বিসমিল্লাহির রহমানির র-হীম
ইসলামে সকল বিধি-বিধানের উৎস হলো পবিত্র কুরআনুল কারীম। মানুষের এমন কোন দিক ও বিভাগ নেই যে, তাতে বর্ণনা করা হয় নাই। ঠিক তদ্রুপ সিয়ামও এই বিধানাবলীর মধ্যে একটি। পবিত্র কুরআনে কোন কোন সিয়ামকে ফরজ বলা হয়েছে আবার কোন কোন সিয়ামকে নফল বলা হয়েছে। আল্লাহ পাক পবিত্র রমজানুল মোবারকে মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের মত একটি মহামূল্যবান আসমানী কিতাব উপহার দিয়েছেন, তা না হলে এই পৃথিবী ও তার মানুষগুলো অন্ধকার ও অজ্ঞতায় নিমজ্জিত থাকতো। তাই মহান আল্লাহর এই উপহারের শোকরিয়া জ্ঞাপনের জন্য তাঁর বান্দাদের কুরআন নাযিলের মাসটিকে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা জানানোর কথা বলে দিয়েছেন। ঠিক তদ্রুপ নফল সিয়ামের ক্ষেত্রেও দেখা যায় কোন না কোন সফলতা বা আনন্দঘন কর্ম সম্পাদনের ক্ষেত্রে অথবা কোন সুসংবাদ প্রাপ্ত হলেই কেবল সিয়াম পালন করার বিধান ইসলামে রয়েছে।
এই প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছেন,
“রমযান মাস হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কুরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্য পথযাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথনির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে যেন এ মাসে সিয়াম সাধনা করে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে সুনির্দিষ্ট সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না যাতে তোমরা সুনির্দিষ্ট সংখ্যা পূরণ কর এবং তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন আল্লাহ তা’আলার মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর। [২:১৮৫]
আমাদের আলোচ্য বিষয় হলো মুহররমে সিয়াম পালন। বিষয়টিকে আরো সুস্পষ্ট করার জন্য পূর্বেই বলে নেয়া অত্যন্ত জরুরী যে, মুহররম মাসে পৃথিবীতে সংগঠিত ঘটনাবলীর মধ্যে সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে কারবালায় সংগঠিত ঘটনাবলী।
প্রথমেই জানা দরকার যে, ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামের শাহাদাতের ঘটনা মুসলমানরা কোন্ দৃষ্টিকোন থেকে দেখেন? তাদের মধ্যে এই ঘটনার প্রতিফলনটা কি? এদিনের ঘটনা মুসলমানদের নিকট কি সুসংবাদ নাকি দুঃসংবাদ? এখানে ১০ই মুহররমের দিনে পৃথিবীতে অনেক ঘটনার মধ্যে কিছু ঘটনা উল্লেখ করছি।
১। আল্লাহ পাক আশুরার দিনে লওহ ও কলমকে সৃষ্টি করেছেন।
২। আশুরার দিনে আল্লাহ পাক জমিন এবং আসমানকে সৃষ্টি করেছেন।
৩। আশুরার দিনে ফেরাউনকে নীল নদে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়। হয়রত মূসা (আ.) তাঁর জাতিকে ফেরাউনের হাত থেকে
রক্ষা করতে আল্লাহর নির্দেশে হাতের লাঠি দিয়ে মাটিতে আঘাত করলে নীল-নদের মধ্যে একটি রাস্তা তৈরী হয়। সে রাস্তায় শুধুমাত্র মূসা (আ.) এবং তার অনুসারীরা নিরাপদে নদী পার হন। আর ফেরাউন সমুদ্রের জলে তলিয়ে যায়।
৪। আশুরার দিনে মহাপ্রলয় বা কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে।
৫। আশুরার দিনে আল্লাহতায়ালা আদি পিতা হযরত আদম (আ.)-কে দুনিয়ায় প্রেরণ করেন।
৬। আশুরার দিনে হজরত আদম (আ.)-এর তওবা কবুল হয়েছিল।
৭। আশুরার দিনে মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) ঈমানের কঠিন পরীক্ষা দিতে নমরুদের অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন।
৮। আশুরার দিনে দীর্ঘ ৪০ দিনের বন্যার পর হযরত নূহ (আ.)- এর নৌকা মাটিতে অবতরণ করে। পরম করুণাময় নতুনভাবে ভুমণ্ডলকে সাজিয়ে মানুষের বাসযোগ্য করে তোলেন।
৯। আশুরার দিনে হযরত ইউনুছ (আ.) ৪০ দিন মাছের পেটে অবস্থানের পর নাজাত পেয়েছিলেন।
১০। আশুরার দিনে হযরত নূহ (আ.) ৪০ দিনের মহাপ্লাবনের পর নৌকা থেকে বেলাভূমিতে অবতরণ করেন।
১১। আশুরার দিনে হযরত ঈসা (আ.) ইহুদিদের অত্যাচার, নির্যাতন- থেকে মুক্তি লাভের পর সশরীরে চতুর্থ আসমানে উপস্থিত হন।
১২। আশুরার দিনে হযরত ইয়াকুব (আ.) তাঁর হারানো ছেলে হযরত ইউসুফ (আ.)-কে ফিরে পান এবং দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসে।
১৩। আশুরার দিনে ধৈর্য, সহনশীলতার মূর্তপ্রতীক হযরত আইয়ুব (আ.) আঠার বছর যাবৎ আক্রান্ত কুষ্ঠ রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করেন।
১৪। আশুরার দিনে কাবাঘরের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল।
১৫। মহররম মাসের ১০ তারিখে কারবালার প্রান্তরে কুখ্যাত ইয়াজিদী বাহিনী আল্লাহর প্রিয় রাসূল (সা.)- এর প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইনকে (আ.) নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। পবিত্র কোরআনে উপরোক্ত ঘটনাবলীর কয়েকটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু ঐ ঘটনাগুলোর কারণে আমাদের কাছে আশুরার দিনটির গুরুত্ব ফুটে উঠে না। যদি গুরুত্বপূর্ণ হতো তাহলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা নিশ্চয়ই ঘটনার দিন তারিখ বর্ণনা করতেন। এবার আমরা কারবালার ঘটনাকে পবিত্র কোরআনের নিরিখে বিশ্লেষণ করবো, এই দিনের ঘটনাবলীতে মুসলমানদের জন্য অর্জন করার কি রয়েছে।
পবিত্র কোরআনের সূরা নিসায় বর্ণনা করা হয়েছে,
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ أَن يَقْتُلَ مُؤْمِناً إِلاَّ خَطَئاً وَمَن قَتَلَ مُؤْمِناً خَطَئاً فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مُّؤْمِنَةٍ وَدِيَةٌ مُّسَلَّمَةٌ إِلَىٰ أَهْلِهِ إِلاَّ أَن يَصَّدَّقُواْ فَإِن كَانَ مِن قَوْمٍ عَدُوٍّ لَّكُمْ وَهُوَ مْؤْمِنٌ فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مُّؤْمِنَةٍ وَإِن كَانَ مِن قَوْمٍ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ مِّيثَاقٌ فَدِيَةٌ مُّسَلَّمَةٌ إِلَىۤ أَهْلِهِ وَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مُّؤْمِنَةً فَمَن لَّمْ يَجِدْ فَصِيَامُ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ تَوْبَةً مِّنَ ٱللَّهِ وَكَانَ ٱللَّهُ عَلِيماً حَكِيماً﴿٩٢﴾
“কোন মুমিনের উচিৎ নয় যে, কোন মুমিনকে হত্যা করে; কিন্তু ভুলক্রমে না হলে। যে ব্যক্তি মুমিনকে ভূলক্রমে হত্যা করে, সে একজন মুমিন ক্রীতদাস মুক্ত করবে এবং তার পরিবার পরিজনদেরকে রক্তপণ পরিশোধ করবে। কিন্তু যদি তারা ক্ষমা করে দেয় এবং যদি নিহত ব্যক্তি তোমাদের শত্রু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ও মুমিন হয় তাহলে মুমিন ক্রীতদাস মুক্ত করবে এবং যদি সে তোমাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ কোন সম্প্রদায়ের অন্তর্গত হয়, তবে রক্ত বিনিময় সমর্পণ করবে তার পরিবার-পরিজনদেরকে এবং একজন মুমিন ক্রীতদাস মুক্ত করবে। অতঃপর যে ব্যক্তি (উপরোক্ত কাজগুলো) না করতে পারে, সে আল্লাহর কাছে তাওবা করবে ও ধারাবাহিকভাবে দুই মাস রোজা রাখবে। আল্লাহ, মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা নিসাঃ৯২)
আলোচ্য আয়াতের বর্ণনা মতো একজন মুমিন অন্য মুমিনকে হত্যা করা সম্পূর্ণরূপে নিষেধ। যদি ভুলক্রমে হয় তাহলে এর বিনিময় কি হবে তাও পবিত্র কোরআন বর্ণনা করেছে। এই আয়াতের বর্ণনা মতে ইমাম হুসাইন কি মুমিনদের নেতা হিসেবে নবী কর্তৃক স্বীকৃতি ছিলেন না? হ্যাঁ মুসলিম বিশ্বের বড় বড় মনিষীদের লিখনীতে ইমাম হুসাইনের ঈমান ও আমলের প্রশংসায় বহু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। পক্ষান্তরে ইয়াযিদের ঈমান আমল তো থাক দূরের কথা তার বদ চরিত্র সম্পর্কে অসংখ্য গ্রন্থাদি রচিত হয়েছে। তারপর ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে ইয়াযিদ কি ভুলক্রমে হত্যা করেছে আর এর জন্য মুসলিম বিশ্বের মনিষীগণ তাদের লিখিত গ্রন্থে ইয়াযিদ কর্তৃক দিয়াত পরিশোধের কথা কী বলেছেন?
না, উম্মতে মুহাম্মদীর প্রতিটি যুগের প্রত্যেক মুমিন মুসলমান ও অমুসলমান লিখেছেন এটি কোন ভুলক্রমে হত্যা নয়। আর ইয়াযিদ কোন দিয়াতও পরিশোধ করে নাই। এমন কোন নজির আছে কি যে ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে হত্যার পর ইয়াযিদ তাওবা করেছে ও পবিত্র কুরআনের বর্ণনা মতে ধারাবাহিকভাবে দুই মাস সিয়াম সাধনা করেছে?
পৃথিবীর তাবৎ মানুষ জানে যে ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়া লানাতুল্লাহি আলাইহিমা সেইদিন তার রাজকীয় দরবারে রাজন্যবর্গের উপস্থিতিতে মদ, নারী ও বানরসহ সকল প্রকার আমোদ ফূর্তির মাধ্যমে ইসলাম বিরোধী কর্মে লিপ্ত ছিল। তাহলে আজকে যারা মহররমে রোজা রাখেন তারা কি সেই অভিশপ্ত ইয়াযিদের মাগফিরাত কামনায় মুহররমে ৬০টি সিয়ামের পরিবর্তে আশুরার দিনে রোজা রাখেন?
আশুরার দিনে রোজার পর্যালোচনা:
আশুরার দিনে রোযা পালন ইসলামের সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনার একটি। এটা বিভিন্ন দিক থেকে পরীক্ষা করার জন্য পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
সর্বপ্রকার মানদন্ডের মাপকাঠিতেই, নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (আ:)-এর এই দিনে শহীদ হওয়া প্রকৃতপক্ষে একটি বড় ট্রাজেডি ও হৃদয় বিদারক ঘটনা। কারণ তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা শহীদ হয়েছিলেন শুধু ইয়াযিদের (বনু উমাইয়া) অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কারণে। ইয়াযিদ (বনু উমাইয়া) ও যিয়াদের পরিবার হুসাইনের (আ:) হত্যার খুশিতে আত্মহারা হয়েছিল। তারা শুধুমাত্র আশুরার দিনটিকে খুশিতে উদযাপন করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, তারা এই দিনটিকে আনন্দের দিন হিসাবে উদযাপন করাটাকে রেওয়াজে পরিণত করল, তাদের পরিবার এবং বন্ধুদের জড়ো করে, ইমাম হুসাইন (আ:)-এর হত্যার দিনটিতে আনন্দ উৎসব করতো প্রত্যেক বছর। পরবর্তীতে এটি উদযাপন করা একটি ঐতিহ্যে পরিণত হল।
রোযা ধর্মাচরণের একটি মহান কর্ম, সুফি তরিকা ও আহলে বাইতের অনুসারী উভয়েরই। আশুরার এই দিনে রোজা রাখা নিয়ে তাদের কিছু বৈধ বিধি আছে। বছরের যে কোন দিন রোজা রাখার নিয়ম বা তাগিদ আছে শুধু ঈদের দিনদ্বয় ব্যতিত। আর আশুরার দিন রোজা রাখার পিছনে রাজনৈতিক একটি ইতিহাস আছে।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্রকে হত্যা করা জঘন্য অপরাধ ছিল, তাই বনু উমাইয়া আশুরার দিনের এই জঘন্য কাজকে মানুষের মন থেকে মুছার চেষ্টা করতে লাগল। ক্ষমতা এবং টাকার বদৌলতে তারা আশুরার দিনকে একটি খুশি ও বরকতময় দিন হিসাবে মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে। তারা আশুরার দিনের তাৎপর্যকে মুছে দিতে বিভিন্ন হাদিস বর্ণনা শুরু করল। উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো বেশী করে প্রচার করল। যেমনঃ মুসা (আ.) মুক্তি পেলেন ফেরাউন থেকে, ইব্রাহিম (আ.) বেঁচে গেলেন নমরুদের আগুন থেকে ইত্যাদি ইত্যাদি…তাই এই বরকতময় দিনে আল্লাহর শুকরিয়া জানানোর মাধ্যম হিসাবে তারা আশুরার দিনে রোজা রাখার জন্য মানুষকে উৎসাহিত করতো বিভিন্ন জাল হাদিস তৈরী করে, যেন ইসলামের জন্য ইমাম হুসাইনের কোরবানি মানুষের কাছে ঢাকা পড়ে যায়। আর এভাবেই বনু উমাইয়া রাজতন্ত্রকে ইসলামের ভিতর কায়েম করে দিল আজ পর্যন্ত। ১৪০০ বছর হয়ে গেল এখনও আমরা ইসলামী শাসনতন্ত্র দেখিনি।
এখানে কিছু বানানো হাদিস পয়েন্ট আকারে উল্লেখ করা হল। আশুরার দিনে রোজা রাখা সম্পর্কিত রাসূলের কিছু বাণী যা তিনি সম্ভবত বলেননি। যা পরে উমাইয়াদের দ্বারা বানানো হয়েছিল। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণিত- রাসূলে পাক (সা.) মক্কা থেকে মদিনা হিজরত করলেন, তখন তিনি সেখানকার ইহুদীদের আশুরার দিন রোজা রাখতে দেখলেন। তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা এই দিনে রোজা রাখছ কেন? তারা উত্তরে বলল, এটি একটি বিরাট সম্মানিত দিন। এই দিনে আল্লাহপাক হযরত মুসা (আ.) এবং তাঁর উম্মতকে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফেরাউন ও তাঁর বাহিনীকে পানিতে ডুবিয়ে ধ্বংস করে দেন। তাই হযরত মুসা (আ.) এর কৃতজ্ঞতাস্বরুপ এ দিনে রোজা পালন করেন বিধায় আমরাও এ দিনে রোজা রাখি।
এতদশ্রবনে রাসুল (সা.) বলেন, মুসা (আ.) এর অনুসরণের ক্ষেত্রে আমরা তোমাদের চেয়ে বেশী উপযুক্ত। অতঃপর রাসুলে পাক (সা.) নিজে আশুরার দিনে রোজা রাখেন এবং মুমিনদেরও রোজা রাখার হুকুম প্রদান করেন। (বুখারী ও মুসলিম)
আশুরার রোযা সম্পর্কে এক হাদিসে আছে যে, ‘তোমরা আশুরার রোযা রাখ এবং ইহুদিদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে; আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোযা রাখ’- মুসনাদে আহমদ ১:২৪১
উপরোক্ত হাদিসগুলো পরীক্ষা করতে নিন্মে উল্লেখিত সাবধানতা বিবেচনা করা আবশ্যক :
১। হাদিস কখন বর্ণনা করা হয়েছে, কে করেছেন এবং তাদের ব্যক্তিগত পরিচয় কি? এবং কোন বইটিতে?
২। ‘আশুরা’ শব্দের অর্থ কি? এর কি একাধিক অর্থ আছে?
৩। ইহুদি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, ইসরায়েলী জাতি কি এইদিনে তাদের মুক্তি উপলক্ষে রোজা রাখতো? ঐদিন মহররম মাসের দশ(১০) তারিখ ছিল কি?
৫।কখন থেকে আরবি ক্যালেন্ডার গণনা শুরু হয়? এবং কিভাবে উপরোক্ত হাদিস এই দিনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়?
৬। কেন রাসুল (সা.) ইহুদিদের অনুশীলন নকল করতে যাবেন?
৭। রাসুল (সা.)-এর আর অন্য কি কি সুন্নত আছে যা উপেক্ষিত হয়েছে?
আশুরার রোজা ঐতিহাসিক ও সমসাময়িক তাৎপর্যকে সমর্থন করে? তার সমসাময়িক গুরুত্বের ক্ষেত্রে, বেশিরভাগ ধর্মপরায়ণ মুসলমান মানুষ আশুরার দিনে রোজা রাখায় ব্যস্ত। কিছু কিছু আলেমের মতে, ‘রমজানের রোজার পরে আশুরার দিনে রোজা রাখা রাসুলের সবচেয়ে প্রিয় ছিল’ তার সমসাময়িক তাৎপর্যের প্রেক্ষিতে। আশুরায় রোজা রাখা গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণটা জানা আমাদের দরকার। কখন এই রোজার ভিত্তি উৎপত্তি হয়েছে, এই আমল কি ইসলামের সব মাজহাবের লোকের দ্বারা স্বীকৃত?
আশুরার রোজার এই সুন্নত আমলটি এত বেশী প্রচার করা হয় অথচ পবিত্র নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর আরও অনেক সুন্নত আছে যা এর মত এত প্রচার করা হয় না কেন? যখনই মহরমের ১০ তারিখ আসে, তখনই আলেম ও মসজিদের ইমামরা এইদিনে রোজার ফযিলত ও তাৎপর্য বয়ানের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। হাজার হাজার লিফলেট, বই, পোস্টার এবং আরো অনেক মিডিয়া যন্ত্রপাতির দ্বারা আশুরাকে কেন্দ্র করে মুসলমানদেরকে ১০ই মহররমে রোজা রাখার জন্য উৎসাহিত করা হয়। আশুরার রোজা ইসলামের ইতিহাসের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে মনে হয়। যেমন, এ দিনে হযরত ইউসুফ (আ.) জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হযরত ইয়াকুব (আ.) চোখের জ্যোতি ফিরে পেয়েছেন। অনেকে বলে, এ দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। হযরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হযরত ইদরীস (আ.)কে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে ইত্যাদি। তবুও, কেন এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে? কেন সব কিছু আশুরার রোজাকে কেন্দ্র করে করা হয়?
আপাত: দৃষ্টিতে মনে হয় ইমাম হুসাইনের (আ:) আন্দোলনের তাৎপর্যের গুরুত্ব কমানোই হল এর মুল উদ্দেশ্য। আশুরার রোজার বিধান, নবী মূসা (আ.) এবং ইসরায়েলী জাতির মুক্তির দিন থেকে উৎপত্তি। ইতিহাস এবং হাদিস থেকে এই রোজার আমলকে ব্যাপক বিশ্লেষণ করা দরকার, তা করতে আমাদেরকে ইহুদি ও ইসলামী ক্যালেন্ডার জানা প্রয়োজন।
প্রশ্ন : ১। হাদিস কখন বর্ণনা করা হয়েছে, কে করেছেন এবং তাদের ব্যক্তিগত ইতিহাস বা পরিচয় কি? এবং কোন বইটিতে?
আশুরার রোজা সম্পর্কিত হাদিস ইমাম বুখারীর সহ্হি-তে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মুসলিম এর সহ্হি এবং তিমমিযি শরীফে আছে। সুতরাং এটা ছয়টি সহিহ বই এর তিনটিতে আছে। যখন ধর্মের কোন বিধান মানতে যাই, যেমন রোজা, তখন আমরা তার নির্ভরযোগ্যতা অবশ্যই যাচাই করি এবং রাবী/বর্ননাকারী কতটুকু আস্থাশীল তাও জেনে নেয়া আবশ্যক বলে মনে করি।
১। ইবনে আব্বাস (রা.) (জন্ম-হিজরতের ৩ বছর আগে মক্কায় আর মৃত্যু ৬৭ হিজরির পর)।
২। আবু মুসা আল আশ’আরী। (জন্ম ৬৬২/৬৭২ খ্রিষ্টাব্দ -মৃত্যু …?)
৩। আবু হুরায়রা (হিজরতের ২১ বছর আগে মক্কায় জন্ম, মৃত্যু ৬১ হিজরি)
৪। মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (হিজরতের ২২ বছর আগে মক্কায়-মৃত্যু ৬০ হিজরি) উপরোক্ত হাদিসটি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম-এর মদিনায় হিজরত করে আসার পরে বর্ণনা করা হয়েছে যা হিজরির প্রথম বর্ষে। অতএব, আমরা এই সময়সীমার বর্ণনাকারীদের কার্যক্রম নির্ণয় করব।
১। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় আগমন করলেন এবং এই হাদিসগুলি যখন উল্লেখ করা হয়েছিল তখন ইবনে আব্বাসের বয়স চার বছর। ইবনে আব্বাস (রাঃ) হিজরতের তিন বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও আমরা ধরে নেই, ইবনে আব্বাস (রা.) কথাগুলি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুনেছেন বা সাথে ছিলেন ঐ শিশু বয়সে, তারপরেও অনেক আলেমদের মতে, চার বছর বয়সী শিশু থেকে রাসুলের হাদিস নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য হয় না।
২। আবু মুসা আল আশ’আরী ইয়েমেনের মধ্যে আশ’আর গোত্র থেকে এসেছিলেন। তিনি হিজরতের আগে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন এবং তখন থেকে খাইবারের দিন পর্যন্ত তাকে দেখা যায়নি ইসলামী ইতিহাস মতে। কারণ তাকে ধর্ম প্রচারের জন্য ইয়েমেনে পাঠানো হয়েছিল। ঐ কারণে সে হিজরতের প্রথম বছরে রাসুলের পাশে ছিলেন না। তাকে খাইবারের পরেই দেখা গিয়েছে। তাহলে তিনি কিভাবে এই হাদিস বর্ণনা করেন?
৩। আবু হুরায়রা (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেছেন মদিনায় ৭ম হিজরিতে খাইবারের যুদ্বের পরে। যে সময়ের কথা হাদিসে বর্ণনা হচ্ছে, তখন উনি ইসলাম গ্রহণ করেননি। তাহলে তিনি কিভাবে এই হাদিস বর্ণনা করেন?
৪। মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান ৮ম হিজরিতে ইসলাম গ্রহণ করে, সে আশুরার রোজা সম্পর্কিত হাদিস উল্লেখ করেছে, যা ঘটেছে তার ইসলামে আসার ৭ বছর আগে। সুতরাং, আমরা কি এক্ষেত্রে মুয়াবিয়াকে একজন নির্ভরযোগ্য হাদিস বর্ণনাকারী বলতে পারি? তিনি মুসলিমই হননি তখন, যেই সময়ের হাদিসের তিনি বর্ণনা করেছেন?
কিছু হাদিস বর্ণনা হয়েছে আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (৬২৪-৬২৯ খ্রি.) থেকে, রাসুল যখন মদিনায় প্রবেশ করেন, তখন ইবনে জুবায়ের (রা.) অল্প বয়স্ক আবার কিছু ইতিহাসবিধের মতে তিনি মদিনায় জন্মগ্রহণ করেছেন।
বর্ণনাকারীদের আরও যাচাই করলে উপরোক্ত হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা আমাদের বোঝার জন্য সহজ হবে:
হযরত উমর আল খাত্তাব ২১ হিজরিতে আবু হুরায়রাকে বাহরাইনের গভর্নর হিসাবে নিযুক্ত করেন। ২৩ হিজরিতে তিনি জানতে পারেন যে, আবু হুরায়রা সম্পদ আহরণ করছে রাসুলের হাদিস বর্ণনা করার মাধ্যমে। খলিফা তাকে বলেন: “যখন আমি আপনাকে বাহরাইনে পাঠাই, তখন আপনার পায়ে জুতাও ছিল না। এখন বাহরাইনে প্রতিটি ঘোড়া ১৬০০ দিনার দিয়ে কিনছেন। আমি শুনতে পেয়েছি যে, আপনি হাদিস বর্ণনার মাধ্যমে অর্থ আয় করছেন”।
এই ঘটনার দ্বারা পবিত্র নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম-এর ইন্তেকালের পরে আবু হুরায়রার জন্যে হাদিস বর্ণনা করা একটি পেশা হয়ে ওঠে। আবু হুরায়রার মত একজন ব্যক্তির কাছ থেকে কিভাবে হাদিস গ্রহণ করতে পারেন? এমনকি তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিতও ছিলেন না, তাহলে তার হাদিস কি নির্ভরযোগ্য হতে পারে?
প্রশ্ন : ২। ‘আশুরা’ শব্দের অর্থ কি? এর কি একাধিক অর্থ আছে? এবং কোন বইটিতে? উপরন্তু, অন্য দৃষ্টিকোন থেকে উপরোক্ত হাদিসটি বিশ্লেষণ করার জন্য “আশুরা” শব্দের অর্থ বিবেচনা গুরুত্বপূর্ণ। আরবি ‘আশারা’ অর্থ দশ। সেই সুবাদে ঐ তারিখ আশুরা বলে উল্লেখিত হয়ে আসছে।
বিশিষ্ট সুন্নি আলেম ইবনে আছির -এর মতে ‘আশুরা’ শব্দের একটি পুরানো অর্থ আছে এবং একটি নতুন অর্থ আছে। যারা পুরাতন অর্থ গ্রহণ করার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন, তাদের দৃষ্টিতে হিজরি ক্যালেন্ডারের যে কোন মাসের ১০ তারিখই আশুরা। আর যদি নতুন অর্থ গ্রহণ করা হয়, তাহলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম-এর নাতিপুত্র ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে কারবালার ময়দানে হত্যার দিনকেই বুঝানো হয়ে থাকে যা ১০ই মুহররম। এই পবিত্র দিন এখন আশুরা নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটা যে কোন মাসের ১০ তারিখকে বুঝায় না। শুধুমাত্র এই পবিত্র দিন মহররম মাসের ১০ তারিখকেই বুঝানো হয়ে থাকে।
প্রখ্যাত সুন্নী তফসীরকারক ইবনে আছির আশুরার রোজা সম্পর্কিত হাদিসটি বিশ্লেষণ করার পর প্রশ্ন উত্থাপন করেন: “হাদিসটি বর্ণনা হয় কখন?” হাদিস বর্ণনাকারীর মাধ্যমে জানা যায় যে, হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে হিজরি প্রথম বছরে। বর্ণনার মতে, ‘আশুরা’ শব্দটির পুরোনো ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং হাদিসের প্রসঙ্গ পড়লেও বুঝা যায় যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আমার উম্মত আশুরার দিনে রোজা রাখবে যে ভাবে তারা (ইহুদি) আশুরার দিন রোজা রাখত”-এর অর্থ হল মদিনার মুসলমানরা ১০ তারিখে রোজা রাখবে, তখন রাসুল মদিনায় ছিলেন। আমাদের যেন ইহুদীদের অনুকরণ না হয়ে যায়, তাই আমাদেরকে হিজরি ক্যালেন্ডারের ৯ ও ১০ তারিখে রোজা রাখার তাগিদ দিয়েছেন। তাহলে কেন মুসলিমরা শুধু মুহররম মাসের ১০ তারিখে রোজা রাখে? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম কখনও মুহররম মাস উল্লেখ করেনি।
প্রপাগান্ডা এবং মিডিয়া যন্ত্রপাতি আমাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করছে যে, রাসুল মুহররম মাসে হিজরত করে মদিনায় আগমন করেছেন এবং তিনি ১০ই মুহররমে ইহুদীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তর্কের খাতিরে যদি আমরা তা সঠিক ধরেও নেই, এরপরো ইহুদি ও ইসলামী ক্যালেন্ডার বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার মিথ্যা যাচাই করা যায়।
প্রশ্ন: ৩। ইহুদি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, ইস্রায়েলী জাতি কি এদিনে তাদের মুক্তি উপলক্ষে রোজা রাখত? ঐদিন মুহররম মাসের দশ তারিখ ছিল কি?
মাস নং | ইসলামী ক্যালেন্ডার (১৪৩৫) | ইহুদি ক্যালেন্ডারের (৫৭৭৪) | ইহুদিদেরধর্মীয় গুরত্বপুর্ণ দিন |
১ | মুহররম | নিসান | ১৫ তারিখ পেসাএহ (Pesaeh) |
২ | সফর | ইয়ার | |
৩ | রবিউল আউয়াল | সিভান | ৬ তারিখ সাভাউত (Shavuot) |
৪ | রবিউল সানি | তাম্মুজ | |
৫ | জুমাদা আউয়াল | আভ | |
৬ | জুমাদা সানি | ইলুল | |
৭ | রজব | তিশরি | ১ তারিখ রোস হাসানাহ (Rosh Hashanah): The Anniversary of the Creation of Adam.
১০ তারিখ ইয়ুম কিপুর (Yom Kippur): The day of Atonement/Musa fast on this day for forgivness. ১৫ তারিখ সুক্কুত (Sukkut): Feast of Booths, Feast of Tabernacles |
৮ | শাবান | চেশভান | |
৯ | রমজান | কিসলেভ | |
১০ | শাউয়াল | তিভেত | |
১১ | জ্বিলক্বাদ | শিভেত | |
১২ | জ্বিলহজ | আদার | ১৪ তারিখ পুরিম (Purim) |
অতএব, অনুমান করি : আশুরার = ১০ই মুহররম হিজরি ১ম বছরের।
আশুরায় রোজা রাখার দাবি সংক্রান্ত হাদিসের বক্তব্য যেদিন নবী মূসা (আ.) মুক্ত করে নিয়ে আসছে ইস্রায়েলি জাতিকে ১০ই তিসরি (ইহুদি ক্যালেন্ডার) ও ১০ই মুহররম (ইসলামী ক্যালেন্ডার)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদিস মতে, ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা ছিল, এর প্রেক্ষিতে ৯ ও ১০ই মুহররম মুসলমানদের রোজা রাখার আদেশ দেন।
ইহুদি ধর্মের অস্তিত্ত্ব আজ আমাদের আরও সত্য পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করেছে। আমরা যদি এখন ইহুদিদেরকে জিজ্ঞাসা করি, তারা এই দিনে কি ফেরাউনের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল, তারা এই দিনে (১০ই মুহররমে) রোজা রাখে কি? তাদের সোজাসুজি উত্তর হবে ‘না’। ইহুদিদের এই দিনে কোন ধরনের রোজা নেই। একমাত্র ১০ই তিসরি (ইহুদি ক্যালেন্ডার) ও ১০ই মুহররম এর সাথে মিলে একই তারিখ হয় ২৯। তবুও, হাদিসের বর্ণনার মাধ্যমে বর্ণনাকারী দাবি করেন যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম-এর হিজরির প্রথম বছরেই ইহুদীদের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে। ইহুদিরা রোজা রাখে ইয়ুম কিপুরে (ইহুদিদের ঈদ)। এইদিনে মুসা (আ.) সিনাই পর্বত থেকে ফিরে এসেছিলেন ও বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার জাতি গরুর উপাসনা করছিল।
এই পাপ থেকে তারা যেন মাফ পায়, সে জন্য মুসা (আ.) রোজা রাখেন। তারা ফেরাউন থেকে মুক্তির জন্য কোনও রোজা রাখেন না। কিন্ত আমাদের সিহাহ সিত্তাহ হাদিস গ্রন্থের মতে ইহুদিরা এই দিনে রোজা রাখে ফেরাউন থেকে মুক্তি পেয়েছেন বলে।
যাই হোক, আশুরায় রোজা রাখার দাবি সংক্রান্ত হাদিসের বক্তব্য মতে এই দিনে নবী মূসা (আ.) মুক্ত করে নিয়ে আসছে ইসরায়েলি জাতিকে ১০ই তিসরি (ইহুদি ক্যালেন্ডার) ও ১০ই মুহররম (ইসলামী ক্যালেন্ডার)। বরং নবী মূসা (আ.) মুক্ত করে নিয়ে আসছে ইস্রায়েলি জাতিকে ১৫ই নিশান (ইহুদি ক্যালেন্ডার ও তাদের মতে), যা ঘটেছিল হিজরি ক্যালেন্ডারে হয় প্রথম হিজরি বছরের ২৩ই রমজানে। তাহলে যদি রোজার হুকুম হয়েই থাকে, তাহলে ১০ই মুহররম উচিত হবে না, হবে ২৩ই রমজান। তাহলে কখন থেকে আশুরার রোজা রাখার হাদিস বর্ণনা শুরু হয়? কেনই বা এত বড় ভুল হয়ে আসছে?
প্রশ্ন : ৪। কখন থেকে আরবি ক্যালেন্ডার গণনা শুরু হয়? এবং কিভাবে উপরোক্ত হাদিস এই দিনের সঙ্গে মিল হয়?
ইসলামী ক্যালেন্ডার শুরু মুহররম মাস থেকে, কিন্তু হাদিস লেখক হাদিসটি লিখেছেন নবী(সা.) মদিনায় আগমন করার ভিত্তিতে যে, তিনি মুহররম মাসে প্রবেশ করেছেন। এটা সকলে ভাল করে জানেন নবী(সা.) রবিউল আউয়াল মাসে মদিনায় আগমন করেছেন। এই বড় ভুল হওয়ার কারণ হাদিস লেখকের অসতর্কতা হতে পারে। কেননা নবী (সা.) রবিউল আউয়াল মাসে মদিনায় প্রবেশ করেন।
“ইসলামী ক্যালেন্ডার শুরু হয় চন্দ্র মাসের গণনা ধরে।তা শুরু হয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম- এর মক্কা থেকে মদিনা হিজরতের সময় থেকে, ইসলামী হিজরি সনের প্রথম মাস হিসাবে ধরা হয়েছে মুহররম মাসকে।”
এই হাদিসটি যিনি বানিয়েছেন তিনি ইসলামী হিজরি ক্যালেন্ডার সম্পর্কে তেমন অবগত ছিলেন না বলে মনে হয়। মুসলমানদের তারিখ নির্ণয়ের জন্য দ্বিতীয় খলিফার আমলে হিজরি সাল তৈরী হয় ইমাম আলীর পরামর্শে। সুতরাং তারা রাসুলের হিজরতকে কেন্দ্র করে ইসলামী হিজরি ক্যালেন্ডার বানালেন। তদুপরি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় আগমন করেছেন রবিউল আউয়াল মাসে, মহররম মাসে নয়। সুতরাং যিনি হাদিসটি বানিয়েছেন, তিনি মনে করেছিলেন রাসুল প্রবেশ করেছেন মদিনায় মহররম মাসে। কারণ, ইসলামী হিজরি ক্যালেন্ডার শুরু হয়েছে হিজরত থেকে। হাদিসের মাধ্যমে জানা যায় তিনি প্রথমে মদিনায় আগমন করেছেন মহররম মাসে ও তিনি দেখলেন ইহুদিরা আশুরায় রোজা রাখতো, কিন্তু রাসুল মহররমে মদিনায় আগমন করেন নাই। তিনি এসেছিলেন রবিউল আউয়াল মাসে। এখানে স্পষ্ট অমিল দেখা যাচ্ছে।
প্রশ্ন : ৫। কেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম ইহুদিদের অনুশীলন নকল করতে যাবেন?
পূর্ববর্তী নবীদের শরিয়ত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম অবগত আছেন। অবশ্যই নবী মুসা (আ.)-এর শরিয়ত থেকে রাসূলুল্লাহর শিক্ষার কোন প্রয়োজন নেই। রাসুল (সা.) ইহুদিদের অনুসরণের অনেক উর্ধ্বে। এটা অবিশ্বাস্য যে কিছু লোক হাদিস অর্থের বিনিময়ে লিখেছেন ও বলেছেন। পরিকল্পনা ও চক্রান্ত যতই করুক না কেন তারাও তো মানুষ। (পবিত্র কুরআন ৩:৫৪)-এ উল্লেখ আছে:
“চক্রান্তকারীর জন্য আল্লাহই শ্রেষ্ঠ চক্রান্ত করেন”। চক্রান্তকারীরা যত ইচ্ছা জাল হাদিস রচনা করতে পারে কিন্তু আল্লাহ্ তায়ালা তাদের সমস্ত চক্রান্ত নস্যাত করে দিবেন। উপরন্তু, যখনই কোন আইন ইসলামে প্রবর্তিত হয়, তা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে পরিবর্তনও হতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ: মদ পান করা হারাম ইসলামের আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু যখন কেউ মরুভূমির মাঝখানে পানির শুন্যতায় মারা যাচ্ছে তখন পান করার জন্য শুধু মদ থাকলে, সেই মদ খেয়ে জীবণ বাচানো জায়েজ। এটা ইসলামে দ্বিতীয় শ্রেণির হুকুম। একইভাবে, প্রতি মাসের ১০ তারিখে (আশুরার) প্রস্তাবিত রোজার আমল সুন্নাহও যদি হয়; তথাপি ইমাম মুহাম্মাদ আল বাকের বলেছেন, “যেভাবে রমজানের রোজা বাধ্যতামূলক হয়েছে তেমনি মহররমের রোজা বাতিল হয়েছে ও পরে তা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
প্রশ্ন : ৬। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম-এর আর অন্য কি কি সুন্নত আছে যা উপেক্ষিত হয়েছে?
হাস্যকর হলেও সত্য, আশুরার রোজাকে কিছু মানুষ এতই গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত বলে দাবি করে, যেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম-এর আরও কত সুন্নত আছে যা তারা অবহেলা করছে। আমরা যদি সুন্নত সম্পর্কে এতই সতর্ক হই তাহলে কেন কোন সুন্নতের পরিবর্তন হলে এই বিষয়ে উদ্বিগ্নও হইনা, বলিও না। যেমন “হাইয়া আলা খাইরিল আ’মাল” দৈনন্দিন আযানের অন্তর্ভুক্ত ছিল ও রাসুলের সুন্নত ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় খলিফার সময় এই সুন্নতটা বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। আবার এমন কিছু বিষয় আমাদের সমাজে সুন্নত হিসেবে চালু হয়ে আছে যা আদৌ নবী সা. করেনওনি, করতে বলেনওনি। এই ক্ষেত্রে আমরা তারাবীর জামাতকে উল্লেখ করতে পারি। যা রাসূল কর্তৃক চালু করা হয়নি পরে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। কেন আমরা রাসূলের সুন্নতের পরিবর্তনে উদ্বিগ্ন হই না। তাহলে কি আশুরায় রোজা রাখা রাসূলের সুন্নত, না অন্য কারো বানানো সুন্নত?
আশুরায় রোজা রাখা নিয়ে আলেমদের, হাজার হাজার বক্তৃতা, লক্ষ লক্ষ লিফলেট, বই বিতরণ করা হয়, এত বেশি প্রচার ও প্রপাগান্ডা হচ্ছে, তাহলে এর পিছনে কি অন্য কোনও এজেন্ডা আছে? আশুরা ছাড়াও আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিন আছে সারা বছরে রোজার ফজিলতের উদ্দেশ্যে, যেমন ২৭ রজব। কিন্তু কেন জানি একটি লিফলেটও বিতরণ হতে দেখা যায় না ঐ দিন সম্পর্কে। বক্তৃতার মাধ্যমে উৎসাহ দিতে দেখা যায় না। স্পষ্টভাবেই বুঝা যায়, আশুরার রোজা রাখার পিছনের এজেন্ডা হল কিভাবে মুসলমানদেরকে কারবালায় রাসুলের নাতিপুত্র জান্নাতের সরদার ইমাম হুসাইনের (আ:) হত্যাকে মানুষের মন থেকে সরানো যায়। যা ইসলামের ইতিহাসে এর চেয়ে বড় জঘন্য ভাবে হত্যাকান্ডের ঘটনা দ্বিতীয়টি নেই।
ইমাম হুসাইন (আ.) বলেনঃ “তোমরা কী দেখতে পাচ্ছো না যে, সত্য অনুসরণ করা হচ্ছে না এবং মিথ্যাকে নিরুৎসাহিত করা হয় না। (পরিস্থিতি এতই গুরুতর যে) ইমানদাররা আল্লাহর সাক্ষাত কামনা করে আর আজ আমি এ সংগ্রামের মাঝে মৃত্যু দেখতে পাই না সমৃদ্ধি ও সাফল্য ছাড়া। অত্যাচারীর সঙ্গে থাকা বিতৃষ্ণা এবং মর্যাদাহানি ছাড়া আর কিছুই না।”
তিনি ইসলামের বিচ্যূতি দেখেছিলেন। যেখানে মদকে হালাল বলা হয়েছিল। নিজের মাহরাম নারীদের সাথে বিয়ে করছিল। রাজ প্রাসাদে বানর নাচ করানো হচ্ছিল …। যদি নবীর আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য হুসাইন (আ.) এইসব মেনে নিয়ে ইয়াযিদের বাইয়াত করে, তাহলে পরবর্তীতে তা হালালের দলিলরূপে পরিণত হবে। আমরাও এখন এই হারাম কাজ করতে দ্বিধা করতাম না। কারণ আহলে বাইতের দোহাই দিতাম। তাই ইমাম হুসাইন এই বিদ’য়াত কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। এর চেয়ে লজ্জাকর আর কি আছে যে, আমরা ঐ সব লোকদের সম্মান দেখাচ্ছি যাদেরকে আল্লাহর রাসূল আখেরাতে শাফায়াত করবেন না। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কি হতে পারে যে, আমরা তাদের প্রশংসা করছি যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম। যেখানে রাসূল ইমাম হুসাইন সম্পর্কে বলেছেন: “হুসাইন আমা হতে ও আমি হুসেইন হতে”। (ইমাম হুসেইনের কার্যক্রম ও জীবন ব্যবস্থা ঠিক রাসুলের প্রতিরূপ।) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “হুসাইন হেদায়েতের চেরাগ ও নাজাতের তরী।” হযরত উমর বিন খাত্তাব থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, হাসান ও হুসাইন জান্নাতের সকল যুবকদের সরদার। পবিত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম ইমাম হাসান ও হুসাইন-এর হাত ধরে বলেছেন: এরা আমার সন্তান।
** পবিত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: খবরদার! এই মসজিদে রাসুলুল্লাহ, আলী, ফাতেমা, হাসান ও হুসাইন ব্যতিত কোন জুনুবি (অপবিত্র পুরুষ/মহিলা) এবং হায়েযা মহিলার জন্য হালাল নয়। এই মহান ব্যক্তিত্বরা ছাড়া অন্য কারো জন্য মসজিদে নব্বীতে জুনুবি অবস্থায় আসা জায়েয নেই। সতর্ক হয়ে যাও! আমি তোমাদেরকে নাম বলে দিয়েছি, যাতে করে তোমরা গুমরাহ না হয়ে যাও।
** পবিত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি আমাকে ভালবেসেছে, তার উপর ওয়াজিব, সে যেন এদের উভয়কেও (হাসান ও হুসাইন) ভালবাসে।
** পবিত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি হাসান হুসাইনকে ভালবাসল, তাকে আল্লাহ্ ভালবাসল। আর যে ব্যক্তি আমাকে ভালবাসল, তাকে আল্লাহ্ ভালবাসেন। আর যাকে আল্লাহ ভালবাসেন, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেন।
** পবিত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: হে আল্লাহ আমি তাদেরকে মহব্বত করি, আপনিও তাদেরকে মহব্বত করুন এবং তাদেরকে যারা মহব্বত করে তাদেরকেও আপনি মহব্বত করুন।
** পবিত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি হাসান হুসাইনের সাথে শত্রুতা করবে অথবা তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে, আমি তার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করব। আর আমি যার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করব, সে আল্লাহর গযবের শিকার হবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর গযবের শিকার হবে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামের আযাবে প্রবেশ করাবেন, যেখানে তার স্থায়ী ঠিকানা হবে।
** আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ বলেছেন, আমি বৃক্ষ আর ফাতেমা সেই বৃক্ষের ডাল স্বরূপ। আলী সেই বৃক্ষের প্রস্ফুটিত পাপড়ি এবং হাসান হুসাইন হলেন সেই বৃক্ষের ফল। আর যারা আহলে বাইতকে ভালবাসে, তারা এই বৃক্ষের পাতা, এরা সকলেই জান্নাতে প্রবেশ করবে। এটি দিবালোকের ন্যায় সত্য কথা।
** হযরত উমর বিন খাত্তাব থেকে বর্ণিত, আমি হাসান হুসাইনকে রাসুলের কাঁধের উপর (আরোহিত) দেখলাম, তখন আমি আনন্দ চিত্তে বললাম, আপনাদের নিচে কতই না উত্তম আরোহণ অবস্থিত!! উত্তরে রাসূলুল্লাহ বললেন, (এটিও দেখ যে,) আরোহীরা কত উত্তম।
** ইয়াযিদ বিন আবু যিয়াদ থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম একদিন ফাতেমা সালামুল্লাহি আলাইহার ঘরে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি হুসাইনের কান্নার আওয়াজ শুনলেন। রাসূলুল্লাহ বলেছেন, তুমি কি জান না, তাদের কান্না আমাকে কষ্ট দেয়।
** হযরত আনাস বিন মালেক থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম ফাতেমাকে বলতেন, আমার সন্তান দু’টিকে ডাক। তারপর তিনি উভয়কে শুকতেন এবং তার বক্ষের সাথে লাগিয়ে রাখতেন। একজনকে তাঁর এক কাধে এবং অপরজনকে অন্য কাধে বসাতেন। পালাক্রমে উভয়কে চুমু খেতেন।
** একদা আসমা আল্লাহর রাসূলকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ “কেন আপনি কাদছেন?” “আমার এই সন্তানের জন্য,” রাসূলুল্লাহ উত্তর দিলেন। “সেতো নবজাতক শিশুমাত্র,” আসমা বলল। “ও আসমা… আমার পরে, সীমালঙ্ঘনকারীর দল তাকে হত্যা করবে। আল্লাহ আমাকে কখনও তাদের শাফায়াতকারী করবেন না। এখন আমরা জিজ্ঞাসা করি, হে আল্লাহর রসূল, আপনি যদি আপনার সন্তানের কান্না সহ্য করতে না পারেন, তাহলে আপনার প্রিয় হুসাইনের নৃশংস হত্যাকা-কে কিভাবে প্রত্যক্ষ করবেন? এই দৃশটা আপনি ইয়া রাসুলুল্লাহ! কি ভাবে সহ্য করবেন। যেখানে আপনার সন্তানের কারবালার ময়দানে পানির পিপাসায় মৃত্যু হচ্ছে। আপনার ছেলেকে একা দেখতে হচ্ছে তার বন্ধু বান্ধব এবং পরিবারের পড়ে থাকা ঐ মৃতদেহগুলিকে। নিজের এই মসিবতে তিনি মহিলাদেরকে সান্তনা দিচ্ছেন। তাকে আক্রমণ করা হচ্ছে চারিদিক থেকে। তীর, বল্লম, ছুরি, তলোয়ারের আঘাতে উনার শরীর চ্ছিন্নভিন্ন হয়ে আছে। ঘোড়ার মাধ্যমে পিষ্ট করে উনার শরীরের পাঁজর ভেঙ্গে ফেলছে। উনি এখন টুকরো অবস্থায় পড়ে আছেন। আপনি যেই গালে চুমু খেতেন ঐ গাল রক্তে মাখা। হে আল্লাহর রসূল! আপনি কি করে ফাতিমা যাহরার কান্নার এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করবেন, যিনি এক দগ্ধ তাঁবু থেকে অন্য দগ্ধ তাঁবুতে দৌড়াচ্ছেন? জান্নাতের নেত্রীর মেয়েকে যুদ্ধবন্দী হিসাবে এক দেশ থেকে অন্য এক দেশে ভেড়ার মত টেনে নিয়ে যাচ্ছে। শত্রুদের দ্বারা অবহেলা ও অসম্মান করা হচ্ছে। ইয়া রাসুলুল্লাহ! কারবালায় আশুরার দিনের এই মর্মাহত দৃশ্যটা কিভাবে সহ্য করবেন?
সুতরাং, এই সব কারণের উপর ভিত্তি করে সুফী তরিকা ও আহলে বাইতের অনুসারীদের আশুরার রোজা রাখা নিয়ে ভিন্ন মত আছে। আশুরার দিনে রোজা রাখার পিছনে ইয়াযিদ ও বনু উমাইয়াদের চাল ছিল। তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে, ইমাম হুসাইন ফেতনা সৃষ্টি করেছে, তাই তার মৃত্যু হয়েছে ও মানুষ ফেতনা থেকে নাজাত পেয়েছে। ঠিক অন্য নবীদের মত।
আমরা ঈদ উদযাপন করি সেদিন, যেদিন ইসমাইলকে আল্লাহর নামে কোরবানি করতে গিয়েছিলেন ইব্রাহিম (আ.) কিন্তু ঐ দিন তার পরিবর্তে দুম্বা জবাই হয়েছিল। তাই এই দিনটি আমাদের জন্য ঈদ বা খুশির দিন। ইসমাইল(আ.) রাজি হয়েছিলেন নিজেকে উৎসর্গ করতে, শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
তেমনি ইমাম হুসাইনও আল্লাহর রাহে কোরবানি হতে এক মুহুর্তও সময় নেননি। তিনিও সবর ধরেছেন ইসমাইল (আ.)এর মত। কিন্তু তাঁর উপরেই কোরবানির আমল হয়েছে, এর পরিবর্তে কোন পশু জবাই হয়নি। ইসমাইল (আ.) অবশ্যই নবী ছিলেন। কিন্তু উনি জান্নাতের সরদার না। উনিও ঐ জান্নাতেই প্রবেশ করবেন যেখানে ইমাম হুসাইন সরদার হবেন। তাহলে কি আমাদের এই দিনটি তার জন্য আনন্দ উৎসব করার পরিবর্তে শোক পালন করা উচিৎ নয়?
ঐ দিন যদি ইসমাইল (আ.) সত্যিই কোরবানি হতেন তাহলে আল্লাহর আদেশও ঈদের পরিবর্তে অন্য কিছু হত। কেউ কেউ ইয়াযিদের পক্ষে সাফাই গায় যে, সে নিজে গলা কাটেনি বা মারার আদেশও দেয়নি। তাহলে উনার শিরচ্ছেদ করার পর উনার মাথা মোবারক যখন ইয়াযিদের কাছে নিয়ে আসা হয়, তখন মালয়ূন ইয়াজিদের কি উক্তি ছিল? রক্তমাখা মাথাকে তার হাতের লাঠি দিয়ে চোখে মুখে খোঁচা দিয়ে বলেছিল “আজকে আমার পূর্বপুরুষদের প্রতিশোধ নিলাম।” মা যায়নাবের বক্তব্য শুনলেই বুঝা যায় মালয়ূন ইয়াযিদই মূল দোষী ব্যক্তি ছিল।
এখনতো বড় বড় আলেম ইয়াযিদকে রাদিয়াল্লাহ বলতেও পিছপা হন না। ডা. জাকির নায়েকের মত তথাকথিত বুদ্ধিজীবী মালয়ূন ইয়াযিদকে ইয়াজিদ রাদিয়াল্লাহ-ই বলে সম্বোধন করেন। আর একপা বাড়িয়ে সৌদি আরবের গ্রান্ড মুফতি শেখ আলে সউদ যিনি হজ্জের সময় আরাফাতের ময়দানে খুতবা পড়েন। তিনি বলেন: ঐসময়ে ইমাম হুসাইনেরই দোষ ছিল, এর জন্য আল্লাহ্ হুসাইনকে মাফ করুক। যদি মালয়ূন ইয়াযিদের মত লোকের উপর আল্লাহর রাজির জন্য দোয়া করা যায়, তাহলে যে কোনো জালেমের নামের পরেও রাদিয়াল্লাহ বলে দোয়া করলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : “আনজিলাতু কুল্লি শাই’ইন আলা কুল্লি মানজিলাতাহুম” প্রত্যেকটি জিনিষ নাজিল করেছেন তার স্বস্থানের উদ্দেশ্য। কিন্তু মুসলিম সমাজ কি ইসলামের এই ভিত্তিগুলোর যে প্রকৃত মূল্য আল্লাহ দিয়েছেন ঠিক সেভাবেই মুল্যায়ন করে? হয়তো ঐরকম নাও করতে পারে। শুধু তাই নয়। কখনো কখনো যেমন আছে তার উল্টোটাই ধরে নেয়। ইসলামে যে ভিত্তিটি প্রথম শ্রেণির মূল্যবহ তাকে হয়তো তৃতীয় শ্রেণিতে ফেলতে পারে আর তৃতীয় শ্রেণির কোন ভিত্তিকে প্রথম শ্রেণিতে নিয়ে আসতে পারে। ইসলামের ভিত্তিগুলো যদি উল্টোপাল্টা হয়ে যায়, তবে ইসলাম তখন উপহাসের পাত্রে পরিণত হবে। শ্রেষ্ঠধর্মের মর্যাদা হারাবে। যেমন ধরুন চুল ও দাড়ি আঁচড়ানো, মেসওয়াক বা পশ্রাব করার পরে ৪০ কদম হাটা সুন্নত। কিন্তু এটা যদি ‘আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার’- এর চেয়ে বেশি গুরুত্ব ও মূল্য লাভ করে তাহলে এটাও ইসলামের নামে একটি বিচ্যুতির কারণ। সামান্য চুল ও দাড়ি আঁচড়ানোর গুরুত্ব ‘আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার’-এর মতে ইসলামের একটা ভিত্তির চেয়ে কোনক্রমেই বেশি হতে পারে না। মুসলমানদের কাছে ‘আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার’ বিভিন্ন আঙ্গিকে মুল্যায়িত হয়েছে। এভাবেই আমরা ইসলামের প্রতি জুলুম করছি আমাদের আলেমদের ভুল প্রচারণার মাধ্যমে। আশুরার রোজার আমলকে বড় করে দেখিয়ে ইমাম হুসাইনের ‘সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ’ করার স্পৃহা কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
ঠিক এভাবেই ইমাম হুসাইনের কোরবানিকে খাট করে দেখানো হয়েছে আমাদের কাছে। তার শিক্ষায় আমরাও যদি প্রতিবাদী হয়ে উঠি, তাহলে মালয়ূন ইয়াযিদের মত অন্য কেউ আর কখনো অত্যাচার করার সাহস পাবে না। এই ভয়ই কাজ করছে সব মুসলমান শাসক সমাজে ও তার দরবারী আলেমদের মনে।
আল্লাহ আমাদেরকে ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামের মত জুলুমের প্রতি প্রতিবাদী হওয়ার তাওফিক্ব দান করুন। আমীন।