ আসে। লোকেরা এমনটিই বলে। এই শাহদাত আমার ভাগ্যে কি আছে? আমি কোথায় আর এই মহান ব্যক্তিরা কোথায়। তাই আপনি আমাকে অনুমতি দিচ্ছেন না।” ইমাম দেখলেন এখন আর তাঁকে অনুমতি না দিয়ে পারা না।

তিনি তাঁকে অনুমতি দিলেন। মুখে বিরত্বের কবিতা আবৃতি করতে করতে তিনি ময়দানের দিকে এগিয়ে গেলেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে জুন ভীষণ আহত হয়ে মাতিতে লুটিয়ে পড়লেন। ইমাম তার নিকট গেলেন এবং তাঁকে উরুর উপর রেখে তার অবস্থা জানতে চাইলেন। ক্ষতের কারণে জুনের চোখে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছিল। ইমাম তার চোখ থেকে রক্ত সরিয়ে নিলে ইমামের পবিত্র চেহারা মোবারক দেখে জুন হাঁসতে থাকেন আর এই অবস্থায় শাহাদাত বরণ করেন। ইমাম বেদনায় মুহ্য হয়ে তার জন্য দোয়া করলেন, “হে আল্লাহ! তাঁকে তুমি আখেরাতে সাদা চামড়া দান কর। তাঁকে আরবদের সাথে শামিল করে উত্থিত কর।”
আব্দুল্লাহ ইবনে উমাইর ইমামের সাথে উমাইয়্যা খেলাফতের দন্ধের সময় তিনি কুফার বাইরে ছিলেন। কুফায় এসে তিনি শুনলেন ইমাম হুসাইনের সাথে কি যেন গন্ডগোল হয়েছে। সব শুনে তিনি ইমামের পক্ষে যুদ্ধে যাওয়ার সংকল্প করলেন। বাড়িতে ফিরে তিনি স্ত্রীর নিকট যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন। কিন্তু স্ত্রী তাকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছিল না। এমন সময় মা এসে আব্দুল্লাহ ইবনে উমাইরকে স্ত্রীর কথায় কান না দিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে বললেন। স্ত্রী ও মাকে নিয়ে তিনি কারবালার পানে ছুটলেন।
যুদ্ধের ময়দানের ঘটনা। ইমাম থেকে যুদ্ধের অনুমতি নিয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে উমাইর যুদ্ধের ময়দানে গেলেন। শত্রুর পানে ছুটে গেলেন ইবনে উমাইর এবং বীরবিক্রমে লড়তে থাকেন। কিছুক্ষন যুদ্ধের পর শত্রুর তরবারির আঘাতে তাঁর হাতের পাঁচটি আক্সগুল কাটা পড়ে যায়। আরেক হাতে তরবারি নিয়ে তিনি যুদ্ধে বিরতি দিয়ে তাবুতে মায়ের নিকট ফিরে আসলেন। বললেন, “মা! তোমার হুসাইনের জন্য আমি আমার হাতের পাঁচটি আঙুল বিসর্জন দিয়ে এসেছি। বল, আমার ত্যাগ কবুল হয়েছে কিনা।” স্ত্রী স্বামীর এমন অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। কিন্তু মা তাঁর এই ত্যাগে সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি রাগত স্বরে বলে উঠলেন, “আমি তোমাকে শুধু হাতের পাঁচটি আক্সগুল বিসর্জন দেয়ার জন্য যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রেরণ করিনি। ফিরে যাও যুদ্ধের দিকে। মনে রেখো! হুসাইনের জন্য জীবন বিসর্জন দেয়া ব্যতীত আর কোন ত্যাগ আজকে কবুল করা হবে না।”

মায়ের কথায় আব্দুল্লাহ্র দেহে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। অসীম সাহসিকতার সাথে আব্দুল্লাহ আবারও ময়দানে ফিরে আসলেন। একের পর এক শত্রæ সেনার বুহ্য ভেদ করে আব্দুল্লাহ এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর লক্ষ্য শাহাদাতের দিকে। তাঁর প্রবল আক্রমনে টিকতে না পেরে উমার বিন স্বাদ সৈন্যদেরকে সম্মিলিত আক্রমণের নির্দেশ দেয়। এমন পৈশাচিক ঘটনা ইতিহাসের পাতায় পুন: পুন: দেখা যায়। যখন সিংহের আক্রমনে নেকড়ে ময়দানে টিকতে পারে না, তখন চারপাশ থেকে তারা হামলা করে। এমন উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে অসংখ্য। সত্যের পতাকাতলে সেদিন যেই সিংহরা মিলিত হয়েছিল, তারা বুঝতে পেরেছিল, তারা শের-এ-খোদার সন্তানের সঙ্গী হয়েছেন। জীবনের এই অমিয় সুধা যারাই পান করেছে, তাঁরা চিরদিনের জন্য তৃপ্ত হয়েছে। সেই অমিয় তৃপ্তি সেদিন ঐ শতাধিক জনকে মৃত্যুযন্ত্রণা যে বুঝতেই দেয়নি, সেই অনুভ‚তি আর কেউ বুঝতে পারবে কি? কোন নেশা সেদিন তাঁদের অন্তরে ছিল তা শুধু তাঁদের ইমাম জানেন আর জানেন তাঁরা। যাই হোক, শত্রæর আক্রমনে টিকতে না পেরে আব্দুল্লাহ নিহত হলেন।
শত্রæরা তাঁর দেহকে অবমানিত করলো। তাঁর মস্তক বিচ্ছিন্ন করে তাঁর মায়ের দিকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “এই নে, তোর ছেলে তোকে ফিরিয়ে দিলাম।” কি হয়েছিল সেদিন! কি পাবার আশায় সেদিন হুসাইনের কাফেলার নারী পুরুষেরা মত্ত হয়েছিল? আসলে স্বর্গীয় নেশা যাকে পেয়ে বসে, তাঁর কী আর কোন কিছুর প্রয়োজন হয়? এমনই নেশায় মত্ত হয়েছিলেন আব্দুল্লাহ এবং তাঁর মা। কর্তিত মস্তকের নিকট গর্বিত মা নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন শহিদ সন্তানের মাথার কাছে। মাটি থেকে সন্তানের মাথা তুলে নিয়ে ধুলো বালি ঝেড়ে ঠোঁটে চুমু খেলেন। অশ্রæ যেন তখন অহংকারের রূপ ধারন করছিল। কারন, তাঁর মতো ত্যাগ আর কে পারবে? জীবনের বৃদ্ধ বয়সের সম্বল সন্তান বিসর্জন করেছেন হুসাইনের জন্য। বিদ্রোহের আগুন যেন নতুন রূপে জেগে উঠলো। সন্তানের মস্তক শত্রæদের দিকে ছুঁড়ে বললেন, “আমরা যা একবার আল্লাহর পথে দান করি, তা কখনও ফিরিয়ে নেই না।”

উমর ইবনে কোরযার
তার শাহাদাত যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে হয়নি। তার শাহাদাতের সময়টি ছিল ইমামের শেষ সালাতে তাঁকে রক্ষা করতে গিয়ে। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে, নামাযের ওয়াক্ত হয়ে গেলে, উমর ইবনে কোরযা ইমামের নিকট এসে বললেন, “হে ইমাম! সালাতের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। মনে বড় স্বাদ, জীবনের শেষ নামাযটা যদি আপনার পিছনে পড়ার সৌভাগ্য হতো!” ইমাম বললেন, “তোমাকে ধন্যবাদ! আল্লাহ্ তোমাকে এর জন্য উত্তম প্রতিদান দিক। সালাতের ব্যবস্থা কর।”

সালাতের ব্যবস্থা হোল। কিন্তু উমর ইবনে কোরযা সালাতে অংশ গ্রহণ করতে পারলেন না। ইমাম ও তাঁর পিছনে দাঁড়ানো লোকদের নিরাপত্তার জন্য তিনি শত্রæদের মুখোমুখি প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হটাৎ শত্রæরা হামলা করলো। কিন্তু যাঁদের জীবনে ইমাম ব্যতীত আর কিছু থাকে না, যারা সকল কিছুর বিনিময় করতে রাজি শুধু ইমামের নিরাপত্তার জন্য তাঁদের বেষ্টনী অতিক্রম করা কি এতোই সহজ! এখানেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। শত্রæদের সুযোগসন্ধানী হামলায় অনেকেই আহত হলেন, আর উমরের বক্ষ বর্শার আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। আফসোস! যে নামাযের জন্য উমর তাগিদ দিল তাঁর শেষ নামায পড়া আর হোল না। কিন্তু উমরের কি আফসোস ছিল?
অবশ্যই না। কারণ সালাত হোল মিলন। যে মিলনে স্বাদ নেই, প্রেম নেই, তাকে কি আর মিলন বলা যায়? উমরের মিলন ছিল ইমামের সাথে। তাই আমরা দেখলাম, ইমাম যখন তাঁর আহত দেহ কোলে নিলেন, তখন উমর শান্তির ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। এর চাইতে উত্তম সালাত আর কি হতে পারে? ইমাম তাঁর জন্য দোয়া করে সৈন্যদের নিকট চলে গেলেন।
প্রকৃতপক্ষে আপনাদের সামনে আমি শোঁকের যে আবহ তৈরি করেছি, তার উদ্দেশ্য ভিন্ন। আজকে আমি এমন কিছু অতিতকে তুলে ধরেছি, যেগুলো আমাদেরকে প্রেরনা যোগাবে। কারবালার সেই উত্তপ্ত ময়দানে ভালোবাসার যে তবাররুক বিতরন হয়েছিল তা আজ ঘুরে ফিরে আমাদের নিকট এসেছে। আমরা তা হাতে নিয়েছি। এখন খাবার পালা। যদি ভালোবাসার এই তবাররুক আমরা গ্রহণ না করি অথবা এর হক আদায় না করতে পারি তাহলে এই শোঁকের পরিবেশ ব্যর্থ হবে। তাঁরা তাঁদের কাজ করেছেন। জীবনের সকল কিছুর বিসর্জনে তাঁরা তাঁদের ইমামের প্রতি ভালোবাসা প্রমাণ করেছেন। এখন আমাদের পালা। আমাদেরকে আমাদের ইমামের প্রতি ভালোবাসার প্রমাণ দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, কারবালা ভালোবাসার সেই ময়দান, যেখানে নিঃস্বার্থতা আদান প্রদান হয়েছে। আমাদেরকেও এমন নিঃস্বার্থ ভালোবাসার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে হবে।
:- মোস্তাফা কামাল সুমন
চলবে…..

পর্ব তিনঃ কারবালা অমর প্রেমের উপন্যাস

🔲⬛🔲⬛🔲⬛🔲⬛🔲⬛🔲⬛🔲⬛

কারবালা এমন এক প্রেমের উপন্যাস যার চয়নেই বুঝা যায়, কিভাবে এই ময়দানে আশেক ও মাসুক তাঁদের প্রেম নিবেদন করেছিল। এই ঘটনার প্রতিটি পরতে জড়িয়ে আছে ভালোবাসার অমোঘ কাহিনী। এমন কোন শহীদ কারবালায় ছিলেন না যে প্রেম নিবেদন না করে যুদ্ধে গমন করেছিল। শুধু শহীদেরাই যে প্রেম নিবেদন করেছিল তা নয়। শহীদদের পরিবারের নারী শিশুরাও এর সাথে সমান তালে শামিল ছিলেন। কারবালার ঘটনা প্রবাহ দেখে মনে হয়, সবাই যেন প্রতিযোগিতায় নেমে ছিল কে ইমামকে কত বেশি ভালোবাসা প্রদর্শন করতে পারে।
যতবার কারবালা নিয়ে আমি পড়েছি, অবাক হয়েছি। এখানে ভালোবাসা বেদনার ন্যায় এমন ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল যে, মিলনের পর পর বিচ্ছেদের এই ব্যতিক্রমি প্রেম পৃথিবীর ইতিহাসে আর একটিও নেই। কারবালা প্রেমের এমন ক্ষেত্র ছিল যেখানে কোন লোক লজ্জার ভয় কাজ করেনি, কোন শঙ্কা বোধ ছিল না ইমামের কোন প্রেমিকদের মনে। তাঁদের এই নিবেদন ছিল প্রকাশ্য এবং সুউচ্চ কন্ঠে। আর তা কারবালার আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয়েছিল। কারবালায় শাহাদাত ও ইমাম প্রেমিক মানুষদের মধ্য থেকে আমরা এমন দুটি ভালোবাসার কাহিনী আপনাদের সামনে তুলে ধরব।

আবিস বিন আবি শাবিব
ঐতিহাসিকরা বলেছেন যে, আবিস বিন আবি শাবিব তাঁর আত্মীয় শওযিব-এর নিকট এসে বলল, “তোমার অন্তরের ইচ্ছা কি?” শওযিব বলল, “আমার ইচ্ছা হল রাসুল(সা.)-এর নাতির হেফাজতের সময় আমি যদি তোমার পাশে থেকে শহীদ হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ করতে পারতাম।” আবিস বলল, “আমিও তোমার মতোই ইচ্ছা পোষণ করি। চল, আমি তোমাকে ইমামের নিকট নিয়ে যাই এবং পরিচয় করিয়ে দেই, যাতে তিনি তোমাকে তাঁর সাহাবীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নেন এবং তুমি তাঁর পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করতে পার। এখন যদি তুমি ব্যতীত আমার নিকটে আপন কেউ থাকতো, তাহলে আমি তাঁকে আমার পূর্বে যুদ্ধে পাঠাতাম, যেন আমি তাঁর শাহাদাতে শোক পালন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি। মনে রেখো! এটাই আমাদের শেষ কথা। আজকের দিনের পর আমাদের আর কোন কাজ থাকবে না।” এরপর শওযিব এগিয়ে গিয়ে ইমাম-কে সালাম দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে চলে গেলেন এবং বীরত্বের সাথে লড়াই করে শাহাদাত বরণ করলেন।

এরপর আবিস বিন আবি শাবিব ইমাম-কে বললেন, “হে আবা আব্দুল্লাহ্! এই দুনিয়ায় আমার নিকটাঅত্মীয় ও আপনজন এমন কেউ নেই যে, সে আপনার চেয়ে আমার নিকট অধিক প্রিয়। যদি আপনাকে সুরক্ষা করার জন্য এই জীবন ব্যতীত আমার নিকট আর অন্য কোন ক্ষমতা থাকতো তাহলে অবশ্যই আমি তা ব্যবহার করতাম। আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক হে আবা আব্দুল্লাহ! আল্লাহর কসম করে বলছি যে, আমি আপনার পিতা ও আপনার অনুসারী।” এই কথা বলেই তিনি তরবারি হাতে নিলেন এবং মাথার উপর তরবারি উঁচিয়ে শত্রæর পানে ছুটে গেলেন।

এমনই হবে প্রেমের নিবেদন। যেখানে আশেক তাঁর মাশুককে চিরদিনের জন্য আপন করে নিবে সেখানে আবেগের এমন বহিঃপ্রকাশ খুবই স্বাভাবিক। প্রেমের আবেদনই এমন। এ ধরনের আবেগের অতিসহ্য যদি না থাকে তবে প্রেম মেকি গন্য হয়। রাসুল(সা.) থেকে শুরু করে ইমাম হুসাইন পর্যন্ত খাঁটি প্রেমের রসায়নের পাশাপাশি অনেক মেকি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশও আমরা বহুবার দেখেছি। কারবালার শহীদদের এই উক্তিগুলো দেখে মনে পড়ে যায় বদরের সেই নিবেদিতপ্রান সাহাবীদের কথা। সেদিন তাঁদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ রাসুল(সা.)-কে বলেছিলেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ্! আমরা মুসার অনুসারীদের মতো আপনাকে বলব না যে আপনি এবং আপনার খোদা গিয়ে যুদ্ধ করুন। আমরা আপনার সাথে থাকবো এবং মরনপণ লড়াই চালিয়ে যাবো।” এর ব্যতিক্রম কারবালাতেও হয়নি।

আবিস বিন আবি শাবিবের বীরত্বের কথা উমাইয়্যা বাহিনির জানা ছিল এবং তাঁদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠলো, “হে লোকেরা! জেনে রেখো সে সিংহ দলের এক সিংহ। সে হল আবু শাবিবের পুত্র।” আবিস শত্রæদের দিকে হুংকার দিয়ে বললেন, “কে আছো আমার সাথে লড়াই করার সাহস রাখে?” উমার বিন স্বাদ একথা শুনে সবাইকে তাঁর দিকে পাথর ছুঁড়ে মারার নির্দেশ দিলে তাঁর দিকে পাথরের বৃষ্টি ঝরতে লাগলো। এটা দেখে তিনি ঢাল এবং যুদ্ধের টুপি পড়ে নিলেন। এরপর তিনি প্রবল বেগে আক্রমন শুরু করে দিলেন। ইতিহাসে এসেছে তিনি একাই দুইশত সৈন্যের মিলিত আক্রমণকে প্রতিহত করেছিলেন। তাঁর আক্রমনের সাথে না পেরে উমাইয়্যা বাহিনী সম্মিলিত হামলা করল। এতে তিনি ভীষণ আহত হয়ে মাটিতে পড়ে যান এবং শাহাদাত বরণ করেন। শত্রæরা তাঁর দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে উল্লাসে ফেটে পড়ছিল। লানাতুল্লাহি আলাল কাওমিয যালেমিন।

বুরাইর হামদানি
মহররমের দশম দিবসে তৃষ্ণার যন্ত্রনা ইমাম হুসাইনের কাফেলার নারী ও শিশুদেরকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। বিশেষ করে শিশুরা এই যন্ত্রনা কোনভাবেই সহ্য করতে পারছিল না। তাঁদের চিৎকার কারবালার আকাশ বাতাসকে ভারী করে তুলেছিল। শত্রæদের অন্তর তবু বিগলিত হয়নি। এমনটা আমরা তাঁদের কাছে আশাও করিনা। কারণ উমাইয়্যারা কখনও মানবিকতার কোন মূল্য দেয়নি। মানুষের প্রতি দয়া করার নীতিকে তারা জাহেলিয়াতের যুগ থেকেই দুপায়ে দলিত করে এসেছিল। এই নীতির পরিবর্তন তাদের অন্তরকে খান খান করে দিয়েছিল বলেই কারবালায় তারা রাসুল(সা.) ও হযরত আলী’র বংশের প্রদীপ শহীদদের নেতা ইমাম হুসাইনের প্রতি এতটা নিষ্ঠুর হয়েছিল। আর নিষ্ঠুরতা উমাইয়্যাদের ঐতিহ্য। এতে তাঁরা উল্লাসিত হয়। এর প্রতিচ্ছবি পূর্ণ রূপেই কারবালায় প্রতিফলিত হয়েছিল।
যাই হোক, তৃষ্ণা যদি এক বেলার হয় তবে তা সহ্য করে নেয়া যায়। কিন্তু তিনদিনের তৃষ্ণা কিভাবে সহ্য হয়। কিভাবে সম্ভব মরুর উতপ্ত খড়ায় পানি ব্যতীত থাকা। শিশুদের চিৎকারও ধিরে ধিরে ক্ষীন হয়ে আসছিল। মরুর মরীচিকায় কোন আশার আলো যেন পাওয়া যাচ্ছিল না। নিরাশার দোলাচলে সেই অবুজ শিশুরা কি বুঝতে পারছিল কি হচ্ছে এখানে। কি ঘটছে তাঁদের জীবনে। পিতা, ভাইহারা এসকল শিশুরা কি ভাবছিল। কেন ফুফু যয়নব আমাদের পানি দিচ্ছেন না। কেন চাচা আব্বাস পানি আনবে বলেও আসলেন না?

শিশুদের যন্ত্রনা বুরাইর হামদানিকে কোনভাবেই স্বস্থি দিচ্ছিল না। শিশুদের আল-আতাশ! আল-আতাশ চিৎকার তাকে অস্থির করে তোলে। আশুরার পূর্ব রাতের ঘটনা এটি। তিনি একটি মশক হাতে নিয়ে ফোরাতের তীরে গেলেন। ফোরাতের তীর থেকে পানি সংগ্রহ করলেন। নিজে পানি পান করলেন না। ভাবলেন কিভাবে তৃষ্ণার্ত শিশুদের পানি পান না করিয়ে তিনি পানি পান করবেন।

এর নাম ভালোবাসা। এর নাম প্রেম। মানুষ যখন প্রেমে পড়ে তখন শুধু মাশুকের চিন্তাই তাঁর থাকে না। মাশুকের চতুরপাশে থাকা সকল কিছুই তাঁর ভালোবাসার কেন্দ্র হয়ে যায়। নিঃস্বার্থ ভালবাসায় সে তখন নিজেকে ভাসিয়ে নেয়ার অনন্তর প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। কোন কিছু তাঁর কাছে বাধা মনে হয় না।
ইতিহাসে এমন অনেক কাহিনী আমরা দেখতে পাই। সিফফিন, জামাল, বদর, উহুদ সকল যুদ্ধেই ভালোবাসার অকৃত্রিম পরাকাষ্ঠা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এখানেও এর ব্যতিক্রম হয় নি। বুরাইর তাঁর ভালোবাসা প্রকাশের মোক্ষম সুযোগ পেয়ে পানি আনার অসম্ভব কাজটি করার সংকল্প করে বসলেন। সে মতেই এগিয়ে গেলেন। পানি নিয়ে যখন তাবুর দিকে ফিরে আসবেন, এমন সময় পথের মাঝে দুজন শত্রæ সেনা বাধা দিয়ে বললো: “এখান থেকে হুসাইনের তাবুতে কোন পানি নেয়া যাবে না।” তিনি তাঁদের বাধা উপেক্ষা করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। তারাও তাঁকে প্রতিরোধ করতে চাইলে তাঁদের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। বুরাইর তাঁদের দুজনকেই হত্যা করেন। তিনি পানির মশক ইমামের তাবুতে নিয়ে আসতে সক্ষম হলেন।
হযরত ফিযযাকে ডেকে তিনি পানির মশক হাতে দিলেন এবং শিশুদেরকে পানি পান করানোর জন্য বললেন। সেখানে আনুমানিক পঞ্চাশের মতো শিশু ছিল। তাঁরা সকলেই ছিল তৃষ্ণার্ত। যেই মাত্র তাঁরা পানি আসার কথা শুনল, তাঁরা ছুটে গিয়ে পানির মশক নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে লাগলো। কাড়াকাড়ির এক পর্যায়ে পানির মশক মাটিতে পড়ে গেলে সব পানি বিক্ষিপ্তভাবে মরুর বালির সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। শিশুরা হতাশায় বিমর্ষ হয়ে পড়ে যাওয়া পানির দিকে চেয়ে রইলো।

এই ঘটনা দেখে বুরাইর এতটা বিমর্ষ হলেন এবং দুঃখ পেলেন যে, আল্লাহ দরবারে হাত তুলে আর্তনাদ করে উঠলেন, “হে আল্লাহ! আজ তোমার এই বান্দা আশা করেছিল, হুসাইনের বাচ্চাদের দুয়া অর্জন করবে। হায়! হামদানির পুত্র বুরাইর কতোই না অভাগা।” ইমাম এই আর্তনাদ শুনে বললেন, “হে আমার বন্ধু! তোমার সাহসী পদক্ষেপের জন্য তুমি ফাতিমার পুত্রের দোয়া অর্জন করেছ।”
আসুন আমরাও তাদের মতো হই, যারা ইমামের ভালোবাসায় নিজেদেরকে সেদিন উজাড় করে দিয়েছিলেন। তাঁদের সকল কিছুর কেন্দ্রবিন্দু যেন ছিল সেদিন ইমাম ও তাঁর পরিবার। আমাদেরকেও আমাদের ইমামের প্রতি ভালোবাসার এমন নজির স্থাপন করতে হবে। এটাই কারবালার দাবী। আর আমাদেরকে সেই দাবী পূরণ করতেই হবে। কারণ, আমরা আহলে বাইতের উপর আরোপিত সকল অনাচারের প্রতিশোধ নেয়ার সংকল্প করেছি। আর তাই ইমাম-এ-যামানার পতাকাতলে নিজেদেরকে শামিল করেছি। এখন আর পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই। আল্লাহ্ আমাদেরকে সেই সুদৃঢ় পথে অবিচল ও দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়ার তৌফিক দান করুন।

পর্ব চারঃ কারবালা-যেখানে ইব্রাহীম(আ.) এর কুরবানি পরিপূর্ণ হয়েছিল

🔲⬛🔲⬛🔲⬛🔲⬛🔲⬛🔲⬛🔲⬛

কারবালা এমন একটি অধ্যায়ের নাম যে অধ্যায় মানবাজতির মুক্তির বার্তা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখলে এটা বলা স্বাভাবিক যে, এই যুদ্ধটি ছিল ইসলামের পুনঃজাগরণের যুদ্ধ। কিন্তু, সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং এই অবস্থায় বনু হাশিম ও ইমাম হুসাইনের অনুসারীদের ক্ষুদ্র সেই দলটির অমিয় বাণির দিকে তাকালে আমরা দেখব এটি ছিল মানবতার মুক্তি আন্দোলন। ইমাম হুসাইনের বক্তব্য এবং সেই ময়দানের শহীদদের কার্যকলাপের বিচক্ষনতার সাথে লক্ষ্য করলেই আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, তাঁরা বিশ্বমানবতার জন্য স্বাধীনতার এক বিরল কাব্য রচনা করেছিলেন। সেই মহা কাব্যে আলাহর নির্দেশকে যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে, তা ইসলামের আর কোন ঘটনার মধ্যে এতো সূক্ষভাবে পাওয়া যায় না।
কারবালা এমন এক মহাকাব্যের নাম, যা থেকে পৃথিবীর বুকে হাজার মহাকাব্য রচিত হয়েছে। এ মহাকাব্যের মূল উপাখ্যান ছিল ইমামের প্রতি আনুগত্য। সেদিনের সেই ছোট্ট কাফেলাটি তাঁদের ইমামের প্রতি আনুগত্যের যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছিল, তা ছিল অনন্য, অসাধারণ এবং অনতিক্রম্য। আনুগত্যের আর কোন প্রকৃষ্ট উদাহরণ মানবসমাজে আমরা দেখি না। আমরা প্রায় সময়ই বলে থাকি, কারবালা হল আল কোরআনের ব্যবহারিক ময়দান। অর্থাৎ, এই ময়দানে কোরআনের সকল নির্দেশগুলো সু¯পষ্ট হয়েছে। এক কথায় বলা যায়, পুরো কোরআন সেখানে বাস্তবিক আকারে মানুষের সামনে প্রতিফলিত হয়েছিল। মুসলিম ইবনে উজ্জাহ নামের ইমামের এক সাথী বললেন, “আমাকে যদি একবার হত্যা করে পুনরায় জীবিত করা হয় এবং ৭০ বার এ প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটানো হয়, তবুও আমি আপনাকে ছেড়ে যাবো না। আমি নিজের জীবন দিয়ে আপনাকে রক্ষার চেষ্টা করবো, যাতে কেয়ামতের ময়দানে বিশ্বনবী(সা.)-কে বলতে পারি, নিজের অস্তিত্ব দিয়ে আমি আপনার আহলে বাইতকে রক্ষার চেষ্টা করেছি।”
যাই হোক, বাহ্যিক দৃষ্টিতে কারবালা পরাজয়ের একটি উপন্যাস হলেও, এই কারবালা হাজারও জয়ের ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। কারবালা শুধু কুফার নিকটবর্তী সেই স্থানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এর বিস্তৃৃতি ঘটেছে মুসলিম সম্রাজ্য বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে। যেখানেই মুসলমানদের শাসন অনুপ্রবেশ করেছে, সেখানেই কারবালা প্রবেশ করেছে। মানুষের অন্তরে কারবালা এমন এক প্রভাব বিস্তাার করেছিল যে, উমাইয়্যা বাহিনির সৈনিকেরাও কারবালার স্মৃতি বয়ে নিয়ে গেছে প্রান্তর থেকে প্রান্তরে। একটা ঘটনা কিভাবে এতটা শক্তিশালি হতে পারে? কিভাবে একটি পরাজিত যুদ্ধ এতগুলো হৃদয়ে বিজয়ের আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারে? আসলে এটাই কারবালার রহস্য। এখানেই কারবালার মৌলিক বিজয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন আর কোন যুদ্ধের অবতারণা হয়নি, যার ধ্বংসযজ্ঞ মানুষের অন্তরে বিজয়ের আকাক্সক্ষা সৃষ্টি করতে পারে। কারবালার বিজয় ছিল এটাই যে এ বিপ্লব নির্যাতিত মানুষের অন্তরে মুক্তির স্বাদ এনে দিয়েছিল। এ ইতিহাস মানুষকে শিখিয়েছে কিভাবে স্বাধীনতা, গৌরব এবং আত্মমর্যাদার জন্য ব্যাকুল হওয়া যায়। কিভাবে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে মুক্তির জন্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়।
কারবালার এ ধরনের গৌরবগাঁথার আরেকটি দিক হল যে, এটা ছিল ইব্রাহীম(আ.)-এর সেই অপূর্ণ কুরবানির পূর্ণতার ইতিহাস। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন তার হাবিব ইব্রাহীমকে স্বপ্নের মাধ্যমে কুরবানির তাগিদ দিলে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁকে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় কিছু কুরবানি করতে হবে। আর সবচেয়ে প্রিয় তাঁর কাছে তখন ইসমাইল ব্যতীত আর কেউ ছিল না। কারণ, ইসমাইল ছিল তার দীর্ঘ সাধনার ফসল। আমরা সকলেই জানি, ইব্রাহীম(আ.) তাঁর একেবারে বৃদ্ধ বয়সে পুত্র সন্তানের জনক হয়েছিলেন। তিনি তাঁর সেই প্রিয় জিনিসের কুরবানির জন্য প্রস্তুত হলেন এবং কুরবানির স্থানে ইসমাইলকে নিয়ে গেলেন। কুরবানির ঠিক পূর্ব মুহূর্তে আল্লাহ্ তাঁর এই কুরবানিকে রহিত করলেন। যার জন্য কোরআনে বলা হয়েছে, “আমি তাঁর কুরবানিকে আরেকটি কুরবানির দ্বারা রহিত করলাম”। আমাদের আলেম সমাজ যদিও এর ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন, আসলে সেই বদলি কুরবানি ঈদ উল আযহার কুরবানি ছিল না। এটা ছিল হুসাইনের কুরবানি। আমাদের এই দাবির পিছনে অত্যন্ত শক্ত যুক্তি রয়েছে। কারন, হুসাইন এবং বনু হাশিম ইসমাইলেরই সন্তান। তথা ইব্রাহীমের সন্তান। যার ধারায় পৃথিবীর ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তনগুলো এসেছিল। যদি আমরা বনু হাশিমের ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব সর্বদাই তাঁরা শাহাদাতের প্রতিযোগিতায় নেতৃত্বের অবস্থানে ছিলেন। বদরে উবায়দুল্লাহ, অহুদে হামযা, মুতার প্রান্তরে জাফর ইবনে আবু তালিব, কুফায় আলী ইবনে আবু তালিব। ইসলামের সকল ঘটনাতেই বনু হাশিম ছিল ইসলাম ও শত্রæর মাঝখানে ঢাল স্বরূপ। শত্রæরা বনু হাশিমকে অতিক্রম করা ব্যতীত ইসলামের চৌহদ্দিতে প্রবেশ করতে পারেনি কখনও।
কারবালাতেও এর বিপরিত হয়নি। সেজন্যই আমি একে ইব্রাহীমের সেই বদলি কুরবানি বলে থাকি। কারণ আল্লাহ্ যে কুরবানি ইব্রাহীমের কাছে চেয়েছিলেন, সেই কুরবানি ইব্রাহীমের সন্তানেরা কারবালার প্রান্তরে দিয়েছিলেন।
হজরত কাশিম ছিলেন ইমাম হাসানের সন্তান। ইমাম হুসাইনের কাছে তিনি ছিলেন ভাইয়ের স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ। কাশিমকে দেখেই ইমাম তাঁর প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের কথা স্মরণ করতেন। যুদ্ধের দিন কাশিমের মা তাঁকে ডেকে বললেন, “বাবা! সকলেই ইমামের জন্য তাদের সন্তান, ভাই, ভাতিজা নজরানা হিসেবে কুরবান করছে। আমার নিকট তুমি ব্যতীত আর কেউ নেই। তোমার চাচার কাছে যাও এবং যুদ্ধের অনুমতি নিয়ে আস।” কাশিম চাচার কাছে যুদ্ধের অনুমতি চাইতে গেলে ইমাম হুসাইন বলেন, “হায়! আমার ভাইয়ের স্মৃতি। তোমাকে যুদ্ধের অনুমতি দেয়া যাবে না। তোমার পিতার বিয়োগই তোমার মায়ের জন্য যথেষ্ট।”
কাশিম মায়ের কাছে ফিরে এলে মা কাশিমের হাতে থাকা তাবিজের ভিতর থেকে একটি চিঠি বের করে ইমামের নিকট পাঠালেন। এই চিঠিটি ইমাম হাসান তাঁর ভাই ইমাম হুসাইনের জন্য লিখে রেখেছিলেন, যা কাশিমের মায়ের জিম্মায় ছিল। সেখানে লিখা ছিল, “ভাই আমার! তোমার সেই দুর্দিনে আমি থাকব না। আমার পক্ষ থেকে এই হাদিয়াটি কবুল করে নিও।” ইমাম চিঠিটি পরে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন এবং কাশিমের কপালে চুমু খেয়ে যুদ্ধের অনুমতি দিলেন। ইতিহাসে এসেছে, কাশিম এতো ছোট ছিলেন যে, কারবালায় ইমাম হুসাইনের দলের পতাকাবাহী আব্বাস বিন আলী তাঁকে কোলে করে ঘোড়ায় চড়িয়ে দিয়েছিলেন। কারবালার সেই সাহসী বীর দৃঢ়তার সাথে ময়াদানে আসলেন। উমার বিন স্বাদ ‘আরজখ’ নামক তার সৈন্যকে কাশিমের মোকাবেলা করতে বললে, সে সেনাপতিকে তিরস্কার করে বলল, “এতো একটা বাচ্চা ছেলে! এর জন্য আমার ছেলেরাই যথেষ্ট।” সে তার এক ছেলেকে কাশিমের মুকাবেলায় পাঠাল। সে ধরাশায়ী হলে সে তার পরবর্তী ছেলেকে পাঠাল। সেও কাশিমের কাছে পরাস্থ হল। এতে আরজখ ক্ষেপে গিয়ে নিজেই ময়দানে নেমে আসলো। হজরত কাশিম তাঁকে দেখে বললেন, “পুত্র হারানোর শোক তোমাকে এতটাই বিমর্ষ করে দিয়েছে যে, তুমি ঘোড়ার জিন লাগাতে ভুলে গেছ?” সে তার ঘোড়ার দিকে তাকাতেই কাশিম তাঁকে এমন সজোরে আঘাত করে যে, আরজখ দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়। এতে ইয়াজিদি বাহিনির মধ্যে আতংক শুরু হয়ে যায়।
আমরা এমনটা সব সময়ই দেখেছি, যখনই রাসুলের আহলে বাইতের সন্তানদের মধ্যে কোন সদস্য যুদ্ধের ময়দানে নেমেছে তখনি শত্রæদের পায়ের তলার মাটি সরে যেত। ইতিহাসের সকল উপাখ্যানেই বনু হাশিম ছিল অপ্রতিরোধ্য। তাঁদের সাহসিকতা বিরোধী শক্তির হৃদয়ে এমন কম্পন সৃষ্টি করতো যে, প্রায় সময়ই আমরা তাদের হাত থেকে তরবারী পড়ে যেতে দেখেছি। আমরা সিফফিনের যুদ্ধে ইমাম আলীর যুলফিকারের মুখোমুখি হয়ে আমর ইবনুল আসকে উলঙ্গ অবস্থায় পালিয়ে যেতে দেখেছি।
ইয়াজিদি বাহিনী কাশিমের মুকাবেলায় সম্মিলিত হামলা চালালো। চারদিক থেকে পঙ্গপালের ন্যায় শকুনের দল ইয়াযিদ বাহিনী কাশিমের কিশোর দেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে ফেলে কাশিমের দেহ। ক্ষত বিক্ষত দেহ নিয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়ার সময় কাশিম চিৎকার করে বলে উঠল, “মা! আমি পড়ে যাচ্ছি।” চিৎকার শুনে চাচা হুসাইন যুদ্ধের ময়দানে কাশিমের দিকে দৌড়ে আসলেন। ততক্ষনে ভাতিজা কাশিমের দেহ ঘোড়ার পায়ের আঘাতে জর্জরিত হয়ে গিয়েছিল। ইমাম হুসাইন তাঁর ভাইয়ের স্মৃতি কাশিমের ছিন্নভিন্ন দেহকে একটি কাপরে জড়িয়ে তাবুর দিকে নিয়ে আসলেন।
আউন ও মুহাম্মদ নামে হযরত যয়নবের দুই সাহসী পুত্র এবং ইমাম হুসাইনের প্রাণপ্রিয় ভাগিনা সেদিন কারবালার প্রান্তরে উপস্থিত ছিলেন। বিবি যয়নাব যখন মদিনা ছেড়ে ভাইয়ের সাথে চলে আসবেন তখন তাঁর অসুস্থ স্বামী আব্দুল্লাহ ইবনে জাফরের কাছে এই পুত্রদ্বয়কে সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্যে অনুমতি চাইতে গিয়েছিলেন। তখন তাঁর স্বামী বলেন, “হে ফাতিমার কন্যা! আমি কখনও তোমাকে কোন কিছুতে বাধা দেইনি। তুমি হুসাইনের সাথে যাও। আর সাথে করে আমাদের এই দুই পুত্রকেও নিয়ে যান। যদি প্রয়োজন হয়, একজনকে তোমার পক্ষ থেকে আর অপরজনকে আমার পক্ষ থেকে হুসাইনের জন্য কুরবান করে দিও।”
আউন ও মুহাম্মদ আশুরার পূর্ব রাতে মায়ের কাছে এসে বললেন: “আগামীকাল সকাল হতে দিন এবং আমাদের জন্য মামার কাছ থেকে যুদ্ধের অনুমতি এনে দিন। তারপর দেখবেন, আমরা কিভাবে যুদ্ধ করি।” পরদিন সকালে তাঁরা ইমামের নিকট যুদ্ধের অনুমতি চাইলে ইমাম(আ.) তাদের বয়সের সল্পতার দরুন অনুমতি দিতে চাননি। বোন যয়নব এবং ভাগিনাদের পীড়াপীড়িতে তিনি অনুমতি দিতে বাধ্য হলেন। তাঁরা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। একজনকে আব্বাস এবং অপরজনকে ইমাম নিজে ঘোড়ায় তুলে দিলেন। যুদ্ধ ক্ষেত্রে যাওয়ার পূর্বে মা যয়নব বললেন, “ময়দানে যদি কেউ তোমাদের পরিচয় জানতে চায়, খবরদার আমার নাম বলবে না। বলবে আমরা হুসাইনের দাসীর পুত্র”। ময়দানে তাঁরা উমার বিন স্বাদকে যুদ্ধের আহŸান জানালে সে তার সকল সৈন্যকে একত্রে হামলা করার নির্দেশ দেয়। দুই ভাই অগনিত সৈন্যের ভিড়ে একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে। বীর বিক্রমে লড়াইয়ে আহত হয়ে তাঁরা ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়ার সময় ইমামের প্রতি তাঁদের শেষ সালাম পেশ করেন।
ইমাম এবং আব্বাস তাঁদের দিকে ছুটে আসেন। দুই ভাইয়ের দেহকে ইমাম ও আব্বাস বিন আলী তাবুতে নিয়ে আসেন। বিবি যয়নব দুই সন্তানের দেহের পাশে শুয়ে পড়েন এবং তাঁদের বুকের উপর হাত রেখে বলতে লাগলেন, “তোমাদেরকে ধন্যবাদ। তোমরা আমার মুখ রক্ষা করেছ। তোমাদের উপর আমি সন্তুষ্ট হয়েছি।” এরপর তিনি আল্লাহর দরবারে হাত তুলে বললেন, “হে আল্লাহ! তুমি আমার এই কুরবানি কবুল করেছ, সে জন্য তোমার শুকরিয়া। কেয়ামতের দিন যেন আমি মা ফাতিমাকে বলতে পারি, আমি তোমার হুসাইনের জন্য আমার দুই সন্তানকে উৎসর্গ করেছি।”
একে একে ইমামের সকল সাথীরা শহীদ হয়ে গেলেন। এরপর ছিলো বনু হাশিমের পালা। তারাও একের পর এক ইমামের পদতলে শাহাদাতের অবিস্মরণীয় ঐতিহাসিক নজরানা পেশ করতে লাগলেন। এবার ইমামের ছেলে আলী আকবর পিতার নিকট যুদ্ধের অনুমতি নিতে আসলেন। ইমাম বললেন, “তোমার অনুমতি আমার কাছে নয়, তোমার ফুফুর কাছ থেকে নিতে হবে। কারণ, তোমার লালন পালনে তিনি অগ্রগামী ছিলেন।” ফুফুর কাছ থেকে অনেক কষ্ট করে অনুমতি নিয়ে আলী আকবর আবার বাবার নিকট ফিরে আসলেন। ইমাম তাঁকে বিদায় জানালেন।
আলী আকবর ময়দানের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। তিনি ছিলেন হুবুহু রাসুল(সা.)-এর মতো দেখতে। তিনি যখন ময়দানের দিকে যাচ্ছিলেন তখন ইমাম হুসাইন তাঁর পিছু পিছু আসতে লাগলেন। আলী আকবর চলা থামিয়ে দিয়ে পিতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি না আমাকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দিলেন? তাহলে কেন আমার পিছু পিছু আসছেন?” ইমাম বললেন, “আমার স্থলে তুমি থাকলে বুঝতে। ঠিক আছে আমি আর তোমার পিছনে আসব না। তবে ওয়াদা কর, যতক্ষন ময়দানে না পৌঁছবে, এভাবে বার বার আমার দিকে ফিরে তাকাবে।” ইমাম অশ্রæ নয়নে দু’হাত আসমানের দিকে তুলে ধরে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে বললেন, “হে আল্লাহ! আমি আমার সেই সন্তানকে যুদ্ধে পাঠালাম যার অবয়ব এবং কণ্ঠস্বর তোমার হাবিবের মত।”
আলী আকবর রনাঙ্গনে গেলেন এবং অবিচল আস্থার সাথে অনেকক্ষন লড়াই করলেন। উমাইয়্যা বাহিনীর বিশাল ক্ষতি সাধনের পর ক্লান্ত হয়ে তিনি তাবুতে ফিরে আসলেন। ইমাম ফিরে আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন যে, তৃষ্ণায় তাঁর বুক ফেটে যাচ্ছে। ইমাম স্বীয় জিহŸা পুত্রের মুখে দিলেন এবং হাত থেকে আংটি খুলে মুখে দিয়ে বললেন, “এটা সাথে রাখ, স্বস্তি পাবে”।
আলী আকবর পুনরায় যুদ্ধের ময়দানে ফিরে গেলেন। যাদের রক্তে বিরত্বের কাব্যগাথা রচিত হয়, তাদের সাথে কোন বাহিনীরই তুলনা হয় না। ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে, সিফফিনের যুদ্ধে আবুল ফযল আব্বাস বিন আলীর বিরত্বের সামনে শত্রæদের পরাস্থ হওয়ার কাহিনী। মুসলিম ইবনে আকিলের বিরত্বও উবায়দুল্লাহ্ বিন যিয়াদের সৈন্যদেরকে সম্মিলিত হামলা করতে বাধ্য করেছিল। জাফর বিন আবু তালিবের বীরত্ব রোমানদেরকে বিচলিত করে দিয়েছিল। আলী আকবর তাঁদেরই সন্তান। এখানেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ইয়াযিদী বাহিনী সম্মিলিত আক্রমন করল। আহত অবস্থায় ক্ষত বিক্ষত দেহ নিয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়ার সময় আলী আকবর পিতার সাহায্য কামনা করলেন। ইমাম ছুটে চললেন আলী আকবরের দিকে। বেশি দূর যেতে পারেননি। তিনি পড়ে গেলেন। বাকি পথ হামাগুড়ি দিয়ে আলী আকবরের কাছে গেলেন। দেখলেন, আলী আকবর বুক চেপে ধরে আছেন। জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি বুক থেকে হাত সরাচ্ছ না কেন?” আলী আকবর বললেন, “বাবা, আমি এখানে তিব্র ব্যথা অনুভব করছি।” হাত সরিয়ে ইমাম দেখলেন তাঁর বুকে বর্শার অগ্রভাগ সমূলে গেঁথে গিয়েছে। সন্তানের বুকের উপর থেকে তিনি বর্শা বের করে নিয়ে আসলেন। আর এতে ছিন্ন হয়ে যায় আলী আকবরের বুকের খাঁচা। ইমাম দেখলেন সন্তানের লাশ একা বহন করা সম্ভব নয়। তাই তিনি তাঁর দলের পতাকাবাহী, তাঁর ভাই আবুল ফযল আব্বাসকে সাহায্যের জন্য ডাকলেন। দুইজন মিলে আলী আকবরের দেহ তাবুতে নিয়ে আসলেন। আলী আকবরের শাহাদাত ইমামের কাফেলায় শোকের মাতমের জন্ম দিল। অসহ্য বেদনায় কাফেলার নারী শিশুরা আর্তনাদ করে উঠলো।
হায়! এ জমিন কেন ভেঙ্গে পড়ে না। এ ব্যথার তিব্রতা সহ্য করি কিভাবে। কিভাবে এ বিরহ মেনে নিতে পারি। নবি পরিবরের নারী-পুরুষ ও শিশুদের আহাজারিতে সেদিন কারবালার আকাশ বাতাস ভারী হয়ে গিয়েছিল।
কারবালার করুন ইতিহাসের বর্ণনা একটি দাবীর ভিত্তিতেই পেশ করা হচ্ছে। আর তা হল, নিজেদেরকে আবারও আরেকটি কারবালার জন্য তৈরি করে নেয়ার আহŸান জানানোর জন্য। আজকের আলোচনা তখনই সার্থক হবে, যখন আমরা নিজেদেরকে ইমাম-এ-জামানার আগমন ও আনুগত্যের জন্য প্রস্তুত করতে পারবো। মনে রাখবেন, এই জীবনে যতো ঋণ রয়ে গেছে তার সবটুকু তাঁদেরই, যারা আমাদেরকে হেদায়েতের জন্য নিজেদেরকে কুরবান করে নজির সৃষ্টি করে গেছেন। তাঁদের সেই আত্মত্যাগের উদ্দেশ্য ছিল একটি। আর তা হল, আগামী দিনের লোকেরা যেন তাঁদের ইমামের জন্য এভাবেই অকাতরে নিজেদেরকে বিলিয়ে দিতে পারে। আল্লাহ আমাদেরকে সেই পথে চলার তৌফিক দান করুন। আমীন।

পর্ব পাঁচঃ কারবালা- চিরসবুজ আন্দোলনের উন্মুক্ত দুয়ার

🔲⬛🔲⬛🔲⬛🔲⬛🔲⬛🔲⬛🔲⬛

কারবালা এমন এক মহাকাব্য যার চয়নে রয়েছে মুক্তির অমৃত সুধা। আর এর রচয়িতা ছিলেন ইমাম হুসাইন, যিনি এমন এক রচয়িতা যার তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর কখনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। যদি কারবালাকে কেউ বিশ্লেষণ করতে চায়, তবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় সে বিচলিত হবে। কারণ, কারবালা এমন বহুমাত্রিক একটি অধ্যায়ের নাম, যার অবদান মানবতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানব জাতির জীবনে এমন কোন দিক নেই যা কারবালায় পদচারনা ঘটেনি। কারবালার এই দিকগুলোকে জানতে হলে অবশ্যই ব্যক্তির বিচক্ষন ক্ষমতা প্রবল থাকতে হবে।
কারবালা বিরত্ব, প্রেম, ত্যাগের এমন এক নজির স্থাপন করেছে, যা কিয়ামত পর্যন্ত সত্যপন্থিদের আলোকবর্তিকা হিসেবে পথ দেখিয়ে যাবে। ইমামের প্রতি ভালোবাসা, তাঁর প্রতি আনুগত্য এবং দ্বীনের ভিত্তি মজবুত করার ক্ষেত্রে সেই শহীদদের তুলনা তাঁরা নিজেই।
ফোরাতের তীরে অবস্থান নেয়া ইমামের কাফেলা চাইলেই সেখানে অবস্থান করতে পারতো। যখন উমাইয়্যা বাহিনী সেখান থেকে ইমামের কাফেলাকে সরিয়ে দিতে চাইছিল তখন মহাবীর আবুল ফযল আব্বাস হুংকার দিয়ে উঠেছিলেন- “কার এত বড় সাহস যে আমাদেরকে এখান থেকে সরাতে চায়?” কিন্তু ইমাম তাঁকে শান্ত করেন এবং বলেন- “আমাদের তাঁবুগুলো সরিয়ে নাও আব্বাস। আগামি দিনের ইতিহাস যেন এটা না বলে যে, কারবালার যুদ্ধ পানির জন্য সংগঠিত হয়েছিল।” আবুল ফযল আব্বাস জানতেন, একবার এখান থেকে সরে গেলে পানির উৎস ইমামের বাহিনীর জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু, এটাই ইসলামি আন্দোলনের বাস্তবতা। ইসলামি আন্দোলন হচ্ছে এমন এক ক্ষেত্র যেখানে নিজেকে বিসর্জন দিতে হয়। যেখানে সুবিধার বিপরীতে অসুবিধাগুলো আপন করে নিয়ে পথ চলতে হয়। এরই নাম আনুগত্য। যদি আব্বাস ইমামের নির্দেশ না মানতেন, তাহলে হয়তো ইমামের বাহিনী এতো চরম পানি সংকটে পড়তো না বা যুদ্ধ জয়ের সম্ভাবনাও থেকে যেতে পারতো। কিন্তু, তাতে লাভ কি হতো? যে বিজয়ে ইমামের আনুগত্য নেই সে বিজয় তো দুনিয়ার অন্যান্য অর্জনের ন্যায় ক্ষণস্থায়ী। আর কারবালার প্রান্তরের সবাই সেদিন ছিলেন পরকালের চিন্তায় ব্যস্ত। কিভাবে ইমামের আনুগত্যে নিজেকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। আনুগত্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল তাঁরা সেদিন।
শিমর বিন জুলজওশানের অকথ্য ভাষায় গালাগালির পর প্রতিশোধ হিসেবে ইমামের এক সৈন্য যুদ্ধ শুরুর অনুমতি চাইলেও ইমাম তাঁকে এই বলে বারণ করেন যে, “আমরা কখনোই যুদ্ধ শুরু করবো না।” তিনি তা মেনে নেন। এরকমই হতে হবে আমাদের। ইমামের নির্দেশই আমাদের পাথেয়। ইমামের খুশিই আমাদের খুশি। যতদিন পর্যন্ত আমরা এই লক্ষ্যকে স্থির করতে না পারবো, ততদিন কারবালাকে সার্থকতায় পৌঁছাতে সক্ষম হবো না।
আর প্রেমের কথা যদি বলি, তাহলে কারবালার সেই ছোট্ট কাফেলাটি ছিল প্রেমের উত্তাল সমুদ্রের ন্যায়। সমুদ্রে যেমন একটার পর একটা ঢেউ এসে তীরে আছড়ে পড়ে, তেমনি সবাই একের পর এক নজরানা দিয়ে ইমামের খুশি অর্জন করার আপ্রান চেষ্টা করেছিলেন সেদিন। কেউ স্বামী, কেউ সন্তান, কেউ ভাই, কেউ পিতা, কেউ নিজেকে উৎসর্গের মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের প্রেম প্রকাশ করছিল। আমরা যখনই কারবালার কথা বলি তখনই জীবন উৎসর্গের কথা বলি। আসলে এছাড়া কারবালায় আর কিই বা ছিল। মানুষের সবচাইতে দামি স¤পদ হল তাঁর জীবন। এর চাইতে প্রিয়, এর চাইতে মুল্যবান আর কিছুই মানুষের কাছে নেই। আর তাঁরা সেটাই উৎসর্গ করেছিলেন সেদিন। তাঁদের এই উৎসর্গ করাটা কিন্তু বাধ্যবাধকতা ছিল না। শুধুমাত্র প্রেমের কারণেই ছিল। কারণ, বাধ্য তাঁরা মোটেই ছিলেন না। আশুরার পূর্ব রাতেই ইমাম তাদেরকে তাঁর বাইয়াত থেকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। ইমামের সামনে দিয়ে যেতে লজ্জা পাবে ভেবে ইমাম বাতি নিভিয়ে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেনঃ “ওরা শুধু আমাকে চায়। তোমাদের সাথে ওদের কোন কাজ নেই। তোমরা এই রাতের অন্ধকারকে কাজে লাগিয়ে এখান থেকে চলে যেতে পার। আমি আমার বাইয়াত তুলে নিলাম এবং আমার আনুগত্য থেকে তোমাদেরকে মুক্ত করে দিলাম।” কিন্তু আশুরার দিনে উপস্থিত কেউ ইমাম-কে একা ফেলে পালিয়ে যায়নি। বরং ইমামের এই কথা শুনে তাঁরা যেন আরও আবেগপ্রবন হয়ে উঠলো। একটার পর একটা ঘোষণা সেদিন ইমামের চোখে পানি এনে দিয়েছিল এবং তিনি বলেছিলেন, “আমার মতো সাহাবী আর কেউ পায় নি।”
কতোই না সুমহান সেই নেতা আর কতোই না ত্যাগী ছিলেন সেই সাহাবীরা। ইতিহাসে আমরা পাই, তারেক বিন যিয়াদ স্পেন আক্রমনের সময় বাহিনীর সকল নৌযান পুড়িয়ে ফেলেছিল এবং মাত্র একদিনের খাবার রেখে সকল খাবার সমুদ্রে ফেলে দিয়েছিল। তখন সৈন্যদের আর যুদ্ধ করা ব্যতীত কোন উপায় ছিল না। বাধ্য হয়েই শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে সেদিন তারা লড়েছিল। কিন্তু কারবালার সেই অসীম সাহসী যোদ্ধারা, তাঁদের বীরত্বের যে নজির স্থাপন করেছিলেন তা ছিল স¤পূর্ণ ভিন্ন। যে যুদ্ধে জয়ের বিন্দুমাত্র কোন আশা নেই, মৃত্যু যেখানে অলিখিত ভাগ্য হিসেবে পরিণতির জন্য অপেক্ষা করছে, এমন একটি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া কোন সাধারণ কথা নয়। তাঁরা সেদিন বেঁচে থাকা বা জয়ের জন্য লড়েননি, তাঁরা লড়েছিলেন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে ইমামের আনুগত্য, প্রেম ও তাঁদের ঐকান্তিকতা প্রমাণ করার জন্য। আর তাঁরা তা সম্পন্ন করেছিলেন কোন প্রকার বিচ্যুতি ব্যতীরকে।
ইমাম থেকে ক্ষমা পাবার পর হুর বলেছিলেন, “মওলা! আপনাকে অবরুদ্ধ করার সময়, একজন নারির কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলাম, আমি তাঁর কাছেও ক্ষমা চাইব।” ইমাম তাঁকে সেখানে বিবি যয়নবের নিকট নিয়ে গেলেন। তিনি যয়নবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। বিবি যয়নব বললেন, “আমি তোমাকে ক্ষমা করলাম। হায়! আজ আমাদের কাছে কিছুই নেই যে তোমাকে আপ্যায়ন করাবো।”
হুর ইমামের কাছ থেকে যুদ্ধের অনুমতি নিলেন। পিতা এবং পুত্র যুদ্ধের ময়দানে চলে গেলেন। হুরের ছেলে বীরবিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগল আর হুর কাছ থেকে সন্তানকে সাহস যোগাচ্ছিলেন। পিতার উৎসাহের কথা শুনে সে আরও সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করতে লাগল। এক পর্যায়ে শত্রæরা একযোগে হামলা করলে সে পরাস্থ হয় এবং আহত হয়ে পড়ে যাওয়ার সময় পিতাকে সাহায্যের জন্য আহবান করে। পুত্রের আহত চিৎকার শুনে হুর সিংহের ন্যায় ময়দানে ছুটে গেলেন। এসে দেখলেন তাঁর পূর্বেই ইমাম তাঁর পুত্রের মাথা পাঁজরে নিয়ে বসে আছেন। ইমাম-কে দেখে হুর লজ্জিত হয়ে বলল, “মওলা! আপনি কেন আসলেন?” ইমাম বললেন, “হায় হুর! যদি আমি না আসতাম তাহলে কিভাবে তুমি সন্তানের লাশ বয়ে নিয়ে যেতে? একজন পিতার পক্ষে কিভাবে সম্ভব পুত্র হারানোর বেদনা সহ্য করা!”
সন্তানের লাশ কোলে নিয়ে তাবুতে এসে হুর নিজের জন্য যুদ্ধের অনুমতি চাইলেন। ইমাম তাঁকে যেতে দিতে না চাইলে সে বলল, “আপনি কি আমাকে জান্নাতি এই কাফেলা থেকে দূরে রাখতে চান? দেখছেন না কিভাবে শকুনের দল রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছে? এই ময়দান আজ খুন চায়। আজ প্রয়োজন ত্যাগের আর আপনি আমাকে তা থেকে ফিরিয়ে রাখবেন।” অগত্যা ইমাম তাঁকে অনুমতি দিলেন এবং আরবের শ্রেষ্ঠ বীর হুর ইবনে ইয়াযিদ ময়দানে ছুটে গেলেন। বীরত্বের সাথে যুদ্ধে হুর উমাইয়্যা বাহিনীর অনেক ক্ষতি সাধন করলেন। এক পর্যায়ে আহত হয়ে পড়ে যাওয়ার সময় হুর চিৎকার করে ইমাম-কে তাঁর শেষ সালাম পেশ করলে ইমাম তাঁর নিকট ছুটে যান। দেখলেন হুরের কপাল থেকে ফিনকি দিয়ে অঝোরে রক্ত ঝরছে। তিনি জামার আস্তিন থেকে ফাতিমা’র রুমাল বেঁধে দিলেন তাঁর মাথায়। সাথে সাথে রক্ত ঝরা বন্ধ হয়ে গেল। ইমাম তাঁর কপালে চুমু দিয়ে বললেন, “তোমার মা তোমার নাম যথার্থই রেখেছেন হুর। তুমি দুনিয়াতেও স্বাধীন আখেরাতেও স্বাধীন।” এরপর ইমাম তাঁর লাশ নিয়ে তাবুতে ফেরত আসলেন।
এরাই প্রকৃত বীর। যাদের বীরত্ব পৃথিবীতে জুলুম শোষণের বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে রয়েছে, তাঁরা এমনই। তাঁদের সৌন্দর্য অতুলনীয়। তাঁদের মৃত্যু নেই। তাঁরা অমর হয়ে থাকে। আর তাঁদের সৌন্দর্যের উপর পৃথিবীর জীবিত মানুষেরা অহংকার করতে পারে।
সেদিন কারো মনে কোন ভীতির রেখা ছিল না। সকলেই একে অন্যের থেকে ত্যাগের অনন্য উদাহরণ সৃষ্টির নেশায় যেন মত্ত হয়েছিল। আর একজনের শাহাদাত আরেকজনের অন্তরে যেন শাহাদাতের আকাক্সক্ষাকে তীব্র থেকে তীব্রতর করছিল। আর এর প্রমাণ আমরা প্রতিটি শহীদের মধ্যেই দেখেছি।
এমনি একজন মুসলিম ইবনে আওসাজাহ। তিনি হাবিব ইবনে মাযাহির এর ভাই। ইমাম থেকে যুদ্ধের অনুমতি নিয়ে তিনি রনাঙ্গনে গেলেন। বীরত্বের সাথে লড়াইয়ের এক পর্যায়ে আহত হয়ে পড়ে গেলে ইমাম হাবিব বিন মাযাহিরকে সাথে নিয়ে তার নিকট গেলেন। হাবিব মুসলিমের নিকট গেলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন তার কোন অসিয়ত আছে কিনা। জবাবে মুসলিম বললেন, “হাবিব! আমার ভাই। আমার অসিয়ত স্ত্রী সন্তানদের জন্য নয়। আমার অসিয়ত তোমার জন্য। সাবধান! এমন যেন না হয় যে, তোমার আগেই ইমাম ময়দানে চলে এসেছেন। তুমি জীবিত থাকতে যেন ইমামের গায়ে একটি আঁচড়ও না লাগে।” এই অসিয়ত করেই মুসলিম শাহাদাত বরণ করলেন।
এরি মধ্যে হটাৎ ইমাম দেখলেন ৯/১০ বছরের একটি বাচ্চা ছেলে তরবারী হাতে রনক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইমাম হাবিবকে নির্দেশ দিলেন বাচ্চাটিকে তাঁর নিকট নিয়ে আসতে। হাবিব তাঁকে ইমামের নিকট নিয়ে আসলেন। ইমাম জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কে? কার সন্তান? তোমাকে যুদ্ধে যেতে কে বলেছে?” জবাবে শিশুটি দু হাত জোড় করে বলল, “মাওলা! আপনি যে শহীদের লাশের পাশে বসে আছেন আমি তাঁর সন্তান।” ইমাম বললেন, “তোমার মায়ের জন্য তোমার বাবার বিয়োগই যথেষ্ট। এখন তুমিই তার সহায়। ফিরে যাও, যাতে তুমি তোমার মায়ের সহায় হতে পার।”
শিশুটি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর বলল, “আমি কী করে ফিরে যাই। এই যে আমার কোমরে যে তরবারি দেখছেন, এটা আমার মা আমার কোমরে বেঁধে দিয়েছেন।” এই পর্যায়ে তাবুর ভেতর থেকে শিশুটির মা বলে উঠলেন, “মাওলা! মুসলিম শাহাদাত বরণ করেছে। তার প্রতিদান সে পাবে। আমি নারী, তাই আমার উপর জিহাদ নিষিদ্ধ। সুতরাং আমার পক্ষ থেকে এই উপহারটি গ্রহণ করুন।”
যুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে স্বাদের বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হল শহিদানের লাশের উপর ঘোড়া দাবড়ানোর জন্য। সৈন্যরা কিছুদুর এগিয়ে গিয়ে যুহাইর ইবনে কায়েনের লাশ দেখতে পেল। তখন তার গোত্রের লোকেরা বলল যদি যুহাইরের লাশ বিনষ্ট করা হয়, তবে আমরা তোমাদের বিপরীতে তরবারি ধারন করবো। স্বাদ তার লাশকে সরিয়ে রাখার নির্দেশ দিল। কিছুদূর গিয়ে পাওয়া গেল মুসলিম ইবনে আসওয়াজার লাশ। তার গোত্রের লোকেরাও এর প্রতিবাদ করলে তার লাশকেও সরিয়ে রাখা হল। এরপর তাঁরা পেল হাবিব ইবনে মাযাহিরের লাশ। তার গোত্রের লোকেরা বলল আমাদের কোন গোত্রের লোকের লাশ অপমানিত হলে আমারা তা মেনে নিব না। যদিও সে হুসাইনের সাথে যুদ্ধ করেছিল, তবুও আমরা এই অপমান সহ্য করবো না। এর পর তার লাশও সরিয়ে নেয়া হল। এভাবে একে একে সকল শহীদদের লাশ তার গোত্রের লোকেরা সরিয়ে নিয়ে গেল। বাকি থাকল শুধু ইমাম হুসাইন এবং বনু হাশিমের লাশগুলো। সেখানে এমন আর কেউ ছিল না যে বলবে এরা আমাদের গোত্রের লোক, তাঁদের অপমান সহ্য করবো না। যে জাহেলিয়াতকে ইমাম হুসাইনের নানা বিতাড়িত করেছিলেন, আজ সেই জাহেলিয়াত হযরত মুহাম্মদের পরিবারের লাশের উপর কার্যকর হল। অথচ সকলে মুসলমান হওয়া সত্বেও কোন প্রতিবাদ করেনি। পাষান উমাইয়্যারা সেদিন শহীদদের নেতা ইমাম হুসাইন ও বনু হাশিমের শহীদদের দেহের উপর ঘোড়া চালিয়ে মানবিকতার চরম অপমান করল। হায় মুহাম্মদ! আজ তুমি কোথায়? কোথায় তোমার শিক্ষা?
এই ত্যাগ শুধু শোকের নয়। এই ত্যাগ নতুন দিনের আশা নিয়ে হতাশ মানবতাকে আশ্রয়ের বার্তা শুনানোর জন্য দেয়া হয়েছিল। ইমাম হুসাইন এবং তার শহীদেরা সেদিন মুক্তি আন্দোলনের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান এবং তার পূর্বসূরি খলিফাদের তৈরি করা ভীতির পিঞ্জরকে তাঁরা ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছিলেন। তাঁরা শিখিয়েছিলেন কিভাবে ভয়ের শৃঙ্খল ভেঙ্গে আলোর প্রদীপ জালাতে হয়। কিভাবে সংগ্রামের আগুনে জ্বলে ইমানকে খাঁটি করতে হয়। কিভাবে ইমামের আনুগত্য করতে হয়। আমাদেরকে সেই পথেই হাঁটতে হবে। মনে রাখতে হবে, ইমাম হুসাইন সেই মহাকাব্যের নাম যার কাছ থেকে আনুগত্য, প্রেম এবং ত্যাগের মহিমা শিখা যায়। আল্লাহ আমাদেরকে সেই পথে দৃঢ়তার সাথে চলার তৌফিক দিন। আমিন।

 

পর্ব চলবে…..

কারবালা-

🔲⬛🔲⬛🔲⬛🔲⬛🔲⬛🔲⬛🔲⬛

[মোস্তাফা কামাল সুমন]

Related Post

স্মৃতিতে মহররম

Posted by - সেপ্টেম্বর ৬, ২০১৯
স্মৃতিতে মহররম – আশিক পারভেজ মিনার   মহররম নিয়ে লিখতে বসেছি কি লিখবো মহররম নিয়ে আমার কলম স্থির, স্তব্ধ, নির্বাক।…

আশুরার পূর্ব রাত

Posted by - আগস্ট ২৯, ২০২০
একষট্টি হিজরীর নবম মহররমের দিবাগত রাত আজ আশুরার পূর্ব রাত। যেন মহাপ্রলয়ের পূর্ব রাত। কারবালা প্রান্তরের বাতাসেও আজ শোকের পূর্বাভাস।…

কালো রাতের মুসাফির

Posted by - আগস্ট ৬, ২০১৯
কালো রাতের মুসাফির __মোস্তফা কামাল সুমন একটি বিদঘুটে কালো রাত দির্ঘ প্রহর নিয়ে যেন এসেছে, পেঁচাদের লোমহর্ষক প্রতিধ্বনিত ডাক, আর…

প্রিয় হে বার্তাবাহক মুস‌লিম !!

Posted by - সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৯
ডা‌কি‌ছে আমায় ক‌রি‌তে বায়াত বস‌তি জন ঐ কুফায়, ‌বিশ্বাস না‌হি লয় ম‌নে জা‌গে কেবলই সংশয় শংকায়! ইমাম‌বিহীন না‌হি জা‌গে প্রাণ…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »