আবু সুফিয়ান ও মুয়াবিয়া সম্পর্কে রাসূলের (সাঃ) পক্ষ থেকে সত্য প্রকাশ

1241

রাসূলের (সাঃ)-এর পক্ষ থেকে সত্য প্রকাশ এবং আবু সুফিয়ান ও মুয়াবিয়ার উপর অভিসম্পাতঃ

ইসলামের মহান রাসূল(সা.) শুধুমাত্র বনি উমাইয়্যার পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্টিত হওয়া ও তাদের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সাবধান বাণী দিয়েই ক্ষ্যান্ত হননি, বরং মুয়াবিয়া যে অনবরত প্রবৃদ্ধি লাভ করছিল তার প্রভাব প্রতিপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন পন্থায় মুসলমানদের মন মননের হেদায়েত ও পথ নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি তার এক বক্তৃতায় আবু সুফিয়ান ও মুয়াবিয়া উভয়কে উদ্দেশ্য করে তাদের উপর অভিসম্পাত দিয়েছেন এবং বিভিন্ন স্থানে তদের একজনকে তার অনুসারীদেরসহ নাম উল্লেখ করেছেন আর মুসলমানদেরকে তাদের ফাঁদে আটকে পড়তে নিষেধ করেছেন। ইতিহাসে এভাবে আমরা পড়ে থাকি: “একদা রাসূল(সা.) আবু সুফিয়ানের মুখোমুখি হলো। তখন আবু সুফিয়ান গাধার পিঠে আরোহন করেছিল এবং তার পুত্র ইয়াযিদ ও মুয়াবিয়া তার সাথে ছিল। প্রথমজন গাধাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল আর দ্বিতীয়জন পশুটিকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। হযরত রাসূল(সা.) বলেন: আল্লাহ অভিসম্পাত (লানত) বর্ষন করুক এই আরোহী, লাগামধারী ও চালকের উপর।”

আরাবীটা হচ্ছেঃ (لَعَنَ اَللَهُ اْلْقَائِدَ وَ اْلْرَاْكِبَ وَ اْلْسَائِقَ)

(মুহাম্মাদ ইবনে জারির তাবারী, তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক, খন্ড ১১, পৃ: ৩৫৭; আব্দুল হুসাইন আমিনী, আল্ গ্বাদীর ফিল কিতাব ওয়াস সুন্নাতি ওয়াল আদাব, খন্ড ১০, পৃ: ১৩৯, ১৪২)।

রাসূলের(সা.) এ হাদিসটি এমনভাবে সর্বত্র প্রচারিত হয়েছিল যে সবাই তা জানতো এবং কথোপকথনের মঝে যদি তা আলোচনা হতো কেউ ব্যাপারটি অস্বীকার করতো না আর হাদিসটি যাদের বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে তাদের এ ব্যাপারে কেউ সন্দেহ করতো না। দৃষ্টান্তস্বরূপ মুহাম্মাদ ইবনে আবু বাকর মুয়াবিয়াকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন: “তুমি অভিশপ্ত ও অভিশপ্ত ব্যক্তির পুত্র এবং আল্লাহ অতি শিঘ্রী তোমাকে শাস্তি প্রদান করবেন।” (আমিনী, আল্ গ্বাদীর, খণ্ড ১০, পৃ: ১৩৯, ১৪২)।

অন্যত্র লিখা হয়েছে, একদা মুয়াবিয়া যখন তার কিছু বন্ধুদের নিয়ে একটি পথ অতিক্রম করছিল তখন রাসূল(সা.) কর্তৃক অভিশাপের সমুক্ষীন হয়। এ সকল ঘটনার একটি হচ্ছে, আমর ইবনুল আসের সাথে মুয়াবিয়ার সফরসঙ্গী হওয়া। ইতিহাসের এ দু’জন রহস্যজনক ও ধোকাবাজ চেহারা শ্যাম ও মিশরের ক্ষমতা আত্মসাৎ করার পূর্বেও নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সমচিন্তার অধিকারী ছিল এবং বিভিন্ন বিষয়ে তারা একই ভুমিকা গ্রহণ করতো। একদা কোন এক ভ্রমনে যখন আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব রাসূলের(সা.) সাথে ছিলেন, তখন তিনি অবলোকন করলেন যে, দু’জন লোক অবৈধ গান বাজনায় ব্যস্ত আর এ গানের মধ্যে একজন অন্যকে উত্তর দেয়। … কিছুক্ষন পর হযরত রাসূল(সা.) জিজ্ঞেস করলেন, দেখো তো এরা কারা? বলা হলো, এরা হলো মুয়াবিয়া ও আমর ইবনুল আস। আল্লাহর প্রিয় রাসূল(সা.) তাঁর হস্তদ্বয় উপরে তুলে ধরে মোনাজাত করলেন, “হে আল্লাহ! এ দু’জনকে ধ্বংস এবং আগুনে নিক্ষেপ করো।” (প্রাগুক্ত, পৃ: ১৪)।

অন্ধকার পরিণামঃ

পয়গম্বর(সা.)-এর জাগ্রতকারী ও সচেতনমূলক সাবধানবাণীগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মুয়াবিয়া সম্পর্কে যা আহলে সুন্নাতের উৎসসুত্রসমূহে উল্লেখিত হয়েছে। তা হলো যে, মুয়াবিয়া ক্বিয়ামতের ময়দানে শিরকের অনুসারী হিসেবে উথিত হবে। একটি হাদিসে স্পষ্টভাবে হযরত (সা.) ভবিষ্যতবাণী করেছেন: “আমার উম্মতের মধ্য থেকে একজন আমার মিল্লাতের বাইরের লোক হিসেবে উথিত হবে আর সে হবে মুয়াবিয়া।” (প্রগুক্ত ; তাবারী, তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক, খন্ড ১১, পৃ: ৫৭)। উক্ত অর্থে বিভিন্ন প্রকার বাক্যের মাধ্যমে এটাই নি:সন্দেহে বলা যায় যে, নবী(সা.)-এর দৃষ্টিতে এ ধরনের পরিণতির অধিকারী একমাত্র মুয়াবিয়া। হযরত তৎকালীন সমাজের মানুষকে সচেতন করতেন যেনো মুয়াবিয়া ও তার বিচ্যুতির ফাঁদ থেকে সবাই নিরাপদে থাকে এবং সময়ের পরিবর্তনে ও ছোট-বড় ঘটনা সংঘটনের মধ্যে উক্ত বিষয়টি যেনো উদাসীনতার সয়লাবে ভেসে না যায়।
অন্য আরেকটি বর্ণনায় রাসূলের(সা.) এক সাহসী সাহাবী ও সংস্কারক আবুযার গিফারী(রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলে আকরাম(সা.) মুয়াবিয়াকে দোজখের আগুনের অধিবাসী হিসেবে গণ্য এবং তার ভবিষ্যত মারাত্মক অন্ধকারাচ্ছন্ন ও ভয়ংকর বলে আখ্যায়িত করেছেন। (ঐ)

সুস্পষ্ট নির্দেশঃ

যদিও উপরোল্লেখিত উপদেশসমূহ ও সাবধানবাণীগুলো মুয়াবিয়ার ব্যক্তিত্ব, তার চিন্তাধারার বিপদসমূহ ও শাষন ক্ষমতার পরিচয় তুলে ধরার ক্ষেত্রে অত্যন্ত পরিস্কার ও শিক্ষামূলক ছিল, তারপরো ইসলামের সুউচ্চ মাক্বামের অধিকারী পয়গম্বর(সা.) আরো পরিস্কারভাবে মুয়াবিয়ার রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ ও দ্বীনি অবস্থানের ব্যাপারে ভবিষ্যতবাণী করেছেন। তিনি এ ব্যাপারে সবচেয়ে কঠোর নির্দেশ প্রদান করেছেন যা দ্বীনের ভবিষ্যত অবস্থা ও মুসলিম সমাজের ভাগ্য সম্পর্কে তাঁর অতি মাত্রার উদ্বেগেরই বহি:প্রকাশ ঘটেছে। ইতিহাসে এসেছে যে, তিনি বলেছেন: “যখন তোমরা মুয়াবিয়াকে আমার মিম্বারের উপর উপবিষ্ট দেখবে তখন তাকে হত্যা করবে”। অন্য এক হাদিসে একই বিষয়ে আমরা পড়ে থাকি: “যখন মুয়াবিয়াকে আমার মিম্বারে বসে বক্তৃতা দিতে দেখবে তখন তাকে হত্যা করবে”। অথবা “যখন মুয়াবিয়াকে দেখবে আমার মিম্বারে বসে বক্তব্য দিচ্ছে তখন তার গর্দান ফেলে দাও”। (ঐ)

আল্লামা আমিনী(রহ.) উক্ত বর্ণনার বর্ণনাকারীদের ধারাবাহিকতার উপর গবেষনা করে জ্ঞানগর্ভ ও রিজাল শাস্ত্রমতে ফলাফলে পৌছে বলেছেন যে, উক্ত রেওয়্যাত অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য (মুসতানাদ) এবং আহলে সুন্নাতের মহান ব্যক্তিদের দৃষ্টিতে উক্ত বর্ণনার মধ্যে ধারাবাহিকভাবে বর্ণনাকারীদের সবাই বিশ্বস্থ ও তারা সবার নিকট গ্রহণযোগ্য। (আমিনী, আল্ গ্বাদীর, খণ্ড ১০, পৃ: ১৪২-১৪৭ মুহাম্মাদ ইবনে আক্বিল আলাভী হাদ্বরামী, আন্ নাসাইয়েহ আল্ কাফিয়্যা, ফারসী অনুবাদ: আযিযুল্লাহ্ আত্বারুদী, পৃ: ২৬)।

আরো দৃষ্টান্তঃ

মুয়াবিয়া ও উমাইয়্যা বংশ সমন্ধে পয়গম্বর আকরাম(সা.)-এর উপদেশ ও ভবিষ্যতবাণীসমূহ উপরোল্লেখিত বর্ণনাগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং রাসূল(সা.) বিভিন্ন সময়ে মুয়াবিয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এবং মুসমানদেরকে তার শাষন ক্ষমতা লাভ ও তার মনের বিপদজনক উদ্দেশ্যের ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছেন।

মহানবীর(সা.) কিছ উপদেশ ও বক্তব্যঃ আমর ইবনুল আসের সাথে মুয়াবিয়ার জমায়েত অথবা অন্যান্য পথচ্যুত ব্যক্তিদের সাথে তার সমাবেশের দিকে ইঙ্গিত বহন করে যেখানে উলেলখ করা হয়েছে যে, “যখন মুয়াবিয়াকে আমর ইবনুল আসের সাথে একত্রিত দেখবে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দাও। কেননা তারা কখনো কোন মঙ্গল কাজে একত্রিত হয় না।”

(আমিনী, আল গ্বাদীর, খন্ড ১০, পৃ: ১৪৮)।

অন্যত্র মহানবী(সা.) তাদের অনৈক্য সৃষ্টিকে তিরস্কার এবং মুসলমানদের নির্দেশ দিয়েছেন, যখনি মুয়াবিয়া ও তার অনুসারীরা মুসলমানদের বিরোদ্ধে অনৈক্য ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করবে তখনি তাদেরকে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করবে।

Related Post

গাদীরে খুমে ইসলামী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গোড়াপত্তন

Posted by - জুলাই ১৪, ২০২২
⁉রাষ্ট্রবিজ্ঞান (Political science) সমন্ধে কতটুকু ধারনা আমাদের রয়েছে? যে বিজ্ঞান রাষ্ট্র, রাষ্ট্র পরিচালনা, সরকার, সরকার পরিচালনা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, নেতা-নেতৃত্ব,…

একনজরে ঐতিহাসিক গ্বাদীরে খুম

Posted by - জুলাই ১৫, ২০২২
হিজরী দশম বছর। রাসূল (সাঃ) বিদায়ী হজ্জ্ব সম্পন্ন করেছেন। এ নশ্বরপৃথিবী থেকে শেষ বিদায়ের জন্যে প্রহর গুণছেন। প্রথম থেকে তিনি…

গাদীরে খুমের ঘটনা

Posted by - জুলাই ১২, ২০২২
হিজরী দশম বছর । রাসূল (সা.) বিদায় হজ্ব সম্পন্ন করেছেন । এ নশ্বর পৃথিবী থেকে শেষ বিদায়ের জণ্যে প্রহর গুনছেন…

ঈদুল মুবাহালা সম্পর্কে ঐতিহাতিক পর্যালোচনা

Posted by - আগস্ট ১৫, ২০২০
🌹ঈদুল মুবাহালা সম্পর্কে ঐতিহাতিক পর্যালোচনাঃ🌹 ✔ ২৪শে যিলহজ্জ্ব, মুসলিম উম্মাহ-র এক ইসলামী-ঐতিহাসিক ও ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক গুরুত্বপূর্ণ দিন। দশম হিজরীর ২৪শে যিলহজ্জ্ব-এ…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »